ডা. শাহীন মাহমুদ:
ইতোপূর্বেও কিছু প্রবন্ধে আমি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ও চিকিৎসা সম্বন্ধে আমাদের ও রোগীদের মাঝে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা ও বোধগুলো সম্বন্ধে আলোচনা করেছি। আসলে বহুদিনের ও বহুজনের ভুল প্র্যাকটিসের দরুন আমাদের সমাজের ভেতরে ও বাইরে কিছু ব্যাপারে অস্বচ্ছতা ও বিভ্রান্তি বিরাজ করছে এবং যা থেকে মুক্ত হতে না পারলে চিকিৎসাক্ষেত্রে সঠিক বিচার-বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত প্রয়োগের কাজটি অত্যন্ত কঠিন হয়েই থাকবে এবং সাধারণ মানুষও চিরজীবন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার স্বরূপ, সক্ষমতা, প্রকৃতি সম্বন্ধে অজ্ঞই থেকে যাবে- যা আমাদের কাজে পদে পদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।
বহু চিকিৎসক হয়তো রোগীদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে উদ্যোগী হন না- রোগীগণ অসন্তুষ্ট হবেন বিধায়। কিন্তু একটু দূরদৃষ্টি প্রয়োগ করলে, এই এড়িয়ে যাবার প্রবণতাটিকে কিন্তু আমাদের কম্যুনিটির ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর হিসাবেই দেখতে পাবো। কিভাবে?
আমাদের চিকিৎসকগণ নিজেদের মধ্যে পোটেন্সি নিয়ে অনেকেই বেশ কঠোর মনোভাব পোষণ করেন এবং মেডিক্যাল ইথিকসের বারোটা বাজিয়ে রোগীদের কাছেই অন্য পোটেন্সি ব্যবহারকারী চিকিৎসকের নিন্দা করেন কিংবা সোস্যাল মিডিয়ার মতো খোলা প্লাটফর্মে- এটা নিয়ে (সেই সাথে টেকনিক্যাল আরো বহু বিষয় নিয়ে) বাদানুবাদ শুরু করেন। অবস্থা তাহলে কি দাঁড়ালো! আপনি রোগীদের একটি অংশকে জানিয়ে দিলেন, হোমিওপ্যাথদের মধ্যে একটি বড় অংশ তাদেরকে ভালো ঔষধ দেয় না। সাধারণ মানুষদের কিন্তু এই সব টেকনিক্যাল ব্যাপারে বিচার করার সামান্যতম সক্ষমতাও থাকার কথা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের মনে একটি সহজাত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবেই এবং পূর্ণাঙ্গ বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াই তারা কোন না কোন পক্ষাবলম্বন করবে; এবং তা না করলেও একেকজন ব্যক্তি এধরণের একেক মতামত দেখে বিভ্রান্ত হবে। এবং এরপর তারা আমাদের মতানৈক্য, মতদ্বৈততা দেখে গালাগালি তো করেনই- হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নিয়েও দ্বিধায় ভুগতে থাকেন।
আমরা সবাই জানি, পঞ্চসহস্রতমিক ঔষধ মহাত্মা হ্যানিমানের সর্বশেষ ও পোটেন্সির ব্যাপারে সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়ের আবিষ্কার। কিন্তু পঞ্চসহস্রতমিক ঔষধে যথাবিহিত নিয়মেই পানি ব্যবহার করতে হয়। রোগীগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে এই ধারণার বিস্তার রয়েছে যে, পানিতে ঔষধ দেয়া মানে ভেজাল ঔষধ দেয়া। তাদের মাঝে এই ধারণার সঞ্চার কিভাবে হলো? ২৩০ বৎসর সময় অতিক্রান্ত হবার পরও কেন তারা কেন এখনো জানতে পারলো না যে, হোমিওপ্যাথিক ঔষধের কোন স্বাদ-গন্ধ-বর্ণ, কিচ্ছু নেই?
অসম্মান করতে চাচ্ছি না, কিন্তু সত্যতা, বাস্তবতা ও আলোচনার খাতিরে বলতেই হচ্ছে, আমাদের প্রবীণ চিকিৎসকগণের অনেকেই রোগীর মুখে খুবই তেজযুক্ত দুই ফোঁটা ঔষধ খাইয়ে দেবার এক ধরণের প্রচলন দীর্ঘদিন বহাল রেখেছিলেন- যা এখন দেশের সর্বস্থানের হোমিওপ্যাথিতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীগণ তাদের কথায় গর্বসহকারে উল্লেখ করেন। দীর্ঘদিন তারা সম্ভবত অনৌষধি দিয়ে প্লাসিবো ইফেক্টকে ব্যবহার করেছেন (যদি ঔষধ দিয়ে থাকেন, তাহলেও সেটা অতি বৃহৎ মাত্রার ব্যবহার হয়েছে)। ফলাফল কি হয়েছে? ভালো-খারাপের কথা যদি বাদও দিই- রোগীদের মধ্যে ধারণা হয়েছে, এই ধরণের তেজযুক্ত পদার্থই ঠিকঠাক ঔষধ, আর সব ভেজাল। তার ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে- বর্তমানে যারা তরলে ঔষধ প্রয়োগ করেন- তাদের। আরো সূক্ষ্ম কি ক্ষতিটা হয়েছে? যেখানে