[লেখক ডা. অমরনাথ চক্রবর্তী এই লেখাটির জন্য বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন করেছেন ডা. জে. এন. কাঞ্জিলালের প্রতি, যার ‘Writings on Homoeopathy’ গ্রন্থের শিক্ষাকে তিনি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন এবং তিনি সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তাঁর শিক্ষাগুরু ডা. বিভা কাঞ্জিলাল ও ডা. তপন কাঞ্জিলালের প্রতি- যাদের ‘রেপার্টরি প্রসঙ্গে’ গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাকে তিনি সর্বদা অন্তরে ধারণ করেন। চলমান পর্বটিতে তিনি মূলত রেপার্টরির সুবিধা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেছেন]
হ্যানিম্যান রেপার্টরির জনক হলেও রেপার্টরি প্রথম প্রকাশ করেন ডা. বোনিংহাউসেন। তিনি হ্যানিম্যানের বন্ধু ছিলেন। তিনি ১৮৩২ খ্রিঃ রেপার্টরি অভ্ অ্যান্টিসোরিক রিমেডিজ প্রকাশ করেন । ১৮৩৫ খ্রিঃ তিনি রেপার্টরি অভ্ দি মেডিসিনস হুইচ আর নট অ্যান্টিসোরিক প্রকাশ করেন ।১৮৩৬ খ্রিঃ তিনি প্রকাশ করেন অ্যাটেমপ্ট অ্যাট শোয়িং দি রিলেটিভ কিনশিপ অভ্ হোমিওপ্যাথিক মেডিসিনস। ১৮৪৬ খ্রিঃ তিনি প্রকাশ করেন থেরাপিউটিক ম্যানুয়াল ফর হোমিওপ্যাথিক ফিজিশিয়ানস ফর ইউজ অ্যাট দি সিক অ্যান্ড ইন দি বেড। এই চারটি বইকে একত্রিত করে জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হয় বোনিংহাউসেনের শ্রেষ্ঠতম অবদান থেরাপিউটিক পকেট বুক।
ডা. হ্যানিম্যান থেকে শুরু করে বোনিংহাউসেন ও বোগার হয়ে রবার্টস পর্যন্ত দার্শনিক চিন্তার জগতে একটি পরম্পরা চলে এসেছে। ডা. কেন্ট তাঁর সামান্য পরিবর্তিত দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা জগতে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেন যা তার বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে এবং এর বিশেষ প্রতিফলন পাই তাঁর রেপার্টরিতে।
রেপার্টরির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে এবার আলোচনা শুরু করবো। আমি রেপার্টরি শিখেছি প্রয়াত ডা. কে সি দাস এর কাছে। আমার জীবনে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হল- হোমিওপ্যাথ হতে হলে যে সব চারিত্রিক গুণের প্রয়োজন, তা তিনি বারে বারে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিতেন। এমন দেবতুল্য মানুষ খুবই বিরল। রোগীর কাছ থেকে কিভাবে লক্ষণ সংগ্রহ করতে হবে এবং তা কিভাবে লক্ষণ শিরোনামে পরিবর্তিত হবে, রোগীর সামনে বসিয়ে শিখিয়েছেন- যা আমার জীবনে এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। তাঁকে প্রণাম জানাই।
সদৃশ ওষুধটি খুঁজে পাবার ক্ষেত্রে একটি বা একাধিক বিশেষ লক্ষণ কোন কোন ওষুধে আছে তা জানতে সাহায্য করে। ধরা যাক একটি ছেলে বলল, “ডাক্তারবাবু, আমি একটি মেয়েকে ভালবাসতাম- সেই সম্পর্ক কেটে যাবার পর থেকেই সব কষ্টের শুরু”। ধরা যাক এটা ব্যর্থ প্রেমের কথা অর্থাৎ ব্যর্থ প্রেম এখানে রোগের উত্তেজক কারণ। ব্যর্থ প্রেম বলতে আমরা সাধারণত IGN, NAT-MUR-এর কথা ভাবি কিন্তু ডা. কেন্টের রেপার্টরিতে যদি, “LOVE AILMENTS, FROM DISAPPOINTED” Rubric টি দেখি, তাহলে দেখতে পাবো সেখানে ১৮টি ওষুধ আছে । সুতরাং স্বাভাবিকতার বিচারে বলতেই পারি এর মধ্যে যে কোন একটি ওষুধ সদৃশ হতে পারে।
