সংকলক: ডা. মাহমুদুল কবির
স্যার জন ওয়্যার একজন স্কটিশ চিকিৎসক যিনি বিংশ-শতাব্দীতে ব্রিটেনের রাজ-পরিবারের কয়েক পুরুষের চিকিৎসা করার সম্মানে ভূষিত। তিনি ১৮৭৯ সালের ১৯ শে অক্টোবর স্কটল্যান্ডের Renfrewshire অঞ্চলের Paisley তে জন্মগ্রহণ করেন। Allan Glen’s School -এ তিনি তার মাধ্যমিক পড়াশুনাটি সম্পন্ন করেন, যে শিক্ষালয়টি তৎকালীন সময়েই বিজ্ঞানের উপর ব্যাপক জোর দিতো।
তিনি তার চিকিৎসাবিদ্যার প্রথম শিক্ষা গ্রহণ করেন Glasgow University তে। তিনি ১৯০৭ সালে Glasgow University থেকে Bachelor of Medicine and Bachelor of Surgery (MB ChB) সম্পন্ন করে গ্র্যাজুয়েশন লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৯০৮ থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত বিরতির বৎসরগুলোতে Tyler Scholership নিয়ে, তিনি ডা. কেন্টের তত্ত্বাবধায়নে শিকাগোর Hering Medical College হোমিওপ্যাথির উপর উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন। সেখানে তিনি আরো দু’জন সুবিখ্যাত হোমিওপ্যাথ Dr. Harold Fergie Woods (1883–1961) ও Dr. Douglas Borland (1885–1961) এর সাথে শিক্ষাগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৪৩ সালে তিনি Fellow of the Faculty of Homoeopathy (FFHom) ও অর্জন করেন।
স্যার ওয়্যার প্রথম হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধে ধারণা লাভ করেন Glasgow Homeopathic Hospital এর প্রধান Dr. Robert Gibson Miller (1862–1919) এর সংস্পর্শে এসে, যিনি এই রাজ-পরিবারের হবু চিকিৎসকটির জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। জানা যায়, Gibson Miller তাঁর একটি ফোঁড়া আরোগ্য করার পর- হোমিওপ্যাথি তাকে আগ্রহী করে তোলে [Bodman, 1971]। আরো দাবী করা হয় যে,
“It was Dr Gibson Miller who advised Sir John Weirto
[Stewart, 1967, p. 260]
go to the United States.”
ডা. গিবসন মিলারের এই প্রভাবের দৌরাত্ম্য Dr. Douglas Gibson (1888–1977) পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায়- যিনি
“স্যার জন ওয়্যারের সাথে ১৯৩৬ সালে একটি সাক্ষাতের পর
[Gibson obit, 1977, 225]
হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধে আগ্রহী হয়ে উঠেন।”
স্যার জন ওয়্যারের জীবন বহু কৃতিত্বপূর্ণ কর্মে সমৃদ্ধ। তিনি লন্ডনের রাজ-পরিবারের চিকিৎসক ছিলেন, British Homoeopathic Congress প্রেসিডেন্ট ছিলেন, Compton Burnett Medical College এর মেটেরিয়া মেডিকার প্রফেসর ছিলেন।
তিনি ১৯১০ সালে London Homeopathic Hospital -এ কন্সালটেন্ট ফিজিশিয়ান হিসাবে এ প্রত্যাবর্তন করেন। আমেরিকাতে প্রত্যাবর্তন করার পর- ডা. কেন্টকে তৎকালীন সময়ে হ্যানিমানের সবচেয়ে বড় প্রবক্তা হিসাবে তিনি সমর্থন প্রদান করেন। কিন্তু তাঁর এই মতটির জন্য British Journal of Homeopathy থেকে ব্যাপক সমালোচিত হন; যে জার্নালটিতে ডা. কেন্টের মেটেরিয়া মেডিকাকে সেসময় অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করা হতো। এমনকি এই মতানৈক্যটি নিম্ন ও উচ্চশক্তি ব্যবহারকারী চিকিৎসকদের মধ্যে চলা দ্বন্দটিকে আরো শক্তিশালী করে। বস্তুত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্তও ব্রিটেনে নিম্নশক্তির ব্যবহারটাই অধিক প্রচলিত ছিলো।
