ডা. আবু সাঈদ:
অনেকে মনে করে থাকেন, হোমিওপ্যাথিতে প্যাথলজি এবং সার্জারির তেমন কোন গুরুত্ব নেই। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানে কোন বিষয়ে জ্ঞান লাভে অবহেলা চিকিৎসকের জন্য গুরুত্বর অপরাধ। মহাত্মা হ্যানিমানের ভাষায়,
When we are dealing with a science which is concerned with the saving of life, it is crime to neglect its study.
যখন আমরা জীবনরক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট কোন বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করবো, সেখানে তার গবেষণাকে অবহেলা করা হচ্ছে অপরাধতুল্য।
আর তাই হোমিওপ্যাথির মূল চিন্তাপদ্ধতি- সামগ্রিকতা ও অখণ্ডতার বিচারে (Holistic Medicine System) কোনো কিছুকে পরিত্যাগ বা অবহেলা করার সুযোগ নেই।
হোমিওপ্যাথি চলমান চিকিৎসা ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে জটিলতম চিকিৎসা পদ্ধতি। কারণ এখানে রোগীর সামগ্রিক বিষয়কে মাথায় রেখে চিকিৎসা করা হয়, রোগীর লক্ষণের সামগ্রিকতাকে চিত্রায়িত করা হয়। অর্থাৎ এখানে রোগীর মন, বুদ্ধিবৃত্তি, আবেগ এবং দেহের সমন্বয়ের সামগ্রিকতা বিচার করে চিকিৎসা করা হয়। তাই এখানে কোনো একক বিষয়কে কেন্দ্র করে, তাকে বিচ্ছিন্ন হিসাবে বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। ঠিক একই কারণে কোনো বিষয়কে অপ্রাসঙ্গিক ভাবারও কোন সুযোগ নেই।
সুস্থ ও সমন্বিত চিন্তা থেকে বিচার-বিবেচনা করলে আমরা প্যাথলজি এবং সার্জারিকে কোনভাবেই অপ্রয়োজনীয় ও বিচ্ছিন্ন কিছু ভেবে পরিত্যাগ করতে পারিনা। মানুষের অসুস্থ অবস্থাটির বহিঃপ্রকাশ মানুষের দেহের বিভিন্ন স্তরে হতে পারে- কখনো এটি মানসিক স্তরে (Mental/Emotional Level) বেশি প্রদর্শিত হতে পারে, কখনো বা দৈহিক স্তরে (Organic Level)। আবার কখনো বা উভয় স্তর একইসাথে আক্রান্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে মানসিক স্তরে রোগের বিস্তারে প্যাথলজির মাধ্যমে আমাদের তেমন কোনো উপকার হয় না। কিন্তু দৈহিক সমস্যার ক্ষেত্রে প্যাথলজির মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি রোগীর দৈহিক সমস্যায় কোন যন্ত্রাংশ কীভাবে এবং কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক সময় এ সকল তথ্য চিকিৎসককে সঠিক নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কেউ হঠাৎ বাহির থেকে কোনো কিছু দিয়ে প্রবলভাবে আঘাত পেল। যায় ফলে তার দেহের ভিতরে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হলো। তখন প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট সঠিক অবস্থাটি জানতে সহায়তা করবে। এখন অনেকের মনেই এ প্রশ্নটি উঠতে পারে যে, তৎকালীন সময়ে অনেক বড় বড় চিকিৎসক এমনকি স্যামুয়েল হ্যানিম্যান নিজেও তেমন প্যাথলজিকাল পরীক্ষাপদ্ধতি খুব বেশি ব্যবহার করেননি। এখানে একটি বিষয় আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, তারা এসব কম ব্যবহার করেছে মানে এই নয় যে, তারা এর সমর্থন করতেন না। প্যাথলজিকাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পূর্ণটাই প্রযুক্তিগত উন্নতির সাথে যুক্ত। আর যেখানে ১৯৪৫ সালে টেলিভিশন আবিষ্কৃত হয়েছে, সেখানে হ্যানিমানের যুগ আমরা চিকিৎসাক্ষেত্রে প্রযুক্তির কোন অগ্রগতি আমরা আশা করতে পারি?
