অনুবাদ: ডা. শাহীন মাহমুদ
David Malcolm Shein একজন ফ্রিল্যান্সার বিজ্ঞান লেখক এবং নিউইয়র্কের রচেস্টারে অবস্থিত মনরো কমিউনিটি কলেজের গণিত এবং ইংরেজির সহকারী অধ্যাপক। লেখাটাতে তিনি হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধে তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন এবং সাথে ব্যক্ত করেছেন প্রচলিত বৈজ্ঞানিক সমাজের কাছে হোমিওপ্যাথি গৃহীত না হওয়ার একটি টেকনিক্যাল মৌলিক কারণ। কথাগুলো অনন্য এবং একই সাথে গাণিতীক শুদ্ধতার মতো সঠিক বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। আর একারণে অনুবাদও শেয়ার না করে পারলাম না।
হোমিওপ্যাথির শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমি, অনেকটা কোকিলের দলে কাকের মতো। কারণ, আমার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের বেশিরভাগ সময়টাতেই আমি হোমিওপ্যাথির একজন স্বভাবসিদ্ধ কঠোর-বিরুদ্ধবাদী ছিলাম। ১৯৬০’ এর দশকে বোস্টনের নিকটে বেড়ে উঠা এই জীবনটাতে, বাবা-মা দু’জনেই ছিলেন স্বাস্থ্যবিজ্ঞান-বিভাগে কর্মরত। আমার বাবা একজন চিকিৎসক, একটি মেডিকেল স্কুলের প্রফেসর, একজন ভাইরোলজিস্ট, এবং নিউরোসায়েন্স রিসার্চার। মা ছিলেন ফিজিও-থেরাপিস্ট। আমার স্মৃতিশক্তির দৌড় যতদূর, সেখানে বিজ্ঞান ও গণিতের আলোচনাটা ছিলো, খাবার টেবিলে চলা গল্পকথার মতো নৈমত্তিক ব্যাপার। বাবা আমাকে বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিকদের সম্বন্ধে গল্প শোনাতেন। কাজেই, বয়স দশ হতে হতে, আমার মাথা লিউয়েনহুক, গ্যালিলিও, ডারউইন, এমনকি বার্নলির কাহিনীগুলো দিয়ে পূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। বাবা বিজ্ঞান ভালোবাসতেন, আমার সাথে তার এই ভালোবাসা বাটোয়ারা করে নিতেন, কাজেই আমিও বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা নিয়েই বড় হলাম। পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি দশক, বিজ্ঞান-লেখক হিসাবে আমার জীবিকা নির্বাহ করেছি। বহুবছর আমি হাইস্কুল বায়োলজি পড়িয়েছি এবং প্রায় দুই দশক ধরে গণিতে শিক্ষকতা করছি।

সর্বপ্রথম আমি হোমিওপ্যাথির কথা শুনতে পাই, 1980 সালে মনট্রিলে আমার এক বন্ধুর কাছে, যিনি লো-পটেন্সির নিয়ে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলো। সে আমাকে হোমিওপ্যাথিটা বোঝাতে এসেছিলো, কিন্তু আমি এককথায় সেটাকে বাতিল করে দিই। (তখন মনে মনে ভেবেছিলাম) “সে যা বলছে এর কোন মানে হয় না; এটা একদম ফালতু কিছু হবে। ঔষধের শক্তি তার কনসেনট্রেশনের বিপরীতক্রমে বৃদ্ধি পাবে? দ্রবন এভোগ্রাডো নাম্বারকে অতিক্রম করবে? ঝাঁকির মা্ধ্যমে শক্তিবৃদ্ধি? থামো…. বাবা”।
