এই উপমহাদেশের লেখকগণের মধ্যে আমার সবচাইতে পছন্দের হচ্ছেন ডা. জে. এন. কাঞ্জিলাল। এই কথার ভিত্তিতে যদি কেউ মনে করে থাকেন, তার বুক রিভিউ দিতে বসে আমি অন্যায্য পক্ষপাতিত্ব করতে যাচ্ছি- ভুলে যান। ডা. জে. এন. কাঞ্জিলাল এমন একজন লেখক ছিলেন- আমাদের সমর্থন যাঁর কোনদিনই প্রয়োজন হবে না। নিজের সৃষ্টিতেই যিনি ভাস্বর হয়ে থাকবেন। তাঁরই একটি বই ‘Repertorization’ সম্বন্ধে আমার অনুভূতিটাই কেবল প্রকাশ করতে চাচ্ছি।
ডা. জে. এন. কাঞ্জিলালের একটা বিষয় আমার কাছে যুগপৎ বিস্ময় ও শিক্ষা। আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবি, একজন মানুষ কেবল উপযুক্ত প্রবন্ধ লিখেই কেমন অমর রচনা-সম্ভার সৃষ্টি করে যেতে পারেন, কিভাবে শক্তিশালী প্রবন্ধ আমাদের সম্পূর্ণ শাস্ত্রকে, তার মূলনীতিগুলোকে, তার শিক্ষাগুলোকে গভীরতম বিশ্লেষণসহ উপস্থাপন করতে পারে। তিনি ‘Hahnemannian gleanings’ এর সম্পাদক ছিলেন। এবং এই বইটি মূলত Hahnemannian gleanings এ বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত তাঁর রেপার্টরি নিয়ে রচনাগুলোর একটি সুসমন্বিত সংকলন।
সমস্ত গুণীজনই আমাদের শাস্ত্রে বহুবার বলেছেন এবং আমিও একবাক্যে কথাটির সাথে সহমত- রেপার্টরি ঔষধ-নির্বাচনের একটি কর্মপ্রক্রিয়াগত সহযোগী যান্ত্রিক অংশ কিন্তু তাকে ব্যবহার করতে হলে দক্ষতাটি থাকতে হয়- চিকিৎসকের মাঝে। চিকিৎসককে জানতে হয়, এর উদ্দেশ্য, প্রক্রিয়া, সুবিধা-অসুবিধা এবং প্রতিটি রেপার্টরির গঠনগত, বৈশিষ্ট্যগত, উপযোগিতাগত পার্থক্য। প্রতিটি রেপার্টরির ভিত্তিতে থাকে একটি দর্শন- তাকে আয়ত্ব করে না নিলে, পুরো কাজটি একটি বিশৃঙ্খল সমস্যায় পরিণত হয়ে- আমাদের ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে।
ডা. কাঞ্জিলাল তাঁর বইটিতে এই ভিত্তিস্থাপনের কাজ করেছেন সর্বোচ্চ উপযুক্ততার সাথে। তিনি বইটিকে দুইটি সেকশনে ভাগ করেছেন। প্রথম সেকশনে- লক্ষণাবলী (Symptoms), লক্ষণাবলী ও রোগের ফল (Symptoms and Ultimate’s of Disease), লক্ষণ-সমগ্রতা (Totality of Symptoms), সঠিক হোমিওপ্যাথিক প্রেসক্রিপশন (Correct Homeopathic Prescription), চারিত্রিক লক্ষণাবলী ও চিহ্নসমূহ (Characteristic Symptoms and Signs), লক্ষণাবলীর বিভাগকরণ ও শ্রেণীকরণ (Categorization and Classification of Symptoms) শিরোনামে প্রবন্ধগুলো তুলে ধরেছেন।
