অনুবাদকঃ ডা. শাহীন মাহমুদ
আমাকে অসাধারণ লক্ষণগুলোর ব্যাপারে কিছু লিখতে অনুরোধ করা হয়েছে কিন্তু এ ব্যাপারে আমার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার আগে, হ্যানিমান এ সম্বন্ধে কি বলেছেন তা দেখে নিতে চাই। অর্গানন অব মেডিসিনের ১৫৩ নং এফোরিজমে হ্যানিমান বলেন- “হোমিওপ্যাথিক মতে সুনির্দিষ্ট ঔষধ অনুসন্ধ্যানের জন্য, অর্থাৎ চিকিৎসাধীন রোগের সদৃশ একটি কৃত্রিম রোগ-সৃষ্টিকারী ঔষধ নির্বাচন করার জন্য, পরিচিতি ঔষধগুলোর লক্ষণের সাথে প্রাকৃতিক রোগের সামগ্রিক লক্ষণগুলোর তুলনা করতে হলে- রোগীর অধিকতর সুস্পষ্ট, একক, অনন্য এবং অদ্ভুত সংকেত ও লক্ষণগুলোর প্রতি বিশেষরূপে ও সর্বতোভাবে লক্ষ রাখতে হবে। কারণ আরোগ্যসাধনের জন্য সবচেয়ে উপযোগী ঔষধ নির্বাচন করতে হলে বিশেষত এইগুলির সাথে নির্বাচিত ঔষধের লক্ষণগুলোর অত্যন্ত সাদৃশ্য থাকা বাঞ্ছনীয়।”
হোমিওপ্যাথি শিক্ষাপ্রদানে এই এফোরিজমটির বোধহয় সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে। কারণ এই এফোরিজমটি না থাকলে হোমিওপ্যাথির যথাযথ শিক্ষাটা অসম্ভব হয়ে যেতো। হোমিওপ্যাথির মূলনীতি “Similia Similibus curentur” অর্থাৎ, ‘সদৃশ আরোগ্য হয় সদৃশ দ্বারা’। কিন্তু হোমিওপ্যাথিক মেটেরিয়া মেডিকাতে- দলবদ্ধ প্রুভারদের থেকে পাওয়া এবং মাথা থেকে পা পর্যন্ত অঞ্চল অনুযায়ী সাজানো বিপুল সংখ্যক লক্ষণের দরুন- এই সাদৃশ্যতাটিতে পৌঁছানো অতি মুশকিল। কিছু সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকলে এই প্রুভিংগুলো থেকে কোন চিত্র বের করে আনা ভীষণ কঠিন।
এই এফোরিজমটিতে হ্যানিমান জোর দিয়ে বলেন যে, ঔষধ নির্বাচনে এই বিশেষ, অনন্য, বিরল ও অদ্ভূত লক্ষণ এবং চিহ্নগুলি মূখ্যত তাৎপর্যপূর্ণ। অন্যভাবে বলতে গেলে, আরোগ্য করতে চাইলে নির্বাচিত ঔষধকে এই প্রকারের লক্ষণগুলোকে অবশ্যই পরিবৃত করতে হবে। যদি নির্বাচিত ঔষধের দ্বারা শুধুমাত্র রোগ-লক্ষণগুলি আস্তীর্ণ হয়, তাহলে কেবলমাত্র উপশমই ঘটতে পারে- আরোগ্য বোধহয় সম্ভব হবে না, কারণ হোমিওপ্যাথিতে কোন রোগের জন্য সুনির্দিষ্ট ঔষধ নেই। হোমিওপ্যাথি মানুষ বা রোগীর স্বাতন্ত্র্যতাতে বিশ্বাস করে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রীকরণের প্রচেষ্টা না করা যেতে পারলে, কোন ঔষধই নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। হ্যানিমান উপর্যুক্ত লক্ষণগুলোকে ‘চারিত্রিক’ বলে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন, অর্থাৎ যে লক্ষণগুলো একটি রোগী বা ঔষধকে (চারিত্রিকভাবে) স্বতন্ত্র করে। এ কারণে, আমি বিশ্বাস করি- হোমিওপ্যাথিক প্রেসক্রাইবিংয়ে সফলতার সূত্রটি এই এফোরিজমটিতে লুকায়িত আছে।
আমি লুকায়িত বলেছি কারণ আমরা এই এফোরিজমটি আমাদের হোমিওপ্যাথিক শিক্ষার সারাটা কোর্সজুড়ে পড়ি ও শিখি। কিন্তু সত্যিই কি এই এফোরিজমটিকে আমরা আমাদের অনুশীলনে সফলভাবে ব্যবহার করি? বোধহয় না। অবধারিত ফল হচ্ছে- রোগ-কেন্দ্রিক প্রেসক্রাইবিং এবং পলিফার্মাসি (একাধিক ঔষধ একত্রে প্রদান)।
