ডা. সহিদুজ্জামান:
হোমিওপ্যাথিক ঔষধের শক্তি ও মাত্রা (Potency and Dose) নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মতভেদ চলমান রয়েছে। আমি মতভেদের বেড়াজালে না গিয়ে এ ব্যাপারে কিছু মৌলিক আলোচনা করার ইচ্ছায় এ প্রসঙ্গের সূত্রপাত করেছি। আলোচনায় যাওয়ার আগে হোমিওপ্যাথি কী- তা সংক্ষিপ্তভাবে বুঝে নেয়া দরকার। হোমিওপ্যাথি হচ্ছে একটি হলিস্টিক বা সমগ্রতার-ভিত্তিতে চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে রোগীকে সামগ্রিকভাবে ও অ-খণ্ডরূপে বিবেচনা করা হয়। হোমিওপ্যাথিক মতে বিশ্বাস করা হয়- প্রত্যেকটি মানুষ এক অদৃশ্য অতিন্দ্রীয় শক্তি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে- যাকে জীবনীশক্তি (Vital force) বলা হয় এবং রোগও হচ্ছে এক প্রকার অদৃশ্য শক্তি (Miasma) যা মূলত জীবনীশক্তির বিপরীত শক্তি হিসেবে কাজ করে। এই অদৃশ্য নেতিবাচক শক্তির জীবনীশক্তিকে আক্রমণ করার মত উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হলে তা জীবনীশক্তিকে আক্রমণ করে। যদি জীবনীশক্তি রোগশক্তির আক্রমণে পরাজিত হয় – তার ফল হিসেবে শরীরের বিভিন্ন লক্ষণাবলী প্রকাশিত হয়- যা রোগলক্ষণ নামে আমরা প্রত্যক্ষ করি। অর্থাৎ রোগশক্তির জীবনীশক্তিকে আক্রমণ ও তার প্রক্রিয়ার এই পুরো ব্যাপারটি- মানবদেহের বিভিন্ন স্তরগুলোর মধ্যে মানবসংস্থানের শক্তিস্তরে (Dynamic level) সংগঠিত হয়ে থাকে। এর ফলে সৃষ্ট লক্ষণগুলো মানবদেহের অন্যান্য স্তর যেমন মানসিক, আবেগীয়, শারীরিক স্তরগুলোতে প্রকাশ পেয়ে থাকে। যেহেতু মূল ঘটনাটি শক্তিস্তরে হয়ে থাকে- তাই এখানে কোন পরিবর্তন আনতে হলে যা দিয়ে পরিবর্তন আনতে হবে তাকে, অর্থাৎ ঔষধকেও শক্তিকৃত হওয়া আবশ্যক। কারণ শক্তিকে শক্তি ছাড়া স্থুল পদার্থ দ্বারা স্পর্শই করা সম্ভব নয়। তাই প্রকৃত হোমিওপ্যাথিক নীতিতে শক্তিকৃত ঔষধ ছাড়া অন্য ঔষধ ব্যবহার করা সম্ভব নয়।
এছাড়া হোমিওপ্যাথিক ঔষধের শক্তি ও মাত্রা নিয়ে বলার আগে বলতে হয়- শক্তি কি? মাত্রা কি? পদার্থবিজ্ঞান মতে, কোন কাজ করার সামর্থ্যই হচ্ছে শক্তি (Energy)। এই শক্তি দেখা যায় না- কেবল শক্তির ক্রিয়াফলটি দেখা বা অনুভব করা যায়। অধিবিজ্ঞানের (Metaphysics) মতে মূলত সবকিছুই হচ্ছে শক্তি, পদার্থগুলো হচ্ছে শক্তির স্থূলরূপ (অবশ্য বর্তমান উচ্চতর পদার্থবিজ্ঞানও এই মতটি বৈজ্ঞানিক বলে প্রমাণ করেছে)। এই স্থূল পর্দাথগুলোকে নির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আবার শক্তিতে রূপান্তর করা যায়।
