ডা. এ. কে. এম. রুহুল আমিন:
ডা. জর্জ ভিথোলকাস এর শৈশব জীবন
ডা. জর্জ ভিথোলকাস, যাকে বর্তমান বিশ্বের হোমিওপ্যাথি জগৎ এক নামে চিনে এবং যিনি বর্তমানে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা জগতে শীর্ষ চিকিৎসক হিসাবে জায়গা করে নিয়েছেন, যার অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী, আন্তর্জাতিক হোমিও পরিমন্ডলে যার এত সুনাম, যিনি ১৯৯৬ সনে অল্টারনেটিভ নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন, যার দিক নির্দেশনায় বিশ্ববিখ্যাত হোমিওপ্যাথি সফটওয়্যার রাডার ও এনসাইক্লোপিডিয়া অব হোমিওপ্যাথিকা তৈরি হয়েছে, যিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, যিনি রচনা করেছেন অসাধারণ হোমিওপ্যাথির গ্রন্থাবলী, কেমন ছিল তার শৈশব, কেমন ছিল তাঁর শিক্ষা জীবন ও কর্মজীবন, তা নিয়েই আমার আজকের লেখা। এই লেখাটির তথ্য সংগ্রহ করেছি তারই বক্তব্য থেকে, যা তিনি তার একটি গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। গ্রন্থটির নাম হচ্ছে – ‘Talks on Classical Homoeopathy’ (The Esalen Conferences 1980 – Part 3), এই বইয়ের অষ্টম অধ্যায়ে তিনি খোলামেলা ভাবে তাঁর শৈশব জীবনের কথাগুলো বলেছেন। যা বড় কষ্টের, বড় বেদনার। আমি যখন প্রথম এই অংশটা পড়ি তখন আমি কেঁদে ফেলেছিলাম, চোখের পানিতে বুকে ভেসে গিয়েছিল। তবে এই অংশটুকু পড়ে অনুপ্রেরণাও পেয়েছিলাম যে, মানুষ চেষ্টা করলে তার কর্ম দ্বারা বিশ্বের অন্য মানুষদের জন্য ভাল কিছু করতে পারে, অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। যা করে দেখিয়েছেন অন্যের দয়ায় প্রতিপালিত এতিম বালক জর্জ ভিথোলকাস।
জর্জ ভিথোলকাস ১৯৩২ সালে গ্রিসের এথেন্সে জন্মগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গ্রিসকে জার্মানি দখল করে নেয়, তখন তাঁর বাবা ও মা উভয়ে নিহত হন। যখন তাঁর বয়স ১০ বছর তখন তাঁর বাবা নিহত হন, তার দুই বছর পরে তাঁর মা নিহত হন। সময়টা ছিল ১৯৪২-১৯৪৪ সাল। সে সময় বালক ভিথোলকাসকে চরম অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হয়েছে। খাওয়ার মতো কোন খাদ্য ছিলনা, মানুষ ছিল চরম ক্ষুধার্ত, কর্মসংস্থানের কোন ব্যবস্থা ছিল না, চারদিকে শুধু হাহাকার, দেশটি চরমভাবে যুদ্ধ বিধ্বস্ত, বড় শহরগুলোর অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়। অনাহারে, অর্ধাহারে কঙ্কালসার মৃতপ্রায় মানুষ শুধু মৃত্যুর প্রহর গুণে যাচ্ছিল। জর্জ ভিথোলকাসের পরিবারের অবস্থাও ছিল বেশ খারাপ, তিনি বিশ্বাস করেন সে সময়কার অপুষ্টির কারণেই তাঁর মেরুদন্ডে একটি মারাত্মক ধরনের অসুস্থতার সৃষ্টি হয়েছে।
জর্জ তার স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেন – তাঁর বাবার একটি আসবাবপত্র তৈরীর কারখানা ছিল এবং তিনি খুবই উন্নতমানের আসবাবপত্র তৈরী করতে পারতেন। জর্জের যখন সাত বছর বয়স তখন তিনি তাঁর বাবার সাথে এথেন্সের একটি রাজ প্রাসাদে গিয়েছিলেন- তার বাবা তাঁকে দেখিয়েছিলেন রাজপ্রাসাদের কোন কোন আসবাবপত্র তাঁর বাবার কারখানায় তৈরী। জর্জের বাবার কাজ ছিল নিখুঁত ও অত্যন্ত উন্নতমানের। তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে তাঁর ছেলেকে সব কাজ দেখিয়েছিলেন। জর্জ ছয় বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হন, স্কুলের ছুটির সময় বিশেষ করে গ্রীষ্মের ছুটির সময় তিনি তাঁর বাবার কারখানায় যেতেন, বাবাকে টুকটাক সহযোগিতা করতেন এবং বাবার কাজকে আগ্রহের সাথে লক্ষ করতেন। পরবর্তীতে বাবার কাজের সাথে পরিচিত হয়ে এ ধরনের সৃজনশীল কাজের প্রতি জর্জের বেশ আগ্রহ জন্মায়। বিধি বাম, ১৯৪২ সালে জর্জের বাবা আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ায় জর্জের মাথায় তখন চিন্তা আসে তাঁদের কারখানাটির ভবিষ্যৎ নিয়ে। কারখানাটি ছোট হলেও এটি ছিল তাঁদের আয়ের একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কারখানাটিও বন্ধ হয়ে যায়, আয় করার মতো আর কোন উপায় তাঁর মায়ের ছিল না। তারা চরম দরিদ্র অবস্থায় পতিত হন। এমনও দিন গিয়েছে জর্জের মা ছেলের মুখে দেয়ার মতো কোন খাবার খুঁজে পায়নি, অনাহারে থাকাই ছিল তাদের নিত্য দিনের রুটিন।
জর্জকে ও জর্জের মাকে তখন কাজের সন্ধানে রাস্তায়, মানুষের বাড়ি বাড়ি হাঁটতে হয়েছে, কেউ কোন কাজ করতে দিলে তা করতে হয়েছে, তা সে কাজ যত পরিশ্রমেরই হোক না কেন। জর্জ ছিলেন তখন ছোট বালক, মাত্র ১০ বছর বয়স, কাজ কতটুকুই বা করতে পারেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে সিগারেট, দিয়াশলাই ও ক্যান্ডি বিক্রয় করবেন। একটি বড় ডিস্কে তাঁর পণ্যের পশরা সাজিয়ে সেটা গলায় ঝুলিয়ে তিনি সেগুলো বিক্রির জন্য রাস্তায় যেতেন। কিন্তু জার্মান দখলদারিত্বের এই সময়টা বড় কঠিন পরিস্থিতিতে যাচ্ছিল। রাস্তার পাশে ময়লা পানি যাওয়ার জন্য ড্রেন ছিল, কিন্তু ড্রেনের যে ম্যানহোল ছিল তাতে কোন ঢাকনা ছিল না। যে যেখানে যা কিছু পেয়েছে তাই চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। একদিন বৃষ্টি হয়েছে, জর্জ তার পণ্য বিক্রির জন্য বেড়িয়েছেন। তিনি পানি জমে থাকার কারণে দেখতে পাননি, সোজা খোলা ম্যানহোলের ভিতরে পড়ে যান, হাত ফসকে তার ডিস্ক ছিটকে দূরে পড়ে যায়, তাঁর সকল মালামাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়, তিনি শরীরে বেশ আঘাত পান। অনেক লোক পাশ দিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু তারা তাঁকে টেনে বের করার কথাও ভাবেনি। তিনি বহু কষ্ট করে নিজ চেষ্টাতেই সেই ম্যানহোল থেকে বেরিয়ে আসেন এবং অবশেষে তিনি তাঁর মায়ের কাছে ফিরে আসেন। তাঁর সমস্ত শরীরে কাটাছেঁড়ার কারণে রক্ত ঝরছিল, তিনি কাঁদছিলেন, তবে সে কান্না শরীরের বেদনার জন্য ছিল না। তিনি কাঁদছিলেন তাঁর সকল পণ্যদ্রব্য হারিয়ে যাওয়ার শোকে, তাঁর সব পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার কারণে।
এই ভাবে নিঃস্ব হওয়ার পরও তিনি তাঁর উদ্যম হারিয়ে ফেলেননি। তিনি একটি ছোট টেবিল যোগাড় করেন, রাস্তার পাশে সেই টেবিলে শিশুদের খেলনার পশরা সাজিয়ে বিক্রির কাজ শুরু করেন। লোকেরা দেখতো একটি শিশু অন্য শিশুদের জন্য খেলনা বিক্রি করছে, কিন্তু সে খেলনা দিয়ে খেলার সৌভাগ্য এই শিশুটির নেই। শিশুরা খেলনা কিনতে আসত, তখন তিনি তাদের সাথে খেলনা দিয়ে দেখানোর ছলে একটু খেলতেন। এভাবেই যুদ্ধের দিনে তার দিন কাটছিল, তারপর যুদ্ধের শেষ সময়ে