ডা. সৌমিত্র সরকার
[Souvenir of the Nadia District Homoeopathic practitioner’s conference 1994, The Homoeopathic Medical Association of India (West Bengal)]
এই পৃথিবীতে কোন দুটি বস্তু পুরোপুরি এক নয়। একই মরশুমে একই গাছের দুটি ফল বা একই মায়ের যমজ সন্তান, আপাত দৃষ্টিতে দেখলে হয়ত মনে হয় দুটির মধ্যে কোন প্রভেদ নেই, খুঁটিয়ে দেখলে তফাৎটা বোঝা যায়।
হোমিওপ্যাথিতে প্রকৃতির আরোগ্য নিয়মের প্রথম এবং প্রধান শর্ত হল- সদৃশ নীতি। সদৃশ বিষয়গুলোকে ঠিক ঠিক নির্ণয় করার জন্য প্রয়োজন ওষুধগুলোর মধ্যকার ও একই রোগের বিভিন্ন রোগীর চিত্রের ব্যবধান ঠিক ঠিক নির্ণয় করা।
মেটেরিয়া মেডিকাতে বিভিন্ন সম্পূর্ণ পরীক্ষিত ওষুধ গুলোর চিত্র থেকে আমরা দেখতে পাই, বিভিন্ন ওষুধের কোন কোনটির মানসিক বা দৈহিক কিছু লক্ষণ মিল থাকলেও, সামগ্রিকভাবে ওষুধগুলোর অবশ্যই কিছু তফাৎ আছে। একটা ওষুধ পরীক্ষণের সময় বেশ কিছু লক্ষণ বিভিন্ন পরীক্ষকের মধ্যে লক্ষ্য করা গেলেও, দুজন পরীক্ষকের লক্ষণ পুরোপুরি কখনই এক হয় না।
এরকম হওয়ার কারণ বিভিন্ন বস্তু বা ব্যক্তি উভয় ক্ষেত্রে অবশ্যই কিছু স্বতন্ত্রতা বজায় রাখে। কেন্টের রেপার্টরিতে (Repertory) আত্মহত্যার পরিকল্পনা (Suicidal disposition) শিরোনামে যে ওষুধগুলোর নাম প্রথম শ্রেণীতে উল্লেখ আছে তাদের মধ্যে অরাম মেট ও নেট্রাম সালফ ও আছে । অরাম মেট ও নেট্রাম সালফ উভয় ওষুধেই রোগী আত্মহত্যার চিন্তায় মগ্ন থাকলেও, নেট্রাম সালফের রোগী নিজেকে সংযত রাখে। অরাম মেটের রোগী চিন্তা চালিয়ে যায়, দু একবার বাঁধাপ্রাপ্ত হলেও হয়ত একদিন সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করে বসে। এছাড়া দুটি ওষুধের অন্য লক্ষণগুলো খুব পরিষ্কারভাবে তাদের তফাৎটা বোঝালেও- এই মানসিক লক্ষণের সুক্ষ্ম প্রভেদটা আমরা যদি এড়িয়ে গিয়ে গতানুগতিকভাবে অরাম মেট ব্যবস্থা করি সফলতা আশা করা যায় না।
অর্গাননের ১১৮ নং সূত্রে হ্যানিম্যান বলেছেন,
“প্রত্যেক ওষুধ মানব শরীরে বিষ্ময়কর ক্রিয়া দর্শায় আর কোন ভিন্ন ওষুধে ঠিক সেরকম দর্শন সম্ভব নয়”।
অর্থাৎ হ্যানিম্যান বোঝাতে চেয়েছেন দুটো ওষুধ কখনই এক নয়। বিভিন্ন ওষুধের মানসিক লক্ষণগুলো আলাদা এবং প্রত্যেকটা ওষুধের মানসিক লক্ষণগুলোর একটা গভীর অর্থ আছে, যেমন অরাম মেটে রোগীর নিজের জীবনের প্রতি ভালোবাসা শেষ হয়ে যায়। নেট্রাম সালফে উত্তেজিত ও স্পর্শকাতর রোগীর আত্মসংযম করাটাই লক্ষণীয়।
এছাড়াও ওষুধ পরীক্ষণের পর লক্ষ্য করা যায় প্রত্যেকটা ওষুধের মানব শরীরে কাজ করার আলাদা আলাদা ক্ষেত্র, অনুভূতি এবং হ্রাস বৃদ্ধি কখনও কখনও কয়েকটা ওষুধের ক্ষেত্র, অনুভূতি বা হ্রাস বৃদ্ধির কিছুটা মিল থাকলেও সামগ্রিক অর্থে তারা ভিন্ন। এছাড়াও কিছু কিছু ওষুধের মূল লক্ষণের পাশাপাশি সম্পুর্ণ ভিন্ন অন্য সহযোগী লক্ষণ (concomitant symptom) থাকতে দেখা যায়। তাদের মধ্যে সম্পর্ক কি, বা একসাথে সম্পর্কহীন এরকম লক্ষণ সৃষ্টির কারণ কি, তার সঠিক ব্যাখ্যা না থাকলেও এই অদ্ভুত সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির লক্ষণগুলোর এক সাথে উপস্থিতি একটা ওষুধের বিশেষত্ব।
