
ডা. শাহীন মাহমুদ:
হোমিওপ্যাথিক এগ্রাভেশন (Homeopathic Aggravation) বা হোমিওপ্যাথিক উপচয় বা বৃদ্ধি শব্দটি আমাদের হোমিওপ্যাথিক সমাজে বহুল পরিচিত। কেবল চিকিৎসকগণই নন- রোগীদের মধ্যেও একটি বদ্ধমূল ধারণা ‘হোমিওপ্যাথিক ঔষধ খেলে প্রথমে বাড়ে’, ‘যে ঔষধ খেলে বাড়বে- সেটাতেই পরে সেরে যাবে’ ইত্যাদি। চিকিৎসকদের মাঝেও বহুপ্রকারের ধারণা দেখতে পাওয়া যায়- ‘ঔষধ বৃহৎমাত্রায় দিলে এগ্রাভেশন দেখা দেয়’, ‘নিচের দিকের পোটেন্সি দিলে এগ্রাভেশন হবে, মেটাসটাসিস হবে’, ‘উচ্চ-পোটেন্সির ঔষধ দিলে এগ্রাভেশন হবে, দাঁত-চুল পড়ে যাবে’, ‘এক মাত্রার বেশি কখনোই প্রয়োগ করা যাবে না- দিলেই এগ্রাভেশন হবে’, ‘এগ্রাভেশন-টেশন কিছু না- সারালে সারায়, না সারাতে পারলে বাড়ে’ ইত্যাদি।
রোগীদের ধারণাগুলো ভুল-শুদ্ধ নির্ধারণ করে তাকে সঠিক জ্ঞান করা ও তাদের সঠিক তথ্যে সমৃদ্ধ করা চিকিৎসকদের দায়িত্ব। কিন্তু আমাদের চিকিৎসকগণ কি এই এগ্রাভেশনের ধরণ-ধারণ, প্রকার সম্বন্ধে সচেতন! আমার দেখা অনেক চিকিৎসকই এ ব্যাপারে ন্যূনতম ধারণাও রাখেন না, অনেকে ভুল ধারণা রাখেন- আবার এমন অনেক ধারণা আমাদের বই-পত্রেও পাই, যেগুলোকে আমার ভুল মনে হয়। আর এ কারণেই আজ আমি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাক্ষেত্রে এগ্রাভেশনের ধরণগুলো পর্যালোচনা করবো।
প্রথমেই বলে নিচ্ছি- আমার মতে, ‘হোমিওপ্যাথিতে এগ্রাভেশন বা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাক্ষেত্রে এগ্রাভেশন’ ও ‘হোমিওপ্যাথিক এগ্রাভেশনে’র মাঝে একটু পার্থক্য রয়েছে। আমি মনে করি, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাক্ষেত্রে ভুল বা বিসদৃশ ঔষধের দরুন যদি এগ্রাভেশন ঘটে থাকে, তাকে হোমিওপ্যাথিক এগ্রাভেশন বলা যৌক্তিক নয়। ইদানিং অনেকেই এই ‘Dissimilar Aggravation’ এর ধারণাটির ব্যাপারে অবশ্য আলোচনা করছেন।

যাই হোক, আলোচনায় ও বোধগম্যতায় সুস্পষ্টতার খাতিরে, প্রথমেই আমি এ দু’টোর সংজ্ঞায়ন করে নিচ্ছি-
১. হোমিওপ্যাথিক এগ্রাভেশন (Homeopathic Aggravation): সম্পূর্ণ (Similimum) বা আংশিকভাবে (Similar) লক্ষণসাদৃশ্যে ঔষধ প্রয়োগ করার পর বিভিন্ন কারণে যে এগ্রাভেশনগুলো ঘটে, সেটাই হোমিওপ্যাথিক এগ্রাভেশন- তা সেটা যে ‘প্যাথি’-র নাম স্মরণ বা উচ্চারণ করেই দেয়া হোক না কেন।
২. অ-হোমিওপ্যাথিক এগ্রাভেশন (Non-Homeopathic Aggravation or Dissimilar Aggravation): ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ হিসাবে ভুল অথবা বিসদৃশ ঔষধ প্রয়োগের দরুন যে এগ্রাভেশন ঘটে তাকে অ-হোমিওপ্যাথিক এগ্রাভেশন বলা যায়- তা সেটা যে ‘প্যাথি’-র চিকিৎসকই প্রদান করে থাকুন না কেন।
আমি এদেশের বহুল-প্রচলিত একটি হোমিওপ্যাথিক টেক্সটবইতে এমন ধারণাও শিক্ষার্থীদের শেখাতে দেখেছি- যেখানে বলা হয়েছে, হোমিওপ্যাথিক এগ্রাভেশন দুই ধরণের, একটি হোমিওপ্যাথিক এগ্রাভেশন – যা জীবনীশক্তি কর্তৃক ঔষধের শক্তির প্রাবল্যের দরুন সৃষ্টি হয়, আর অন্যটি মেডিসিনাল। ভালো কথা- এ দু’ধরণের এগ্রাভেশন যে হোমিওপ্যাথিতে আছে সন্দেহ নেই কিন্তু কেবল কি এই দুই ধরণেরই এগ্রাভেশন? মেডিসিনাল এগ্রাভেশন কি হোমিওপ্যাথিক এগ্রাভেশন নয়? যদি আরো ভিন্ন ভিন্ন রকম এগ্রাভেশন থেকে থাকে এবং পাঠ্যপুস্তকে ও শিক্ষালয়ে যদি শিক্ষার্থীগণ এই দুটো ধরণকে শিখে- তারপর সমস্ত রোগীতে ‘কুমীরের এই খাঁজ কাটা লেজটি’কে বসাতে থাকে- তাহলে শেষমেষ অবস্থা কি দাঁড়াবে?