(১) রেপার্টরির সাহায্যে ওষুধগুলিকে তুলনামূলক ভাবে পড়ার ফলে মেটিরিয়া মেডিকার জ্ঞানের গভীরতা বাড়ে।
(২) অনেক সময় নতুন ওষুধ ভাবতে বা পেতে সাহায্য করে যা রোগী দেখার পরে আমাদের মনে আসে না।
(৩) রেপার্টরির জ্ঞান যে চিকিৎসকের যতই গভীর ততই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সদৃশ ওষুধটি নির্বাচনের জন্য সঠিক প্রশ্ন করতে পারেন। মায়াজমের জ্ঞান গভীর হলে প্রশ্নের গভীরতার সঙ্গে তীক্ষ্মতা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। মানব মনের বিচ্যুতিগুলি আরো পরিষ্কার, স্পষ্ট ও সূক্ষাতিসূক্ষ ভাবে অনুভব করা যায়। আমি ব্যর্থ প্রেমের কথা আগেই বলেছি। একটু বিশদ আলোচনা করলে, রোগীর চরিত্রগত লক্ষণের বৈশিষ্ট্যগুলি অনুধাবন করলে, বিষয়টি দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমরা জানি- কারণ এক হলেও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের জন্য ফল ভিন্ন ভিন্ন হয়। সম্পর্কটি কেটে যাওয়া নয় বরং কি ভাবে কাটলো এবং মনে কি ছাপ ফেলল তার সঠিক চিত্রায়ন আমাদের বিমূর্ত শিল্পীতে পরিণত করবে। আমি মনে করি প্রত্যেক হোমিওপ্যাথ হচ্ছেন বিমূর্ত শিল্পী।
মনের লক্ষণ রোগীর কাছ থেকে বার করা কঠিনতম কাজ। কিন্তু এই কাজটি যথাযত করতে পারলে কঠিনতম রোগগুলি সহজেই আরোগ্য বা উপশম হয়। প্রশ্ন করার বিষয়ে চিকিৎসককে সৃষ্টিশীল হতে হবে। আমি এখানে রোগীর কাছে প্রাপ্ত ঘটনাগুলিই বলছি-
ঘটনা: আমার প্রেমিকা মামাতো বোনের বিয়েতে গিয়েছিল। বিয়ের দিন সন্ধ্যাবেলায় তার মামাতো বোন প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যায় একটি চিঠি রেখে এবং এই রকম পরিস্থিতিতে উভয় পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্য বিয়ে হয়। মেয়েটার কোন দোষ নাই।
প্রশ্ন- তোমার কষ্ট কি?
উত্তর:
(ক) বড় একা লাগে কোন কিছু ভাল লাগে না।
FORSAKEN FEELING (Abandoned or Deserted or friendless)
(খ) আমি ওকে ছেড়ে বাঁচবো কি করে? ওযে চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবে আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি নি।
GRIEF (emotion of losing something for ever) মৃত্যু হলেই Grief হবে এরকম বদ্ধমূল ধারণা অনেকের আছে। অনেকে মৃত্যু শোক পান না। আসলে চিরদিন হারাবার বেদনা থাকলেই Grief হবে। টাকা, জমি ইত্যাদি হারালেও Grief হবে।
(গ) আমার কপালটাই খারাপ সবই ভাগ্য।
UNFORTUNATE FEEL
আবার রেপার্টরিতে SILENT GRIEF বলে একটি কথা আছে। আসলে এটা কি? দুঃখ পেলে অনেকে কাঁদতে পারে না। কষ্ট পেলেও এদের চোখে জল বের হয় না। এটাকেই SILENT GRIEF বলে।
ঘটনা: ডাক্তার বাবু, আমার প্রেমিকার বাবা স্থানীয় নেতাকে সঙ্গে নিয়ে আমার বাড়ীতে এসে আমার বাবা-মাকে যাচ্ছেতাই করে অপমান করেছে তার ফলে সম্পর্ক কেটে গেছে।
প্রশ্ন: তোমার কষ্ট কি?
