হোমিওপ্যাথি একটি ব্যবহারিক চিকিৎসা বিধান। নিরসল জ্ঞানার্জন ও হাতে কলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই প্যাথিতে দক্ষতা অর্জন করতে হয়। তার জন্য প্রয়োজন সকল শিক্ষার্থী এবং চিকিৎসকদের শ্রমসাধ্য অধ্যয়ন ও হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ। বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথি আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য রয়েছে বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃত দুটি কোর্স- বিএইচএমএস ও ডিএইচএমএস কোর্স। এই দুটি কোর্সের কোন একটি পাশ করে এবং ইন্টার্ণশীপ সমাপ্ত করার পর আপনি একজন সরকার স্বীকৃত ডাক্তার বা চিকিৎসক। তার পর চিকিৎসক রেজিস্ট্রেশন গ্রহণ করার পর আপনি বাংলাদেশের যে কোন স্থানে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত হতে পারেন।
পাশ করা অধিকাংশ চিকিৎসকের মধ্যে একটি ভুল ধারনা আছে যে পাশ করে রেজিস্টেশন করতে পারলেই আমার আর লেখাপড়া করার বা জ্ঞান বৃদ্ধি করার দরকার নেই। এখন চেম্বারে বসব আর রোগী দেখব, রোগী যখন না থাকে তখন পত্রিকা পড়ে পড়ে সময় কাটাব এবং শান্ত নিরুত্তাপ জীবন অতিবাহিত করব। এদেরকে যদি হোমিওপ্যাথির কোন সভা, সেমিনারে অংশ গ্রহণের অনুরোধ করেন তখন মুখ বিকৃত করে এবং অবজ্ঞার দৃষ্টিতে উত্তর দেন যে- তার চেম্বারে রোগী দেখতে হবে, যাওয়ার সময় হবে না। কেউ কেউ আবার বলে দেয়- যান ভাই, আপনি সেমিনার থেকে এসে আমাকে বলবেন কে কি বলেছে, আমি আপনার কাছ থেকে সব শুনে নেব। আবার কেউ কেউ নিজে তো যাবেনই না আবার অন্যকে যেতেও নিরুৎসাহিত করে থাকেন।
উক্ত চরিত্রের ডাক্তারের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর যদি জিজ্ঞাসা করেন- ভাই, আমি হোমিওপ্যাথি পড়তে চাই, আমাকে কিছু উপদেশ দেন, সপ্তাহে কয়দিন ক্লাশ হয়, ক্লাশে কি প্রতিদিন যেতে হয়, পরীক্ষা কিভাবে হয়, পাশ কিভাবে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। উনি হয়তো বলবেন ক্লাশ হয়, আমার সময় হয় না, তাই আমি যাই নাই, পরীক্ষার পূর্বে ফরম ফিলাপ করেছি আর পরীক্ষার আগের রাত্রে গাইড বই এক নজর দেখেছি এবং ভাল পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর দেখলাম আমি ভালভাবেই পাশ করতে পেরেছি এবং এখন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক হিসাবে ডাক্তারখানা খুলেছি। মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টিভ আসে তারা কিছু হারবাল, পেটেন্ট ওষুধ, বায়োপ্লাজন, পটেন্টাইজড ওষুধের কথা বলে যায়, আমার অত পড়া লাগেনা, একটি অব্যর্থ ওষুধের বই আছে, ওটা দেখে ওষুধ নির্বাচন করি। রোগীকে একটা বা কয়েকটা মাদার টিংচার দেই, কয়েকটা বায়োকেমিক ওষুধ দেই, কয়েকটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধ দেই, যেটায় কাজ করে, এভাবেই চালিয়ে যাচ্ছি আর কি। বেশি কাপ, বেশী লাভ-বেশি ওষুধ বেশি লাভ।