হোমিওপ্যাথিতে রোগ নির্ণয় (Diagnosis) বিষয়টা আপাত মূল্যহীন হয়ে পড়ে- যদি লক্ষ্মণ গুরুত্বহীন হয়। কারণ এক্ষেত্রে ওষুধের কাজ রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করা নয়। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় ওষুধ অসুস্থ জীবনী শক্তিকে উজ্জীবিত করে। সদৃশ ও রোগ শক্তি অপেক্ষা বলবত্তর হওয়ার জন্যই অসুস্থ জীবনী শক্তি রোগ শক্তিকে ত্যাগ করে ওষুধজ শক্তির উপর আশ্রয় নিয়ে থাকে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে রোগজ শক্তি দ্বারা সম্পূর্ণ আবিষ্ট (Induced) জীবনীশক্তি কেবলমাত্র তখনই রোগজ শক্তির স্থলে ওষুধজ শক্তিকে নিজের অজান্তে গ্রহণ করে, যখন ওষুধজ শক্তি সম্পূর্ণভাবে সদৃশ। এক্ষেত্রে তিনটি ওষুধ – ক, খ, গ’কে যদিও মনে হয় সম্পূর্ণ সদৃশ। গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তিনটি ওষুধের চিত্র রোগীর চিত্রের সাথে কখন একই হারে সদৃশ নয়। হয়ত ক. ৮০%, খ. ৯৫% ও গ. ৯২% সদৃশ। সুতরাং খ সদৃশতম ওষুধ হওয়ার জন্য যত দ্রুত রোগীকে আরোগ্যের দিকে নিয়ে যাবে- তা অন্য ওষুধের পক্ষে সম্ভব নয়।
হ্যানিম্যান নির্দেশ দিয়েছেন, রোগীর বিবরণ লেখবার সময় রোগী যখন তার কষ্টকর লক্ষ্মণগুলো বর্ণনা করে, কোনও রকমভাবে বাঁধা না দেওয়ার জন্য। কারণ রোগী যখন গভীর মনযোগ সহকারে নিজের উপলব্ধি ব্যাখ্যা করে- তার উপস্থাপনার ভঙ্গী, তীব্রতা, আবেগ তার পরিবার, পরিবেশ রোগ যন্ত্রনার প্রতি এই সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো বাঁধা প্রাপ্ত হলে সঠিকভাবে ও সম্পূর্ণভাবে রোগীকে চেনা সম্ভব হয় না। রোগীর বিবরণ লেখবার সময় ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলা, কান্নায় ভেঙ্গে পড়া, প্রিয়জন সম্বন্ধে ঘৃণাপূর্ণ বক্তব্য প্রকাশ করা এসব তো আমরা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে দেখে থাকি। নিজেদের তাড়া থাকার জন্য যদি রোগীকে দ্রুত প্রশ্ন করতে থাকি- রোগীর এই মূল্যবান ভাবপ্রকাশগুলো পাওয়া সম্ভম হয় না। এছাড়া রোগী পরীক্ষার সময় তার দৈহিক লক্ষণের সাথে মানসিক অত্যানুভূতি, নির্লিপ্তভাব, বাড়িয়ে বলা বা লক্ষণের সাথে সম্বন্ধ ইত্যাদি সবই বিভিন্ন ওষুধ সন্ধানে সাহায্য করে। সামগ্রিকভাবে একটা রোগীকে বোঝাই আমাদের লক্ষ্য। প্রত্যেকটা রোগীর এই পরিচয় একান্ত নিজস্ব জিনিস যা অন্য রোগীর মধ্যে থাকতে পারে না।
হ্যানিম্যান অচির রোগ চিকিৎসায় নির্দিষ্ট উত্তেজক কারণকে ও চিররোগ চিকিৎসায় মূল (Fundamental) কারণের উপর লক্ষ দিতে বলেছেন। অচির রোগ নিয়ে আলোচনা করলে দেখতে পাই, যেমন জ্বরের কারণ হয়ত রোগীর অত্যাধিক খাওয়ার জন্য নতুবা গ্রীষ্মের প্রচন্ড রোদে ঘুরে। দুই ক্ষেত্রে ওষুধ নির্বাচন অবশ্যই উত্তেজক কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়। যদি উভয় ক্ষেত্রেই দেখা যায় রোগী উত্তেজিত, একা চুপচাপ থাকতে চায়, জিহ্বা সাদা, জল পিপাসা আছে, শীতকাতর, প্রথম ক্ষেত্রে যদি নির্বাচিত ওষুধ নাক্স ভমিকা হয়, পরের ক্ষেত্রে ওষুধ হবে ব্রাইওনিয়া এল্বা। শীতকাতরতা দেখে উভয় ক্ষেত্রেই যেমন নাক্স ভমিকা ওষুধ হয়না, জল পিপাসা লক্ষ করে উভয় ক্ষেত্রেই ওষুধ ব্রাইওনিয়া এল্বাও হয় না।
