চিকিৎসাবিজ্ঞানে “The Father of modern psychiatry”, “The Father of Experimental Pharmacology” এবং “Human drug trials” ও ব্যবহারিকভাবে “Double-blind Trial” এর প্রবর্তক ডা. ক্রিশ্চিয়ান ফ্রেডরিখ স্যামুয়েল হ্যানিমান (MD)। আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসে তিনিই সর্বপ্রথম আদর্শ “Mental Asylum” প্রতিষ্ঠাকারী ও ‘মানসিক রোগ চিকিৎসার আধুনিক গাইডলাইন ও আরোগ্যকারী চিকিৎসাপদ্ধতি’ প্রদানকারী। অপরিসীম মেধা, ধৈর্য্য, অধ্যবসায় ও ধীশক্তির অধিকারী এই প্রডিজি ছিলেন একাধারে আজ অব্দি স্মরণীয় কেমিস্ট, বহুভাষাবিদ, যুগান্তকারী চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী। তৎকালীন চিকিৎসাবিদ্যার সর্বোচ্চ শিক্ষালাভ ও ডিগ্রি অর্জন করার পর, সেই চিকিৎসাপদ্ধতির আরোগ্যক্ষমতার সীমাবদ্ধতাকে উপলব্ধি করে তিনি আবিষ্কার করেন আরোগ্যের প্রাকৃতিক সূত্র ও তত্ত্ব এবং তার ভিত্তিতে গড়ে তোলেন তার উদ্ভাবিত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাপদ্ধতি। সেইসাথে পূর্বে থেকে চলমান তৎকালীন সে ব্যর্থ চিকিৎসাপদ্ধতির নামকরণ করেন ‘Allopathy’।
রেঁনেসা-উত্তর যুগে যে সময়টিতে রেনে ডেকার্টের দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে- মানুষকে কেবল এক বস্তুগত সত্ত্বা কল্পনা করে, তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চিকিৎসায় চিকিৎসক-সমাজ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়া শুরু করলেন এবং অবিরাম ব্যর্থতায়; ভুল, অপ্রাকৃতিক, ধারণাপ্রসূত ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াযুক্ত চিকিৎসায় মানুষের জীবনকে করে যাচ্ছিলেন বিপর্যস্ত। ঠিক সেই সময়ে মানবজাতির চিকিৎসা-ইতিহাসের ভ্রান্ত পদ্ধতিগুলোর বিরূদ্ধে সর্বশেষ শক্তিমান বিদ্রোহী হয়ে দাঁড়ালেন এই প্রচণ্ড মেধাশক্তির অধিকারী চিকিৎসক। এজন্য অনেকে তাকে ‘A medical rebel’ আইকন হিসাবেও সম্মান প্রদান করা হয়। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জ্ঞানকাণ্ডটিকে তিনিই একা হাতে পরিপূর্ণরূপে দাঁড় করিয়ে, ইতিহাস-যুক্তি-তত্ত্ব-তথ্য-দর্শন-বিজ্ঞান ও বাস্তব প্রমাণের মাধ্যমে দেখিয়ে দিলেন- ‘Reductionist’ নয়, মানুষের প্রকৃত আরোগ্য সম্ভব কেবলমাত্র ‘Holistic’ পদ্ধতিতেই সম্ভব।
কেমিস্ট্রিতে তার অবদান এতটাই তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্ববহ ছিলো যে তিনি যদি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কার না করে কেবল কেমিস্ট হিসাবেই নিজেকে পরিচিত করতেন- তাহলেও বর্তমান সময়ের মানুষকে তাঁর নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হতো। তিনি Forensic medicine ও Toxicology -তে এর ব্যবহার নিয়ে একটি নতুন টেস্টপদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। ওয়াইনের মধ্যকার ভেজাল নির্ণয়ের জন্য তার উদ্ভাবিত পরীক্ষা-পদ্ধতি তখন সবচেয়ে ভালো ও আধুনিক বলে এককথায় স্বীকৃতি লাভ করে। যে পদ্ধতি ঊনিশ শতকের একটি বিশাল সময় জুড়ে জার্মানির সুবিখ্যাত ফার্মাসি Lexicon ব্যবহার করেছে। আর দ্রবণীয় মার্কারির সবচেয়ে কার্যকরী ও আধুনিক প্রস্তুতপ্রণালী উদ্ভাবনের কৃতজ্ঞতায় তার নাম আজও সম্মানের সাথে উচ্চারিত হয়। তাঁর এই বহুমুখী, বহুমাত্রিক প্রজ্ঞাকে তাঁর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জীবনী-লেখক DR. T. L. Bradford অত্যন্ত যথার্থ শব্দগুচ্ছে বিবৃত করেন,
“Scholar whom scholars honored & respected,
Physician whom physicians feared,
Philologist with whom philologists dreaded to dispute, Chemist who taught chemists,
Philosopher whom no adversity or honor had power to change”
এই মহাত্মা স্যামুয়েল হ্যানিম্যান ১৭৫৫ সালের ১০ এপ্রিল জার্মানির স্যাক্সোনি প্রদেশের মেইসেন শহরে জন্মগ্রহন করেন, যার অবস্থান ড্রিসডেন শহরের বিশ মাইল উত্তর-পশ্চিমে (পোল্যান্ড এবং চেকোশ্লোভাকিয়ার বর্ডারের কাছে)। তাঁর পুরো নাম ছিল ক্রিস্টিয়ান ফ্রেডরিক স্যামুয়েল হ্যানিম্যান (Christian Friedrich Samuel Hahnemann)। হ্যানিম্যান ছিলেন তাঁর পিতা-মাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে তৃতীয় এবং পুত্রদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। শিশুকাল থেকেই তিনি পড়াশুনায় অসাধারণ মেধার পরিচয় দেন, বিশেষত ভাষা এবং বিজ্ঞানে। তিনি ইংরেজী, ফরাসি, গ্রিক, ল্যাটিন, স্প্যানিশ এবং আরবি ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। সেকালে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আরব দেশীয় মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের (ইবনে সিনা, ফারাবি, আল কিন্দি প্রভৃতি) লেখা পুস্তকসমূহ পড়ানো হতো; ফলে কারো পক্ষে সত্যিকারের চিকিৎসক বা চিকিৎসা বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য আরবি ভাষা শেখা ব্যতীত কোনো উপায় ছিল না। এমনকি মাত্র বারো বছর বয়সে তাঁর শিক্ষকের নির্দেশে হ্যানিম্যান তাঁর সহপাঠিদের গ্রিক ভাষা শিক্ষা দিতেন।
