ডা. শাহীন মাহমুদ:
হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নিয়ে আমাদের মাঝে খুব একটি প্রবল-বিরাজিত বিভ্রান্তি রয়েছে বলেই মনে হয়। রোগীগণ কোন একটি ফার্মাসির বাইরে ‘হোমিওপ্যাথিক’ শব্দটি লেখা দেখলেই ধারণা করেন- সেখান থেকে ক্রয়কৃত ঔষধটিই হোমিওপ্যাথিক ঔষধ। রোগীগণের এই ধারণাটিকে আরো বাঁচিয়ে রেখেছে, আমাদের হোমিওপ্যাথদের নিজেদের মধ্যে থাকা বিভ্রান্তি ও আমাদের মাঝেই থাকা একটি ব্যবসায়িক শ্রেণির লোভ।
আমাদের বিভ্রান্তি বলছি, কারণ অনেক চিকিৎসকেরও হয়তো হোমিওপ্যাথিক ঔষধ কোনটিকে বলা যাবে সে সম্বন্ধে ধারণার অস্বচ্ছতা রয়েছে। ক্লিনিকে একজন রোগী এসে যদি বলে, সে সাইনোসাইটিসের জন্য সাইলিশিয়া – ২০০ খেয়েছে এবং তার উপসর্গের প্রকোপ হ্রাস পেয়েছে- সে কি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ খেয়েছে?
মূলত হোমিওপ্যাথি একটি মূলনীতি ও দর্শনগত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান। যার মূলকথা ‘Similia Similibus Curentur’। অর্থাৎ, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা দিতে হলে, রোগীর শরীরে প্রকাশিত লক্ষণসমষ্টির সমগ্রতার সাথে সদৃশ লক্ষণ ও অবস্থা সৃষ্টি করতে সক্ষম একটি ঔষধ প্রদান করতে হবে। উপযুক্ত সদৃশ ঔষধটি প্রয়োগ করতে পারলে রোগ আরোগ্য হবে। এক্ষেত্রে আপনি যে সদৃশ ঔষধটি রোগীকে প্রয়োগ করলেন, সেটিই হবে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ। সেটা আরো ভালো হোমিওপ্যাথিক ঔষধ হবে,
১. যখন তাকে শক্তিকৃত করা হবে
২. যখন তাকে রোগের শক্তির সাথে সদৃশ শক্তিতে প্রয়োগ করা হবে
৩. যখন রোগের প্রকোপ, তীব্রতা, গভীরতার সাথে সদৃশরূপে তার মাত্রা নিরূপণ করা হবে
অর্থাৎ, যেভাবেই আপনি বিবেচনা করুন না কেন, ‘সদৃশতা’-টিই হচ্ছে মূলকথা। রোগীর সাথে তার সদৃশতার মাত্রা যত বৃদ্ধি পাবে, সেটা তত উত্তম হোমিওপ্যাথিক ঔষধ হিসাবে বিবেচিত হবে কিন্তু মূলে অন্তত হোমিওপ্যাথির মূলনীতি লক্ষণ-সদৃশতা থাকতেই হবে। কাজেই, যেখানেই এই সদৃশতা না থাকবে কিংবা সেই সদৃশতার ভিত্তিতে ঔষধ প্রয়োগ না হবে- তা শক্তিকৃত হোক বা না হোক, তা যে ফার্মাসি থেকেই কেনা হয়ে থাকুক, তার উৎস যেখান থেকেই হোক- সেটি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ হবে না। এবার চলুন, আমরা আগের প্রশ্নটিকেই বিবেচনা করে দেখি, সেটা হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ছিলো কিনা-
ক) ক্রনিক সাইনোসাইটিস (Chronic Sinusitis), রোগীর একটি ক্রনিক প্রদাহজনিত অবস্থা (Chronic Inflammatory Condition) – হোমিওপ্যাথিক দৃষ্টিকোণ থেক যা মাত্র একটি লক্ষণ বা রোগীর একটি বৈশিষ্ট্যকে প্রকাশ করে; কাজেই এই পরিভাষাগত শব্দটি (Nosological Term) শুনে কোনভাবেই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়- রোগী আদৌ হোমিওপ্যাথিক ঔষধ পেয়েছে কিনা।
খ) আমরা দেখতে পাচ্ছি, যেহেতু রোগীর লক্ষণ-সমষ্টির সাথে সাইলিশিয়া সদৃশ কিনা তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়- কাজেই তা শক্তিকৃত হওয়া সত্ত্বেও রোগীর জন্য তা হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ছিলো কিনা, সেটা নিশ্চিত করা আর কোনভাবেই সম্ভব নয়।
গ) কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, রোগীর উপসর্গটিতে উন্নতি হয়েছে। প্রশ্ন আসতে পারে, সদৃশ না হলে তো এই উন্নতি হতো না। কাজেই এই হিসাব মোতাবেক, ঔষধটা তো হোমিওপ্যাথিক ছিলো। কিন্তু এখানেও একটা ফ্যাকড়া রয়ে গেছে; রোগীর স্বাস্থ্যের সার্বিক উন্নতি, বা আরোগ্যের শর্তানুযায়ী, রোগীর স্বাস্থ্যের পুনঃসংস্থাপন (Restoration of Health) হয়েছে কিনা সে সংক্রান্ত কোন তথ্য এখানে নেই। কাজেই, এটি দেখেও বলতে পারা যাবে না যে, আসলেই রোগী আরোগ্য হয়েছে, নাকি তার লক্ষণ অবদমিত (Suppressed) হয়েছে। ফলাফলস্বরূপ, এটাও নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই- রোগী তার হোমিওপ্যাথিক ঔষধটি পেয়েছেন কিনা।
তাহলে আমরা আসলে কি দেখতে পাচ্ছি, একটি জ্ঞাত লক্ষণে শক্তিকৃত ঔষধ প্রয়োগ করার পর সেই লক্ষণ হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও বলার উপায় উপায় নেই- রোগীকে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ দেয়া হয়েছে কিনা; যতক্ষণ না রোগীর ঔষধ নির্বাচনটি হোমিওপ্যাথির মূলনীতি অনুযায়ী নির্বাচন ও প্রয়োগ করা হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যায়।
এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে বায়োকেমিক, প্যাটেন্ট, পলিফার্মাসি, মিক্সড-ঔষধগুলোকে কোনভাবেই আর হোমিওপ্যাথিক বলার কায়দা থাকে কি! এগুলো দিয়ে যারা চিকিৎসা করেন, তাদেরকে আর হোমিওপ্যাথ বলার কোন উপায় থাকে কি?