প্রথম সেকশনের তার প্রবন্ধগুলোর এই বাছাইটি, তাঁর চিন্তার গভীরতা ও মৌলিকত্বের নিদর্শন। এখানে রেপার্টরি নিয়ে একটি প্রবন্ধও নেই- আছে রেপার্টরির সেই ভিত্তিমূলগুলো সম্বন্ধে লেখা, যে ব্যাপারে চরম দক্ষতা অর্জন না করলে, রেপার্টরি কেবল ভুল পথেই ঠেলে দেবে এবং চিকিৎসক ও রোগীর সর্বনাশের কারণ হবে।
আর দ্বিতীয় সেকশনে তিনি সংকলিত করেছেন তাঁর হোমিওপ্যাথিক প্র্যাকটিসে রেপার্টরির গুরুত্ব (Importance of Repertory in Homoeopathic Practice), বিভিন্ন প্রকারের রেপার্টরি (The Different Varieties of the Repertory), কিভাবে রেপার্টরি ব্যবহার করতে হয় (How to use Repertory), রেপার্টরিগত পদ্ধতি চিত্রায়নকৃত কেইস-সমূহ (Cases Illustrating the Method of Repertorization), শয্যাপার্শে বা রোগীদেখার সময় রেপার্টরির ব্যবহার (Bed-side or Desk-use of Repertory)।
এবং বইটি সমাপ্ত করেছেন একটি সুবিস্তৃত Bibliography প্রদান করে। এই দ্বিতীয় সেকশনটি চমৎকৃত করে, গুরুত্বানুসারে লেখার ধারাবাহিক বাছাইটি- যে কারণে এই সংকলনটিকে আমি পূর্বে ‘সুসমন্বিত’ বলে উপরে উল্লেখ করে এসেছি।
আমার দেখামতে, মহাত্মা ডা. হ্যানিমানের পরে, সবচেয়ে বেশি ‘Skilled in Condensed-writings’ অর্থাৎ স্বল্প-পরিসরে সবচেয়ে, অল্প কথায়- ব্যাপক মাত্রার বিষয় ও ভাবের সমাবেশ ঘটানোর যোগ্যতাসম্পন্ন হোমিওপ্যাথিক প্রবন্ধ লেখক। কাজেই, কেউ যদি বইটির বিষয়বস্তুর গভীরতাকে উপরের শিরোনামগুলো দেখে পরিমাপ করতে যান – নিঃসন্দেহে একটি বিভ্রান্তি ও বঞ্চনাতে পড়তে যাচ্ছেন। এই পরিসরের মধ্যেই তিনি রেপার্টরির ভিত্তি, এর দর্শন, এর অপরিহার্য মৌলিক জ্ঞান, গঠন, বিভাগ, ব্যবহারসহ আরো প্রাসঙ্গিক বহুকিছুকে অত্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠভাবে তুলে ধরেছেন।
আসলে, রেপার্টরির ব্যাপারে সঠিক ও সার্বিক ধারণা নিয়ে, উপযুক্ত উপায়ে তাকে ব্যবহার করতে চাইলে এই বইটি পড়া আমাদের, হোমিওপ্যাথদের জন্য অপরিহার্য। Condensed-writings এর একটি অসুবিধা হচ্ছে, ভাষার উপর কিছুমাত্রায় দক্ষতা না থাকলে, তার সম্পূর্ণ রসাস্বাদন সম্ভব হয়ে উঠে না। এবং আমার জানামতে, বইটি কেবলমাত্র ইংরেজিতেই প্রকাশিত হয়েছে। আমি মনে করি, কাঞ্জিলাল পরিবার যদি অনুগ্রহ করে বইটির বাংলা অনুবাদ বাংলা ভাষা-ভাষীদের জন্য প্রকাশ করেন, তাহলে একদিকে মহর্ষি কাঞ্জিলাল সম্বন্ধে যেমন আরো বেশি হোমিওপ্যাথগণ অবগত হতে পারবেন, তেমনি তাঁর ক্ষুরধার লেখনী ও মৌলিক শিক্ষার সাথে পরিচিত হয়ে পুরো হোমিওপ্যাথিক সমাজ অশেষ উপকৃত হবেন।
Discussion about this post