বহুবছর হোমিওপ্যাথিকে অবজ্ঞা করার জন্য আমার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছি, কিন্তু অবশেষে এটা নিজেই আমাকে খুঁজে নিলো। 2010 সালে, আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং প্রতিবেশি, মাওরিন- ক্রনিক ডিপ্রেশনের চরম সীমায় ভুগছিলো। সে তার পুরো বুঝ-জ্ঞানের সময় ধরেই এটাতে ভুগছিলো। সকালে ঘুম থেকে উঠাটা তার জন্য ছিলো এমন একটি পরীক্ষার মতো, যেটাতে সে বরাবরই ব্যর্থ হতো। সে তীব্রভাবে এগোরাফোবিক ছিলো এবং প্রায় সময়ই আত্মহত্যার কথা বলতো। সে বার বার তার পরিবারের সবার সাথে বাজে ব্যবহার করতো, তীব্র কটুক্তি করতো। অতি সামান্য কারণেই কান্না জুড়তো, আর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়েই তার মেজাজ উঠে যেতো সপ্তমে। তার এন্টিডিপ্রেসেন্ট কাজ করছিলো না। ঔষধের সর্বোচ্চ ডোজ ব্যবহার করেও, চরম বাজে অবস্থায় পড়ে ছিলো। তার ডাক্তার তাকে বলেছিলো, নতুন কোন ঔষধ শুরু করার আগে তার আগের ঔষধগুলো কমাতে হবে। বিবাহিত জীবন তখন ডিভোর্সের দুয়ারে; স্বামী-সন্তানও তার এই রোগের কারণে ভোগান্তি পোহাচ্ছিলো। সে ছিলো তখন মহা-বিপাকে।
যখন অবস্থা সর্বোচ্চ খারাপে নেমে গেলো, আমাদের দুইজনেরই বন্ধু অড্রে এগিয়ে এলো এবং মাওরিনের জন্য একজন হোমিওপ্যাথকে বুক করলো- যদিও তা করার মতো অর্থসচ্ছল ব্যক্তি সে কোনভাবেই ছিলো না। একারণে, মাওরিনও লজ্জার খাতিরে তা ফিরিয়ে দিতে পারলো না। মাওরিন ভেবেছিলো, এই উপহারটা ফিরিয়ে দিলে অড্রের অনুভূতিকে গভীরভাবে আঘাত করা হবে, এমনকি তাদের বন্ধুত্বও নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে। অড্রে ইতোমধ্যে হোমিওপ্যাথের ফি প্রদান করে রেখেছে, এবং টাকাটা নন-রিফান্ডেবল ছিলো। এটা অড্রের জন্য একই সাথে একটা মহৎ উদ্যোগ এবং একটি ব্যক্তিগত ত্যাগ। কাজেই, মাওরিন সেটা গ্রহণ করলো, যদিও তার বাসায় কফি খেতে খেতে তার সাথে এটা নিয়ে বেশ হাস্য-কৌতুক করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “এই ভুডু ডাক্তার (আফ্রিকান যাদুকর) এর সাথে কথা বলতে যাচ্ছো কখন?” মাওরিন নাক সিঁটকালো। আমরা নিশ্চিত ছিলাম এই হোমিওপ্যাথির পুরোটাই একটা আবর্জনা- ইউনিকর্ন বা জলপরীর মতো কাল্পনিক।
পরের সপ্তাহে, মাওরিন ফ্লোরিডার জেন মার্কস নামের হোমিওপ্যাথটির সাথে স্কাইপিতে বসে কথা বললো। আমি তাকে পরের দিন এ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে জানায়, হোমিওপ্যাথ তাকে অল্প কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলো এবং মূলত প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টার মতো বিশাল সময়, মাওরিনকে দিয়ে তার নিজের সম্বন্ধে কথা বলিয়েছিলো। পরের দিন, জেন- মাওরিনকে ফোন করে হায়োসায়েমাস নিগার – 200 নামে একটা ঔষধ খাওয়ার পরামর্শ দেয় এবং মাওরিনকে এমন কিছু হোমিওপ্যাথিক ফার্মাসির তালিকা দেয়, যেখানে সে ঔষধটা অর্ডার করতে পারবে। 2 দিন পরে, তখনও চরম সন্দেহের সাথে, মাওরিন তার ডোজটাকে দেখছিলো, এবং তা সত্ত্বেও অবশেষে পেলেটগুলো জিহ্বাতে বিসর্জন দিলো।