১৭৭৫ সালে তিনি লিপজিগ ইউনিভার্সিটিতে চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুষদে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানকার অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধার কারণে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন; কেননা সেই ডিপার্টমেন্টের অধীনে না ছিল কোন ক্লিনিক, না ছিল কোন হাসপাতাল। ১৭৭৭ সালের প্রথমার্ধে চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চতর জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভের নিমিত্তে তিনি ভিয়েনা গমন করেন। রয়েল কলেজের একজন অধ্যাপক হ্যানিম্যানের প্রতিভায় এমনই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি তাকে রোমানিয়ার গভর্নরের ব্যক্তিগত চিকিৎসকের পদে একটি চাকুরির ব্যবস্থা করে দেন। গভর্নরের ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান হিসেবে তিনি গভর্নরের প্রাচীন মুদ্রার কালেকশান, পুরনো পুস্তকসমূহ এবং পাণ্ডুলিপিসমূহের একটি ক্যাটালগ তৈরি করে দেন- যেটি ছিল রসায়ন শাস্ত্র এবং অকাল্টের উপর ইউরোপের সবচেয়ে বড় এবং দুর্বল পাণ্ডুলিপির লাইব্রেরি। এখানে অবস্থানকালীন সময়ে তিনি আরো কয়েকটি ভাষা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত কয়েকটি শাখায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।
ক্রমান্বয়ে নিজের অবিরাম প্রচেষ্টায় তিনি তৎকালীন চিকিৎসাবিদ্যায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন। আরলেঙ্গেন ইউনির্ভার্সিটিতে তাঁর শেষ সেমিস্টার অধ্যয়নের পর পেশীর আক্ষেপের (Cramps) ওপর একটি থিসিস পেপার জমা দেন এবং চিকিৎসক হিসেবে এম.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৭৮১ সালে তিনি ম্যান্সফিল্ডের তামার খনি এলাকার নিকটবর্তী গোমেরন এলাকায় তদাঞ্চলের গভর্নর কর্তৃক সরকারি চিকিৎসক হিসাবে নিয়োজিত হন। ১৭৮০ থেকে ১৭৮৩ সালের মধ্যে তিনি চিকিৎসক হিসেবে বেশ কয়েকটি চাকুরিতে যোগদান করেন। কিন্তু ১৭৮২ সালে তাঁর বিয়ের পর থেকেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের অপূর্ণতা এবং ব্যর্থতা লক্ষ্য করে চিকিৎসা পেশার প্রতি ধীরে ধীরে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলতে থাকেন।
তিনি লক্ষ করেন, ঔষধের ক্ষতিকর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার ফলে রোগীদের স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অধিকাংশ রোগই ঔষধে নিরাময় হয় না, যে রোগ তিনি সারিয়ে দিচ্ছেন, একই রোগ নিয়ে কয়েক মাস অথবা কয়েক বছর পরে রোগীরা পুনরায় ফিরে আসছে কিংবা আরো গভীর ও বড় কোন রোগে আক্রান্ত হয়ে ফিরে আসছে।চিকিৎসা করার দরুন নিয়ে আসা রোগ থেকে হয়তো মুক্ত হচ্ছে কিন্তু তার সার্বিক অবস্থা চিকিৎসার নেবার আগের অবস্থার চাইতে খারাপ হয়ে গেছে। ফলে ১৭৮৪ সালে ড্রেসডেন শহরে পৌঁছানোর পর তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে ডাক্তারি পেশা বর্জন করেন এবং তাঁর ক্রমবর্ধিষ্ণু পরিবারের সৎ উপায়ে ভরণপোষণের জন্য অনুবাদকের পেশা সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করেন।
চিকিৎসার নামে এসব অবৈজ্ঞানিক-অমানবিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে হ্যানিম্যান তাঁর অর্গানন (Organon of Medicine) নামক পুস্তকে ১৮১০ সালে লিখেছিলেন,
“(রোগীর) শরীরকে অত্যাচার করে দুর্বল করার মাধ্যমে (রোগীকে) মৃত্যুর দুয়ারে পৌছেঁ দিয়ে আমরা কোনো রোগমুক্তি আশা করতে পারি না। আর এখনও এই প্রাচীনপন্থী (এলোপ্যাথিক) ডাক্তাররা জানেন না- জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের রোগমুক্ত করার জন্য কী করতে হবে; কেবল তাদেরকে নিযার্তন করা, শক্তি ক্ষয় করা, তাদের জীবনবাহী (অতিপ্রয়োজনীয়) তরল পদার্থ (রক্ত) নষ্ট করা এবং আয়ু হ্রাস করা ছাড়া”।
এ সময় ড্রেসডেনেও তিনি একটু-আধটু ডাক্তারি করতেন, তবে তা জীবিকা অর্জনের জন্য ছিলো না বরং তা ছিলো প্রচলিত এলোপ্যাথিক চিকিৎসার অকার্যকারিতা এবং ক্ষতিকারক দিক নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে। ১৭৮৪ সালে তিনি Demarchy-র The ‘Art of Manufacturing Chemical Products’ বইটি ফরাসী ভাষা থেকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন। এটি ছিল দুই খণ্ডের একটি বিশাল অনুবাদ কর্ম যাতে তিনি নিজে থেকে অনেক কিছু ফুটনোট ও কমেন্টারি হিসাবে যোগ করেছেন। এই সময়টিতে স্বেচ্ছায় তাকে অনেক অভাব-অনটন সহ্য করতে হয়েছে এবং দারিদ্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছে। কেননা অনুবাদের কাজে তিনি খুবই সামান্য অর্থ উপার্জন করতে পারতেন। ডিমারকি ছিলেন সেকালের একজন শ্রেষ্ঠ রসায়নবিদ (Chemist)। ফ্রেঞ্চ একাডেমি তার বইটি ছাপিয়েছিল- যাতে জনগণ কেমিক্যাল দ্রব্যাদির উৎপাদন কৌশল আয়ত্ত করতে পারে। কেননা তৎকালে অধিকাংশ কেমিক্যালের উৎপাদনকারী ছিল ওলন্দাজরা (Dutch) এবং বাণিজ্যিক কারণে তারা এসব ব্যাপারে খুবই গোপনীয়তা বজায় রাখতো।
হ্যানিম্যানও বইটিকে জার্মান ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে দেশবাসীর বিরাট উপকার করেছিলেন। বইটি অনুবাদের পাশাপাশি এতে তিনি নিজে থেকে অনেক তথ্য পাদটিকা আকারে সংযুক্ত করে দিয়েছেন, ত্রুটিগুলি সংশোধন করে দিয়েছেন, অসম্পূর্ণ তথ্যকে সম্পূর্ণ করে দিয়েছেন; যা পড়লে রসায়ন শাস্ত্রে এই তরুণ চিকিৎসকের অসাধারণ পাণ্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়। Antimonials, Lead, Quicksilver, Camphor, Succinic acid, Borax ইত্যাদির ব্যাপারে তিনি দশজন লেখকের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ডিমারকি যেখানে বলেছেন যে, ‘Carbonification of turf’-এর ওপর কোন গবেষণার কথা তার জানা নেই, হ্যানিম্যান সেখানে ছয়টি গবেষণা উল্লেখ করেছেন। ডিমারকি একজন বিখ্যাত জার্মান চিকিৎসকের কথা উল্লেখ করেছিলেন; হ্যানিম্যান তার নাম, বইয়ের নাম এবং সংশ্লিষ্ট পরিচ্ছদেরও উল্লেখ করেছেন। মোটামুটি বইয়ের প্রতি পৃষ্ঠাতেই তার ফুটনোট চোখে পড়ে।
ক্যামিকেল ছাঁকন বা উত্তপ্ত করার পাত্র (Retorts) তৈরিতে হ্যানিম্যান নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। বিভিন্ন দেশে কেমিকেল উৎপাদনের পদ্ধতির সাথে তাঁর পরিচয় ছিল। রাশিয়া, সুইডেন, জার্মানি, ইটালি, সিসিলি প্রভৃতি দেশে এলুমিনিয়ামের (Alum) ব্যবহারের বিষয়ে ডিমারকি’র ভুল তথ্যকে হ্যানিম্যান সংশোধন করে দেন। Annalen নামক একটি বিখ্যাত কেমিকেল সাময়িকীর সম্পাদক Crell লিখেছিলেন,
“আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, রসায়ন শাস্ত্রের ওপর এর চাইতে উন্নত, পুর্ণাঙ্গ এবং প্রামান্য গ্রন্থ আর দ্বিতীয়টি নেই”।
১৭৮৫ সালে ডিমারকির ‘Art of Distilling Liquor’ নামক বইটিও হ্যানিম্যান অনুবাদ করে দুই খণ্ডে প্রকাশ করেন। ১৭৮৪ সালে দুরারোগ্য ক্ষতের (Scrofulous sores) চিকিৎসার ওপর তাঁর একটি মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এতে তিনি লিখেন যে,
“এটি খুবই সত্য কথা (এবং যা আমাদেরকে বিনয়ী হতে সাহায্য করে) যে- সাধারণ, প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম যে-সব বস্তু ঔষধরূপে ব্যবহৃত হয়, তাদের অধিকাংশেরই গুণাগুণ জানা গেছে সাধারণ মানুষের প্রাত্যাহিক ব্যবহার থেকে (অর্থাৎ দাদী-নানীদের কাছ থেকে)। আর এই কারণে বিজ্ঞ চিকিৎসকদের নিকট এসব গৃহ ব্যবহৃত ঔষধের গুরুত্ব অপরিসীম”।
এই বইটি ছিল প্রধানত ট্রান্সসিলভানিয়ায় বসবাস কালীন সময়কার তাঁর অভিজ্ঞতার ফসল। সেই সময়কার ডাক্তাররা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে কোন গুরুত্ব দিতেন না। এই কারণে হ্যানিম্যান তাঁর এই পুস্তকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ব্যায়াম, মুক্ত বায়ু সেবন, স্থান পরিবর্তন, ঠাণ্ডা পানির ঔষধি গুণ, সমূদ্র সৈকতে গমন ইত্যাদির গুরুত্ব বুঝাতে অনেকগুলো পৃষ্ঠা ব্যয় করেন। আর পদ্ধতিগত স্বাস্থবিধির ক্ষেত্রে এটাই ছিলো পৃথিবীর সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা- যেগুলো চিকিৎসকগণ এখনো অনুসরণ করতে বাধ্য হন।
তাঁর এই বইটি সমকালীন চিকিৎসক সমাজে বেশ সমাদর লাভ করে। লেখালেখি এবং অনুবাদে সাধারণত আয়-রোজগার খুবই কম হয়। এই কারণে ১৭৯০ সালের দিকে তিনি ভয়ানক দারিদ্রে পতিত হন এবং এ কারণে তাকে লিপজিগ ছেড়ে স্টোটারিজ শহরে গমন করতে হয়। এ সময় ড্রেসডেন ইকোনোমিক্যাল সোসাইটি তাকে ফরাসি এবং ইংরেজি থেকে জার্মান ভাষায় বিজ্ঞান এবং চিকিৎসা বিষয়ক পুস্তক অনুবাদে প্রশংসনীয় অবদানের জন্য বিশেষভাবে সম্মাননা প্রদান করে। ফলে বলা চলে, সেসময় চিকিৎসক হিসেবে তাঁর পরিচিতি ঢাকা পড়ে গিয়েছিল এবং (বিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থের) অনুবাদক ও লেখক হিসেবে তাঁর সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল।
১৭৯২ থেকে ১৮০৪ সাল পর্যন্ত বার বছরে তিনি তাঁর গোটা পরিবার নিয়ে মোট চৌদ্দটি শহরে বসবাস করেছেন; প্রতিটি শহরে গড়পড়তা কয়েক মাস করে। তাঁর এই বিরামহীন ভ্রমণের শেষ পযার্য়ে তিনি টরগাউ (Torgau) শহরে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং এই শহরে সুদীর্ঘ চৌদ্দ বছর অবস্থান করেন। তাঁর লেখালেখির সবচেয়ে বড় অংশটি এই শহরে রচিত হয়। ১৭৭৭ থেকে ১৮০৬ সালের মধ্যে তিনি মেগাসাইজের ২৪ টি পাণ্ডুলিপি এবং অগণিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুবাদ করেন। প্রতিটি অনুবাদেই তিনি নিজ থেকে অগণিত পাদটিকা সংযুক্ত করতেন এবং পুস্তকের ভুলক্রুটিও সংশোধন করে দিতেন।
এই সময় তিনি তাঁর পড়াশুনা এবং গবেষণায় প্রাপ্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপর নতুন আইডিয়া নিয়ে পত্রিকায় প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখতেন। অনেকগুলো বছরের ছন্নছাড়া জীবন এবং চিকিৎসা বিষয়ক বই-পুস্তক অনুবাদের ফলে হ্যানিম্যান চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে অগ্রসর দিকগুলো সম্পর্কে অবগত থাকতেন এবং সেগুলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যাচাই-বাছাই করার সুযোগ পেয়েছিলেন। হ্যানিম্যানের জীবনে এই সময়টি ছিল একটি চরম সন্ধিক্ষণ; কেননা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর বৈপ্লবিক সব থিউরি এবং ফিলোসোফির প্রমাণ তাঁর হাতে আসার দরুন, তখন তাঁর ভেতরে যে আলোড়নের সৃষ্টি হয়- তারই তাগাদায়ই তিনি ভেতরে ভেতরে নিজের ভবিষ্যত কর্মপদ্ধতি স্থির করে ফেলেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর তিনি যেই বৈপ্লবিক আবিষ্কার সম্পন্ন করেন- তা প্রথম তাঁর মাথায় আসে ১৯৭০ সালে উইলিয়াম কালেন (William Cullen)-এর মেটেরিয়া মেডিকা অনুবাদ করার সময়। উক্ত পুস্তকে লেখা ছিল যে, কুইনাইন (Cinchona) ম্যালেরিয়া জ্বরের সুনির্দিষ্ট ঔষধ। সিঙ্কোনাতে ম্যালেরিয়া আরোগ্যের কারণ হিসাবে সেখানে বলা হয়েছিলো এর তিক্তস্বাদ ও গুণকে। সিঙ্কোনাতে ম্যালেরিয়া আরোগ্য হয় তা হ্যানিমান জানতেন কিন্তু সেটা যে তার তিক্ত স্বাদ ও গুণের দরুণ- তা তিনি মেনে নিতে পারেননি। অধিকন্তু তিনি সেখানে দেখতে পেলেন সিঙ্কোনার বিষক্রিয়াতে যে লক্ষণগুলো উৎপন্ন হয়- তা অনেকটা ম্যালেরিয়ার লক্ষণসদৃশ। তাঁর চিন্তা জগতে তখন সে নতুন এক দিগন্তের আভাস পেলেন; তিনি নিজের সুস্থ শরীরে সিঙ্কোনার নিয়ন্ত্রিত বিষক্রিয়া ঘটালেন।
এই একটি ঘটনা চিকিৎসাজগতের একটি বিশাল ও মহৎ দৃষ্টান্ত। এই একটি কাজ- চিকিৎসাবিদ্যার একটি অনন্য আধুনিকায়ন ছিলো, কাজটিতে ছিলো একটি বিপ্লবের বীজমন্ত্র। তিনি স্রেফ এই কাজটির দ্বারাই মানবজাতির স্বার্থে নিজে বিষ গ্রহণ করে- একজন চিকিৎসকের মানবতার লক্ষ্যে নিজেকে উৎসর্গ করার এক মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।যেখানে আজকের বহু চিকিৎসককে জীবনের জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞান ও পেশাকে বেছে নেন- সেখানে তিনি এই বিজ্ঞান ও পেশার জন্য জীবনকে বেছে নিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন- জ্ঞান ও মানবতার জন্য নিজের সর্বস্ব নিয়ে কিভাবে প্রস্তুত হতে হয়!
