ডা. এ. বি. এম. শহীদুল্লাহ:
সেই কবে হোমিওপ্যাথির জন্ম। তবু এখনো তা সর্বজনের আস্থা অর্জন করে উঠতে পারেনি! এখানে ব্যর্থতা কিসের? যদি এর উত্তর দিতে হয়, তাহলে আমি অকপটে বলবো- এর দায় আমাদেরই বিপথগামীতার। কেমন বিপথগামীতা? উত্তর সহজ, অথচ মানা কঠিন। এখন সহজ কোন বিষয়টিকে মানার প্রশ্ন? আমি বলবো- সহজ বিষয়টি হলো অর্গাননকে মানা। তাহলে কঠিন বিষয়টি কি? অর্গাননকে না মানাই হলো কঠিন বিষয়। অথচ এটাকেই আমরা বহুসংখ্যক ডাক্তারগণ না মেনে হোমিওপ্যাথিতে অপচিকিৎসার বদনাম এনে দিয়েছি। জনগণকে হোমিওপ্যাথির অমৃত স্বাদ পাওয়া থেকে বঞ্চিত করছি। এখনো আমরা যারা বিপথগামী তারা যদি নিজেদের খামখেয়ালি মনোভাব পরিহার না করে, অর্গাননের আলোকে উদ্ভাসিত হতে না পারি- তবে সাধারণের কাছে হোমিওপ্যাথি অবহেলিত হয়েই থাকবে। হোমিওপ্যাথির প্রতি মানুষের নাক সিটকান ভাব দূর করা যাবেনা। অথচ হোমিওপ্যাথি সর্বক্ষেত্রেই মিরাকল আরোগ্য এনে দেয়। এই বাস্তব সত্যটা আমাদের সবার সামনে তুলে ধরতে ডাঃ হ্যানিম্যানকে অনুসরণ করা ছাড়া আর কোন পন্থা নেই। তাকে পদে পদে অনুসরণ করলে কি ফলাফল পাওয়া যায়, প্রতিনিয়তই তার সাক্ষী হয়ে থাকছেন সকল ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাগণ।
হোমিওপ্যাথির যাদুকরি চিকিৎসা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করলেও সম্প্রতি একটি ঘটনার উল্লেখ না করে করে পারছি না। আমার এক রোগিণীর Missed abortion হয়। Abortion-এ ভ্রূণ মরে গিয়ে জরায়ুতেই আটকে থাকে। কিন্তু অ্যালোপ্যাথদের সর্বচ্চ চেষ্টাতেও সে ভ্রূণকে জরায়ু থেকে বের করা সম্ভব হয় না। ফলে তার জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে যায়।
সাধারণত এসবক্ষেত্রে অ্যালোপ্যাথরা প্রথমে ইনজেকশকন দিয়ে কৃত্রিম ব্যথা উপশমের মাধ্যমে চেষ্টা করে যাতে জরায়ু থেকে ওভাম বের করা যায়। তাতে কাজ না হলে অপারেশন করেন এবং এই ধরনের অপারেশনে ৮০% মৃত্যু ঝুঁকি থাকে। আমার ওই রোগিণীর ক্ষেত্রে ঘটনাটি সেদিকেই প্রবাহিত হচ্ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হোমিওপ্যাথির যাদুকরি চিকিৎসায় তিনি জীবন ফিরে পেতে সক্ষম হন।
ঘটনাটি শুরু থেকে কিছুটা আলোকপাতি করছি। আমার সেই রোগিণীর দুই মাসের গর্ভাবস্থায় রক্তস্রাব দেখা দিলে তারা প্রথমে অ্যালোপ্যাথির শরনাপন্ন হন। তার ভ্রূণটিকে রক্ষার জন্য হরমোন ইনজেকশনসহ নানা চেষ্টা অব্যহত রাখেন। এভাবে মাস অতিক্রম হয়। কিন্তু চার মাসের সময় ঘটে বিপত্তি, Missed abortion হয়ে ভ্রূণটি মরে গিয়ে জরায়ুতেই আটকে থাকে। এমতাবস্থায় তাকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হওয়ায় তার সাথে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল।
তাকে বেডে স্থানান্তরের পর শুরু হলো তাদের প্রচেষ্টা। প্রথমেই তারা ডিপ দেয়ার (এক জাতীয় স্যালাইনের সঙ্গে ইনজেকশন মিশিয়ে কৃত্রিম ব্যাথা তুলার জন্য চেষ্টা করা) মাধ্যমে কৃত্রিম ব্যথা তোলার চেষ্টা করে যেতে লাগলেন। তিন দিন গড়িয়ে গেলেও কোনো ফল না আসায় তারা শেষপর্যন্ত অপারেশনের প্রস্তুতি নিতে বললেন। তারা সাফ জানিয়ে দিলেন আর ৬/৭ ঘন্টা দেখবেন, নাহলে অপারেশন।