আমার আলোচ্য বিষয়- অসাধারণ, অদ্ভূত লক্ষণসমূহ এবং হোমিওপ্যাথিক প্রেসক্রাইবিংয়ে তাদের ব্যবহার। একটি অনন্য লক্ষণ হচ্ছে সেই লক্ষণ যা সাধারণত একটি রোগে অথবা একটি ঔষধের রোগলক্ষণে প্রত্যাশা করা হয় না। জ্বরের ক্ষেত্রে পিপাসাটি সাধারণত প্রত্যাশিত। কিন্তু এর অনুপস্থিতিটি অসাধারণ, সুতরাং লক্ষণীয়। ঔষধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমরা এ ধরণের লক্ষণগুলোকে উপেক্ষা করতে পারি না। এটা আরো তাৎপর্যপূর্ণ হয় যদি অতি-উত্তাপযুক্ত জ্বরের ক্ষেত্রে তা উপস্থিত থাকে- যেখানে তাপমাত্রা ১০৪ বা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট। সামগ্রিক শোথের সাথে পিপাসা একটি অসাধারণ লক্ষণ। কিন্তু এটা অদ্ভূত (লক্ষণ) হবে যদি রোগী অল্প কিছুক্ষণ পর পরই অধিক পরিমাণ করে পানি চায়। এ প্রকারের অদ্ভূত লক্ষণগুলো একজন রোগীকে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র করতে সহায়তা করে, যা ঔষধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবহেলা করা যায় না।
ইগ্নেশিয়া একটি ঔষধ, যা এ প্রকারের অদ্ভূত লক্ষণে পূর্ণ, যেমন- গলার ব্যথা ঢোক গিললে উপশম, অর্শ্বের ব্যথা হাঁটলে উপশম, পাতলা পায়খানার সাথে মলদ্বারের বহিঃনির্গমন এবং এরকম আরো অনেক। এ প্রকারের বহু অদ্ভূত লক্ষণ আমাদের মেটেরিয়া মেডিকাতে আছে- যা একজন রোগীকে স্বাতন্ত্রীকরণে আমাদের সাহায্য করে, যেখানে হোমিওপ্যাথির শিক্ষাই হচ্ছে- রোগ নয়, রোগীর চিকিৎসা করা। কিন্তু যথাযথ পর্যবেক্ষণের অভাবে প্রায়শই আমরা এ প্রকারের লক্ষণগুলো লক্ষ করতে ব্যর্থ হই। এখানটাতেই হোমিওপ্যাথির নৈপুণ্য লুকায়িত। হ্যানিমান বলেন যে, একজন হোমিওপ্যাথকে অবশ্যই একটি প্রখর পর্যবেক্ষণকরী হতে হবে। এই পর্যবেক্ষণে চাই- নিবিড়ভাবে লক্ষ করা, গভীর তীক্ষবুদ্ধিযুক্ত উপলব্ধি এবং সাধারণভাবে সমস্ত চিকিৎসা বিষয়ক জ্ঞানে, বিশেষ করে হোমিওপ্যাথির সমস্ত বিষয়ের উপর ধারণা। রোগীর রুটিনমূলক পরীক্ষা এবং অতীত সম্বন্ধে একটি সাধারণ অনুসন্ধ্যান হয়তো সাধারণীকরণে (Generalization) সাহায্য করতে পারে কিন্তু সম্ভবত কোন স্বাতন্ত্রীকরণ (Individualization) তাতে সম্ভব হবে না। কয়েকটি উদারহণ দিয়ে ব্যাপারটিতে আলোকপাত করা যাক-
১. একটি আমাশয়ের কেইসে স্বল্পবিরতিতে প্রচুর পরিমাণ ঠাণ্ডা পানির পিপাসা থাকতে পারে, যা আমাদের ফসফরাসের কথা মনে করিয়ে দেবে। কিন্তু তার মাথা ও মুখসহ- নিজেকে ঢেকে রাখার ইচ্ছের সাথে ভীষণ শীতবোধও থাকতে পারে, যা আমাদের নাক্স-ভমকে মনে করিয়ে দেবে। পেটে কিছু ঢুকলেই তার রক্তযুক্ত পায়খানাও থাকতে পারে, যা মনে করাবে আর্সেনিক এল্বামের অথবা যে ঔষধের এরকম লক্ষণ আছে- তার কথা। কিন্তু যদি চিকিৎসক রোগীর পাশে বসে তাকে সতর্কভাবে লক্ষ করেন, তিনি হয়তো তিনটি বিষয়যুক্ত একটি অদ্ভূত লক্ষণ খূঁজে পাবেন, যা হচ্ছে- তীব্র পিপাসাযুক্ত আমাশয়, পানি পান করলে শরীরে কাঁপুনির সৃষ্টি হয় এবং প্রতিবার পানি পান করার পর রোগীর পায়খানা হয়। আমরা সবাই জানি যে এ অদ্ভূত লক্ষণগুলো একমাত্র ঔষধ ক্যাপ্সিকামকে নির্দেশ করে।