দ্বিতীয়ত তিনি মানুষের আরোগ্যের প্রাকৃতিক সূত্র আবিষ্কারে সমর্থ হলেন। পৃথিবীর সমস্ত বিজ্ঞান কিছু মৌলিক প্রাকৃতিক নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তিনি এই আবিষ্কারটির আগ পর্যন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানের সেই প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যাপারটি ছিলো অজ্ঞাত। প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থায় যা আজো অজ্ঞাত হয়েই আছে (কিংবা অজ্ঞাত করে রাখা হয়েছে)।তিনি উন্মোচন করলেন মানুষের আরোগ্যের সেই চিরন্তন নিয়মটি- ‘Similia Similibus Curentur’ বা সদৃশ দ্বারাই সদৃশ আরোগ্য হয়।
তৃতীয়ত, চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক্সপেরিমেন্টাল ফার্মাকোলজির সূচনা করলেন। তিনিই প্রথম মানবদেহে ঔষধ পরীক্ষণ পদ্ধতি, তার ফলাফল পর্যবেক্ষণ, লিপিবদ্ধকরণ ইত্যাদি ব্যাপারগুলো দিয়ে যাত্রা শুরু করে, সবচেয়ে আধুনিক, সবচেয়ে কার্যকরী ও যৌক্তিক ফার্মাকোলজি বা ঔষধবিজ্ঞানশাস্ত্র সৃষ্টি করলেন। আর এ কারণেই কেবল হোমিওপ্যাথগণ নন, বিশ্বের সমস্ত প্যাথিই তাকে স্বীকার করে ‘Father of Experimental Pharmacology’ হিসাবে।
চতুর্থত, অযৌক্তিক ভ্রান্ত ধারণাসমৃদ্ধ মেটেরিয়া মেডিকার বদলে নিশ্চিত পদ্ধতিগত এক মেটেরিয়া মেডিকার সূচনা করলেন। হ্যানিম্যানের যুগান্তকারী আবিষ্কার হলো সুস্থ মানুষের শরীরে ঔষধের গুণাগুণ পরীক্ষা করা। হ্যানিম্যান তাঁর জীবনকালে ৯০টি ঔষধ নিজের শরীরে পরীক্ষা করে তার বিস্তারিত গুণাগুণ তাঁর রচিত “মেটেরিয়া মেডিকা পিউরা” (Materia medica pura) নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে গেছেন এবং বলতে হয় সিঙ্কোনা ছিল তাঁর জীবনে তাঁর নিজের শরীরে পরীক্ষা করা ঔষধগুলোর মধ্যে প্রথম ঔষধ।
১৭৯৬ সালে তাঁর রচিত ‘Essay on a New Principlea’ প্রবন্ধে তাঁর নতুন আবিষ্কৃত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মূল বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হয়েছিল। এসময় তিনি পুনরায় চিকিৎসা পেশাকে গ্রহণ করেন। তবে তিনি রোগীদেরকে দিতেন তাঁর আবিষ্কৃত নতুন ধরণের (হোমিও) ঔষধ যার জন্য তিনি রোগীদের নিকট থেকে ফি রাখতেন না। এ সময় ল্যাটিন ভাষায় তাঁর ‘Fragmenta de viribus medicamentorum: positivis sive in sano corpore humano observatis’ (Fragmentary Observations relative to the Positive Powers of Medicines on the healthy human body) নামক গ্রন্থটি প্রকাশ হয়- যাতে Pulsatilla, Ignatia, Aconite, Drosera, Belladonna ইত্যাদিসহ ২৭টি ঔষধের পরীক্ষা-নিরীক্ষালব্ধ (Proving) বিস্তারিত বিবরণ ছিল। এই বইটি এবং তাতে উল্লেখিত ঔষধ পরীক্ষার নতুন পদ্ধতিটি ছিল চিকিৎসক সমাজের নিকট একেবারেই আনকোরা, বিস্ময়কর, অভিনব। তিনি এমন একটি চিকিৎসা বিজ্ঞান আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেছিলেন- যাতে রোগীদেরকে একবারে মাত্র একটি ঔষধ দেওয়া হবে, ক্ষতি করতে না পারে এমন অল্পমাত্রায় ঔষধ দেওয়া হবে এবং আন্দাজ-অনুমান নয় বরং সুস্থ মানুষের শরীরে পরীক্ষা করে ঔষধের গুণাগুণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে এমন ঔষধ রোগীদের দেওয়া হবে।
১৮০৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘The Medicine of Experience of Experience’ নামক বইটি যা ছিল হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মূলনীতি বিষয়ক গ্রন্থ অর্গাননের (Organon of Medicine) পূর্বসুরী। ১৮০৫, ১৮০৮ এবং ১৮০৯ সালে প্রকাশিত অন্যান্য প্রবন্ধমালার আলোচ্য বিষয় ছিল প্রচলিত সকল চিকিৎসা পদ্ধতিসমূহের যুক্তিসঙ্গত সমালোচনা এবং সদৃশ বিধান (Similia) এবং একটি রোগীতে একক ঔষধ (Single drug) নীতি কেন সর্বকালেই শ্রেষ্ঠ- তার ব্যাখ্যা সম্বলিত। এর পরপরই ১৮১০ সালে প্রকাশিত তাঁর কিংবদন্তীতুল্য গ্রন্থ অর্গানন অব দ্যা আর্ট অব হিলিং (Organon of the Art of Healing) যাতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মূলনীতিগুলোকে আইনের ধারার মতো একে একে সজ্জিত করে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এটি ছিল একটি সম্পূর্ণ নতুন এবং ইতিপূর্বে চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্য সমস্ত লেখার চাইতে অনন্য। চিকিৎসা বিজ্ঞান হিসেবে হোমিওপ্যাথির যাত্রাপথের একটি মাইলফলক (Landmarks) স্বরূপ। ১৮০৬ সালে তিনি তাঁর সর্বশেষ অনুবাদ করেন Albrecht von Haller -এর মেটেরিয়া মেডিকা- ল্যাটিন ভাষা থেকে জার্মান ভাষায়। আর এরপর তিনি নিজের গবেষণা কর্মকে একটি সুনির্দিষ্ট রূপ দেওয়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। জীবনের এই সুদীর্ঘ সময় জুড়ে অধ্যয়ন এবং অনুবাদের মাধ্যমে লাগাতার তিনি অন্যদের কর্মের সাথে পরিচিত হয়েছেন। তিনি তৎকালীন সময় থেকে ২৫০০ বৎসর আগ পর্যন্ত চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাস ও তত্ত্বগুলোকে স্টাডি করেছিলেন এবং এই বিচিত্র ভ্রমণ, বিভিন্ন স্থানে কর্ম ও অনুবাদের সুবাদে পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলের চিকিৎসাপদ্ধতি সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন করেন।
এজন্যই চিকিৎসার ইতিহাসে মেডিক্যাল সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাকারী, Johns Hopkins Hospital এর মেডিসিন বিভাগের প্রথম অধ্যাপক – যিনি প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থায় “Father of modern medicine” (এলোপ্যাথিক!) হিসাবে স্বীকৃত, সেই SirWilliam Osler, (MD, CM) ছিলেন হোমিওপ্যাথি ও হ্যানিমানের একান্ত ভক্ত এবং তিনি ডা. হ্যানিমান সম্বন্ধে অকুণ্ঠচিত্তে বলেছেন,
“His belief that over-treatment with drugs was one of the medical errors of the day has been hinted at, and it was always one of his favorite axioms that no one individual had done more good to the medical profession than Samuel Hahnemann, whose therapeutic methods had demonstrated that the natural tendency of diseases was toward recovery, provided that the patient was decently cared for, properly nurses, and not over-dosed.”