ইতোমধ্যে আমি কর্তব্যরত ডাক্তারের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করে কিছু লক্ষণ সংগ্রহ করে রাখি। এই ভেবে যে, যদি ঔষধ দেয়ার প্রয়োজন হয়। আমি উনার কাছ থেকে তাৎক্ষণিক লক্ষণ হিসেবে প্রধান যে লক্ষণটি পাই, তা হচ্ছে- জরায়ুর মুখ খুব শক্ত হয়ে আটকে আছে। এতোটুকুই জানতে পারি এবং উনাকে আমি আরেকটি কথা জিজ্ঞেস করে জেনে নেই যে- ওই জায়গায় কোনো স্প্যাজম হচ্ছে কিনা। ডাক্তার বললেন, না ওইখানেই কোনো স্প্যাজম হচ্ছেনা, কেবল জরায়ুর মুখ খুব শক্ত হয়ে আছে। কোনো ব্যথাও নেই।
রাত তখন আনুমানিক নয়টা বাজে অর্থাৎ ভোরের দিকেই অপারেশ হবে। হাসপাতালে অগত্যা বসে না থেকে আমি এক আত্মীয়ের বাসায় চলে আসি। মিরাকল যা হবার তা হয়ে গেল আমার অনুপস্থিতেই। আমি পরদিন সকাল ৮টায় এসে দেখি চার মাসের বাচ্চা মেঝেতে পড়ে আছে। এই অসাধ্য কিভাবে সাধন হলো তা জিজ্ঞাস করলে ওই রোগিণী জানান- তাকে আমি যে ঔষধ দিয়ে এসেছিলাম তা রাত ৩/৪ টার দিকে চার ফোঁটা খেয়েছিলেন। ওষুধ খাওয়র ১৫/২০ মিনিটের মধ্যেই তার ভীষণ ব্যাথা দেখা দিয়ে মৃত বাচ্চাটি খালাস হয়ে যায়।
সকালে আমি আসার আগেই হাসপাতালের ডাক্তারগণ এ দৃশ্য দেখে বলেন, “you are a lucky. বেঁচে গেলেন আপনি”। তবে এ মিরাকলের কারণটা কিন্তু তারা তখনও জানতেন না। সেই প্রথম সাক্ষাতের মহিলা ডাক্তার, যার কাছ থেকে আমি লক্ষণ সংগ্রহ করে রেখেছিলাম। তিনি এসেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি ঔষধ দিয়েছিলাম কি-না। উত্তরে জানালাম, দিয়েছিলাম। সে তখন আবারো আমায় পরপর দুই বার প্রশ্ন করলেন, “সত্যিই দিয়েছিলেন?” আমি বললাম, “সত্যিই দিয়েছিলাম।” তিনি তখন আমার দিকে অনেকক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন এবং অবশেষে বললেন, “রোগীর ভাগ্য ভালো- তাই বেঁচে গেল। কারণ এ ধরণের রোগিণীর অপারেশনে মৃত্যু ঝুঁকি থাকে ৮০%।”
আমি তার লক্ষণগুলো স্টাডি করে ঔষধ দিয়েছিলাম কলোফাইলাম ০/২। এই ঔষধের লক্ষণে জরায়ুর মুখ খুব শক্ত থাকে এবং একদম ব্যাথা থাকেনা। আবার এই অবস্থায় যদি ঐখানে স্প্যাজম থাকে, তবে বেলেডোনা প্রযোজ্য হয়। এই অবস্থার রোগিকে চিকিৎসা দিতে গেলে, সাবধান! কেউ যেন তখন ধাতুগত লক্ষণের খোঁজ না নেন। কারণ এটা একটা একিউট ফিজিওলজিক্যাল ডিসফাংশন (একিউট রোগ নয়)- এমতাবস্থায় স্থানীয় লক্ষণ ধরে ঔষধ প্রয়োগ করাই নিয়ম। পরে সুস্থাবস্থায় ধাতুগত লক্ষণের চিকিৎসা করতে হয়, যাতে করে পরবর্তীতে এই ধরনের সমস্যা আর না হয়। এই রোগিণীর প্রথম দিকে রক্তস্রাব অবস্থায় চিকিৎসা করলে হয়তো গর্ভস্রাব প্রতিহত করা যেতো। রোগিণীর কাছ থেকে গর্ভের প্রারম্ভিক সময়টার সংগৃহীত লক্ষণ ছিল- ওই সময় রোগিণীর কালো কালো বড়-ছোট রক্তের টুকরাসহ রক্তস্রাব হতো, প্রতিদিনই কম বেশী রক্তস্রাব হতো। ওই সময় রক্তস্রাবসহ কোমর হতে তলপেট হয়ে কুঁচকী পর্যন্ত প্রচণ্ড ব্যথা ছুটে যেতো। রোগিণী গান-বাজনা, কোনো প্রকার শব্দ সহ্য করতে পারতোনা, প্রচণ্ড গরম অনুভব করতো। এমন অবস্থা গর্ভিণীর ২ থেকে ৪ মাস পর্যন্ত চলছিল। এলোপ্যাথিতে কিছুই না হয়ে অবশেষে Missed abortion হয়ে যায়, অথচ গর্ভস্রাব চলাকালীন যে লক্ষণ ছিল তাতে স্যাবাইনা প্রয়োগ করলে আল্লাহর কৃপায় হয়তো রোগিণীর গর্ভস্রাবটাকে আরোগ্য করে গর্ভাবস্থাকে রক্ষা করা যেতো।

বায়োগ্রাফি:
ডা. এ, বি, এম, শহীদুল্লাহ, ডি, এইচ, এম, এস (ঢাকা)
ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথ
চেম্বারঃ– ওহি হোমিও কেয়ার
কলতাপাড়া বাজার, গৌরীপুর, ময়মনসিংহ।
মোবাইল নাম্বার: ০১৭১১০৪৭৯৪৩
Discussion about this post