এখানে আরেকটি বিষয় স্মরণে রাখতে হবে যে, তখন রোগও এতো জটিল ছিল না। মানুষের কন্সটিটিউশনগুলো তুলনামূলক অনেকটা শুদ্ধ অবস্থায় থাকার দরুন গভীর প্যাথলজির হার বর্তমান সময়ের চাইতে কম ছিলো এবং তা ঔষধে অনেক সহজেই নিয়ন্ত্রণসাধ্য, আরোগ্যসাধ্য ছিলো। কিন্তু বতর্মানে নানাবিধ কারণে মানুষের রোগগুলি চরম জটিল আকার ধারণ করেছে। এখন রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে এবং চিকিৎসায় সফলতা লাভের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সর্তক থাকতে হয়। এবং প্যাথলজি হচ্ছে সেই সতর্কতার একটি উপায়।

বিজ্ঞান সর্বদা গতিশীল। হোমিওপ্যাথিও একটি বিজ্ঞান, জীবনের একটি সমন্বিত ও বৃহৎ বিজ্ঞান। কাজেই তাকেও কোনো নির্দিষ্ট অবস্থানে আটকে থাকা চলে না। ধরুন, একজন রোগী পিত্ত প্রদাহ (Cholecystitis) তীব্র ব্যথা নিয়ে আপনার কাছে আসলো। আর আপনি তার সমগ্র লক্ষণ সংগ্রহ করে তাকে ঔষধ দিলেন এবং তার উপশমও হলো। কিন্তু দেখা গেল কিছু দিন পর পর সেই একই সমস্যা নিয়ে রোগী আপনার কাছে আসতে লাগল। এবার আর ঔষধ প্রয়োগে আগের মতো উপশম হচ্ছে না। এ অবস্থায় যে কোনো হোমিওপ্যাথই জানেন, এবার তাকে রোগীর মায়াজমটিকে নিস্তেজ বা দূর করতে হবে। আপনি তার একটি আল্ট্রাসাউন্ড করলেন। প্যাথলজিক্যাল টেস্টের মাধ্যমে দেখা গেল তার পিত্তথলিতে বেশ বড় দুটি পাথর হয়েছে, অথবা সেখানে এক প্রকারের পঁচন-প্রবণতা (Suppuration) দেখা যাচ্ছে, কিংবা সেখানে তেমন কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি এখন নেই- এমনকি প্রদাহও আর দেখা যাচ্ছে না। তিনটি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত কী একই হবে? প্রথম অবস্থাটি সাইকোটিক প্রবণতা নির্দেশক, দ্বিতীয়টি সিফিলিটিক, আর শেষের অবস্থাটি সোরিক। এক্ষেত্রে এই রিপোর্ট আপনাকে এবং হোমিওপ্যাথি উভয়কেই অপযশের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেবে, হয়তো বহু সময়ক্ষেপণ ও দীর্ঘসূত্রিতা থেকে রক্ষা করবে।
প্যাথলজিক্যাল ডায়াগনোসিসের সাথে সাধারণ মানুষের কাছে একইভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে সার্জারির ব্যাপারটি। আগের প্রসঙ্গ ধরেই বলছি – পিত্তথলিতে পাথর হলে অন্যান্য চিকিৎসাপদ্ধতিতে তা নিরাময় অযোগ্য, সেখানে তার আরোগ্যকারী কোন ঔষধ নেই। কিন্তু হোমিওপ্যাথিতে কিন্তু ঘটনাটি ভিন্ন। কেইসটা ত্রুটিপূর্ণ চিকিৎসায় আরোগ্য অনুপযোগী না হলে, হোমিওপ্যাথ চিকিৎসার মাধ্যমে শুধু ঔষধ দিয়েই সারানো সম্ভব। এখানেই সার্জারির ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথির পদক্ষেপের একটি ভিন্নতার সূচনা হয়। আর সে ভিন্নতাটি হচ্ছে, হোমিওপ্যাথিতে ঔষধ প্রয়োগে আরোগ্যক্ষমতা বহুগুণ বেশি থাকায় সার্জারির শরণাপন্ন হবার চিন্তাটি আসে বহু পরে। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে, হোমিওপ্যাথিতে সার্জারি নেই। মহাত্মা হ্যানিমান বরঞ্চ সার্জারির ক্ষেত্রগুলো সম্বন্ধে নামোল্লেখ করে পরিচ্ছন্ন দিক-নির্দেশনা প্রদান করে গিয়েছেন।
প্রকৃত সত্য হচ্ছে, বিজ্ঞানের কোনো বিষয়, কোনো সম্পদই কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা কোনো নির্দিষ্ট ভূ-ভাগের জনগণের কুক্ষিগত সম্পদ নয়- তা সার্বজনীন। এর যে কোন বিষয়ের উপর পুরো মানবজাতির তা ব্যবহারের অধিকার থাকে। সার্জারি চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র শাখা- যে কোন চিকিৎসাপদ্ধতির চিকিৎসক প্রয়োজনীয় মুহূর্তে যার শরণাপন্ন হতে পারেন ও হওয়ার অধিকার রাখেন। যারা বলে থাকেন- হোমিওপ্যাথিতে সার্জারির কোনো প্রয়োজন নেই- এটি এ্যালোপ্যাথির বিষয়, তাদের অবগতির জন্য বলতে চাই তাদের এই স্থূল ধারণা অত্যন্ত অযৌক্তিক।
একটি শিশু একটি কয়েন গিলে ফেলেছে এবং এমতাবস্থায় শিশুটিকে আপনার কাছে নিয়ে আসা হলো। আপনি কি এখন তাদেরকে এই প্রশ্ন করবেন যে আপনার শিশুকে এ্যালপ্যাথি নাকি হোমিওপ্যাথি ট্রিটমেন্ট করবেন? অবশ্যই এই প্রশ্ন করবেন না। বরং বলবেন একে অপারেশন করতে হবে- ক্ষেত্রটি সার্জারির এবং কথাটি বলতে হবে- তা আপনি যে পদ্ধতির চিকিৎসকই হোন না কেন। কাজেই হোমিওপ্যাথিতে সার্জারির প্রয়োজন নেই এই কথাটি নিতান্তই অমূলক। তবে এধরনের দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে যেটি দায়ী তা হলো আমাদের হোমিওপ্যাথিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এসব বিষয়ে যথাযথভাবে অনুশীলনের পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকা। তাই এ সকল বিষয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দানের মাধ্যমে অনুশীলনের বিষয়গুলো নিশ্চিত করা খুবই জরুরি বলে আমি মনে করি। নয়তো মহাত্মা হ্যানিমানের বিবেচনায় আমরা সকলেই ক্রিমিনাল হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য হবো।
Discussion about this post