জর্জের চোখের সামনেই বাড়ির আরও সাতজন মানুষের সাথে তাঁর মা নিহত হলেন । কি ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্যে জর্জ তখন ছিলেন। চোখের সামনে মায়ের মৃতদেহ, বাড়ির সাত জন লোকের মৃতদেহ, তার মধ্যে তিনি একা কোন রকমে প্রাণ নিয়ে বেঁচে আছেন। তিনি প্রায় মরেই গিয়েছিলেন এবং মৃত্যুকে দেখেছেন খুব নিকট থেকে। ফলে তিনি প্রচন্ড শক পান, যে শক তাঁকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ১৬ বছর বয়সে তাঁর পিঠে প্রচন্ড বেদনা শুরু হয়, যা তাঁর যুদ্ধের সময়ের অপুষ্টি, পূর্বে পড়ে গিয়ে আঘাত পাওয়া ও যুদ্ধের সময়ের আঘাতের কারণে হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

প্রতিবেশীদের সিদ্ধান্ত অনুসারে অনাথ জর্জকে তাঁর এক দূর সম্পর্কের চাচীর দায়িত্বে দেয়া হয়। চাচী দায়িত্ব নিতে রাজী ছিলেন না, তারপরও অনাদর অবহেলা সত্ত্বেও তিনি চাচীর সাথে থাকতেন, অনেকটা নিরুপায় হয়ে। জর্জের ভরণপোষণ এবং দেখাশোনার জন্য পরিবারের কেউ ছিল না। তিনি কাজের সন্ধান করতে থাকেন এবং লেখাপড়া করার চিন্তাও করতে থাকেন। সে সময় সবাই বলাবলি করতো যে, এমন কোন কাজ বা পেশা বা শিক্ষা নেয়া উচিত যাতে- করে অধিক অর্থ উপার্জন করা যায়। তাই তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার কথা চিন্তা করেন। কেননা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশকে পুনর্গঠন করতে হলে ইঞ্জিনিয়ারদের প্রয়োজন হবে এবং ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদাও ব্যাপক হবে। তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর চাচীর আর্থিক অবস্থা ভাল ছিলনা। অধিকন্তু চাচী তাঁর পড়ালেখার খরচ চালাতে অস্বীকৃতি জানান। তাই পড়ালেখার খরচ কিভাবে মিটাবেন সে চিন্তায় তিনি চিন্তিত ছিলেন। সে সময় তিনি তাঁর কোমরের যন্ত্রণার চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হন, কোমরের এক্স-রে করান এবং তাতে তাঁর কোমরের পঞ্চম কশেরুকার প্রলাপ্স পাওয়া যায়। সে সময়ে তিনি একটি বৃত্তি লাভ করে এথেন্সের সেরা স্কুলে পড়ার সুযোগ লাভ করেন- যে স্কুলে সমাজের উচ্চস্তরের ধনীদের সন্তানরাই পড়তে আসতো। ধনী ছেলে মেয়েদের বিরূপ আচরণের কারণে তখন তাঁর মধ্যে উচ্চবিত্তদের প্রতি ঘৃণা জন্মায়।
সে সময় তাঁর কোমরের যন্ত্রণার জন্য তিনি স্বাভাবিক হাঁটা চলা করতে পারতেন না, অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করতেন। ডাক্তারগণ তাঁকে পরিষ্কার করে কিছু বলছিলেন না, আরোগ্যের আশাও দিচ্ছিলেন না, অপারেশন করলে সফল হবে কিনা তাও জানাচ্ছিলেন না। অপারেশন করলে তার সম্ভাব্য কি উপকার বা ক্ষতি হতে পারে- সে সম্পর্কেও জানতে পারছিলেন না। তবে অপারেশন করলে ভাল কিছু ঘটবেনা, এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। কোন ওষুধই তখন জর্জের ক্ষেত্রে কাজে আসছিল না। শুধু এসপিরিন সেবনে ব্যথা কিছু সময়ের জন্য নিবারিত থাকত। অপারেশন করলে নিম্নাঙ্গের পক্ষাঘাত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী, তাই তিনি অপারেশন না করে ব্যথা নিয়ে থাকাকেই যুক্তিযুক্ত মনে করেন। পক্ষাঘাতগ্রস্থ হওয়ার চেয়ে এই রোগে মৃত্যুবরণ করাকেই তিনি শ্রেয় মনে করেন এবং ভাবলেন এভাবে হয়ত তিনি ২৫-২৭ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচবেন, তারপর মরে যাবেন।