কেউ কেউ আবার কোন ডিগ্রি নেয়ার ধার ধারেন না, হোমিওপ্যাথির বইপুস্তক পড়ার প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করেন না, বেকার জীবনের সাথী হিসাবে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করাকে বেছে নিয়েছেন, কেউ কেউ অফিস করার পর অবসর সময় কাটানোর জন্য একটি এন সি ঘোষ কিনে মহাপন্ডিত হোমিওপ্যাথ সেজে বসে গেছেন। জিজ্ঞাসা করলেন- ডাক্তার সাহেব কেমন চলে? উত্তর হবে- বাজার খরচ উঠে। এদেরকে চিনে রাখুন, প্রতিহত করুন -এরা বাজার খরচ উঠানোর জন্য হোমিওপ্যাথির নামাবলী গায়ে চড়িয়েছে। এরা হ্যানিম্যানের হোমিওপ্যাথিকে ভালবেসে নয়, হোমিওপ্যাথির নাম ভাঙ্গিয়ে হোমিওপ্যাথির সর্বনাশ করার জন্য মাঠে নেমেছে। এই কপট হোমিওপ্যাথদের জন্য হ্যানিম্যান অভিশাপ দিয়ে গিয়েছেন, আমরাও হ্যানিম্যানের কথার সাথে সায় দিব, নিজকে সংশোধন করে নেব, যাতে আমিও যেন এই অভিশাপের কবলে না পড়ি।
যারা হ্যানিম্যানের হোমিওপ্যাথিকে বিকৃত করে কপট হোমিওপ্যাথ হয়েছেন তাদের জন্য হ্যানিম্যানের অভিশাপ বিষয়টি নিম্নে তুলে ধরছি। তথ্যটি নেয়া হয়েছে ডাঃ ত্রিগুণনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অনুদিত অর্গানন অব মেডিসিন গ্রন্থের ২৬৫ নং পৃষ্ঠা হতে। তথ্যটি সহজে অনুধাবনের জন্য ব্রাকেটের ভেতরে আমার সংযুক্ত করা কথা বলা হয়েছে, ব্রাকেটের বাইরের কথা ডা. ত্রিগুণানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুবহু অনুবাদ।
অর্গানন অব মেডিসিন, অনুচ্ছেদ ১৪৮, পাদটীকা ১০৮
“কিন্তু প্রত্যেকটি ক্ষেত্রের জন্য (প্রতিটি ব্যক্তিগত রোগীর চিকিৎসা ক্ষেত্রে) সর্ব বিষয়ে এবং সর্বাপেক্ষা সদৃশ হোমিওপ্যাথিক ঔষধের অনুসন্ধান ও নির্বাচন শ্রমসাধ্য কার্য এবং তাহা কখনও কখনও অত্যন্ত শ্রমসাধ্য; ইহা এমন একটি প্রয়াস যাহার জন্য উৎকৃষ্ট পুস্তকসমূহের সাহায্য সত্ত্বেও মূল গ্রন্থসমূহও পড়িবার প্রয়োজন হয় ও সেই বিষয়ে গভীর আলোচনা ও চিন্তাশীলতার প্রয়োজন যাহার পুরস্কার সরূপ, বিশ্বস্ততার সহিত কার্য সম্পন্ন করিয়াছি, এই বোধ জন্মে (জ্ঞানী চিকিৎসক সুচিকিৎসা দেয়ার পর নিজে একটি স্বর্গীয় আনন্দ অনুভব করেন)। এই শ্রম ও যত্নসাধ্য কার্য, যাহা ব্যাধি নিরাময় করিবার পক্ষে একমাত্র প্রশস্ততম উপায় তাহা কেমন করিয়া সেই সকল নূতন সঙ্করজাতীয় ভদ্রলোককে (Mongrel -কপট বা ভন্ড বা চিটার বা বাটপাড়, হ্যানিম্যান এদেরকে চিকিৎসক বলেন নাই) সন্তুষ্ট করিবে যাহারা