হোমিওপ্যাথিক দর্শনের প্র্যাকটিক্যাল প্রয়োগটি এই চিন্তাগুচ্ছের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। হেরিংয়ের ল’, কেন্টের বা ভিথোলকাসের অবজারভেশনগুলোকে উপলব্ধি করতে হলে- এই এগ্রাভেশন ফ্যাক্টরটিকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে চিনতে হবে, জানতে হবে। আমি এমনও চিকিৎসক দেখেছি- যারা হোমিওপ্যাথিক দর্শনের এই বিষয়টি না বোঝার দরুনই পুরো চিকিৎসাকে বিশৃঙ্খল করে ফেলেছেন, অসংখ্য কেইস ডিসরাপ্ট করেছেন, বহুরোগীর জীবনের অন্যায়ভাবে ক্ষতিসাধন করেছেন। আর এ সমস্যাগুলো থেকে রক্ষা পাবার লক্ষ্যেই আমাদের শাস্ত্রে ও আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় যে যে প্রকারের এগ্রাভেশনগুলোকে আমি প্রত্যক্ষ করেছি- সেগুলো আমি সংক্ষেপে বর্ণনা করার চেষ্টা করছি। প্রথমেই বলে নিই- এর অনেকগুলো ধরণকে হয়তো অনভিজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নতুন বা আশ্চর্যজনক মনে হবে। সন্দেহজনকও মনে হতে পারে। বস্তুত আমি হোমিওপ্যাথিতে যখন নতুন প্রবেশ করি, তখন এগুলোকে আমিও সন্দেহজনক বা আশ্চর্যজনক দৃষ্টিতেই দেখেছি কিন্তু যতই দিন গিয়েছে- আমাদের দর্শনের অভ্রান্ততা আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে। এখন অন্তত ব্যক্তিগতভাবে আমি আমাদের দর্শনের উপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করতে পারি।
প্রথমে আমি মূলত হোমিওপ্যাথিক এগ্রাভেশনগুলো নিয়ে আলোচনা করছি-
১. ঔষধজ এগ্রাভেশন (Medicinal Aggravation): চিন্তার জগতে জট বাঁধিয়ে বিবেচনা না করলে, এই এগ্রাভেশনটি নিছক ঔষধ থেকেই সৃষ্টি। এটি হোমিওপ্যাথিক ও নন-হোমিওপ্যাথিক দু’ধরণেরই হতে পারে। মোদ্দাকথাটি হচ্ছে- এখানে আপনি যে ঔষধটি রোগীকে প্রদান করেছেন, সরাসরি তার ফিজিওলজিক্যাল, কেমিক্যাল ক্রিয়া রোগীর মাঝে বৃদ্ধি সৃষ্টি করেছে। বলাই বাহুল্য, হোমিওপ্যাথিতে কেবলমাত্র নিম্নশক্তির ঔষধের দ্বারাই এই এগ্রাভেশনটি হতে পারে। অর্থাৎ, যতটুকু শক্তিসীমাতে ঔষধজ উপাদান থাকবে, বলা চলে সর্বোচ্চ ১২c, বা ২৭x শক্তি পর্যন্ত এই এগ্রাভেশনটি দেখা যাবার সম্ভাবনা ও সুযোগ থাকে। এর উপরে গেলে আর তাকে মেডিসিনাল বা ঔষধজ এগ্রাভেশন বলা চলে বলে, আমি মনে করি না- তাকে বরঞ্চ শক্তিসংক্রান্ত এগ্রাভেশন (Dynamic Aggravation) বলাই সঙ্গত হয়।

২. জীবনীশক্তির উত্তেজনাজনিত এগ্রাভেশন (Aggravation due to oversensitivity of Vital Force): বই-পুস্তকে এটাকেই ‘Homeopathic Aggravation’ নামে বর্ণনা করা হয় এবং অনেকে এটাকে ‘Primary Aggravation’-ও বলে। মহাত্মা হ্যানিমান তার অর্গানন অব মেডিসিন গ্রন্থের ১৫৭ নং এফোরিজমে, একিউট রোগের শুরুতে ও ক্রনিক রোগের শেষে যে এগ্রাভেশনটি হবার কথা বলেছেন- এটি হচ্ছে সেই এগ্রাভেশন। এই এগ্রাভেশনটি নিতান্তই জীবনীশক্তির উত্তেজনাজনিত কারণে হয়ে থাকে। একিউট রোগে জীবনীশক্তি প্রায়শই অতি-সক্রিয় ও অতি-সংবেদনশীল থাকে এবং হোমিওপ্যাথিক ঔষধশক্তি সবসময়ই চলমান রোগশক্তির চাইতে উচ্চতর হতে হয়; আর এ কারণে অতিসংবেদনশীল একিউট রোগগ্রস্ত জীবনীশক্তি উচ্চতর শক্তির ঔষধের প্রতি প্রাথমিক যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সেটিই এই এগ্রাভেশনটি সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, ক্রনিক রোগের শুরুর দিকে জীবনীশক্তি যদি এতটাই নিস্তেজ থাকে যে, সদৃশ ঔষধেও যথাযথ প্রতিক্রিয়া ও সংবেদনশীলতার বহিঃপ্রদর্শন করতে অক্ষম হয়- সেক্ষেত্রে প্রথম দিকে যথাযথ শক্তিপ্রদানে এগ্রাভেশনটা না-ও হতে পারে; বরঞ্চ এরকম ক্ষেত্রে এই এগ্রাভেশনটি দেখা দেবার সম্ভাবনা থাকে জীবনীশক্তি যথোপযুক্ত পরিমাণে শক্তিশালী হবার পরে- রোগের শেষের দিকে। আর এ কারণেই, এমনও কয়েকজন বিখ্যাত চিকিৎসক আছেন – যারা রোগের প্রথমদিকে উচ্চশক্তি ও আরোগ্য শুরু হলে ক্রমান্বয়ে নিম্নশক্তি প্রদান করতেন।
৩. প্রুভিং-জনিত এগ্রাভেশন (Proving Aggravation): এই প্রুভিংজনিত এগ্রাভেশনটি আবার কয়েক রকমের হতে পারে-
- ফিজিওলজিক্যাল প্রুভিং এগ্রাভেশন (Aggravation Due to Physiological Proving): এটি নিতান্তই ঔষধজ এগ্রাভেশন- যা কিছু পরিমাণে আমি আগেই আলোচনা করে এসেছি। নিম্নশক্তিতে ঔষধের প্রুভিং করতে গেলে এই ফিজিওলজিক্যাল প্রুভিংই মূলত ও প্রাথমিকভাবে ঘটে। কাজেই, কিছুটা সংবেদনশীলতা থাকলে সে রোগী হোক বা সুস্থ হোক- এই প্রুভিংটি ঘটবে এবং রোগী হলে তার ঔষধজ বৃদ্ধি দেখা দেবে। মহাত্মা হ্যানিম্যান প্রথম জীবনে রোগীদের নিম্নশক্তি, বৃহৎমাত্রায় প্রয়োগ করার পর এই বৃদ্ধিটিই দেখতে পান এবং তাকে এড়ানোর লক্ষ্যেই তিনি ঔষধ পানিতে দ্রবীভূত করে ও পরে ক্রমান্বেয়ে সাক্কাশনের মাধ্যমে শক্তিবৃদ্ধি করে ক্ষুদ্রমাত্রায় প্রয়োগ করতে থাকেন এবং উচ্চতর ডায়নামিক এনার্জেটিক ঔষধ প্রস্তুত প্রণালী আবিষ্কার করেন। ডায়নামিক এগ্রাভেশনের কথাটি যারা চিন্তা না করেন, তারা হ্যানিমানের এই এগ্রাভেশন এড়ানোর কৌশলটি দেখে মনে করে থাকেন- ঔষধ যত উচ্চশক্তিতে প্রদান করা হবে, ততই তা নিরাপদ। হ্যা, সেটি মেডিসিনাল বা ফিজিওলজিক্যাল এগ্রাভেশন থেকে নিরাপদ হবে তো বটেই। কিন্তু তারা ডায়নামিক বা এনার্জেটিক এগ্রাভেশনগুলোর কবলে পড়ে যেতে পারেন- এজন্য তাদের সতর্ক থাকাটাও জরুরি। উচ্চশক্তির ঔষধের সবচেয়ে বড় পথিকৃৎদের একজন মহামতি ডা. কেন্ট এই ডায়নামিক এগ্রাভেশনের বিপদটা জানতেন এবং এজন্য সে ব্যাপারে সতর্কতাস্বরূপ তাঁর বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন,