(Harvey Cushing The Life of William Osler P. 171)
অর্থাৎ, যে সময়ের কথা বলা হয়েছে, তাঁর (উইলিয়াম অসলার) মতে তখন অতিরিক্ত ঔষধ প্রয়োগ করে চিকিৎসা করাটি চিকিৎসাব্যবস্থার ভুলগুলির মধ্যে ছিলো একটি এবং এই কথাটি সবসময়ই তার প্রিয় বাক্যের মধ্যে একটি ছিলো যে-
‘চিকিৎসা পেশায় স্যামুয়েল হ্যানিমানের চাইতে বেশি অবদান আর কোন ব্যক্তির নেই, যার ঔষধ প্রয়োগ পদ্ধতি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, রোগের সহজাত গতি আরোগ্যের দিকে- কেবল যদি রোগীকে যথাযোগ্য যত্ন, উপযুক্ত সেবা করা হয় এবং অতিরিক্ত মাত্রায় ঔষধ না দেয়া হয়।’
১৭৯০ সাল থেকে ১৮৫৫ সালে হ্যানিম্যানের মৃত্যু পর্যন্ত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের আবির্ভাব হয়েছে টুকরা টুকরা, অংশ খণ্ডাংশ রূপে। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি হোমিওপ্যাথির মূল সূত্রগুলি (Aphorism) আবিষ্কার করেছেন, আরো গবেষণা-পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পর্যায়ক্রয়ে তাদেরকে সংশোধন-পরিবর্ধন-পরিবর্তন করেছেন, ঔষধ আবিষ্কার ও প্রুভিং করেছেন, ঔষধের মাত্রাতত্ত্ব (Posology) আবিষ্কার ও সংশোধন করেছেন, ঔষধের শক্তিবৃদ্ধি (Potentization) করার প্রক্রিয়া আবিষ্কার ও তাকে আধুনিকায়ন করেছেন, জটিল (Chronic) রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন, রোগীদের শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতি ও কারণতত্ত্ব আবিষ্কার (Miasm theory) আবিষ্কার করেছেন। ড্রাগ-প্রুভিংয়ের ক্ষেত্রে প্রবর্তন করেছেন- Double blind Method।
১৮১২ সালে হ্যানিম্যান পুনরায় লিপজিগ শহরে ফিরে যান; মূল উদ্দেশ্য ছিল এলোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতিকে চ্যালেঞ্জ করা। তিনি ফিরে এসেছিলেন শিক্ষক হিসেবে- তাঁর আবিষ্কৃত নতুন চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেওয়ার জন্য। হেলিবোরের (Hellebore) ওপর একটি অভিসন্দর্ভ (Thesis) জমা দিয়ে তিনি ইউনিভার্সিটিতে মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টির অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন। তাঁর এই থিসিসে প্রাচীনকাল থেকে সমকালীন অন্তত পঞ্চাশজন ডাক্তার, দার্শনিক ও প্রকৃতি বিজ্ঞানীর উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন ইউরোপে প্রচলিত বিভিন্ন ভাষায়। সমকালীন চিকিৎসা বিজ্ঞান আর ভাষার ওপর হ্যানিম্যানের জ্ঞান ছিল এতটাই গভীর ও বিস্তৃত যে- জার্মান, ফ্রেন্স, ইংরেজী, ইটালিয়ান, ল্যাটিন, গ্রিক, হিব্রু এবং এরাবিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে ভাষার ওপর তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা প্রদর্শন করেছিলেন যা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলকে বিমুগ্ধ করেছিল।
কিন্তু একটি সময় তিনি লিপজিগও ত্যাগ করেন। কারণটি ছিল ঔষধ-প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের স্বার্থহানি। ডা. হ্যানিমান অতি অল্পমাত্রায় নিজে প্রস্তুতকৃত ঔষধ প্রয়োগ করতেন এবং তার অনুসারীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় তৎকালীন ঔষধ ব্যবসায়ীদের আঁতে ঘা লাগে (যেমনটা বর্তমানে বিগ ফার্মাদের লাগে)।তাদের প্ররোচনায় একটি সরকারি আইন পাশ হয়, যেখানে তাঁর নিজে নিজে ঔষধ প্রস্তুত করে রোগীদের মধ্যে বিতরণ করা নিষিদ্ধ হয়। ফলে লিপজিগে হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করতে হ্যানিম্যান আইনগত বাঁধার সম্মুখীন হন এবং দেশ ত্যাগ করাকেই এর একমাত্র সম্মানজনক সমাধান হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
কোহেনের অন্তর্গত আলটোনার মহান ডিউক ফারডিন্যাণ্ডে সাথে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা ও কাজ করার স্বাধীনতার ব্যাপারে ব্যাপক পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে তাঁর লিপজিগ ত্যাগ করার পথ প্রশস্ত হয়। কোহেনের উিউক তাকে একটি সরকারি চিকিৎসকের পদ এবং স্বাধীনভাবে গবেষণা আর নিজের আবিষ্কৃত নতুন ধরণের (হোমিওপ্যাথিক) ঔষধ তৈরী করা ও রোগীদের প্রদানের আইনগত অধিকার প্রদান করেন। ফলে ১৮২১ সালের জুন মাসে তিনি লিপজিগ ত্যাগ করে কোহেন গমন করেন। কোহেনে তিনি সব ধরণের সুযোগ-সুবিধাই পেয়েছেন এবং এখানে “স্বর্গীয় নিঃসঙ্গতায়” কাটিয়েছেন চৌদ্দটি বছর। এই সময়গুলোতে তিনি তাঁর গবেষণা প্রবদ্ধগুলি এবং (অর্গানন, মেটেরিয়া মেডিকা পিউরা ইত্যাদি) বই-পুস্তকগুলো ক্রমাগত ছাপিয়েছেন এবং বিভিন্ন সংশোধন-সংস্কারের মাধ্যমে নতুন নতুন এডিশন বের করেছেন।
এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, এলোপ্যাথিক চিকিৎসার অসারতা এবং বর্বরতার কারণে হতাশ হয়ে হ্যানিম্যান এলোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতিকে বর্জন করেছিলেন এবং হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতিকেও বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণটা আর কিছু নয়- এলোপ্যাথিক চিকিৎসায় সে যুগে অধিকাংশ রোগই সারানো যেতো না এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসার কারণে রোগী তার আগের রোগের চাইতে আরো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হতো। পক্ষান্তরে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় অধিকাংশ রোগই খুব সহজে নিরাময় করা যেতো কিন্তু হ্যানিম্যান লক্ষ করে দেখলেন যে, যে-রোগ তিনি সারিয়ে দিলেন, দু’চার বছর পর একই রোগে আক্রান্ত হয়ে সেই রোগী আবার তাঁর নিকট ফেরত আসছে। এবং এই ব্যাপারটি তাকে এতটাই নিরাশ করেছিলো যে, তিনি হোমিওপ্যাথি আবিষ্কারের কয়েক বছর পর- চিকিৎসা ও হোমিওপ্যাথি নিয়ে কাজ করাটি ছেড়ে দেবারই মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু আমাদের পরম সৌভাগ্য, তিনি জন্মেছিলেন অসীম অধ্যবসায় নিয়ে। নৈরাশ্য তাকে গ্রাস করতে পারেনি। দীর্ঘ আরো বারোটি বৎসরের গবেষণায় তিনি খূঁজে বের করলেন এই রোগগুলোর ফিরে ফিরে আসার কারণ।
কোহেনে আসার পর, জীবনের এই সময়টুকুতে তিনি নির্বিঘ্নে কাজ করার সুযোগ পান এবং এই সময়টাতেই তিনি তাঁর সবচেয়ে গভীরতম তত্ত্বটি দীর্ঘ গবেষণার পর প্রদান করেন। ১৮২৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘ক্রনিক ডিজিজেস’ (The Chronic Diseases)- যেটিতে তিনি জটিল রোগের (Chronic Diseases) অন্তর্নিহিত কারণগুলোকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেন- সোরা (Psora- skin diseases with itching), সাইকোসিস (Sycosis- from suppressed gonorrhoea- diseases with growth and hypertrophy) এবং সিফিলিস (Syphilis- diseases with decay & destruction)। এগুলোকে তিনি নামকরণ করেন মায়াজম (Miasm) নামে। মানবজাতিতে তিনি দান করলেন, ক্রনিক রোগের সবচেয়ে মৌলিক তত্ত্ব ‘Miasm Theory’।