অবধারিতভাবে, আমরা এটা নিয়ে কিছুটা অবজ্ঞা-ভ্রুক্ষেপ করেছিলাম, কিন্তু কি বলেছিলাম তা এখন আর মনে নেই। এরপরের শনিবার সকালের কফি খেতে মাওরিনের বাসায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত কয়েকদিন তার সাথে দেখা হয়নি। আমার স্বভাব অনুযায়ী, বাসায় ঢুকেই দরজার সামনে থেকে আমি চিৎকার করছিলাম, “হ্যালো!”। স্টোভে তার ছেলের জন্য ডিম ভাজা অবস্থায়, মাওরিন আমার দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। সে ঘোরার পরে, আমি তার মুখ দেখতে পেলাম। তার মুখের ভাব ছিলো প্রশান্ত, যেন এমন একজনের মুখ দেখছি- যে ছুটিতে আছে।
মানুষ পরিচিতজনের মুখে একই ধরণের আবেগ-অভিব্যক্তি দেখেই অভ্যস্থ থাকে। সেই অভিব্যক্তিগুলো অনেকটা রংয়ের মতো, যেগুলোর খুব বেশি পরিবর্তন হয় না। যদি জানতে চাও, তবে আমি বলবো- চিরজীবন মাওরিনের সেই অভিব্যক্তির রং ছিলো লাল, এবং ধূসর, এবং কালো- কিন্তু সেই মুহূর্তে প্যান হাতে স্টোভের পাশে দাঁড়ানো, তার (অভিব্যক্তির) রং ছিলো উজ্জল কমলা। সুখী গোলাপি রং নয়, উচ্ছসিত হলুদও নয়, কিন্তু একটি প্রশান্ত এবং নম্র আত্মসংযত কমলা।

পাছে না এই কমলা রংয়ের ব্যাঘাত ঘটে, তাই আমি আমার এই দেখাটাকে নিজের কাছেই রাখলাম, এবং এটা টিকে থাকে কিনা তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। এটা টিকে ছিলো। সাথে আরো বহু কিছু হতে থাকলো। তিন সপ্তাহ আমি মাওরিনের সামনে হোমিওপ্যাথির ব্যাপারে একটা শব্দও উচ্চারণ করলাম না। তাকে চমৎকার দেখাচ্ছিলো। একদম নিঁখূত নয়, একদম নি:রোগ নয়- যদি আমাকে বলতে বলো, আমি বলবো সে আগের চেয়ে প্রায় ৮০% ভালো ছিলো। আর নি:সন্দেহে সে তখন ছিলো কর্মক্ষম, যা সে আগে ছিলো না। এই সময়ের মধ্যে সে একটা পার্টটাইম কাজের জন্য আবেদন করে এবং কাজটা পায়; যেখানে বিগত ২ বছরের মধ্যে আমি তাকে কাজ করতে পারার মতো সমর্থ অবস্থায় দেখিনি।
অবশেষে একদিন সকালে কফি খাওয়ার ফাকেঁ আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তাহলে, এটা হোমিওপ্যাথির কাজ…..তুমি কিছু খেয়াল করেছো?” তার চোখগুলো পেয়ালার মতো গোল গোল হয়ে গেলো, সাথে উত্তর আসলো, “উম..হ্যা। তুমি কিছু লক্ষ করেছো?” আমি হ্যা-সূচক মাথা নাড়ালাম। মাসের শুরু থেকে সে তার পার্টটাইম কাজটা শুরু করলো, এবং সাথে “মহিলা এ্যামেচার রোলার ডার্বি” খেলার ট্রেনিংও নিতে শুরু করলো। ট্রেনিং নেয়ার সময়, তার হাতের কব্জি ভেঙ্গে যায়; তবু সে তা চালিয়ে যেতে থাকে, এবং ২ বছর ট্রেনিংয়ের পর “Women’s Indoor Flat Track Derby Association” এর খেলোয়াড় হিসাবে গৃহীত হয়। কর্মক্ষেত্রে, তার পার্টটাইম চাকুরিটা ফুলটাইম তত্ত্বাবধায়কের পদে অগ্রগতি লাভ করে। মাওরিন, যে কিনা আগে ফোনে কথা বলতে হিমশিম খেতো, এমনকি মুদি দোকানে পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষমতা ছিলো না, সে আজ তার অধীনস্থ ২৫ জন মেয়েকে চালাচ্ছে আর বহু সন্ধ্যা কাটাচ্ছে অন্য মেয়েদের “পাছায় লাথি মেরে” (ডারবির মতো একটা প্রতিযোগীতামূলক খেলা খেলে)।