“হাতুরে চিকিৎসকের হাতে উচ্চশক্তিতে চিকিৎসা নেবার চেয়ে আমি বরং ছুরি নিয়ে খুনে উদ্যত এক ডজন নিগ্রোর সঙ্গে একসাথে থাকতে পারি।”
- অপ্রয়োজনীয় পুনঃপ্রয়োগের কারণে (Aggravation due to unnecessary repeatation): সংবেদনশীল বা আংশিক সংবেদনশীল (Susceptible or Partially-Susceptible) রোগীদেহে বা সুস্থদেহে ঔষধের শক্তিকৃত মাত্রাটিরও বার বার প্রয়োগ, ঘন ঘন প্রয়োগ, মোদ্দাকথা অপ্রয়োজনীয় পুনঃপ্রয়োগের দরুন এই এগ্রাভেশনটি ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে নিরাময়যোগ্য রোগীর ক্ষেত্রেও তিনটি ঘটনা ঘটতে পারে-
ক) তীব্রভাবে পূর্বতন লক্ষণগুলোর বৃদ্ধি
খ) নতুন নতুন কিছু কষ্টকর লক্ষণের আবির্ভাব
গ) রোগী অধিকমাত্রায় সংবেদনশীল থাকলে- রীতিমতো ঔষধের প্রুভিং আর এই অবস্থাটিকে নতুন চিকিৎসক কিংবা অতিমাত্রায় মাত্রার পুনঃপ্রয়োগকারী চিকিৎসকটি- এর পেছনের ঘটনাটিকে বুঝতে না পেরে কেইসটিকে গুলিয়ে ফেলতে পারেন। আরোগ্যকারী ঔষধকে দোষারোপ করে – অন্য ঔষধের (স্বভাবতই তা ভুল) শরণাপন্ন হতে পারেন। সবশেষে এলোমেলো, বিশৃঙ্খল একটি কেইসের জন্মদান করতে পারেন। - বৃহৎমাত্রায় শক্তিকৃত ঔষধ প্রয়োগজনিত: বার বার পুনঃপ্রয়োগজনিত বৃদ্ধির চাইতে এটি তুলনামূলক কম হানিকর হলেও, এটাকেও একেবারে নিরাপদ ভাবার কোন কারণ নেই। অনেকে অবশ্য মনে করেন, হোমিওপ্যাথিক ঔষধ যেহেতু শক্তি- কাজেই ঔষধটি ঔষধজ অস্তিত্ব থেকে শক্তিস্তরে নেবার পর পরিমাণের কম-বেশি হিসেব করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ধারণাটি একদমই ভুল। শক্তিকৃত ঔষধের আবিষ্কারক ও চিকিৎসাক্ষেত্রে রোগ, সুস্থতা ও ঔষধের ডায়নামিক সম্পর্কের জনক মহাত্মা হ্যানিমান এমনকি পঞ্চসহস্রতমিক ঔষধের ক্ষেত্রেও কয়টি পিল দিতে হবে, তার আকার কি হবে তা নিয়ে বিশেষ সতর্ক থেকেছেন ও সবাইকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ করেছেন। প্রসঙ্গ ভিন্ন বলে, আজ সে আলোচনায় যাবো না। কিন্তু বৃহৎমাত্রায় ঔষধ প্রয়োগ করলেও- পুনঃপ্রয়োগজনিত এগ্রাভেশনগুলোর মতো অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। পার্থক্য একটাই, চিকিৎসক এক্ষেত্রে ঘটনাটি বুঝতে পেরে নিজে ধের্য্যধারণ করতে পারলে ও রোগীকে করাতে পারলে- প্রথম ধাক্কাটি কেটে যাবার পর আবার সুস্পষ্ট আরোগ্যক্রিয়া হতে দেখা যাবে (যদি না তাকে দ্রুত করার চেষ্টায় আবার পুনঃপ্রয়োগ-ত্রুটি করা হয়)।
- অতি-সংবেদনশীল রোগীদের ক্ষেত্রে (In Idiosyncratic Persons ): ঔষধ বৃহৎমাত্রায় না প্রদান করা হলেও, এমনকি অযাচিত পুনঃপ্রয়োগ না করা হলেও – এই রোগীদের ক্ষেত্রে শক্তিকৃত ঔষধের প্রুভিংজনিত বৃদ্ধি ঘটতে পারে। ফিজিওলজিক্যাল প্রুভিংয়ের চাইতে ডায়নামিক প্রুভিং আরো বেশি গভীর, প্রভাববিস্তারকারী ও শক্তিশালী বিধায় এটি অত্যন্ত বিরক্তিকর ও কষ্টসাধ্য। ফিজিওলজিক্যাল প্রুভিং অনেকটা একিউট অবস্থার মতো- রোগী না মরলে সে প্রায় ক্ষেত্রেই কেবল পুরোপুরি সুস্থই হবে না- ঐ ঔষধের লক্ষণসম্পর্কিত রোগগুলো থেকে ইমিউনিটিও লাভ করবে কিন্তু ডায়নামিক প্রুভিং ক্রনিক রোগগুলোর মতো ভীষণ ঝামেলাকর। রোগীর মাঝে বহু অনাকাঙ্ক্ষিত চিরকালীন পরিবর্তনও সৃষ্টি করতে পারে।

৪. কৃত্রিম সংবেদনশীলতা তৈরী করা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে (In Iatrogenically-induced Susceptible persons): এটি অনেকটা অতিসংবেদনশীল রোগীদের ক্ষেত্রে বৃদ্ধির ব্যাপারটির মতোই। মূল পার্থক্য হচ্ছে- এক্ষেত্রে রোগীদের মাঝে দীর্ঘদিন ধরে একই ঔষধের বা কিছু সংখ্যক নির্দিষ্ট ঔষধের- অতিরিক্ত প্রয়োগ বা অপ্রয়োজনীয় প্রুভিং করে ঔষধসৃষ্ট রোগের অবস্থাটি (Iatrogenic Disease State) তৈরী করা হয়েছে। এটি প্রকৃত চিররোগ নয় বটে, তবে তা সচরাচর কিছু কষ্টদায়ক লক্ষণের কেবল বিশৃঙ্খল প্রদর্শনও নয়। এটি রোগীকেই পরিবর্তন করে ফেলে। তার মূল মায়াজমের উপর একটি বা একাধিক জঘন্য আস্তর (Layer) তৈরী করে। বিসদৃশ ঔষধ তো বটেই, এমনকি সেটি হোমিওপ্যাথিক্যালি সদৃশতম ঔষধ দ্বারাও করা হয়ে থাকতে পারে। ডা. জে. এন. কাঞ্জিলাল খুব সুন্দরভাবে তার বর্ণনা করেছেন,
“We find a similar but more paradoxical or even apparently contradictory phenomenon with respect to drugs. A drug when over used with respect to dose and repetition, may in the beginning create resistance against it but later on creates hypersensibility or susceptibility (creating various adverse allergic symptoms and disease conditions) not only with respect to the same drug but with respect to various other allied drugs, or even diseases.”