British Homeopathic Journal এর সম্পাদক চিকিৎসা শুরু করার জন্য হিউজেসের ফার্মাকোডায়নামিক গ্রন্থটিকে সুপারিশ করতেন কিন্তু ডা. ওয়্যার কেন্টের মেটেরিয়া মেডিকা অনুসরণ করতে জোরপ্রদান করতেন। তিনি কেন্টের রেপার্টরিকে বিশেষভাবে সমর্থন করতেন এবং শিকাগো থেকে ফেরার পর এটি ছিলো তার নিত্যসঙ্গী।
সেই সাথে ডা. ওয়্যার মেটেরিয়া মেডিকাকে লাগাতার পড়ে যাবার প্রয়োজনীয়তাটির উপর গুরুত্বপ্রদান করতেন এবং এক দিনে একটি ঔষধ পাঠ করাকে সুপারিশ করতেন, সাথে সেই ঔষধটির সার্বিক ধারণা পাবার লক্ষ্যে বিভিন্ন বই থেকে পড়া উচিৎ বলে মনে করতেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ঠিক আগমুহূর্তে তিনি একক ঔষধ, একক মাত্রা ও প্রারম্ভিক বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করে British Homoeopathic Congress এ একটি রচনাপত্র প্রেরণ করেন। ঔষধের কাজে যেন বিঘ্ন ঘটানো না হয়- এই ব্যাপারটির প্রতিও তিনি তাতে জোর প্রদান করেন। একক মাত্রাতত্ত্বের সাথে সমন্বয় রেখে, ডা. ওয়্যার উচ্চশক্তি ব্যবহারেই অভ্যস্ত ছিলেন।
কিন্তু ওয়্যারের মতের বিরুদ্ধবাদীগণ তখন ছিলো শক্তিশালী। ১৯১৭ সালের জুলাই মাসে, হাসপাতালে প্রেসক্রাইবকৃত ঔষধগুলোর একটি শুমারি করা হয়; যেখানে ১৬৬৪ টি প্রেসক্রিপশন করা হয়েছিলো, যার মধ্য মাত্র ৩৯ টি ছিলো ২০০ শক্তির উপরে।
১৯১১ সালে তিনি Compton Burnett Medical College এ মেটেরিয়া মেডিকার প্রফেসর হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৯২৩ সালে তিনি হোমিওপ্যাথিক ফ্যাকাল্টির প্রেসিডেন্ট হিসাবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে নিয়মিত শিক্ষকতা প্রদান করেন। ১৯৬০ সালে তিনি London Homoeopathic Hospital এর সহকারী ফিজিশিয়ান হিসাবে নিযুক্ত হন, যেখানে বর্হিবিভাগে ও ওয়ার্ডে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রদানের সুযোগ তাকে দেয়া হয়।
উচ্চশক্তির প্রেসক্রাইবিংয়ের সমর্থনকারী হওয়ায়, এলোপ্যাথিক চিকিৎসকদের সাথে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য সুস্পষ্ট হয় এবং তিনি এলোপ্যাথির তুলনায় হোমিওপ্যাথির গুরুত্বের ব্যাপারে তৎকালীন অন্যান্য চিকিৎসকদের চাইতে স্বভাবতই অধিক ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। ১৯৩২ সালে তিনি Knight Grand Cross of The Royal Victorian পদবীতে রাজ পরিবারের চিকিৎসক হিসাবে আনুষ্ঠিানিকভাবে নিযুক্ত হন এবং সেখানে তিনি ‘Homoeopathy, an explanation of its principles’ নামে একটি বিবৃতি পাঠ করে Royal Society of Medicine কে আক্রমণ করেন। সেই একই বৎসরই তিনি King George V কর্তৃক নাইট উপাধিতে ভূষিত হন। Royal Victorian Order এর সমস্ত পর্যায়েই অগ্রবর্তী ভূমিকার জন্য এখানে তিনি বিরল ও স্বতন্ত্ররূপে সম্মানিত হতেন। ১৯৪৭ সালে সম্ভবত King George VI কে চিকিৎসা সেবা প্রদানের পুরস্কার স্বরূপ Royal Victorian Chain পুরস্কারে সম্মানিত হন।