অন্যদিকে এ সময় তাঁর সেই পালক চাচীর সাথে তাঁর মতবিরোধ দেখা দেয়ায় তাঁকে অনেক সময় অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হয়েছে। এভাবে তখন তিনি কঠিন সময় পার করেছেন, অর্থের জন্য অন্যের কাজ করেছেন, একই সাথে তাঁর ইঞ্জিনিয়ারিং লেখাপড়াও শেষ করেছেন। ভারী কাজ করতে পারতেন না, তাঁকে হালকা ধরনের কাজ খুঁজতে হয়েছে। তখন গ্রিসে কাজ পাওয়া ছিল দুষ্কর, প্রায় সবাই ছিল বেকার। সেসময় তিনি কিছুদিন সেনাবাহিনীতেও কাজ করেছেন। এসময় “The Autobiography of a Yogi” নামক যোগব্যায়ামের একটি বই তাঁর হাতে আসে এবং তিনি যোগ ব্যায়ামের মাধ্যমে রোগারোগ্য সম্পর্কে জানতে পারেন এবং যোগ ব্যায়ামের মাধ্যমে তাঁর কোমরের ব্যথা সারিয়ে তুলতে পারবেন বলে ধারণা করেন।
তিনি যোগব্যায়াম শেখার জন্য ভারতে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাঁর কাছে ভারতে আসার মতো পর্যাপ্ত টাকা ছিলনা, তিনি সেনাবাহিনীর কাজ ছেড়ে দেন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ লাভ করেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় কাজ করলে গ্রিসের চেয়ে তিন গুণ বেশী অর্থ উপার্জন করা যাবে এবং গ্রিসের চেয়ে সেখানে জীবন-যাত্রার ব্যয় প্রায় অর্ধেক। তিনি ভাবেন চার বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় কাজ করলে তিনি যে টাকা সঞ্চয় করতে পারবেন- তা দিয়ে তিনি হিমালয়ের পাদদেশে যোগীগুরুদের সাথে দীর্ঘদিন থাকতে এবং যোগব্যায়াম শিখতে ও তাঁর নিজের কোমরের যন্ত্রণার চিকিৎসা নিতে পারবেন। তিনি গ্রীস থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যা ছিল অত্যন্ত বেদনাময় একটি ঘটনা। জন্মভূমির মায়া সবারই থাকে এবং এই জন্মভূমির মায়ার কারণেই তিনি বেদনাহত হয়েই গ্রীস ত্যাগ করেছিলেন। এবং সেখানেই তিনি সন্ধান পান হোমিওপ্যাথির।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার নব জাগরণের অগ্রদূত গ্রীসের ডা. জর্জ ভিথোলকাস
তিনি ১৯৬০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় হোমিওপ্যাথি অধ্যয়ন শুরু করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ হোমিওপ্যাথি থেকে ডিপ্লোমা অর্জন করেন এবং ভারতের বিভিন্ন হোমিওপ্যাথিক কলেজে অধ্যয়ন করে ছিলেন।
পরের বছর গ্রিসে ফিরে আসার পর ভিথোলকাস গ্রিসে হোমিওপ্যাথ অনুশীলন শুরু করেন এবং গ্রিক মেডিক্যাল ডাক্তারদের একটি ছোটো দলকে হোমিওপ্যাথি শিক্ষা দেয়া শুরু করেন। তাঁর প্রথম প্রশিক্ষিত ডাক্তারদের থেরাপিউটিক সফলতা অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়, যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭০ সালে এথেনীয় স্কুল হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন নামক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে এই স্কুলটি “হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন সেন্টার” (Center of Homoeopathic Medicine) নামে পুনরায় নামকরণ করা হয়, যা “ডক্টর অব মেডিসিন” (MD) শিক্ষা ও ডিগ্রি প্রদানের জন্য বিশেষভাবে উৎসর্গ করা হয়।