কোন রোগীর এই অবস্থায় যাবার পর তার উপর প্রয়োগকৃত ঔষধে অতি-সংবেদনশীল রোগীদের মতোই বৃদ্ধি প্রদর্শন করতে পারে- এমনকি সেটা সদৃশ ও অতি ক্ষুদ্র মাত্রায় হলেও। এদের ক্ষেত্রে বরঞ্চ ঔষধ যত সদৃশ হয়- সাবধানতার পরিমাণ তত বৃদ্ধি করা উচিৎ। বর্তমানে মানুষ অতি জটিল রোগগুলোর সাথে, অতি অতি ভীষণতর সব ঔষধের অতিপ্রয়োগে কাহিল। এই সৃষ্টিকৃত সংবেদনশীল রোগীর দেখা পাওয়া আজ নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। কাজেই, চিকিৎসকদের চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। এধরণের রোগীদের বৃদ্ধি ঘটলে, তা সংবরণ করা ও চিকিৎসাকে সঠিকপথে পরিচালিত করা ভীষণ দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও ধৈর্য্যের ব্যাপার।
৫. মায়াজমের উত্তেজনাজনিত এগ্রাভেশন (Aggravation due to Miasmatic irritation): এই ব্যাপারটি সরাসরি মহাত্মা হ্যানিমান সতর্ক করে যাওয়া সত্ত্বেও, বহুক্ষেত্রেই তা আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। মানসিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে মহাত্মা হ্যানিমান শুরুতেই এন্টিসোরিক ঔষধ প্রয়োগ করতে নিষেধ করেছেন। কারণ রোগীর একিউট অবস্থাটি কোন একিউট ঔষধ দিয়ে স্তিমিত করে না নিলে- গভীর এন্টিসোরিক ঔষধ রোগীর মাঝে তীব্র বৃদ্ধি সঞ্চার করবে।
ঠিক একইভাবে, একাধিক মায়াজমযুক্ত রোগীতে কোন কারণে ডমিনেন্ট মায়াজমকে (ধরা যাক, সাইকোসিস) বাদ দিয়ে ভুলবশত তার নিচে থাকা (ধরা যাক, সোরিক) মায়াজমের জন্য ঔষধ প্রয়োগ করলে তা আংশিক সদৃশ কিন্তু যথেষ্ঠ সংবেদনশীলতাযুক্ত হয়ে থাকে। ফলাফলস্বরূপ, তা উপরস্থিত মায়াজমটিকে অযাচিতরকম উত্তেজিত করে একটি তীব্র বৃদ্ধি ঘটাবে। উপরস্থিত মায়াজমেটিক লক্ষণের বৃদ্ধি মানেই রোগীর বর্তমান কষ্টগুলোর বৃদ্ধি। এই বৃদ্ধিকে অন্য কোন প্রকারের বৃদ্ধি ভেবে চিকিৎসা পরিচালনা করতে থাকলে ক্রমান্বয়ে কেইসটি চরম বিশৃঙ্খলার দিকে এগিয়ে যাবে।
৬. এক-দৈশিক রোগীতে (In One-Sided diseased persons): অতি দুর্বল জীবনীশক্তিযুক্ত রোগীতে এই ইতিবাচক এগ্রাভেশনটি দেখতে দেখতে পাওয়া যায়। শক্তিশালী জীবনীশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিদের শরীরে রোগের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসহ লক্ষণগুলো সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ পায়। কিন্তু যাদের জীবনীশক্তি অত্যন্ত দুর্বল- তাদের শরীরে লক্ষণগুলো খুবই অস্পষ্ট আকারে প্রকাশ পায়। অথবা ক্রনিক রোগ যখন বেশ এগিয়ে গিয়ে ভীষণরকম প্যাথলজিকাল পরিবর্তন সাধন করে, টিস্যু-বিধ্বংসী পরিণতি ধারণ করে- সেখানেও তার লক্ষণগুলোর চারিত্রিক ও নির্বাচক বৈশিষ্ট্যগুলোর বহিঃপ্রকাশ থাকে না। সে ক্ষেত্রগুলোতে ঔষধের শক্তি-নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। ডা. হ্যানিমানের দেয়া নির্দেশনা মোতাবেক- এ সময় যতটুকু লক্ষণই পাওয়া যায় তার উপর ভিত্তি করে সবচাইতে সদৃশ ঔষধটি প্রয়োগ করলে- তার ফলস্বরূপ আরো কিছু সুস্পষ্ট লক্ষণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে (তীব্র প্যাথলজিক্যাল রোগীর ক্ষেত্রে অবশ্য আরো বিবেচনাধীন বিষয় থাকতে পারে)। এটি একটি ইতিবাচক বৃদ্ধি এবং চিকিৎসকদের এই বৃদ্ধিটিকে অত্যন্ত যত্নের সাথে চিহ্নিত করতে হবে। রোগীর পূর্বতন লক্ষণের এই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অবস্থার সাথে নতুন লক্ষণগুলোর সহযোগে আরো পরিচ্ছন্ন ঔষধচিত্র পাওয়া সম্ভব হয়। কাজেই এই বৃদ্ধিটিকে বিশেষভাবে চিনতে না পারলে, কিংবা তাকে যেন-তেন প্রকারে অন্য যে কোন বৃদ্ধি হিসাবে বিবেচনা করে চিকিৎসা করতে গেলে – তা কেইসটিকে আরো বিশৃঙ্খলার দিকেই কেবল ঠেলে দেবে। এ সকল রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চশক্তি প্রয়োগেও যথেষ্ঠ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

৭. আংশিক সদৃশ বা ভুল ঔষধ প্রয়োগজনিত বৃদ্ধি (Aggravation due to Wrong or Partially similar Prescription): প্রায় একই রকম দেখতে নেতিবাচক বৃদ্ধি (Negative Aggravation) ঘটে এই ঘটনাটিতে। রোগীকে আংশিক সদৃশ ভুল ঔষধ প্রদত্ত হলেও, রোগীর দেহ-মনে নতুন নতুন লক্ষণের (Accessory symptoms) আর্বিভাব হতে থাকে। কিন্তু এই নতুন লক্ষণের আবির্ভাবটি কোনক্রমেই ইতিবাচক বৃদ্ধি নয়। এমনকি এটি একদমই ভুল ঔষধ প্রয়োগজনিত হলে- তাকে নন-হোমিওপ্যাথিক এগ্রাভেশনই বলতে হবে। তবে আলোচ্য ক্ষেত্রটিতে, ঔষধটির প্রতি রোগীর একদমই সংবেদনশীলতা (Suceptibility) না থাকলে ক্ষুদ্রমাত্রায় শক্তিকৃত ঔষধ প্রয়োগে কোন প্রতিক্রিয়ায় হতো না- এই সংবেদশীলতার সামান্য সাদৃশ্যের জন্যই তাকে এখানে হোমিওপ্যাথিক এগ্রাভেশন হিসাবে বিবেচনা করছি।
বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কার করার জন্যে এই বৃদ্ধিটিরই আরেকটি অবস্থার উদাহরণ দিয়ে বলছি। এই এগ্রাভেশনের ধরণটি সম্বন্ধে ডা. জর্জ ভিথোলকাসের স্বনামধন্য ছাত্র ডা. এলফন্স গোকেন্সের আলোচনায়ই প্রথম দেখতে পাই। কোন ঔষধ প্রয়োগ করার পর যদি তার কাজ নিঃশেষ হয় এবং অন্য কোন ঔষধের প্রয়োজন হয়- তাহলে যে ঘটনাটি ঘটে তা হচ্ছে- পূর্বতন ঔষধের কিছু কিছু সদৃশ লক্ষণ এখনও অবশিষ্ট থাকায়, এবং একটি লক্ষণীয় সময় রোগীর শরীরের ঔষধটির তীব্র সংবেদনশীলতা থাকায়- এখনো তার কিছু সংবেদনশীলতা রোগীর মাঝে অবশিষ্ট রয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পূর্বতন অবস্থাটির পরিবর্তন ও লক্ষণের পরিবর্তন মূলত এখন নতুন একটি ঔষধচিত্র সৃষ্টি করে আছে। চিকিৎসক যদি এই নতুন চিত্রটি পর্যবেক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়ে- আগের ঔষধটিই আরো উচ্চশক্তিতে (যেহেতু আগের শক্তি আর কাজ করছে না) প্রয়োগ করেন, তাহলে সেই পূর্বতন ঔষধের প্রতি আংশিক সংবেদনশীলতার দরুন এক প্রকার বৃদ্ধি ও অনাকাঙ্ক্ষিত লক্ষণ সৃষ্টি করে। তখন পূর্বের সেই সিমিলিমাম ঔষধটি বর্তমানে সিমিলার ঔষধ হিসাবে আচরণ করে- যেখানে আসলে এই সিমিলারিটিটা আর আরোগ্যকারী নয়।
৮. কৃত্রিম ক্রনিক রোগে গভীর এন্টিমায়াজমটিক ঔষধ প্রয়োগজনিত বৃদ্ধি (Aggravation due to application of deep antimiasmatic remedies in false chronic diseases): যে সমস্ত রোগ বা রোগলক্ষণ প্রকৃত চিররোগপ্রসূত নয়- কেবলমাত্র আমাদের জীবনযাত্রার ত্রুটি, খাদ্যাভ্যাস, পেশাগত ঝক্কি বা হাজারো প্রকারের বদভ্যাসজনিত বা এরকম বিষয়গুলো থেকে উদ্ভূত- সেই লক্ষণগুলোর সাথে হোমিওপ্যাথিক ঔষধের কোন সম্পর্ক নেই। হ্যা, এগুলোর দরুন যদি কারো অন্তর্নিহিত সুপ্ত মায়াজম জাগ্রত হয়ে যায়- তাহলে ভিন্ন কথা এবং সেক্ষেত্রে যথাযথ এন্টিমায়াজমেটিক ও কন্সটিটিউশনাল ট্রিটমেন্ট করতে হবে। কিন্তু যেখানে এই সুগভীর অবস্থাটি এখনো সৃষ্টি হয়নি- সেখানে গভীর এন্টিমায়াজমেটিক ঔষধ প্রয়োগে একসাথে কয়েকটি ঘটনা ঘটে-
ক) তার সুপ্ত মায়াজমটি অযথা উত্তেজিত হতে পারে
খ) জীবনীশক্তিটি, তার সাথে সংবেদনশীল কোন (ঔষধ) শক্তির অপ্রয়োজনীয় সংস্পর্শে আসায় অযাচিতরূপে উত্তেজিত হতে পারে
গ) উপরের কারণ দুটো বা এর যে কোন একটির কারণে- ঔষধের সাথে সম্পর্কহীন কৃত্রিম রোগলক্ষণগুলোর অযথা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অবস্থা দেখা যেতে পারে।
অনেকেই ভাবতে পারেন, প্রদর্শিত কৃত্রিম লক্ষণগুলোর সাদৃশ্যে ঔষধ প্রয়োগ করলেই তো ল্যাঠা চুকে যাবে। লক্ষণের সাদৃশ্যে তাকে আরোগ্য করবে- তা সে কৃত্রিমই হোক বা অকৃত্রিম। কিন্তু তাদের আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- প্রকৃত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ কখনোই এবং কোনদিনও কোন লক্ষণের উপর ক্রিয়া করে না- সে ক্রিয়া করে জীবনীশক্তির উপর ও তার সাথে অস্তিত্বগতভাবে সম্পর্কিত মায়াজম ও কন্সটিটিউশনের উপর। স্থানীয় লক্ষণের উপর ঔষধ প্রয়োগ করা হলেও- প্রকারান্তরে বলা চলে, তা জীবনীশক্তিকেই বাধ্য করে- নিয়মভঙ্গ করে একটি স্থানের রোগলক্ষণকে অপসারিত করে অন্য স্থানে (হয়তো আরো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে) তাকে অবারিত করে দিতে। অর্থাৎ আমার আঙ্গিনা থেকে তোমার সেনা সরিয়ে পড়শির আঙ্গিনায় নিয়ে যাও (যদিও পড়শিটি হয়তো আমাদের গোষ্ঠীর প্রধান)।

১০. রোগের বহির্গতকরণ প্রক্রিয়াজনিত বৃদ্ধি (Aggravation due to eliminating process of disease or Exteriorization): সুনির্বাচিত ও প্রকৃত সদৃশ ঔষধ প্রয়োগে জীবনীশক্তির সামঞ্জস্য প্রবাহ প্রতিষ্ঠিত হয়, আমাদের ডিফেন্স সিস্টেম শক্তিশালী হয় এবং হেরিংয়ের আরোগ্যনীতি অনুসারে, রোগ ও তার লক্ষণ ভেতর থেকে বাইরের দিকে চালিত হয়। একজন ভয়াবহ এলার্জিক রোগী- যে প্রায় কোন খাবারই সহ্য করতে পারে না, শরীরের সমস্ত চর্মে আর্টিকেরিয়া তো দেখা দিতোই; সাইনাসে ব্যথা, মাথার চামড়ায় ভীষণ টানবোধ, নাক দিয়ে কিছু কিছু ডিসচার্জ হতে থাকতো; সাথে কখনো কখনো শ্বাসকষ্ট। চিকিৎসা করায় দেখা গেলো – তার লাগাতার নাক দিয়ে প্রচুর পরিমাণে স্রাব হতে থাকলো- আর তার সমস্ত লক্ষণ হ্রাস পেতে থাকলো। তার এই স্রাবটি কি কোনভাবেই বৃদ্ধি? একটি বাচ্চার ঠান্ডা লেগে বুকে কফ বসে আছে। ঔষধ দেবার পরই তার ডায়রিয়া দেখা দিলো। এই ডায়রিয়াটি কি প্রকৃতপক্ষে নতুন আক্রমণকৃত রোগ? (দু’টো ঘটনাই আমার চিকিৎসাকৃত বাস্তব কেইস থেকে দেয়া)। না, এগুলোর দুটোই ছিলো- রোগীর আরোগ্য প্রক্রিয়ায় রোগ ও তার লক্ষণের বহির্গমন বা Eliminating Process। রোগীকে ভেতর থেকে আরোগ্য করার লক্ষ্যে বহুসময়ই চর্ম, শ্লেষ্মিক ঝিল্লি, সিরাস ঝিল্লি, কিডনি, উদর, ফুসফুস থেকে স্রাব নির্গত হতে পারে, শরীরের প্রান্তসীমার অঙ্গগুলোতে চুলকানি, চর্মরোগ, সামান্য ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। এগুলোকে ‘Exteriorization’ বলেও উল্লেখ করা হয়।
চিকিৎসাক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ব্যক্তিই জানেন, পূর্বের তীব্রতম লক্ষণ থেকে আরোগ্য পাবার পর – বর্তমান ক্ষুদ্রতম লক্ষণটিই রোগীর কাছে তীব্রতম হয়ে যায়। কাজেই, তারা তাদের এই দেখা দেয়া লক্ষণগুলোকে নতুন রোগ বলে বিবেচনা করার মতো ভুল করলেও, চিকিৎসকের কিন্তু এই ভুলটি করলে কখনোই চলবে না। এমনকি এই বৃদ্ধির বৈশিষ্ট্যগুলোকেও তাকে বেশ ভালোরূপে চিনে ও জেনে নিতে হবে।