আমি যখন কাউকে এই অভিজ্ঞতার কথা বলি, আমি হোমিওপ্যাথিকে প্রায়ই “ভুডু” ম্যাজিকের সাথে তুলনা করি। আমি তাদের বলি, হোমিওপ্যাথিক ঔষধের কাউকে সুগভীর ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন থেকে টেনে-ছেঁচড়ে বের করার দৃশ্যটা অনেকটা একটা একটা কুকুরের ভাসতে ভাসতে চারণকবিতা আবৃত্তি করতে দেখার মতো ব্যাপার। মাওরিনের ব্যাপারে প্রাশ্চাত্য ঔষধগুলি ব্যর্থ হয়েছিলো। সে দুই দশক ধরে এক ডজন বা তারও বেশি বিভিন্ন ধরণের ঔষধ খেয়েছিলো, যা তার ডিপ্রেশনকে দূর করতে পারেনি মোটেও। কিন্তু কিন্তু সমাধানটা এসেছে একটা বিষাক্ত ফুলের এক ফোঁটা, 10400 ভাগ পানিতে গুলে সুনির্দিষ্ট বিরতিতে তীব্রভাবে ঝাঁকিয়ে খাওয়ার পর।
মাওরিনের সুস্থতার ব্যাপারে আমার বিস্ময়টা আমার কৌতুহলের সাথে পাল্লা দিলো। (আমার তখনকার হিসাব মতে) হোমিওপ্যাথির কাজ করার কথা ছিলো না। হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধে আমি আগে যা শুনতাম তাতে এটাকে একটা পুরোমাত্রার বকোয়াজ বলে মনে হতো। আমার বা মাওরিনের- কারো বিন্দুমাত্র বিশ্বাস বা প্রত্যাশা ছিলো না যে তার হোমিওপ্যাথিক “ঔষধ” আদৌ কিছু করতে পারবে। একজন সফল বৈজ্ঞানিক গবেষকের সন্তান হিসাবে, বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের কাহিনীর মাঝে বড় হয়ে উঠায়, এবং একজন গৃহীত বিজ্ঞান লেখক হিসাবে- “প্লাসিবো ইফেক্ট” কাকে বলে, আর এটা কি রকম- তা আমি জানতাম। আমি বুঝেছিলাম, আমি যা দেখছি তা প্লাসিবো নয়। যেখানে কোন এলোপ্যাথিক ঔষধই কাজ করছিলো না, এবং কোন স্থায়ী প্রভাব রাখতে পারছিলো না সেখানে মাওরিনের উপর এই ঔষধটার ইফেক্ট এতটাই সুনির্দিষ্ট ও নাটকীয় যে, সেটা প্লাসিবো ইফেক্ট হতে পারে না। আমি বুঝতে পারছিলাম, “রোগকে এটা ওটা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ” করা নয়- আমি একটা আরোগ্য প্রত্যক্ষ করছি।
কি হচ্ছে, সেটা সম্বন্ধে আমার কোন ধারণাই ছিলো না কিন্তু আমি এটাও জানতাম যে, মাওরিনের এই পরিবর্তন তার বিশ্বাসের জোরে বা, তার এলোপ্যাথিক ঔষধ বাদ দেয়াতে হচ্ছে না। তার পরিবর্তনটা ছিলো আমার কাছে চরম রহস্যময়, এবং আমি তা বুঝতে চাইলাম। বৈধ সায়েন্টিফিক স্টাডিগুলো দেখতে কেমন হয় আমি জানতাম, এবং ভাবছিলাম হোমিওপ্যাথি সেই ছাচেঁ পড়বে কিনা। মাওরিনের আরোগ্য সম্বন্ধে কোন বিজ্ঞান-সুলভ ব্যাখ্যাই আমি জড় করতে পারলাম না। সবচেয়ে সাধারণ যে ব্যাখ্যাটা আমি পাচ্ছিলাম সেটা হচ্ছে- “হোমিওপ্যাথিক ঔষধ কাজ করেছে”। কিন্তু কিভাবে?!!!