হোমিওপ্যাথিস্ট নামে গৌরববোধ করে, এমন কি যাহাদিগকে আকারে প্রকারে হোমিওপ্যাথিক বলিয়া প্রচারিত ঔষধ প্রয়োগ করিতে দেখা যায় এবং যাহারা তাহাদের প্রযুক্ত অনুপযোগী ঔষধ তখনই ফল প্রদান না করিলে তাহাদের অমার্জনীয় অজ্ঞতা ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মানবকল্যাণসাধনে শিথিলতার দোষ না দেখিয়া হোমিওপ্যাথি ত্রুটিযুক্ত বলিয়া দোষারোপ করিয়া থাকে (নিজের ব্যর্থতাকে ঢাকার জন্য হোমিওপ্যাথির ব্যর্থতা বলে চালাতে চায়)। সত্য কথা বলিতে গেলে, ইহাকে (হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিধান) ত্রুটিপূর্ণ বলে এই জন্য যে, প্রত্যেকটি পীড়ার ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা উপযোগী হোমিওপ্যাথিক ঔষধ পায়রার কাবাবের মতো বিনা আয়াসে আপনা আপনি তাহাদের মুখগহ্বরে উড়িয়া আসিয়া পড়ে না (বিনা পরিশ্রমে কোন কিছু অর্জন হয় না, কেবল বেহেশত লাভ করলেই এরূপ সম্ভব, বেহেশতে যে যা চাইবে তাই তৎক্ষনাৎ তাঁর সামনে হাজির হবে, দুনিয়াটা বেহেশত নয়, এখানে সব কিছুই কঠোর পরিশ্রম করে অর্জন করতে হয়)।
তাহাদের আধা-হোমিওপ্যাথিক ঔষধের অকৃতকার্যতা ঢাকিবার জন্য যাহা তাহারা প্রায়ই যা করিয়া থাকে তাহা হইল অ্যালোপ্যাথিক পদ্ধতির যেমন, আক্রান্ত স্থানে এক বা একাধির ডজন জোঁক লাগান বা ক্ষতিকর প্রায় আট আউন্স পরিমাণ রক্তমোক্ষণ ইত্যাদি যেগুলি তাহাদের নিকট সুবিধাজনক ও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার (নিজের অজ্ঞতাকে ঢাকার জন্য অন্য পদ্ধতির ক্ষতিকারক কিন্তু আপা্ত উপশমদায়ক পদ্ধতি অবলম্বন)। ইহা সত্ত্বেও রোগী যদি বাঁচিয়া যায় তখন তাহারা রক্তমোক্ষম, জোঁকলাগান প্রভৃতির প্রশংসা করিয়া বলেন যে, এই সব ব্যবস্থা করা না হইলে রোগী বাঁচিত না (অর্থাৎ এরূপ বলে কৃতিত্ব নেয়া যে আমি এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলাম বলেই রোগীটির প্রাণ রক্ষা হয়েছে)। স্পষ্টভাবে তাঁহারা আমাদিগকে এই কথা বুঝাইতে চেষ্টা করেন যে এই সকল ব্যবস্থা-যেগুলি বিচারবুদ্ধিহীন প্রাচীন চিকিৎসার অনিষ্টকর বাঁধাধরা প্রণালী হইতে উদ্ভুত-আরোগ্যকল্পে বহুল পরিমানে সাহায্য করিয়াছে। কিন্তু রোগী যদি ঐ চিকিৎসায় মারা যায়-যাহা অনেক ক্ষেত্রেই ঘটে-তখন তাঁহারা রোগীর স্বজনবন্ধুবর্গকে এই বলিয়া প্রবোধ দিতে চেষ্টা করেন যে, তাঁহার সচক্ষেই তো দেখিলেন যাহা কিছু করিবার ছিল সবই হতভাগ্য মৃত রোগীর জন্য করা হইয়াছে। এমন কে আছে যে অত্যন্ত শ্রমসাধ্য কিন্তু হিতকারী আরোগ্য কলার কথা স্মরণ করিয়া সেই সকল চপল প্রকৃতির, অনিষ্টকারী ব্যক্তিকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক বলিয়া সম্মান দান করিবে?”