কথা এখানেই শেষ নয়, এ প্রসঙ্গে আরো একটা ব্যাপার হোমিওপ্যাথদের সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে। হোমিওপ্যাথির আরেকটি মূলনীতি হচ্ছে- ব্যক্তিস্বতন্ত্রতার বিধান (Law of Individuality)। প্রতিটি রোগী পৃথক, স্বতন্ত্র- কাজেই তাদের হোমিওপ্যাথিক ঔষধও পৃথক। একজন রোগীর জন্য যা হোমিওপ্যাথিক (সদৃশ), অন্যজনের জন্য তা হোমিওপ্যাথিক নয় বলেই আমাদের প্রাথমিকভাবে বিবেচনা করতে হয়। সেক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাবো, হোমিওপ্যাথিক ঔষধ কোন নামকরণকৃত শ্রেণি নয়- এটি হচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক নীতিভিত্তিক প্রয়োগের নাম। একজন রোগীতে যথোপযুক্ত নিয়মে প্রয়োগ করে ক্রিয়াশীল হবার আগ পর্যন্ত কোন ঔষধকেই আসলে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ বলে বিবেচনা করা যায় না- এমনকি হোমিওপ্যাথিক মেটেরিয়া মেডিকাতে সেই নামটি যত বিস্তৃতভাবে বর্ণিত থাকুক এবং তার দ্বারা আরোগ্যের যত নিদর্শনই আমাদের সমাজে বর্তমান থাকুক।
আমাদের হোমিওপ্যাথদের আগে এই ব্যাপারটিতে স্বচ্ছ হতে হবে এবং এরপর রোগীদের ধারণাকেও স্বচ্ছ করতে হবে। কারণ, হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগ ব্যতীত রোগীর প্রকৃত আরোগ্য সম্ভব নয়। কিন্তু এই কথাটি শুনে, রোগীগণ বিভিন্ন ফার্মাসি থেকে- ‘যা দেবে তাই’ কিনে এনে আরো নিত্য-নতুন দুর্দশায় পতিত হয়ে- হোমিওপ্যাথ ও হোমিওপ্যাথির গুষ্ঠি উদ্ধার করবে; এটা কখনোই কাম্য হতে পারে না। আর এই বেহাল কর্মকাণ্ডের দরুণ, ইতোমধ্যে হোমিওপ্যাথির যথেষ্ঠ দুর্নাম হয়েছে।
সেই সাথে, হোমিওপ্যাথিক ঔষধগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক থাকায়, রোগী এসে যখন বলেন- ‘আমি অমুক হোমিওপ্যাথের কাছ থেকে ঔষধ খেয়েছি’, তখন আদৌ তিনি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ খেয়েছেন কিনা তা নির্ণয় করাটি তখন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াতে পারে। মোদ্দাকথাটি হচ্ছে, রোগীগণ যেখানে উপযুক্ত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পাবেন, সেখানেই কেবল তার নির্দিষ্ট হোমিওপ্যাথিক ঔষধটি পেতে পারেন। আজকে ফার্মাসিতে সাজানো বা মেটেরিয়া মেডিকাতে লেখা নামের ভিত্তিতে যেরকমভাবে হোমিওপ্যাথিক ঔষধকে চিহ্নিত করার ধারণা সর্বত্র বিরাজিত রয়েছে- তা নিতান্তই বিভ্রান্তিজনক। বর্তমানে আসলে সেই লেবেলকৃত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ দিয়েই উল্টো হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাকে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে। কিন্তু যে সত্যিটা সবাইকে এখন জানতেই হবে, তা হচ্ছে- হোমিওপ্যাথিক (লেবেলকৃত) ঔষধ মানেই হোমিওপ্যাথি নয়; বরঞ্চ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাই একমাত্র স্বতন্ত্র ব্যক্তির হোমিওপ্যাথিক ঔষধকে নির্দিষ্ট করতে পারে।
Discussion about this post