জর্জ ভিথোলকাস ১৯৬৭ সালে শাস্ত্রীয় হোমিওপ্যাথি (Classical Homoeopathy) শিক্ষা দেয়া শুরু করেন। ১৯৭১ সালে প্রথম গ্রীক হোমিওপ্যাথিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তার এক বছর পর ভিথোলকাস গ্রিক হোমিওপ্যাথিক জার্নাল, হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন জার্নাল ইত্যাদি প্রকাশনা শুরু করেন।
১৯৭৬ সালে তিনি গ্রীসে প্রথম আন্তর্জাতিক হোমিওপ্যাথিক সেমিনার করেন। তারপর থেকে, প্রতি বছর গ্রীসে নিয়মিতভাবে হোমিওপ্যাথিক আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, যে সেমিনারে সারা বিশ্ব থেকে স্বাস্থ্য পেশাদার স্বাস্থ্য কর্মী বা পেশাদার হোমিওপ্যাথিগণ অংশগ্রহণ করে আসছেন।
১৯৯৪ সালে, ভিথোলকাস গ্রিক দ্বীপ আলোনিসোসে (Greek island of Alonissos) ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথির জন্য আন্তর্জাতিক একাডেমী খুললেন, যার উদ্দেশ্য সারা বিশ্বে স্বাস্থ্যসেবার জন্য স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণ (Post-graduate training) প্রদান। বর্তমানে, এথেন্সের কেন্দ্রের পরিচালক হিসাবে, ভিথোলকাস ৩০ জন ডাক্তারের একটি দলকে ব্যবহারিক চিকিৎসা দেয়ার জন্য নিযুক্ত করেন যারা তাঁর কেন্দ্রে হোমিওপ্যাথি অনুশীলন করে এবং তাঁর তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করে। তিনি গ্রীসে হোমিওপ্যাথিকে প্রতিষ্ঠা করেছেন যা মেডিকেল পেশাজীবী কর্তৃক সম্মানিত পেশা হিসাবে স্বীকৃত, এবং পশ্চিমা বিশ্বের কাছে হোমিওপ্যাথি শিক্ষার জন্য তিনি তার দেশকে অন্যতম প্রধান শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
ভিথোলকাসের বই, Homeopathy: Medicine of the New Man (Arco, New York, 1979) , যা সাধারণ মানুষের জন্য লিখিত এবং The Science of Homeopathy (Grove Press, New York, 1980), যা পেশাদার স্বাস্থ্য কর্মী বা ডাক্তারদের জন্য; ইতোমধ্যে বিশ্বের বিশটি ভাষায় এই গ্রন্থটি অনুবাদ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী হোমিওপ্যাথিকে পেশা ও চিকিৎসা হিসাবে গ্রহণ এবং অনুশীলন উপর যা গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাঁর বই, A New Model for Health and Disease, ১৯৯১ সালে জার্মান ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়, যা প্রচলিত অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ এর মৌলিক সমালোচনা করে এবং ওষুধ বিজ্ঞানের জন্য একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
তিনি ২০ বছর ধরে ক্লাসিক হোমিওপ্যাথি শিক্ষার একজন আন্তর্জাতিক শিক্ষক হিসাবে নিজকে নিয়োজিত রেখেছেন। ১৯৯৬ সালে, তিনি ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথি শিক্ষা, চিকিৎসা ও গবেষণা ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য বিকল্প নোবেল পুরস্কার (Alternative Novel Prize) লাভ করেন।