হোমিওপ্যাথির প্রাধান্য ও তার বিভিন্ন আঙ্গিককে রোগীদের বোঝানোর জন্য এর শক্তিময়তার নীতিকে তাদের ক্রমান্বয়ে অবগত করা দরকার ছিলো- আমরা এই কাজের দ্বারা তাদের চিন্তাকে আবার সেই বস্তুময়তার দিকেই ঠেলে দিয়েছি; নিদেনপক্ষে সমর্থন করেছি। এবার তারা তাদের সেই ধারণা মোতাবেক তাদের বিভিন্ন রোগলক্ষণের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ঔষধের জোর দাবী জানাতে থাকেন, বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ছুটোছুটি করতে থাকেন এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চান বা করেই ফেলেন।
স্বাধীনতার আগে থেকেই এ অঞ্চলে হোমিওপ্যাথির প্রচলন থাকা সত্ত্বেও, রোগীদের মধ্যে এখনো এই ধারণাটি সৃষ্টি হতে পারেনি যে, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় রোগীর সামগ্রিক অবস্থা, সমস্ত রোগলক্ষণের উন্নতি ঘটে, ব্যক্তি হিসাবে সম্পূর্ণ মানুষটির উন্নয়ন হয়। এখনো তারা প্রচলিত এলোপ্যাথিক ঘরানার ধারণাটি নিয়ে আমাদের কাছে আসেন, একেকটা রোগের ভিত্তিতে চিকিৎসা নিতে এবং তাদেরকে যখন বোঝাতে যাওয়া হয় যে, সত্যিকারের আরোগ্যের জন্য তার সমস্ত রোগলক্ষণগুলিকেই আমাদের বিবেচনা করতে হবে; যদিও সে চর্মরোগটি নিয়ে এসেছেন কিন্তু আমাকে অবশ্যই তার ডায়াবেটিসটার দিকে মনোযোগ দিতেই হবে এবং রোগ একটি নির্দিষ্ট ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে আরোগ্য হবে (হেরিংসের ল’ অনুসারে)- তখন তারা মনে মনে কি ভাবেন, সেটা আল্লাহই জানেন!
বর্তমান সময়ের মানুষ অনেক বেশি সচেতন। তারা যখন আজ বিভিন্ন স্থানে দেখবে- হোমিওপ্যাথিক ঔষধে মাইক্রোস্কোপ দিয়েও বস্তুগত পদার্থ পাওয়া যায় না, তখন তাদের কি উত্তর দেবেন? আর এভাবেই ছোট ছোট প্রায়-নির্দোষ কিন্তু অবিবেচক কর্মকান্ড আমাদের উপর দীর্ঘকালীন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। যেরকমটি আরেকটি ধারণা বহুজনের মধ্যে প্রোথিত- বিশ্বাস না থাকলে হোমিপ্যাথিক ঔষধ কাজ করবে না।
কেন? বিশ্বাসের সাথে এর সম্পর্ক কি? হতে পারে, চিকিৎসক ও চিকিৎসার উপর আস্থা রাখলে, রোগীর ধৈর্য্য বৃদ্ধি পাবে, পর্যাপ্ত সময় চিকিৎসাতে লেগে থেকে উপকৃত হতে পারবেন, রিপোর্টিংও সুন্দর হবে কিন্তু ঔষধ কাজ করা না করার সাথে এর কি সম্পর্ক? বিশ্বাসের আলাদা একটা শক্তি আছে- সেটাও না হয় মেনে নিলাম, কিন্তু তারপরও হোমিওপ্যাথিক ঔষধ কাজ করার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। হোমিওপ্যাথির ভিত্তিপ্রস্তর যারা স্থাপন করেছেন, হোমিওপ্যাথিকে যারা যুগে যুগে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন- তাদের অধিকাংশই হোমিওপ্যাথিকে প্রথমে এটিকে অবিশ্বাসই করতেন এবং এর কার্যক্ষমতার প্রমাণ কোন না কোনভাবে পাবার পর তার উপর আস্থা এসেছে। তাহলে, রোগীদের মধ্যে এই ধারণাটিই বা এত শক্তভাবে আসন গাড়লো কিভাবে?
মোদ্দাকথাটি হচ্ছে, মিথ্যাচার বা অনৈতিক পন্থা কখনোই কোন ইতিবাচক পরিণতি আনতে পারে না। অতীতে বিভিন্ন কারণে যে ভুলগুলো হয়ে গেছে, তাকে পুষে রাখার আমাদের কোন কারণ নেই। এখন যারা সচেতন আছেন এবং নতুন শিক্ষার্থী আছেন, গোড়াতেই তাদের এই বিষয়গুলোতে স্বচ্ছতা এনে, রোগীদের মাঝে থাকা ধারণাকেও স্বচ্ছ করা উচিৎ। সত্যিকারভাবে বলতে গেলে, হোমিওপ্যাথির শ্রেষ্ঠত্ব এর স্বরূপকে সবার সামনে উন্মোচন করতে পারলেই কেবল তারা টের পাবে। যতদিন আমরা প্রচলিত চিকিৎসাধারার সাথে আমাদের পার্থক্যটি রোগীদের বোঝাতে না পারবো- সাধারণ চিন্তায়ই বোঝা যায়, ততদিন তারা আমাদের সেই ধারাটিরই একটি অল্প-খরুচে, ছোটখাটো রোগে চিকিৎসা করতে সক্ষম একটি ফর্ম বলে মনে করবে। হোমিওপ্যাথি যে স্বতন্ত্র, পূর্ণাঙ্গ, আরো শক্তিশালী, যৌক্তিক, বৈজ্ঞানিক ও চূড়ান্ত ভিত্তিযুক্ত একটি চিকিৎসাব্যবস্থা; যার ধরণ-ধারণ, চিন্তন, প্রকৃতি ও স্বরূপ সম্পূর্ণ আলাদা, সেটা রোগীদের মাঝে সুস্পষ্ট করার সময় কি এখনো আসেনি?
Discussion about this post