হ্যানিম্যান এই সকল সঙ্কর প্রকৃতির অসাধু ব্যক্তিদের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক বলতে নারাজ, কারণ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক হচ্ছেন একজন সম্মানীত ব্যক্তি। যেমন- যদি কোন ব্যক্তির নাম যদি হয় জাস্টিস আর কে চৌধুরী, মেজর জেনারেল আসিফ আহনাফ, বিগ্রেডিয়ার সোবহান, ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন, তাহলে আমরা তাঁর নামের পূর্বের উপাধি থেকেই ব্যক্তিটিকে সম্মানীত ব্যক্তি মনে করি। অনুরূপ ভাবে যদি কোন ব্যাক্তির নাম হয় হোমিওপ্যাথিস্ট আলী রেজা, হোমিওপ্যাথিস্ট খুরশিদ আলম, হোমিওপ্যাথিস্ট রায়হান আমিন, তখন বুঝে নেই তিনি একটি মহান চিকিৎসা পদ্ধতি হোমিওপ্যাথির ধারক ও বাহক, তিনি সম্মানিত ব্যক্তি।
সে জন্যই হ্যানিম্যান সঙ্কর প্রকৃতির আধাহোমিওপ্যাথদের চিকিৎসক হিসাবে তথা হোমিওপ্যাথিস্ট হিসাবে স্বীকার করেননি, তিনি তাদেরকে আমাদের দেশের প্রচলিত ভাষায় হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার শব্দের গৌরবময় মর্যাদা দিতে নিষেধ করেছেন। হ্যানিম্যান বুঝাতে চেয়েছেন যে, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক হওয়া অনেক গৌরবের, অনেক মর্যাদার। এই উপাধি অর্জন করতে হলে তাঁকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়, তাঁকে চিকিৎসাবিদ্যার উৎকৃষ্ট পুস্তকসমূহকে পাঠ করতে হয়, চিকিৎসা বিদ্যা সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতে হয়। যারা এই মহান হোমিওপ্যাথি আয়ত্তের কঠোর পরিশ্রম না করেই হোমিওপ্যাথ নামে পরিচিত হতে চান, কাক হয়ে ময়ুরপুচ্ছ ধারণ করে নকল ময়ুর সাজার চেষ্টা করেন, হ্যানিম্যান তাদেরকে ধিক্কার দিয়েছেন, তাদেরকে অভিশাপ দিয়েছেন),
“তাঁহারা যেন ঠিক এই পুরস্কার প্রাপ্ত হন যে পীড়িত হইলে তাঁহারাও যেন সেই একইভাবে চিকিৎসিত হন।”
এই অপচিকিৎসকগণ যখন রোগাক্রান্ত হন তখন যেন তাঁহারাও অপচিকিৎসার দ্বারা অনিষ্টপ্রাপ্ত হন, তাঁহার ভাগ্যেও যেন সুচিকিৎসা না জোটে। কারও মনে কষ্ট দেয়ার জন্য এটি লেখা হয়নি, শুধু মহাত্মা হ্যানিম্যানের বানীকে আপনাদের আবারও স্মরণ করিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যেই এই লেখাটির অবতারণা। মনের মাঝে আকাঙ্ক্ষা- হ্যানিম্যানের অভিশাপ স্মরণ করে যেন আধা-হোমিওপ্যাথগণ প্রকৃত হোমিওপ্যাথের সম্মান অর্জন করতে সচেষ্ট হন, হোমিওপ্যাথির নামে যেন অপহোমিওপ্যাথি থেকে বিরত থাকেন।
Discussion about this post