১৯৮৭-১৯৯১ সাল সময়ে বেলজিয়ামের নামুর বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of Namur, Belgium) সহযোগিতায়, তিনি একটি অত্যন্ত উন্নত কম্পিউটার সিস্টেম তৈরি এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিষয়ক প্রোগ্রামিং করার কাজ সম্পাদন করেন, যার নাম VES (Vithoulkas Expert System), যা রাডার হোমিওপ্যাথিক কম্পিউটার প্রোগ্রামের (RADAR, Homoeopathic Software) জন্য একটি উন্নত ও সুবিধা প্রদানকারী সংযোজন। ভিথোলকাস এক্সপার্ট সিস্টেম বা VES ইতোমধ্যে ১০০০ কপি কপি বিক্রি হয়েছে এবং যা বিশ্বব্যাপী হোমিওপ্যাথির অনুশীলনকারীদের কাছে পৌঁছানোর পর ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথি পদ্ধতির ব্যাপক প্রসার ও উন্নত চিকিৎসা প্রদান সম্ভব হয়েছে। জনাব ভিথোলকাস তাঁর হোমিওপ্যাথি শিক্ষা বিষয়ক বক্তৃতা থেকে একটি সিরিজ ভিডিও কোর্সও তৈরি করেছেন।
জর্জ ভিথোলকাস এর সামগ্রিক কাজের ফলস্রুতিতে বিশ্বব্যাপী হোমিওপ্যাথির প্রতিষ্ঠালাভে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। তাঁর প্রচেষ্টার একটি প্রধান লক্ষ্য হল- হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল সাইন্সকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেন সর্বোচ্চ স্তরে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেয়া যেতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে, হোমিওপ্যাথী ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি অফ নিউইয়র্কের একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, (classicalhomeopathy.com)
বর্তমানে জর্জ ভিথোলকাস একটি নতুন আঙ্গিকে হোমিওপ্যাথিক ম্যাটেরিয়া মেডিকা লিখেছেন, যা হবে ১৬টি ভলিউমে, যার নাম Materia Medica Viva, যাতে অন্তর্ভূক্ত হচ্ছে সমকালীন জ্ঞান এবং এথেন্সের চিকিৎসালয়ে চিকিৎসিত প্রায় এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি রোগীর চিকিৎসালদ্ধ জ্ঞান। বর্তমানে মেটেরিয়া মেডিকা ভিভার ৯টি ভলিউম প্রকাশিত হয়েছে।
জর্জ ভিথোলকাস আন্তর্জাতিক ভাবে ও গ্রীসে তাঁর শিক্ষা প্রদান অব্যাহত রেখেছেন। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বের অনেক দেশে হোমিওপ্যাথির অনুশীলন আরও ব্যাপক হয়েছে, জনাব ভিথোলকাস তার প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের মানুষের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা ও কল্যাণে একটি বড় চলমান অবদান রেখে যাচ্ছেন, হোমিওপ্যাথি একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থা যা মানুষের স্বাস্থ্য এবং কল্যাণকে সুষ্ঠুভাবে উপকৃত করতে পারে।
জর্জ ভিথোলকাস বর্তমান বিশ্বের জীবিত হোমিওপ্যাথদের মধ্যে শীর্ষ স্থানে অবস্থান করছেন।
জর্জ ভিথোলকাস রচিত গ্রন্থ ও সেমিনার সংকলন:
- Homeopathy – Medicine Of The New Millenium, Published in May 2000
- This is an expanded version of Homeopathy – Medicine of the New Man,1970
- The Science Of Homeopathy 1980
- Materia Medica Viva 9 volumes
- A New Model For Health And Disease
- Essence Of Materia Medica
- Talks On Classical Homeopathy (Homeopathic Conference Esalen), First edition in English 1980
- The Bern Seminar 1987
- The Celle Seminars 1992
- Classical Homoepaty for Anxiety & Jealousy
Contact Details:
Website: www.vithoulkas.com