তিনি Manchester Homoeopathic Institute কে পুনরুজ্জীবিত করেন এবং ১৯৩৯ সালের মে মাসে অক্সফোর্ড স্ট্রিটে ডিসপেনসারি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তার একটি বক্তৃতায় বলেন,
“হোমিওপ্যাথি…………ধর্ম নয়, সম্প্রদায় নয়, হুযুগ নয়, কোন ধোকাবাজিও নয়………..ঔষধ সরাসরি রোগের উপর কোন কাজ করে না; এটি স্রেফ রোগীর জীবনীশক্তির প্রতিক্রিয়াকে প্রণোদিত করে, আর এটিই তাকে নিজেকে আরোগ্য করার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।”
[Sir John Weir, 1931, 200-201]।
Julian Winston তার ‘Faces of Homeopathy’-তে বর্ণনা করেছেন কিভাবে তিনি পাঁচজন রাজা ও তিনজন রাণীর জন্য Ignatia প্রেসক্রাইব করেছিলেন। তার মতে, এই ঘটনাটি পৃথিবীর ইতিহাসে সম্ভবত অন্য আর কেউ দাবী করতে পারবে না। এছাড়া তিনি ব্রিটিশ Bacteriologist ও Immunologist Almroth Edward Wright এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।
বলা হয়, রাজ-পরিবারের নিয়োগকৃত প্রথম হোমিওপ্যাথ ছিলেন Frederick Hervey Foster Quin। আর ডা. জন ওয়্যার ছিলেন রাজ-পরিবারে নিয়োগকৃত প্রথম আধুনিক হোমিওপ্যাথ। তার চিকিৎসা করা এই সুবিখ্যাত ব্যক্তিগণের তালিকায় আছেন-
- King George V (1910 থেকে 1936 সাল পর্যন্ত শাসন করেন; Weir তার চিকিৎসক হিসাবে 1918 সালেই অনানুষ্ঠানিকভাবে নিযুক্ত হন)
- King Edward VIII (reigned 1936 সালে শাসন করেন)
- King George VI (1936 সাল থেকে 1952 সাল পর্যন্ত শাসন করেন)
- Queen Elizabeth II (1952 সাল থেকে 1968 সাল পর্যন্ত শাসন করেন)
- নরওয়ের King Haakon VII (1872 সাল থেকে 1957 সাল পর্যন্ত শাসন করেন)
- নরওয়ের রাজার স্ত্রী Maud (1869–1938) যিনি ছিলেন King Edward VII এর ছোট মেয়ে।
প্রচন্ড প্রতিভাবান ও হোমিওপ্যাথির এই অগ্রনায়ক ১৯৭১ সালের ১৭ ই এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। তিনি মার্গারেট টাইলারের সাথে সম্মিলিতভাবে, একিউট অবস্থা এবং ক্রনিক রোগের চিকিৎসাকেত্রে তাদের গুরুত্ব সম্বন্ধে কিছু হোমিওপ্যাথিক ঔষধের চমৎকার বর্ণনা প্রদান করেন। এছাড়া তাঁর বিখ্যাত রচনাসমূহ হচ্ছে:
- Homeopathy and its Importance in Treatment of Chronic Disease, (1915)
- The Trend of Modern Medicine (1922)
- The Science and Art of Homeopathy, British Homoeopathic Journal (1925)
- The Present Day Attitude of the Medical Profession Towards Homeopathy, British Homoeopathic Journal XVI, 1926, p. 212ff
- Homeopathy: a System of Therapeutics (1928)
- “The Hahnemann Convalescent Home, Bournemouth”, British Homoeopathic Journal 20, 1931, 200-201
- Homeopathy: An Explanation of its Principles (1932)
- “British Homeopathy During the Last 100 Years”, British Homoeopathic Journal 23, 1932: II, pp. 603–5
- “Samuel Hahnemann and his Influence on Medical Thought”, Trans. Roy. Soc. Med., (1933)
- Hahnemann on Homeopathic Philosophy (1935)
- Homeopathy: a System of Therapeutics
Discussion about this post