এ সময়টিতে তাঁর জীবনে ঘটে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর চার বছর ছয় মাস পর- ১৮৩৫ সালের ১৮ই জানুয়ারি, হ্যানিম্যান এই কোহেনেই দ্বিতীয় বিয়ে করেন মেলানিকে (Melanie D’Hervilly Gohier)। সে ছিলেন ফ্রান্সের এক সুন্দরী, আকর্ষণীয়া তরুণী আর্টিস্ট। মেলানি প্রথমে ছিলেন হ্যানিম্যানের রোগী, তারপরে ছিলেন হোমিওপ্যাথির ছাত্রী এবং শেষে ছিলেন প্রেমিকা এবং স্ত্রী। মেলানি বয়সে ছিলেন হ্যানিম্যানের চাইতে চল্লিশ বছরের ছোট। ১৮৩৪ সালের ৮ই অক্টোবর মেলানি প্রথম যখন চিকিৎসার জন্য ফ্রান্স থেকে জার্মানীর কোহেন নগরে হ্যানিম্যানের চেম্বারে এসে উপস্থিত হন- হ্যানিমান এই তরুণীর আচার-আচরণ ও বুদ্ধিমত্তা দেখে বেশ আশ্চর্য হন। আর তা থেকেই জন্মায় অনুরাগ, যা অবশেষে দুজনের প্রেম ও বিয়েতে পরিণতি পায়। কোহেন নগরীতেই তাদের বিয়ে হয় এবং জানুয়ারিতে বিয়ে সম্পন্ন হবার পর, জুন মাসের ৭ তারিখে তিনি দেশত্যাগ করে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বসবাস শুরু করেন। মানবজাতিকে রোগমুক্ত করার মানসে তাঁর এই হিজরত ছিল অনেকটা আরব্য রজনীর রূপকথার মতো। আর এটি ছিলো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
কারণ, জীবনের শেষের এই সময়টিতেই হ্যানিমান কাটিয়েছেন নিরঙ্কুশ শান্তিতে। প্যারিসে হ্যানিম্যানের জীবনের এই শেষ আট বছরে তিনি ছিলেন একজন বিশ্বখ্যাত মহাব্যস্ত চিকিৎসক এবং তাঁর তরুণী স্ত্রী ছিলেন তাঁর সহকারী চিকিৎসক। মিসেস মেলানি হ্যানিমান এমনিতেই যথেষ্ঠ অর্থশালী ও প্রভাবশালী ছিলেন। সমাজের অভিজাত ও সম্মানিত স্থানে ছিলো তাঁর অবস্থান। এসময়ে ধনী, বিত্তশালী এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের সবচেয়ে পছন্দের ডাক্তার ছিলেন হ্যানিম্যান। জানা মতে, এই আট বছরে হ্যানিম্যান ও মেলানী দুইজনে মিলে আয় করেছিলেন আট লক্ষ ফ্রাঙ্ক। কিন্তু তাই বলে তিনি তার মহান দায়িত্ব ও মানবিকতাকে ত্যাগ করেননি। দরিদ্র রোগীদের তিনি চিকিৎসা করতেন বিনা পয়সায়; তাদের নিকট থেকে ফি এবং ঔষধের মুল্য কোনটাই রাখতেন না।
মোদ্দাকথাটি ছিলো, এসময় হ্যানিমানের কোন অর্থকষ্ট ও অর্থচিন্তা ছিলো না- যার পেছনে অতীতে তাকে তাঁর বহু মূল্যবান সময়, শ্রম ও চিন্তা ব্যয় করতে হয়েছে। তিনি এবার পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে পারেন- মানবসেবায় এবং বিজ্ঞানের গবেষণায় তিনি এসময়টিতে রোগ, আরোগ্য, চিকিৎসাপদ্ধতি, মাত্রাতত্ত্ব ও ঔষধ পুনঃপ্রয়োগ ইত্যাদি ব্যাপারগুলো নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম গবেষণা করে হোমিওপ্যাথিকে আরো নিখূঁত অবস্থানে উন্নীত করেন এবং মানবজাতির রোগমুক্তির সর্বশ্রেষ্ঠ দিশারী “অর্গানন অব মেডিসিন” গ্রন্থটির সর্বশেষ সংস্করণের পান্ডুলিপি সম্পন্ন করেন। এ কাজটি করার জন্য সমাজের সর্বশ্রেণির রোগী প্রাপ্তির সুযোগও এখানে এভাবে তাঁর হয়ে গিয়েছিলো।
অবশ্য মিসেস মেলানি হ্যানিমানকে তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য চিরকালই একজন রহস্যময় নারী হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। তাঁর সমালোচকদের মতে, “মেলানী একজন উচ্চাভিলাসী, স্বার্থপর, সুযোগসন্ধানী এবং ধান্ধাবাজ বুদ্ধিজীবী মহিলা ছিলেন।”। কিন্তু অন্যদিকে, হোমিওপ্যাথি ও হ্যানিমানের প্রতি তার অনুরক্তিতেও কোন খাঁদ দেখতে পাওয়া যায় না। মেলানী কখনও হ্যানিম্যানের পাশ ছাড়তেন না। তিনি হ্যানিম্যানের রোগীলিপিগুলি (Casebooks) মুখস্থ করেছিলেন। মেটেরিয়া মেডিকা পিউরা’র (Materia Medica Pura) অনেক জটিল লক্ষণ এবং দুর্লভ নোট ছিল তাঁর নখদর্পণে- যা এতটা দক্ষতার সাথে আয়ত্ত করা হ্যানিম্যানের অন্য কোন ছাত্রের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে তিনি হোমিওপ্যাথির একজন জীবন্ত বিশ্বকোষে (Encyclopaedia) পরিণত হন। মেলানী সবচেয়ে বেশী বিতর্কিত হন দুটি কাজের মাধ্যমে; একটি হলো হ্যানিম্যানের মৃত্যুর পর কাউকে না জানিয়ে তাড়াতাড়ি অতি গোপনীয়তার সাথে হ্যানিম্যানকে দাফন করা এবং দ্বিতীয়ত হ্যানিম্যান রচিত অর্গাননের ষষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশ না করে প্রায় সত্তর বছর ব্যাপারটিকে পিছিয়ে দেয়া। মহাত্মা হ্যানিমান মারা যাবার পর- তার সর্বশেষ আবিষ্কার, তার গ্রন্থের সর্বশেষ সংস্করণ প্রকাশের মুখ দেখতে পায়নি ১৯২১ সাল পর্যন্ত- কেবল সেই পান্ডুলিপিটির জন্য মিসেস মেলানির অতিরিক্ত পরিমাণে অর্থদাবীর দরুণ।
প্যারিসে গবেষণার এই সময়টিতেই হ্যানিম্যান যদিও নিঃশ্বাস নেওয়ার মাধ্যমে রোগীদের শরীরে ঔষধ প্রয়োগের পদ্ধতি (Olfaction) চালু করেছিলেন। তাছাড়া ঔষধের পঞ্চাশ সহস্রতমিক শক্তিকরণ পদ্ধতিও (LM potency) তাঁর এই শেষ জীবনের আবিষ্কার যা অর্গাননের ষষ্ঠ সংস্করণে তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তার মৃত্যুর আগেই ১৮৪২ সালে প্যারিসে তিনি অর্গাননের পঞ্চম সংষ্করণের সর্বশেষ পুনঃলিখন সমপন্ন করেন কিন্তু যদিও তা প্রকাশকের নিকট পাঠানোর আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। একারণে, প্যারিসে অবস্থানকালীন সময়ে, হ্যানিম্যানের জীবনের শেষ আটটি বছর ঔষধের মাত্রা, শক্তি ও ঔষধের প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়ে যে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নতুন পদ্ধতিগুলো প্রদান করেছেন এবং এই সময়ে তিনি ঔষধের যে তরল মাত্রা ও পঞ্চাশ সহস্রতমিক শক্তিকরণ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, তা হোমিও চিকিৎসকদের অবগতিতে আসতে দীর্ঘদিন অপচয় হয়ে গেছে।
শেষ বয়সে হ্যানিম্যানের শরীর পাতলা (চিকন) এবং বেটে-খাটো হয়ে গিয়েছিলেন। হাঁটু সামান্য বেঁকে গিয়েছিল এবং তাঁর শরীরের মধ্যাংশও কিছুটা সামনের দিকে বেঁকে গিয়েছিল- যার ফলে পুরোপুরি সোজা হয়ে দাঁড়াতে তাঁর অসুবিধা হতো। ১৮৪৩ সালের ২ রা জুলাই প্যারিসে হ্যানিম্যান ব্রঙ্কাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানে মন্টমার্ট্রিতে (Montmartre) তাকে সমাহিত করা হয়। পরে আমেরিকান হোমিও ডাক্তাররা তাঁর সম্মানে বহু অর্থ ব্যয় করে সেখান থেকে সরিয়ে – একটি অভিজাত সিমেট্রি ‘Cimitiêre Pere Lachaise’ পুনরায় দাফন করেন, যেখানে Jean-Pierre Aumont, Balzac, Beaumarchais, Sarah Bernhardt, Bizet, Chopin, Molier, Yves Montand, Edith Piaf, Proust, Simone Signoret, Gertrude Stein, Oscar Wilde, Ben Franklin’s grandson Temple সহ আরো অনেক বিখ্যাত লোকদের কবর। যেখানে তাঁর কবরে সম্মাননাস্বরূপ লিখিত হয়-
“Standing between the Inorganic and the Organic world; Uniting them for the benefit of the sick;
Earning their Gratitude!