মাওরিনকে যিনি চিকিৎসা করেছিলেন, আমি সেই হোমিওপ্যাথের সাথে যোগাযোগ করে বললাম, “আমাকে কিছু পড়ার জন্য বই দিন। আমি যা দেখেছি, তা ব্যাখ্যা করতে পারছি না এবং এটাকে মেনেও নিতে পারছি না”। যদিও আমি পড়ার জন্য বই চাইলাম, তবু সেসময়ও আমি পুরোদমে সন্দেহগ্রস্থ। বাস্তবে, আন্তরিকভাবে আমি আশা করছিলাম জেন- ক্রিস্টাল বা ম্যাগনেটিজম অথবা এনার্জি সংক্রান্ত- আবর্জনার মতো, নিবোর্ধ অসংলগ্ন প্রলাপ-সমৃদ্ধ কিছু লেখা পাঠিয়ে দেবে, এবং এরপর আমি যে সাফল্য দেখেছি, তাকে একটা অপ্রত্যাশিত সাফল্য হিসাবে বিবেচনা করে হোমিওপ্যাথিকে বাতিল হিসাবে নির্ধারণ করতে পারবো। আমি দেখলাম, সে আমাকে হতাশ করে মিরান্ডা ক্যাস্ট্রোর “The Complete Homeopathy Handbook “ নামে একটা বই পাঠিয়ে দিলো। যেটাতে দু:খজনকভাবে সেইসব নির্বোধ কথাবার্তাগুলোর ঘাটতি ছিলো। আমি হোমিওপ্যাথিকে পুরোপুরি বুঝতে পারলাম না কিন্তু ক্যাস্ট্রোর লেখা থেকে মনে হলো এর একটা অন্তর্নিহিত যুক্তি এবং সংগতি আছে, যা আমি মোটেও আশা করিনি। আমি দেখলাম, এটাকে আমি হাতে হাতে বাতিল করতে পারছি না।
আমি জেনকে বললাম, “আমাকে আরো শাঁসালো কিছু দিন”। সে বললো, “বেশ, তাহলে তোমার হ্যানিম্যান থেকে পড়া উচিৎ”। মাওরিনের আরোগ্যের মতো, অর্গাননও আমার কাছে ছিলো এক মহা-বিস্ময়।
অর্গাননে কোন ইউনিকর্ন (এক শিংওয়ালা অবাস্তব ঘোড়া), কোন পরীকাহিনী, কোন ক্রিস্টালের কথা, বা কোন হাবি-জাবি ধারণা বা কল্পনার কথা ছিলো না। তার বদলে আমি খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম, একজন নীতিবান, প্রজ্ঞাময় রসায়নবিদ এবং সহজাত-দার্শনিক তার সবোর্চ্চ ক্ষমতা নিয়ে কাজ করেছেন। আমি ফিলোসফিতে আমার B.A. করেছি, এবং আমার তৃতীয় কোর্সওয়ার্কের পুরোটাতেই জ্ঞানী দার্শনিক- কান্ট, হেগেল, ডেকার্ট, বার্কলি, হবস এবং অন্যান্যদের লেখাগুলো পড়তে হয়েছিলো। পাঁচ পৃষ্ঠা পড়তে না পড়তেই হ্যানিম্যানের লেখার মান ও পান্ডিত্যের সাথে পরিচিত হলাম। আমি আগে যেরকমটা পড়তাম, এখানে তেমন সুনির্দিষ্ট, এবং নিঁখুত একটি যুক্তিবাদী সত্ত্বার উপস্থিতি পেলাম। তার লেখাগুলো ছিলো বাহুল্যবর্জিত, স্বচ্ছ, উৎসাহজ্ঞাপক, বুদ্ধিদীপ্ত।
“আচ্ছা, একারণেই হোমিওপ্যাথি কার্যকরী!” আমি ভাবলাম। আমি হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধে এর আগে শুনিনি কেন?!!! আমি যখন ছোট ছিলাম, বাবা কখনো আমাকে হ্যানিম্যানের কোন গল্প বলেননি। রচেস্টার ইউনিভার্সিটির ফিলসফি বিভাগে হ্যানিম্যানের উপরে কোন কোর্স ছিলো না। তার সম্বন্ধে কোন উল্লেখ পর্যন্ত ছিলো না। আমি আগে ভাবতাম, প্রজ্ঞাদীপ্ত সব লেখাই একসময় পরিচিতি পায় এবং আমাদের সংস্কৃতি থেকে প্রসংশিত হয়। আমি ডারউইন পড়েছি। আমি (দর্শনের) প্রাথমিক সময়েরও বহু প্রকৃতি-বিজ্ঞানীর কথা জানি। কিন্তু, আমি হ্যানিম্যান সম্বন্ধে একটা পাদটীকাও স্মৃতি থেকে মনে করতে পারলাম না।