১১. পুরাতন লক্ষণের প্রত্যাবর্তন (Return of Old Symptoms): এটিও আসলে এক প্রকার Exteriorization বা Eliminating Process। আমার চিকিৎসাজীবনে আমি ৩০ বৎসর আগের চর্মরোগ একই স্থানে, একইরকমভাবে, হুবহু একই বৈশিষ্ট্যে ফেরত আসতে দেখেছি (রোগী প্রদত্ত প্রমাণে)। কিন্তু বহু চিকিৎসক (বিশেষ করে যারা কেইস রেকর্ড করেন না, কিংবা সংক্ষিপ্ত রেকর্ড করেন) রোগীর পূর্বতন রোগগুলোর ব্যাপারে অসচেতন থাকেন। ফলাফলস্বরূপ প্রকৃত ও যথাযথ ঔষধের পরে, অতীতের অবদমিত এইসব লক্ষণগুলোকে একটি এগ্রাভেশনের মতো মনে হয়। এটি এগ্রাভেশন তো বটেই – তবে ইতিবাচক এগ্রাভেশন (Positive Aggravation)। রোগীর ভেতরের অব্স্থার উন্নতির সাথে সাথে বাইরের অবস্থার এগ্রাভেশন- একটি আরোগ্যমূখী প্রক্রিয়ার সুস্পষ্ট নিদর্শন। কিন্তু সম্বন্ধে যথাযথ সচেতন না হলে, এই আরোগ্যমূখী প্রক্রিয়াকে অন্যান্য এগ্রাভেশনের সাথে গুলিয়ে ফেলে পুরো শ্রমটিকে নষ্ট করে ফেলারও প্রবল সম্ভাবনা থাকে।

১২. পরম এগ্রাভেশন (Euthanasia): অর্থাৎ রোগীর শান্তিতে, কষ্টদায়ক লক্ষণ থেকে তাকে মুক্ত করে, যাতনাহীন মৃত্যুদানের প্রক্রিয়া। বহুক্ষণ দ্বিধায় ছিলাম- এটাকে এগ্রাভেশন হিসাবে মত প্রকাশ করবো কিনা। আসলে এগ্রাভেশনের সাধারণ ও সহজাত বৈশিষ্ট্যগুলো তো এতে নেই বটেই- বলতে গেলে, এটাকে আপাতঃদৃষ্টিতে রোগীর চূড়ান্ত উপশম হিসাবে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এর পেছনের ঘটনাটির কথা বিবেচনা করলে- তাকে এগ্রাভেশন ছাড়া আর কিছু বলার উপায় থাকে না। কারণ প্রথম কথা হচ্ছে, এটি কোন আরোগ্যকারী উপায় নয়। প্রকৃতদৃষ্টিতে এটি কোন উপশমদায়ী পদ্ধতিও নয়- এটি হচ্ছে অতি-দুর্বল জীবনীশক্তিকে হতবিহ্বল, কিংকর্তব্যবিমূঢ় করার প্রক্রিয়া; তাকে বোকা বানানোর প্রক্রিয়া। অতি-দুর্বল জীবনীশক্তিতে এমনভাবে ঔষধ প্রয়োগ- যাতে সে ভীষণরকম উদ্দীপনার কবলে পড়ে এবং তার অতি দুর্বল শক্তি যেন সেই উত্তেজনায় সাড়া দিতে গিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। তার শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাওয়া মানে – মনে ও দেহে তার পক্ষে আর কোন লক্ষণ (ব্যথা, কষ্ট, যাতনা, ব্যতিক্রম অনুভূতি ইত্যাদি) প্রকাশ করাই সম্ভব নয় এবং নিঃশেষিত জীবনীশক্তির পক্ষে প্রাণময় সত্ত্বাকে জীবিত রাখা, তাকে পরিচালিত করাও আর সম্ভব নয়। ফলাফল- বেদনাহীন মৃত্যু বা Euthanasia। যবনিকার পেছনে চলছে আসলে- একটি আগ্রাসী, ভয়ানক বৃদ্ধির ঘটনা। আর এজন্যই এর মূল বেশিষ্ট্য অনুযায়ী তাকে ‘পরম-বৃদ্ধি’ বলাটাকেই আমি এক দৃষ্টিতে উপযুক্ত বলে মনে করি।
এবার স্বভাবতই আসে অ-হোমিওপ্যাথিক এগ্রাভেশনের (Non-Homeopathic Aggravation) প্রশ্নটি। উপর্যুক্ত আলোচনায় এই Aggravation -এর কথা কিছুমাত্রায় ইতোমধ্যে এসে গেছে এবং এটি আজকের আলোচ্য বিষয়ও নয়। তথাপি কেবলমাত্র বোঝার সুবিধার্থে সংক্ষেপে বলছি, সাধারণভাবে এই এগ্রাভেশনকে দুইটি শ্রেণিতে বর্ণনা করা যায়-
১. অসদৃশ এগ্রাভেশন (Dissimilar aggravation): যখন একদমই ভুল ঔষধ বা অসদৃশ ঔষধ প্রয়োগের পর, রোগীর মাঝে সেই ঔষধের ক্রিয়াজনিত রোগলক্ষণ দেখা দিতে থাকে- তখন সেই বৃদ্ধিটিই অসদৃশ এগ্রাভেশন। এলোপ্যাথিক ঔষধের সাইড-ইফেক্টগুলো সবই এই অসদৃশ এগ্রাভেশনের উদাহরণ। হোমিওপ্যাথিতে একদমই অসদৃশ বা ভুল ঔষধ অতিবৃহৎ মাত্রায় নিম্নশক্তিতে প্রয়োগের ফলে যে প্রুভিং-লক্ষণগুলোর উৎপত্তি হয় বা বিষক্রিয়ার সঞ্চার হয়- সেটিও এই অসদৃশ এগ্রাভেশন।
২. অবদমনজনিত এগ্রাভেশন (Aggravation due to Suppression): এই নন-হোমিওপ্যাথিক এগ্রাভেশনটি এলোপ্যাথিক ও হোমিওপ্যাথিক দুই ধরণের ঔষধ দিয়েই করা যেতে পারে। যখনই কোন স্থানীয় লক্ষণের উপর ভিত্তি করে ঔষধ নির্বাচন করে কেবলমাত্র রোগের সেই বহিঃপ্রকাশকেই উপশম করার চেষ্টা করা হয় (তা সে যে ‘প্যাথি’-র ঔষধ দিয়েই করা হোক না কেন), তখন বাইরের সেই লক্ষণটি সম্পূর্ণ বা কিছুমাত্রায় উপশম হয়ে- রোগীর আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে, সার্বিক ক্ষেত্রে কিংবা উচ্চতর ক্ষেত্রে বৃদ্ধি ঘটাতে থাকে। রোগীর মন-মেজাজ, আবেগপ্রবণতা, জীবনের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা আরো বৃদ্ধি পায়। এই এগ্রাভেশনটিতে স্থানীয় লক্ষণের সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও, হোমিওপ্যাথির মূলনীতি বিরোধী হওয়ায়- তা কোনভাবেই হোমিওপ্যাথিক এগ্রাভেশন নয়।
তবে এখানেই শেষ নয়, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাক্ষেত্রে আরো কিছু এগ্রাভেশন বা বৃদ্ধিজনিত অবস্থা দেখা যায়, যেগুলো আসলে ঔষধের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত নয়। এগুলো কিছু অবস্থা, পরিস্থিতি, রোগের ও আরোগ্যের ধর্ম বা আগের কৃতকর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এজন্য এগুলো সদৃশ ও অসদৃশ কোন শ্রেণিতেই ঠিকঠাকভাবে উল্লেখ করা যায় না। এগুলোকে আসলে প্রক্রিয়াগত এগ্রাভেশন (Procedural Aggravation) বলাই বেশি সঙ্গত। নিচে এই এগ্রাভেশন সম্বন্ধেও সংক্ষেপে ধারণা দেবার চেষ্টা করা হলো-
১. লক্ষণের আবর্তনধর্মী বৃদ্ধি (Rotational aggravation of symptoms): ক্রনিক রোগগুলোর চিকিৎসাক্ষেত্র একটি চলমান প্রক্রিয়া যেখানে রোগী তার সবচেয়ে বাজে অবস্থা থেকে ক্রমান্বয়ে উন্নত অবস্থার দিকে অভিগমন করে এবং সেই যাত্রাটি নিতান্ত রাতারাতি ঘটে না। মূলত এটি রোগের বিরূদ্ধে প্রয়োগকৃত ঔষধের (সৈন্য) সহযোগিতায় আমাদের জীবনীশক্তির (সেনানায়ক) একটি দীর্ঘ প্রাণান্তকর সংগ্রাম। একটি যুদ্ধে যে দলই জয়লাভ করুক- যুদ্ধক্ষেত্রটির চিত্র যেমন ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হয় (অনেক সময় নিশ্চিত বিজেতারও যুদ্ধকৌশলের দরুন পিছু হটতে হয়); তেমনি রোগ ও আরোগ্যকারী শক্তিগুলোর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াও অবিরত পরিবর্তনশীল অবস্থায় দেখা যায়। আর সেক্ষেত্রে যে চিত্রগুলোকে বৃদ্ধি বলে আমাদের বিভ্রান্তি আসতে পারে-