Looking towards eternity Samuel Hahnemann,
Benefactor of Mankind.”

তাঁর মৃত্যুতে পৃথিবী এই মানবজাতির একজন সত্যিকারের বিজ্ঞানী, গবেষক, চিন্তাবিদ, আবিষ্কারক, চিকিৎসক ও মানবতাবাদীকে হারালো। তিনি নিজেই একটি গভীর ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের তিনি ছিলেন পথ প্রদর্শক। বস্তুত তাঁর চিন্তা তার সময়কে ছাড়িয়ে আরো বহু এগিয়ে ছিলো। ডা. জে. এন. কাঞ্জিলাল যথার্থই বলেছিলেন,
“The only fault with him (Dr. Hahnemann) was that, he took his birth a few centuries before his due time.”
তাঁর মতো একটি বিরল প্রতিভা- চিরটি জীবন তিনি মানবজাতির কল্যাণ ও সত্যের পক্ষ হয়ে লড়েছেন। কখনোই আপোষ করেননি। একটির পর একটি স্থান পরিবর্তন করেছেন; মেনে নিয়েছেন দারিদ্রতা, সামাজিক বঞ্চনা। তাঁর প্রতি এই অবহেলা ও উপেক্ষা প্রসঙ্গে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনকের আরেকটি কথা এখানে উল্লেখ না করলেই চলছে না,
“It is distressing that so many good men live isolated in a measure from the great body of the profession. The grievous mistake was ours: to quarrel with our brothers over infinitesimals was a most unwise and stupid thing to do.” and “Our homeopathic brothers pursue very seriously the scientific study of disease.”
(William Osler _Counsels and ideals from the writings of William Osler 1905)
“এটি পীড়াদায়ক যে, আমাদের পেশার বৃহত্তর অংশের কাজের দরুন বহু মহৎ আত্মা নির্বাসিত জীবনযাপন করে গেছেন। আমাদের মর্মান্তিক ভুলগুলোর মধ্যে: ক্ষুদ্র মাত্রার ঔষধ নিয়ে আমাদের ভাইদের সাথে দ্বন্দ ছিলো একটি সবচেয়ে মূর্খ ও নির্বোধের মতো কাজ।” এবং “আমাদের হোমিওপ্যাথিক ভ্রাতাগণ রোগ নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা অত্যন্ত দায়িত্বশীলরূপে অনুসরণ করেন।”
তথাপি তাঁর প্রতি এই অবহেলা, উপেক্ষা তার সত্যের অগ্রগতিকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি এগুলোকে তার সুখ ও আনন্দের প্রতিবন্ধকও মনে করতেন না। জীবনের ছোটখাটো আনন্দ ও সুখকে তিনি বরণ করে নিতে জানতেন। তিনি পেশাগত এই ঈর্ষাকে যেভাবে মূল্যায়ন করতেন,
“আমি আমার প্রিয়জনদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে বেঁচে আছি- দেবীর মতো একজন স্ত্রী, সাতটি মেয়ে যারা বড় প্রায় বড় হয়ে গেছে এবং আনন্দমূখর, শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী, নিষ্কলুষ; এমনকি সঙ্গীতও আমাকে আনন্দিত করে…………. আমি কি প্রায় ঈর্ষান্বিত হবার যোগ্য নই?”

তাঁর মৃত্যুর পর ইউরোপ, রাশিয়া, ইন্ডিয়া এবং আমেরিকাতে অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়েছিল। কিছুটা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতির বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচারের কৌতূহলী হয়ে পরীক্ষা করতে আসা মানুষের জন্য এবং বাকীটা হোমিও চিকিৎসার যাদুকরী রোগ নিরাময় ক্ষমতার কারণে। এবং বিশ্বজুড়ে তার শিক্ষার ও আদর্শের বিস্তার ঘটে। ব্রিটেনের কিংবদন্তী চিকিৎসক Sir John Weir (MD) [যাকে এলোপ্যাথিক পড়াশুনা শেষ করে- তারপর হোমিওপ্যাথি পড়তে হয়েছিলো] ডা. হ্যানিম্যানের স্মরণে বলেন,
“It is said that when great people die,
They leave their senses, knowledge & wisdom for their future generations; Spirit of Dr. Hahnemann is always for us like a glowing musk, as He was not on time, but before time & that still obtains!”
তিনি ব্যর্থ হননি। ব্যর্থ হয়েছে মানবজাতি তাঁকে মূল্যায়ন করতে। আর তার ভোগান্তিও আসছে- পৃথিবীজুড়ে ক্রমে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ক্রনিক রোগ ও স্বাস্থ্যগত দুর্দশায় আক্রান্ত হয়ে, বিপর্যস্ত হয়ে বিদ্ধস্থ হয়ে। মহাসম্মানিত, প্রতিভাশীল মহাত্মা ডা. হ্যানিমান পৃথিবীতে তাঁর উদ্দিষ্ট্য কাজটি করে গেছেন। সত্যসাধনায় নিরলস বিজ্ঞানী আজীবন নিমগ্ন থেকেছেন তার সফল সাধনায়। আর এজন্যই তিনি তার কবরফলকের লেখা নিজেই নির্বাচন করে দিয়ে যেতে পেরেছিলেন-
‘Non inutilis vixi’
(I have not lived in vain)
জীবনকে আমি বৃথা কাটাইনি

Homeopathy Looks at the Horrors of Allopathy
[এলোপ্যাথির বিভীষিকার দিকে হোমিওপ্যাথির দৃষ্টি]
‘Homeopathy Looks at the Horrors of Allopathy’ নামের এই ছবিটি ১৮৫৭ সালে রাশিয়ান চিত্রকর Alexander Beideman-এর অঙ্কন করা- একটি রূপক চিত্রাঙ্কন। বর্তমানে এটি রাশিয়ার Tretyakov Gallery-তে সংরক্ষিত আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এটি ‘Triumph of Homeopathy’ বা ‘হোমিওপ্যাথির বিজয়’ নামেও পরিচিত হয়।
ছবিটিতে দুইটি ভাবের সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে। ডানদিকে ‘চরম ইতিবাচকতা’ ও বামদিকে ‘চরম নেতিবাচকতা’। ছবির ডানপাশের অংশে- হোমিওপ্যাথির রূপক প্রতিকৃতি মেঘের উপর উড্ডায়মান। তার সম্মুখে চিকিৎসাবিদ্যার দেবতা বলে গ্রীক মিথোলজিতে যাকে মনে করা হয় সেই Aesculapius লাল কাপড় পরিহিত অবস্থায় বাম হাত উপরে উঠিয়ে রাগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। তাঁর পাশে গ্রীক দেবী Athena, যিনি বিজ্ঞানের রক্ষাকরী দেবী হিসাবে সম্মানিত হন। চিত্রের একেবারে ডান প্রান্তে হোমিওপ্যাথির প্রতিষ্ঠাতা ডা. হ্যানিমান দাঁড়িয়ে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন। প্রত্যেকটি সত্তা অসন্তোষ ও ক্ষোভ নিয়ে তাকিয়ে আছেন- ছবির বামপাশের ‘চরম নেতিবাচক’ অংশ- এলোপ্যাথিক চিকিৎসকদের (প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থা) কৃত চিকিৎসার ফলে সৃষ্ট একজন রোগীর দুর্দশার দিকে। একজন চিকিৎসক রোগীর পা কেটে ফেলছেন এবং রোগীর স্ত্রী ও সন্তানরা ছবির একেবারে বামপাশে জড়োসড়ো হয়ে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে- কিন্তু মৃত্যুর রূপক প্রতিকৃতিটি দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।
ডা. হ্যানিমানের কাজ, অনুবাদ ও অবদান:
1777 – Translations of Nugent’s Experiment on Hydrophobia from English [১৫০ পৃষ্ঠা]
– Translations of Stedmann’s Physiological Experiments and Observations with Copper from English [১৩৪ পৃষ্ঠা]
– Translations of Falconeri Experiment with Mineral Water and Warm Bath, from English [৮০০ পৃষ্ঠা]
– Translations of Ball’s Newer Art of Healing, from English
1784 – Translations of Demacly’s Laboratory Chemist on the preparation of chemicals for manufacture as for Art, from French [১০০০ পৃষ্ঠা]
প্রবন্ধসমূহ:
1779 – Desertatio inaugur medic : Conrpectus adifectum sparmodicorum aetiologicus et thrapeuticus.