“হোমিওপ্যাথরা জানেন যে- হোমিওপ্যাথি কাজ করে। একটি চাহিদাসম্পন্ন এবং কার্যকরী চিকিৎসা ব্যবস্থার ভিত্তিতে থাকা অর্গানন- অত্যন্ত হিসেবি, নৈতিক এবং নিঁখুতভাবে যৌক্তিক একটা কর্মপদ্ধতি (Methodology)। হোমিওপ্যাথিকে আমি নিজের চোখে কাজ করতে দেখেছি। খুব দ্রুতই আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেলো যে, হ্যানিমান এবং হোমিওপ্যাথিকে- একাডেমিক ইতিহাসবেত্তারা (Historiographers) প্রায় সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে গেছেন।
তারচেয়েও খারাপ কথা, যেখানে তাদের উপেক্ষা করা না হতো, সেখানে একদল প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, দার্শনিক এবং চিকিৎসক হোমিওপ্যাথিকে এবং এর অনুশীলনকারীকে মোহগ্রস্থ নির্বোধ অথবা বিজ্ঞান-বিরুদ্ধবাদী বলে অসংলগ্ন কথা প্রচার করতে থাকতো। হোমিওপ্যাথির কার্যকারীতা দেখার আগে, আমিও সেই সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছিলাম। আমি যখন এই আপাত-বিরোধী চিন্তায় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিলাম, স্টিভ ওয়ান্ডারের “Superstition” বইটার সেই লাইন কয়টা আমার মাথায় তখন অনুরণিত হচ্ছিলো:
“তুমি যখন এমন কিছুতে বিশ্বাস করবে, যা তুমি বুঝতে পারবে না- তখনই তুমি কষ্ট পেতে থাকবে। কুসংস্কার- কখনোই কোন পথ নয়।”
আমি উৎঘাটন করলাম যে, হোমিওপ্যাথি কোন বিশ্বাস বা কুসংস্কারের উপর নির্ভর করে বা ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়নি- তবু কেনো হোমিওপ্যাথির গায়ে এই কলঙ্কগুলো লেগে রয়েছে, তা বুঝতে আমার বহু সময় লেগেছিলো। চলমান সংস্কৃতিতে নিরপেক্ষ সত্যকে পাওয়ার একটিমাত্র উপায় ছাড়া অন্য কোন পথ নেই- যা বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে যা উপস্থাপিত হয়। বাদবাকী আর সবকিছু বিশ্বাস এবং কুসংস্কার- এটাই প্রচলিত বিজ্ঞানের ধ্যান-ধারণা। স্যাটেলাইট, জিপিএস, ইলেকট্রিসিটি, স্পেস ট্রাভেল, এম আর আই। বিজ্ঞান ফলাফল চায়। আর হোমিওপ্যাথি এবং হোমিওপ্যাথ ঠিক এটারই বিপরীত ধারা থেকে উঠে এসেছে। বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে- যদি কেউ হোমিওপ্যাথ হয়ে থাকে, তবে নিশ্চিতভাবে হয় সে বিশ্বাসের উপর চালিত, অথবা একজন মূর্খ, অথবা একজন র্নিবোধ, অথবা সে একজন ধাপ্পাবাজ, বা ধূর্ত। যদি কেউ বিশ্বাস করে, বিজ্ঞানের বাইরে কোন বাস্তব, প্রতিপাদ্য সত্য নেই- তাকে তখন ‘Occam’s Razor’ নীতিটি (তুলনামূলক সহজ চিন্তায় প্রাপ্ত বিকল্প পথটি গ্রহণের নীতি) এই সব অতিসহজ সমাধানগুলোর দিকে ঠেলে দেয়।
বিগত পাঁচ বৎসর যাবৎ, আমি হোমিওপ্যাথির সাথে প্রচলিত বিজ্ঞানের পার্থক্যটিতে সংগতি আনার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। হ্যানিমানের কাজ এবং বছরে ১ বিলিয়নেরও চাইতে বেশি মানুষের সফল চিকিৎসা- এই প্রশ্নের উত্তরটির জন্য মিনতি করে: হোমিওপ্যাথি কি নিরপেক্ষ সত্যকে পাওয়ার ভিন্ন কোন উপায়ের প্রতিনিধিত্ব করে? স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে? উত্তরটা হচ্ছে, “হ্যা”- অন্তত হ্যানিমানের ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথির বিবেচনায়।