- লক্ষণগুচ্ছের আবর্তন: কোন কোন সময় একক ঔষধের একক মাত্রায় রোগীর উন্নতি চলতে থাকে। তথাপি রোগীর সার্বিক উন্নতি বা এনার্জি-মেন্টাল-ইমোশনাল-ফিজিক্যাল লেভেলের সামগ্রিক উন্নতি থাকা সত্ত্বেও কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন লক্ষণ কিছু নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সাময়িকভাবে বৃদ্ধি পায়। রোগীর সার্বিক উন্নতিকে অবলোকন, পর্যবেক্ষণ ও বিবেচনা না করে – হুট হাট সে সময় ঔষধ প্রয়োগ করলে বা বদল করলে, তা চিকিৎসাতে বিঘ্ন ও আরোগ্যপ্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে বাধ্য। এই বৃদ্ধিগুলো অনেকটা ঢেউয়ের মতো; তারা আসবে এবং চলে যাবে। তাকে সুনামি বা জলোচ্ছাস মনে করে প্রতিরোধ করতে যাওয়া একই সাথে বোকামি ও সময়-শ্রম-ঔষধ-শক্তি অপচয়।
- মায়াজমেটিক আবর্তন: হোমিওপ্যাথ মাত্রই জানেন, মিশ্র-মায়াজমেটিক রোগীর চিকিৎসাক্ষেত্রে – চিকিৎসাটি যদি সঠিক পদ্ধতিতে চলমান থাকে- তাহলে ক্রমান্বয়ে রোগীর মধ্যে থাকা মায়াজমগুলোর আবর্তন ঘটতে থাকে। হয়তো সিফিলিসের প্রভাবকে নিরাময় বা হ্রাস করার পর সাইকোটিক লক্ষণগুচ্ছের বৃদ্ধি আসতে পারে, তাকে যথাযথ উপায়ে নিবৃত্ত করতে পারলে হয়তো আবার সোরার তীব্রতা দর্শিত হবে; এরপর আবার সোরাকে থামানোর পর হয়তো রয়ে যাওয়া সিফিলিসের দুর্বল প্রভাবটিই আবার পুনরায় দেখা দেবে। এসময় যদি চিকিৎসক লক্ষণগুলোকে মায়াজমের ভিত্তিতে যথাযথ মূল্যায়ন না করে- মনে করেন তার চিকিৎসাপদ্ধতি ভুল (নয়তো বার বার এটা ওটা বাড়ছে কেন!) কিংবা প্রথম এন্টিসিফিলিটিকটি ভুল ছিলো (নয়তো এতদূর আগানোর পরও আবার সেই আগের সিফিলিটিক লক্ষণ দেখা দিলো কেন!)- তাহলে সেটাই তার এক মস্ত বড় ভুলের কারণ হতে পারে।
আর এজন্যই লক্ষণ ও মায়াজমেটিক প্রভাবের এই পুনরাবর্তনকে অন্য কোন এগ্রাভেশনের সাথে গুলিয়ে না ফেলে- তার যথাযথ মূল্যায়ন করাটা বাধ্যতামূলক।

২. উত্থান-পতনধর্মী এগ্রাভেশন (‘Ups and Downs’ OR ‘Wave-like aggravation’): মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই একটি অদ্ভূত বৈশিষ্ট্যের ধারক। আর তা হচ্ছে- পৃথিবীর এমন কোন কিছু নেই যা তার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। তার চারপাশের পরিবেশ, আবহাওয়া, আর্দ্রতা, শুষ্কতা, মাটির অবস্থা, রসায়ন ও তেজষ্ক্রিয়তার পরিমাণ, আকাশের চাঁদ, বাতাসের ধুলো- এককথায় অন্য সমস্ত সৃষ্টির সাথে মানুষের সম্পর্কটা অতি-নিবিড়। প্রতিটি ব্যাপারই মানুষকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। কেবল বস্তুগত বিষয়ই বলছি কেন- সম্পর্কের উত্থান-পতন, তার জীবনযাত্রা, চিন্তা, জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা, ভয় ইত্যাদি হাজারো বিমূর্ত বিষয়গুলোর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকও তাকে অবিরত প্রভাবিত করে চলে। ইতিবাচক দিকগুলো যেমন ঔষধের ইতিবাচক শক্তিকে আরো শক্তিশালী করে আরোগ্যপ্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত ও গতিশীল করে, নেতিবাচক প্রভাবগুলো তেমনি তাকে হ্রাস করে। কাজেই, একটি নির্দিষ্ট ঔষধশক্তির ইতিবাচক প্রভাবটি যথাযথভাবে ক্রিয়াশীল থাকা সত্ত্বেও এবং তদনুযায়ী রোগীর ক্রম-উন্নতির থাকা সত্ত্বেও- এক প্রকার ছোট-ছোট তরঙ্গাকার উত্থান-পতন, তথা হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। কোন একটি নির্দিষ্ট দিন বা সময়ে রোগীর লক্ষণ – অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে আপেক্ষিকভাবে হয় বেশি, নয় কম কিন্তু সঠিক ঔষধের প্রয়োগে একটি দীর্ঘ সময় পরিসরের তুলনায় তা নিশ্চিতভাবেই কম। রিপোর্টিংয়ের সময়, যদি চিকিৎসক এই বিষয়টিকে লক্ষ না রাখেন- তাহলে অনেক রোগীর বিবৃতিতেই তিনি বিভ্রান্ত হবেন এবং সাময়িক সেইসব উত্থানকে বৃদ্ধি বা এগ্রাভেশন ধরে নিয়ে ভুল পথে চালিত হবেন।
৩. ছদ্ম-উপচয় (Pseudo-Aggravation): আসলে এটা আদৌ কোন এগ্রাভেশনই নয়- কিন্তু রোগীর বর্ণনায়, তার কান্নাকাটির বহরে তাকে এগ্রাভেশন বলে রোগী ও চিকিৎসক দু’পক্ষই ভুল করতে পারেন। মূলত রোগীকে কোন ঔষধ দেবার পর- স্বভাবতই তা সবচেয়ে তীব্রতর লক্ষণ, যা প্রায় সময়ই তার সবচেয়ে কষ্টকর, যাতনাদায়ক লক্ষণ তাকে উপশম প্রদান করে বা আরোগ্য করে। কিন্তু রোগী কেবল একটি কষ্ট বা যন্ত্রণা নিয়েই আসেন না। অধিকাংশ সময়ই তাদের মাঝে আরো কষ্ট-যাতনা পূর্বে থেকেই থাকে- যেগুলোর ব্যাপারে প্রশ্ন করতে গেলেও প্রথমবার রোগী বিরক্ত হতে পারে। মনে করে- চিকিৎসক তার মূল যন্ত্রণা বোধহয় বুঝতে পারেনি; অনেকসময় তারা বলেই ফেলে, “ডাক্তার, আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ে তা আপনার দেখতে হবে না- আমার বাতের ব্যথাগুলোর যন্ত্রণা থেকে আমাকে মুক্তি দিন”। কিন্তু এই রোগীই বাতের ব্যথা কমার পর- চোখ দিয়ে পানি পড়ার কষ্টটিকে এমনভাবে বর্ণনা করতে পারে- মনে হবে চোখের সমস্যা না জানি কত বৃদ্ধি পেয়েছে (আমার চিকিৎসাকৃত বাস্তব কেইসের অভিজ্ঞতা থেকে প্রদত্ত)। আরাম আয়েশ মানুষের সহ্যক্ষমতার ব্যস্তানুপাতিক। কাজেই, রোগীর তীব্র কষ্ট চলে যাবার পর যে কষ্টটি থাকে সেটিই তার কাছে তীব্র হয়ে দেখা দেয়। রোগী প্রকৃত বিশ্বাস ও অনুভূতি থেকে তার এই যন্ত্রণার বর্ণনা আন্তরিকভাবে প্রদান করে বলে- চিকিৎসকের কাছে মনে হতে পারে, রোগীর যন্ত্রণা আসলেও বৃদ্ধি পেয়েছে।কিন্তু এরকম ক্ষেত্রগুলোকে সার্বিক ও সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে- বিচার করতে না পারলে, তাকে কোন এক প্রকার প্রকৃত বৃদ্ধি মনে করে চিকিৎসকের ভুল পথে চালিত হবার সম্ভাবনা থাকে।