(ক) উত্তর: আমি এই অপমানের জ্বালা কিছুতেই ভুলতে পারছি না।
MORTIFICATION AILMENTS AFTER.
(খ) উত্তর: আমি যতদিন পর্যন্ত এই অপমানের প্রতিশোধ না নিতে পারছি ততদিন পর্যন্ত আমার মনে শান্তি নাই।
MORTIFICATION AILMENTS AFTER + MALICIOUS.
ঘটনা: মেয়েটি দুদিনের জ্বরে মারা গেছে।
প্রশ্ন: তোমার কষ্ট কি?
উত্তর: আমি কিছুতেই মন থেকে মানতে পারছি না। ও কোথায় নেই ভাবলেই চোখে জল আসে। GRIEF.
ঘটনা: মেয়েটি অন্য একটি ছেলের সঙ্গে কথা বলেছিল। সেই জন্য ওর সাথে খুব ঝগড়া হয় এবং মেয়েটি আত্মহত্যা করে।
প্রশ্ন: তোমার কষ্ট কি?
উত্তর: আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না। শুধু মায়ের মুখ চেয়ে কিছু করি নাই।
SUSPICIOUS, REMORSE.
ঘটনা: ডাক্তারবাবু মেয়েটি নিচু জাতের সেই কারণে আমার বাবা ও মা কিছুতেই আমাদের সম্পর্ক মেনে নেবেন না। আমি বিয়ে করলে আত্মহত্যা করবার হুমকি দিয়েছেন। আমি সে কথা তাকে বলেছি। আমার অক্ষমতার জন্য ক্ষমা চেয়েছি। কিন্তু তার অন্যত্র বিয়ে হবার পর সব কিছু ওলোট-পালট হয়ে গেল।
প্রশ্ন: তোমার কষ্ট কি?
উত্তর: ডাক্তারবাবু, আমি তাকে কিছুতেই ভুলতে পারছি না। নিজেকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছে আর খুব কষ্ট পাচ্ছি। বাবা-মার ওপর খুব রাগ, কিছুতেই তাদের অন্যায় মানতে পারছি না। বাবা ও মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। বাবা- মা বলে ডাকতে ইচ্ছা করছে না। এই ঘটনার পর থেকেই আমি আর ভাল নাই-
এই ঘটনা বিশ্লেষণ করলেই বাবা-মায়ের বিশেষ চরিত্র প্রকাশ পাবে-
এটা কুসংস্কার হতে পারে, অহঙ্কার হতে পারে, আবার ঘৃণার প্রকাশ হতে পারে।
(১) যখন বংশ মর্যাদা বা আর্থিক তুলনার মাধ্যমে ছোট-বড় ভাবা হয় তখন সেটা অহঙ্কারের (EGOTISM) প্রকাশ।
(২) বহু শতাব্দীর ধর্মীয় প্রথার জন্য মানুষকে ছোট বড় বিভিন্ন কৃত্রিম ভাগে ভাগ করা হয়েছে যা বর্তমান যুগে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অনেকেই মানে না। আমার বিনীত প্রশ্ন- সূর্য কি কোন ব্যক্তিকে কম আলো দেয়? বর্তমান যুগের বিচারে এটা হবে- অন্ধবিশ্বাস। ভেবে দেখুন নিজের সন্তানের আনন্দময় জীবনের থেকে তার ধর্মবিশ্বাসের মূল্য অধিক। একে SUPERSTITION বলে রেপার্টরিতে বলা হয় SUPERSTITIOUS.
(৩) এই অন্ধবিশ্বাসের সঙ্গে যখন ঘৃণা যোগ হবে তখন রেপার্টরির ভাষায় হবে MISANTHROPY.