চিররোগ নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায় এর মূল কারণ চির-মায়াজম। রোগীর মধ্যে শুধু সোরা বা সোরা সমেত অন্য যে কোন একটি মায়াজম সিফিলিস সাইকোসিস বা দুটি মায়াজমই বর্তমান থাকতে পারে। এরকম অবস্থায় প্রতি ক্ষেত্রেই বিভিন্ন রোগীর অবস্থা আলাদা আলাদা হয়। বংশ গতি মারফৎ পেয়ে থাকা চিররোগ অবশ্যই অর্জিত মায়াজম অপেক্ষা জটিলতর হওয়ার জন্য রোগীর চিত্র অধিকতর অস্বচ্ছ হয়। কখনও কখনও অচিররোগ (হাম,বসন্ত) হওয়ার পর থেকে প্রাপ্ত অসুস্থতা যার সঙ্গে অবশ্যই রোগীর চির-মায়াজমগুলো যুক্ত থাকার জন্য প্রতি ক্ষেত্রেই রোগীর চিত্র আলাদা আলাদা হয়। আরো বিস্তারিতভাবে দেখলে দেখা যায় রোগীর অবস্থা অনেক সময়ই নির্ভর করে তার বাসস্থান, কর্মস্থল, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ, মানসিক অশান্তি, রাত্রি জাগরণ, চাপা পড়া রোগ, দুঃখ, তাড়না বিভিন্ন নেশা, খাদ্যের অভ্যাস ইত্যাদির উপর। সুতরাং কোন রকমভাবেই একই ভাবে দুটি রোগীর অবস্থা এক হয় না বা হতে পারে না।
এখানে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে হ্যানিম্যান সংক্রামক ব্যাধির ক্ষেত্রে কিছু আলাদা আলাদা রোগীর রোগ চিত্রের উপর ভিত্তি করে ৫,৬টি জেনাস এপিডেমিকাস (Genus Epidemicus) ওষুধ নির্বাচন করতে বলেছেন- যাদের দিয়ে সেই সংক্রামক ব্যাধির মোকাবিলা করতে বলেছেন। সুতরাং ৫, ৬টি ওষুধ দিয়ে কেমন করে ব্যাপক রোগীর মোকাবিলা করা সম্ভব হচ্ছে? এক্ষেত্রে প্রথমত নির্দিষ্ট অচির মায়াজম, উত্তেজক চিরমায়াজম সোরা, নির্দিষ্ট এলাকার জল, আবহাওয়া, পরিবেশ, খাদ্যের অভ্যাস প্রভৃতির জন্যই এটা সম্ভব হয়।
হোমিওপ্যাথিক বিজ্ঞানে প্রকৃতির নিয়ম সদৃশনীতি ব্যবহৃত হলেও, এই নীতিকে ঠিকভাবে প্রয়োগ করতে একটা কঠিন কাজ রোগীর জন্য সঠিক ওষুধটা নির্বাচন করা। বিশেষ করে এই কাজটা আরো কঠিন এই জন্য যে মেটেরিয়া মেডিকাতে বহু সংখ্যক লক্ষণবিশিষ্ট বিভিন্ন ওষুধ, যাদের সংখ্যাও অনেক। ব্যাপক অধ্যয়ন ও নিষ্ঠার সাথে প্রয়োগ মারফৎ আমরা একটা ওষুধকে ঠিক যেমন চিনতে পারি, সেই রকম রোগীর রোগিলিপি অর্গাননে নির্দেশিত সূত্র ৮৩ থেকে ১০৪ অনুযায়ী তৈরী করে রোগী পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা বাড়িয়ে আমরা দক্ষ চিকিৎসক হতে পারি। লক্ষটা হচ্ছে সঠিক যায়গায় পৌঁছানো এবং উভয় ক্ষেত্রেই কি রোগীর জন্য কি ওষুদের জন্য। যেখানে কোন রকমভাবেই একজন রোগীকে আর একটা সেই রকম রোগী যেমন ভেবে নেওয়ার উপায় নাই, ঠিক সেই রকমভাবে একটা ওষুধের পরিবর্তে অন্য ওষুধ ব্যবহার করে রোগী দ্রুত আরোগ্য করারও কোন পথ নেই। হোমিওপ্যাথিতে বিকল্প কোন ওষুধ নির্বাচন করা যায় না। রোগীর জন্য নির্দিষ্ট ওষুধটা একপ্রকার সুন্দর স্বাতন্ত্রীকরণের দ্বারাই খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
Discussion about this post