1782 – The first small medical essays appear in Dr. Fr. Chr. Krebs, Quedlinburg “Medical Observation”
1784 – Directions for curing old sores and ulcers.
অনুবাদসমূহ:
1785 – Translation of Demachy’s “Art of Distilling Liquor” from French [৬১৬ পৃষ্ঠা]
1787 – Translation of Demachy’s “Art of the Manufacture of Vinegar from French [১৭৬ পৃষ্ঠা]
– “Signs of Purify and Adulteraion of Drugs” by B.Vanden. Sanden, a chemist in Brussels [৩৫০ পৃষ্ঠা]
কেমিস্ট্রির উপর করা কাজসমূহ:
1787 – Prejudice against heating with coal and ways improving this fuel etc.
– Preservation of mineral alkaline salt by means of potash and kitchen salt.
1788 – The influence of certain gasses in the formentation of wine.
– Wine test in Iron & Lead.
– Concerning bile & gall stone
– A remedy of checking putrefaction
1789 – Unsuccessful experiment with some new discoveries.
– Concerning Sulphate of Baryta.
– Discovery of a new constituent in Plumbago.
– Observation on the Astringent Properties of plant.
চিকিৎসাবিদ্যার উপর করা কাজসমূহ:
1786 – On poisoning by Arsenic : Its Treatment and Forensic detection [২৭৬ পৃষ্ঠা]
1789 – Instruction for Surgeons on Veneral Diseases[২৭২ পৃষ্ঠা]
চিকিৎসা, কেমিস্ট্রি ও এগ্রিকালচারের উপর করা অনুবাদকর্মসমূহ:
1790 – Ryan.Enquiries in to the Nature and Cure of Phthisis from English [১৬৪ পৃষ্ঠা]
– Fabroni , The Art of Making Wine in Accordance with Sennible Principles from Italian [২৭৮ পৃষ্ঠা]
– Arth Young Anals of Agriculture, from English[৬০৩ পৃষ্ঠা]
– CULLEN, A TREATISE ON MATERIA MADICA, from English to German [১১৪০পৃষ্ঠা]
1791 – Monoro’s Materia Medica, from English [৯৫২পৃষ্ঠা]
– Grigg’s precautionary measures for the Female sex, from English [২৮৫পৃষ্ঠা]
– Dela metheria on pure air and different kinds of air from French [১০৪৮পৃষ্ঠা]
– Rigby’s Chemical observation on sugar, from English [৮২পৃষ্ঠা]
কেমিস্ট্রির উপর করা গবেষণাসমূহ:
1790 – Minor Essays on various subjects
– Directions for the preparation of Mercury Solubilies.
1791 – Insolubility of some metals and their oxides in caustic ammonia.
1792 – Contribution to the wine test
– Preparation of Glauber’s Salts, according to the method of Ballen.
চিকিৎসাসংক্রান্ত কাজসমূহ:
1790 – A method of check salivation and the destructive method of mercury [১০৯১পৃষ্ঠা]
1792 – The friend of Health [১০০পৃষ্ঠা]
কেমিস্ট্রির উপর করা কাজসমূহ:
1793 – Wine test continued.
– Preparation of Cassel Yellow
1794 – Hahnemann’s new wine test and new liquor.
1797 – Pulvarisation of Ignatia Beans.
চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত কাজসমূহ:
1795 –
On Crusta Lactea
– The Friend Of Health
1796 – Essay on a New Principle for ascertaining the curative power of drugs
& Experiments
1797 – A case of rapidly cured Colico dynia
– Antidotes to heroic vegetable
substances.
– Some kind of continued and
remittent fevers
– Some periodical & Hebdomadal
diseases.
1801 – Fragmentary observation on Brow’s Elements of Medicine.
– On the power of small dose of
medicine
– Obsevation on three current method
of treatment.
1803 – On the effect of Coffee.
চিকিৎসাবিদ্যাসংক্রান্ত অনুবাদকর্ম:
1796 –
Hand Book for Mothers
1797 – Translation of Taplin’s Enquiry [৬৯১পৃষ্ঠা]
1798 – Translation of New Edinburgh Dispensatory [১২১১পৃষ্ঠা]
1800 – Translation of Treasures Medica Minimum [৪১২পৃষ্ঠা]
– Translation of Homes Practical
Observations on cure of Strictures of Urethra by Caustics.
চিকিৎসাবিদ্যা ও হোমিওপ্যাথি সংক্রান্ত প্রবন্ধ ও রচনাসমূহ:
1805- Aesculapius in the Balance
– Medicine of Experience
– Fragmenta de Viribus medica mentorum Positivis sive in sano Corpore Humano obrervatis (Fragmentary Observations relative to the Positive Powers of Medicines on the healthy Human Body)
1806 –
On Substitute for Cinchona
– What are Poisons? What are
Medicines?
– Objection to the proposed
substitute for Chinchona.
– Scarlet fever & Milliary
purple fever.
– Medicine of Experience
– Albrecht V. Haller’s Materia
Medica
1807 – Homoeopathic Employment of Medicine in Ordinary Practice
1808 – On the present want of medicines.
– On substitute for foreign drugs.
– On the value of Speculative System
of Medicine
1809 – Signs of times in ordinary system of medicine.
1810 – Organon of Rational Medicine
– 2nd Edition – 1819 – Organon of
the Art of Healing.
– 3rd Edition – 1824
– 4th Edition – 1829
– 5th Edition – 1833
– 6th Edition – 1921
1811 – Materia Medica Pura Part-I (Reine Arzneimittellehre)
লিপজিকে ডা. হ্যানিমানের কাজ:
1811 – 1821 – Materia Medica Pura
Part-
I – 1811 (3 Editions)
Part- II – 1816 (3 Editions)
Part- III- 1816 (3 Editions
Part- IV– 1818 (3 Editions)
Part- V – 1819 (3 Editions)
Part-VI – 1821 (3 Editions)
1812 –
Dissertations on Helleborismus Veratrum
1813 – Spirit of New Medical Doctrine [৬২৬পৃষ্ঠা]
1814 – Method of Treatment for New Prevailing Nerve & Hospital Fever.
1816 – On Veneral Disease and Its ordinary improper treatment.
– On treatment of Burns
1819 – On uncharitableness towards suicides.
1820 – On the Preparation of Medicines by Homoeopathic Physicians themselves.
1821 – Medical Advice in Purpura Milliaries.
1828 –The Chronic Diseases,
Their Peculiar Nature and Their Homoeopathic Cure (Diechronischen
Krankheiten ,1st Edition)
1838-1839- The Chronic Diseases, Their Peculiar Nature and Their Homoeopathic Cure (2nd edition, five volumes, consisting of 48 drugs)
Discussion about this post