৪. সহযোগী-চিকিৎসাব্যবস্থাগুলোর নিজস্ব বৃদ্ধিজনিত অবস্থা (Aggravated conditions from Adopted Accessory Treatments): বহু সময়, বহু কারণে অনেকসময় চিকিৎসকের পরামর্শে অথবা পরামর্শ ব্যতীতই রোগী হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সাথে আনুষাঙ্গিক অন্য কোন ন্যাচারোপ্যাথিক চিকিৎসা বা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। আমাদের অনেকেই হয়তো মনে করতে পারেন- হোমিওপ্যাথি ছাড়া পৃথিবীর আর তাবৎ চিকিৎসাপদ্ধতি বিসৃদশ। কিন্তু এভাবে চিন্তা করলে বিষয়টি কিন্তু অতিসরলীকরণ (Over-simplification) বা অতিসাধারণীকরণ (Over-generalization) হয়ে যেতে পারে। এমন বহু চিকিৎসাপদ্ধতিই থাকতে পারে- যা হোমিওপ্যাথির মতো পূর্ণাঙ্গ সদৃশ-পদ্ধতি না হলেও, আংশিক সদৃশ। আর সেক্ষেত্রেও এই বৃদ্ধির ঘটনাটি ঘটা অসম্ভব নয়। মূলত আকুপাংচার, অস্টিওপ্যাথিক ম্যানিপুলেশন, কলোনিক ইরিগেশন, ম্যাসাজ, ফাস্টিং বা অন্য ধরণের উপবাস এবং সাইকোথেরাপিতে হোমিওপ্যাথির মতো প্রারম্ভিক এগ্রাভেশনের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। কাজেই, কোন রোগী যদি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার পাশাপাশি অন্য কোন চিকিৎসা বা ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে- তাহলে তার ক্রিয়াকাণ্ড ও বৃদ্ধি-সম্ভাবনাকেও বিবেচনায় রাখতে হবে। নয়তো হিসাব-নিকাশে ভুল হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়।
৫. অঙ্গহানির দরুন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অবস্থার পুনঃ পুনঃ প্রত্যাবর্তন (Bouncing of Aggravated Condition due to organ-removal): অতীতে যে সমস্ত রোগীর কোন কারণে শরীরযন্ত্রের কোন মৌলিক অঙ্গ (পিত্তথলী, কিডনি, জরায়ু ইত্যাদি) অপারেশনের মাধ্যমে কেটে ফেলা হয়েছে – তাদের শত-সহস্র ঔষধও সেই অঙ্গটিকে আর ফিরিয়ে আনতে পারবে না। প্রকৃতির সহজাত ও স্বাভাবিক যে সমন্বয়পূর্ণ ক্রিয়াধারা এই দেহ থেকে এভাবে বিনষ্ট হয়- তাকে আরোগ্য করা কোন ঔষধের কর্মও নয়, সাধ্যও নয়। এইসব রোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসার একটি পর্যায়ে কিছু লক্ষণ বার বার প্রত্যাবর্তিত হতে থাকে, বার বার বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই অবস্থাটি বিবেচনা করে তাকে আরোগ্য নয়- কেবল উপশম দানের ঔষধই প্রদান করতে হবে। এই বার বার বৃদ্ধিকে অন্য কোন এগ্রাভেশন ভেবে সিদ্ধান্ত নিলে পরবর্তীতে কেইসটিতে কেবল জটিলতাই বৃদ্ধি পাবে এবং কর্মফলস্বরূপ অন্য প্রকারের নেতিবাচক এগ্রাভেশনগুলো সৃষ্টি হবে।

৬. রোগজ বৃদ্ধি (Disease aggravation): আরোগ্যকারী ঔষধ ছাড়া- অন্য যে কোন অবস্থায় বা ঔষধে ক্রনিক রোগগুলো ক্রমহারে বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এটিই ক্রনিক রোগের ধর্ম। এমনকি আরোগ্যযোগ্যতাহীন কেইসগুলোতেও (Incurable Cases) একটি সীমার পর তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এই মূলরোগের অবধারিত বৃদ্ধিটিই হচ্ছে রোগজ বৃদ্ধি, যা তার সহজাত বৈশিষ্ট্য। এটি চিকিৎসাজনিত কোন বৃদ্ধি নয়।
সংক্ষেপে আমার পড়াশুনা ও অভিজ্ঞতা থেকে, চিকিৎসাক্ষেত্রে রোগলক্ষণের বৃদ্ধির এই অবস্থাগুলোর সাথেই আমি পরিচিত হয়েছি। এই বিভিন্ন প্রকারের বৃদ্ধিকে জানতে পারা, বুঝতে পারা- সঠিক ঔষধ নির্বাচনে, সঠিক কেইস ম্যানেজমেন্ট, ফলো-আপ ম্যানেজমেন্টে অপরিহার্য সহযোগিতা করে। হ্যা, একজন চিকিৎসকের সবচেয়ে কাম্য অবস্থা হচ্ছে, কোনরকম এগ্রাভেশন না হয়ে- অবিরত উন্নতি। কিন্তু বাস্তবে বহুকারণে তা সম্ভব হয় না। অনেকে দাবী করেন, অর্গাননের ৬ষ্ঠ সংস্করণে ডা. হ্যানিমান নির্দেশিত পঞ্চসহস্রতমিক স্কেলে এগ্রাভেশন হয় না। কিন্তু আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে- ৪র্থ সংস্করণের সেন্টিসিমাল, ৫ম সংস্করণের স্প্লিটডোজিং ও ৬ষ্ঠ সংস্করণের ফিফটি-মিলেসিমাল- এই তিনটি ধরণের যে কোনটিইতে কার্যক্ষেত্রে বিভিন্ন ফ্যাক্টরের প্রভাবে এগ্রাভেশন হতে পারে। যদিও সেন্টিসিমালের চাইতে স্প্লিটডোজিং, ও তার চাইতেও ফিফটি মিলেসিমালে এই এগ্রাভেশনের প্রকোপ কম কিন্তু কোনটিই চূড়ান্তভাবে মুক্ত নয়। তাছাড়া আমরা দেখতে পেয়েছি বহুপ্রকারের এগ্রাভেশন আছে, যেগুলো আসলে কোনপ্রকারের ঔষধের উপরই আসলে নির্ভর করে না। আর এজন্যই প্রতিটি চিকিৎসককে এই এগ্রাভেশনগুলো সম্বন্ধে সম্যক ধারণা রেখে – তাদের চিকিৎসাক্ষেত্রে তার সুবিবেচনা ও প্রয়োগ ঘটাতে হবে।
Discussion about this post