২. একটি আথ্রাইটিসের কেইসে হয়তো ঠাণ্ডা প্রয়োগে উপশম থাকতে পারে, যা আমাদের পালসেটিলার মতো একটি ঔষধকে মনে করিয়ে দেবে। কিন্তু আমাদের পর্যবেক্ষণে প্রকাশ পেতে পারে যে, আক্রান্ত জয়েন্টটি স্পর্শে বরফের মতো ঠাণ্ডা, যা একমাত্র লিডাম প্যালেস্টারকে নির্দেশ করে।
৩. চরম অবসন্নতার (Collapse) একটি কেইসে পোষাক খুলে রাখার ইচ্ছার ক্ষেত্রে সিকেলি বা ক্যাম্ফর চিন্তায় আসতে পারে। কিন্তু যদি দেহের উপরিভাগ স্পর্শে বরফ-শীতল বোধ হয়, তবে তা কেবলমাত্র ক্যাম্ফরকেই নির্দেশ করে। কিন্তু তাতে কাজ না হলে, এটা মেডোরিনামকে ইঙ্গিত করে।
৪. বেদনাদায়ক হওয়া উচিৎ ছিলো কিন্তু তা ব্যথাহীন- এরকম ক্ষেত্রটি আর্নিকা, অপিয়াম এবং স্ট্রামোনিয়ামের কথা মনে করিয়ে দেয়। গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের পৃথক করা যেতে পারে।
৫. যদি আমরা রোগীকে পর্যবেক্ষণ করার প্রতি যত্নবান হই, অচেতন অবস্থার সাথে কোঁকানো- সহজেই মিউরিয়াটিক এসিডের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
৬. মানসিক বিষণ্নতা বহু রোগের সাথে যুক্ত একটি সাধারণ লক্ষণ। কিন্তু অরাম মেটালিকামের এই বিষণ্নতা এবং নৈরাশ্য একজন আন্তরিক পর্যবেক্ষকের মনোযোগ এড়াতে পারে না।
৭. যদি চিকিৎসক রোগীর ঢেকে-ঢুকে থাকার ইচ্ছাকে উপেক্ষা না করেন- অস্থিরতার সাথে জ্বালাপোড়া, আর্সেনিকাম এল্বামকে নির্দেশ করতে পারে।
৮. ব্যথার সাথে শীতবোধ, ঋতুস্রাবের সময়ে বা আগে গলাব্যথা, ঋতুস্রাবের সময় বা আগে কলেরার মতো লক্ষণ, কাশির সময় দূরবর্তী অঙ্গে ব্যথার মতো সহগামী লক্ষণগুলোর সবই অদ্ভূত লক্ষণ এবং তাদের সনাক্তকরণে নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। আমাদের মেটেরিয়া মেডিকাতে এ প্রকারের বহু অদ্ভূত লক্ষণ বিদ্যমান।
মনোযোগ আকর্ষণ করার মতো হলে অনেক বিভ্রম, অসাধারণ মনো-সার্বিক, স্থানীয়-অনন্য এবং সহগামী ইত্যাদি লক্ষণগুলো ‘অদ্ভূত’ শিরোনামের অধীনে শ্রেণিবদ্ধ করা যেতে পারে। প্যাথলজির জ্ঞান দ্বারা যে লক্ষণগুলোকেই ব্যাখ্যা করা যায় না, সেগুলোকেই অসাধারণ বা অদ্ভূত লক্ষণ হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই লক্ষণগুলোকে আমরা যতবেশি আলাদা করতে শিখবো, ততবেশি সফল আমরা হবো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বর্তমানে আমরা নির্দিষ্ট রোগগুলোর জন্য নির্দিষ্ট ঔষধ প্রেসক্রাইব করতে এবং রোগীর জীবনের বিনিময়ে হলেও অবদমন ও উপশমের পেছনে ছুটতে মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছি। তথাপি আমরা দাবী করি যে, এই এপ্রোচগুলির মাধ্যমে হোমিওপ্যাথির আধুনিকায়ন হচ্ছে। আমরা যদি আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সচেতন ও সতর্ক না হই, হোমিওপ্যাথি হয়তো আমাদের দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
Discussion about this post