(৪) যখন এই ঘৃণার মাত্রা তীব্র হয় তখন খুন করতেও দ্বিধাবোধ করে না। তখন একে বলে FANATICISM , দাঙ্গা লাগার অন্যতম কারণ।
এই লক্ষণগুলিকে পরিবারের ইতিহাসে আমি স্থান দিই। পরিবারে রোগের ইতিহাসের থেকেও ঐ মানসিক লক্ষণগুলি ওষুধ নির্বাচনে খুবই সাহায্য করে।
এবার ছেলেটির কথায় ফিরে আসি। ছেলেটি যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন কিছু মানুষ তার বিরূপ সমালোচনা করবেই। এখানে ছেলেটি বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন বলে নিজের কষ্টকে উপেক্ষা করে উৎসকে (বাবা ও মা) মান্যতা দিয়েছে। ছেলেটির এই অপরাধবোধকে রেপার্টরির ভাষায় বলে, ANXIETY, CONSCIENCE OF (AS IF GUILTY OF A CRIME)। আবার বাবা-মার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না বা ডাকতে পারছি না বা ক্ষমা করতে পারছি না এই সব অনুভূতি সবগুলিকেই ঘৃণার প্রকাশ বলা যায় অর্থাৎ HATRED।
ঘটনা: ডাক্তারবাবু ওর সঙ্গে স্বামী- স্ত্রীর সম্পর্ক ছিল। ওর বাবা দেশে নিয়ে গিয়ে অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। আর যোগাযোগ নেই।
প্রশ্ন: তোমার কষ্ট কি?
উত্তর: ডাক্তারবাবু সারারাত উত্তেজনার জন্য ঘুমাতে পারি না।
প্রশ্ন: উত্তেজনা বলতে কি বলতে চাইছ?
উত্তর: স্যার, যৌন উত্তেজনা । আমাদের মধ্যে ভালবাসা ছিল বলেই তো এই সম্পর্ক হয়েছিল।
প্রশ্ন: তোমার ভালবাসার বিশেষ মুহূর্ত কিছু মনে পড়ে?
উত্তর: সে তো মনে পড়ে অবশ্যই।
প্রশ্ন: যৌন বিষয় বা অন্য বিষয়ের মধ্যে কোন কথা বেশি মনে পড়ে?
(কোন বিষয় বেশি মনে পড়ে এর বিশেষ গুরুত্ব আছে। INTENSITY OF SYMPTOM এর বিশেষ গুরুত্ব আছে। এটা অনেক ক্ষেত্রেই DOMINANT MIASM টিকে চিহ্নিত করে ওষুধ নির্বাচনে। এটা লক্ষণের গুণগত মান অর্থাৎ RANK কে বোঝায় যা GRADE এর থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।)
উত্তর: স্যার, যে বয়সে যা মনে পড়া উচিৎ সেটাই মনে পড়ে। অন্য কথাও মাঝে মাঝে মনে পড়ে তখন খুব খারাপ লাগে।
প্রশ্ন: কতটা খারাপ লাগে?
উত্তর: স্যার আপনি কান্নার কথা বলছেন কি? স্যার কান্না আমার আসে না। মেয়েদের মতো (EGOTISM?) কাঁদতে পারি না।
(এখানে ভালবাসার ‘ভ’ নেই তাই LOVE DISAPPOINTMENT কখনোই হবে না। এখানে LOSS OF SLEEP এর গুরুত্ব খুবই কম, কারণ এটা REFLEX SYMPTOM। এখানে হবে- SEXUAL DESIRE, SUPRESSION OF AGG.)
প্রশ্ন: উত্তেজনা হলে কি করো?
উত্তর: স্যার প্রায়ই হস্তমৈথুন করি।
এখানে MASTURBATION, DISPOSITION ধরা চলবে না কারণ এটা বিকল্প উপায় হিসাবে ছেলেটি গ্রহণ করেছে। এখানে স্বাস্থ্য খারাপ হলে বা বিশেষ দুর্বলতা থাকলে আমরা LOSS OF FLUIDS ধরতে পারি। SUPPRESSION OF SEXUAL DESIRE বিধবা বা আধুনিক কুমারী মেয়েদের মধ্যে প্রচুর পাওয়া যায়।
Discussion about this post