এ ব্যাপারে আমি যে সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছি: বিজ্ঞান এবং হোমিওপ্যাথির যৌক্তিক উপস্থাপনের একটা বড় অংশ পরস্পরের বিপরীত প্রান্ত থেকে শুরু করে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগুলো মূলত অবরোহী (উপর থেকে নীচে, অনুমান থেকে ফল) এবং হ্যানিমানিয়ান পদ্ধতির বড় অংশটাই আরোহী (নীচের থেকে উপরে, ফল থেকে অনুমান)। উভয়েই প্রকৃতির নিরপেক্ষ, শ্বাশ্বত নিয়মগুলোর ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট ধরণের প্রমাণ সংগ্রহ করে। বিজ্ঞানীসমাজ এবং হোমিওপ্যাথগন- দু’জনেই নিরপেক্ষ প্রমাণগুলোকে সুগভীর গুরুত্ব প্রদান করে, কিন্তু তারা এটাকে ব্যবহার করে ভিন্নভাবে। প্রত্যেকটা কর্মপদ্ধতির নিজস্ব কিছু কর্মধারা থাকে, যৌক্তিক মূল্যায়নের জন্য তার নিজস্ব কিছু নিয়ম বর্তমান থাকে এবং তারা প্রত্যেকে যে ধরণের তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে- তার একটা থাকে, অন্যগুলোর থেকে বেশ খানিকটা ভিন্ন।
এই ভিন্নতার শেকড় থাকে তাদের দর্শনে, তাদের যৌক্তিক উপস্থাপনে, তাদের তাত্ত্বিক জ্ঞানে- যা উপস্থাপনের সময় বিতর্কের সূচনা করে। অর্গানন পড়ার সময়, আমার কাছে পরিস্কার হয়ে যায় যে, হ্যানিমান শুধুমাত্র তৎকালীন সময়ের চিকিৎসাপদ্ধতির বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করেননি, তিনি অন্যান্য বেশিরভাগ প্রজ্ঞাময় প্রকৃতিবিজ্ঞানীর বেছে নেয়া ও নির্ধারিত করে নেয়া- অবরোহী পদ্ধতির বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এ কারণেই হ্যানিম্যান অর্গাননে লাগাতার সতর্কতা আরোপ করে গেছেন যে, হোমিওপ্যাথির যৌক্তিক চিন্তাধারায় সেইসব তাত্ত্বিক ধারণাকে বাতিল করতে হবে- যেগুলো, সরাসরি বার বার পর্যবেক্ষণকৃত ও পুনঃনির্মানযোগ্য পরীক্ষণ থেকে উপজাত হয়নি, অর্থাৎ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা কঠোরভাবে আরোহী পদ্ধতির অনুসরণ করে।
হ্যানিমানিয়ান কর্মপদ্ধতিতে, প্রমাণ বা ফলাফল (Evidence)- যে কোন একটি বা সমস্ত সাধারণীকরণকৃত (Generalization) সিদ্ধান্তকে পরিচালনা করে এবং প্রাপ্ত প্রমাণ বা ফলাফলের উপর ভিত্তি করেই, সমস্ত সাধারণীকরণকৃত সিদ্ধান্তের সীমা খুব কঠোর ভাবে আরোপিত হয়। এটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগুলো থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন- যেখানে যে কোন উৎস থেকে প্রাপ্ত অনুমানকে পরীক্ষা করা হয়, পাশাপাশি তাকে পর্যবেক্ষণকৃত প্রমাণ বা তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালনা করা হয়। অপরদিকে বিজ্ঞানীগণ হোমিওপ্যাথির শাস্ত্রকে দেখেন এবং তাত্ত্বিক (বৈজ্ঞানিক) কাঠামোর অভাব আছে মনে করে এটাকে তখনই বাতিল করে দেন- যেহেতু (তাদের মতে) এগুলো শুধুমাত্র অভিজ্ঞতাপ্রসূত এবং গল্পকথার উপর ভিত্তি করে তৈরি, যা আনুষ্ঠানিক বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনার (Peer review Process) মধ্য দিয়ে যায়নি।
লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে, এই পার্থক্যগুলো হোমিওপ্যাথির সীমাকে বিকল্প চিকিৎসাব্যবস্থা হিসাবে অবস্থানের উর্ধ্বে নিয়ে যায়। হোমিওপ্যাথি প্রাকৃতিক জগৎ সম্বন্ধে নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহের একটি ভিন্ন এবং যৌক্তিক অভিব্যক্তি। এটা সত্যের দিকে চালিত তার নিজস্ব পথ; তার জ্ঞানতত্ত্বের নিজস্ব পদ্ধতি। এই পার্থক্য হোমিওপ্যাথিক অনুশীলন করতে অনু্প্রবেশের পথে খুব শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এতে একজনকে বারংবার-পরীক্ষাযোগ্য ভিত্তির উপর নির্ভর করে পৌঁছানো- একশ্রেণীর ধারণাসমষ্টিকে মেনে নিতে হবে, যার সিংহভাগই পর্যবেক্ষণভিত্তিক কর্মপদ্ধতিতে প্রাপ্ত এবং যেগুলোর- হয় খুব সামান্য তাত্ত্বিক, অবরোহী ভিত্তি আছে অথবা তা একদমই নেই। বিজ্ঞানসমাজ যাকে “বাস্তবতথ্যমূলক” তাত্ত্বিক কাঠামো হিসাবে মেনে চলে, হোমিওপ্যাথিতে এর কোন অর্থ নেই- সেটা যে কোন ব্যাপারেই হোক না কেন। (অপরদিকে বিজ্ঞানসমাজে) ঝাঁকির মাধ্যমে শক্তিবৃদ্ধিকরনের কোন মানে নেই। বিপরীতক্রমিক শক্তিবৃদ্ধি/দ্রবণকে (Inverse potency/dilution) যদি কোন বিধি বলা হয়, তার কোন মানে নেই। সেই লোকসমাজ ও সংস্কৃতির কাছে সদৃশ-বিধানের নিয়মটারও কোন মানে নেই- যারা শুধুমাত্র এলোপ্যাথিক ঔষধ এবং তার চিকিৎসাব্যবস্থা সম্বন্ধে জ্ঞান রাখে। কাজেই অবশেষে, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাপদ্ধতি, মেটেরিয়া মেডিকা, হোমিওপ্যাথিক দর্শন, রেপার্টরাইজেশন, কেইস-টেকিং সবকিছুই বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আপত্তিকর হয়ে চলেছে।
জ্ঞানের একটি কাণ্ড হিসাবে যে যুদ্ধটা হোমিওপ্যাথিকে করতে হচ্ছে, এটাই হচ্ছে তার মূলকথা। এটাতে ঢোকার প্রবেশপথে প্রতিবন্ধকতাটা মাথা নষ্ট করার মতো বড়, কারণ মানুষকে তখন একটা বিশাল বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন প্রয়োগ করতে হয় এবং তাকে একদিকে অবশ্যই খোলা মনের হতে হয় এবং অপরদিকে তার বেশিরভাগ গতানুগতিক সুবিধাজনক ধারণাগুলোকে প্রশ্নের সম্মুখীন করার মতো বিরল ইচ্ছাশক্তিটাও থাকতে হয়। দর্শনবিদ্যা তার শিক্ষার্থীদের কাছে এই ব্যাপারগুলো দাবী করে এবং পাশ্চাত্য দর্শনের উপর ভিত্তি করা হোমিওপ্যাথিও সেই দাবীগুলোই করে। হোমিওপ্যাথি কার্যকরী- কারণ তার ভিত্তি একটি যৌক্তিক জ্ঞানতত্ত্বের উপর, যদিও আমরা বুঝতে পারি না এটা কিভাবে কাজ করে- কারণ প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া তত্ত্বপ্রদানটি আরোহী (Inductive) নয়, সেটা অবরোহী (প্রস্তাবনামূলক, Deductive)। হোমিওপ্যাথ হিসাবে, এটা কার্যকরী বলে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় বলে, এটা কিভাবে কাজ করে সে প্রশ্নকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যাই। কিন্তু একজন বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি হিসাবে, হোমিওপ্যাথি কিভাবে কাজ করে তা জানতে আমি প্রচণ্ড আগ্রহী। একজন হোমিওপ্যাথের কাছে, কেবলমাত্র যে ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ- তা হচ্ছে তার রোগী এবং রোগীটির লক্ষণসমূহ।”
Discussion about this post