হোমিওপ্যাথিক ঔষধের শক্তি বলতে সেই শক্তিকে বোঝায় যা মানবদেহের বিভিন্ন স্তরগুলোতে পরিবর্তন করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করে। মূলত শক্তিকৃত বলতে বোঝানো হয় কিছু নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোন ভেষজ পদার্থের অন্তর্নিহিত পরিবর্তন সাধন ক্ষমতার স্ফূরণ ঘটানো- যার ফলে তা মানবদেহের শক্তির স্তরগুলোতে কাজ করার সামর্থ্য অর্জন করে। ভেষজকে শক্তিকৃত করার যে পদ্ধতি ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান আমাদের শিখিয়ে গিয়েছেন, তদনুসারে আমরা কোন ভেষজকে দুইভাবে শক্তিকৃত করতে পারি। তা হচ্ছে- ট্রাইটুরেশন (Trituration) বা বির্চূণকরণ এবং সাক্কাশন (Succuation) বা ঝাঁকুনি। আবার এই শক্তিকরণের (Potentization) উপায় দুটি ব্যবহার করে ভিন্ন ভিন্ন শক্তিতে পরিণত করার জন্য সাধারণত তিনটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
১. দশমিক পদ্ধতি (Decimal Scale)
২. শততমিক পদ্ধতি (Centesimal Scale)
৩.পঞ্চাশ সহস্রতমিক পদ্ধতি (50 Millesimal Scale)
বাংলায় ‘মাত্রা’ ও ইংরেজিতে ‘Dose’ শব্দটি একটি গ্রীক শব্দ Posos থেকে উৎপন্ন হয়েছে যার অর্থ- পরিমাণ। সুতরাং মাত্রা বলতে কোন কিছুর নির্দিষ্ট পরিমাণকে বোঝায়। যেমন-এক ড্রাম, এক ফোঁটা ইত্যাদি। মাত্রাতত্ব (Posology) বলতে বোঝায় বিজ্ঞানের যে শাখায় মাত্রা বা পরিমাণ নিয়ে আলোচনা করা হয়।
হোমিওপ্যাথিক ঔষধের মাত্রাতত্ত্ব (Homeopathic Posology) বলতে মূলত প্রুভিংয়ের সময় প্রুভারের উপরে অসুস্থতার সময় রোগীর উপর ঔষধ প্রয়োগের পরিমাণকে বুঝানো হয়ে থাকে। হোমিওপ্যাথিক ঔষধ যেহেতু শক্তি তাই এর মাত্রা বা পরিমাণ বলতে ঔষধের শক্তির পরিমাণকেই বোঝানো হয়। এই ব্যাপারটি হোমিওপ্যাথিক দর্শনের সাথে সরাসরি সর্ম্পকযুক্ত কারণ উপযুক্ত শক্তির উপযুক্ত মাত্রায় প্রয়োগের আগে ঔষধের শক্তি ও রোগের শক্তিকে ভালোভাবে উপলদ্ধি করতে হয় এবং তার সাথে, ঔষধের কোন শক্তিটি মানবদেহের কোন স্তরে সাধারণত কতক্ষণ কাজ করার ক্ষমতা রাখে তার একটা ধারণা থাকতে হয়। এই মাত্রার প্রয়োগ নিয়ে বিভিন্ন প্রকারের মতভেদ ও মতবাদ প্রচলিত রয়েছে এবং এই মতবাদ অনুসরণকারীদের সংখ্যাটাও কম নয়। আমরা বিভিন্ন মতবাদের বেড়াজালে না গিয়ে ব্যাপারটি সহজ সরলভাবে বোঝার ও বোঝানোর চেষ্টা করেছি।
রোগ হচ্ছে একপ্রকার শক্তি এবং তা জীবনীশক্তিকে আক্রমণ করার পর- তা মানবদেহের বিভিন্ন স্তরগুলোর (Level of Human being) মধ্যে কোন স্তরে অবস্থান করছে তার অবস্থান অনুযায়ী ঔষধেরও শক্তির মাত্রা পরিবর্তন করতে হবে। তাই উপরোল্লিখিত কোনো স্কেলের দ্বারা শক্তিকৃত ঔষধকেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। মাত্রার বিভিন্ন প্রকার রয়েছে- কোন রোগীর ক্ষেত্রে রোগশক্তির পরিমাণ কতটুকু বা রোগশক্তি কোন রোগীর কতটুকু ক্ষতি করেছে, তার উপর র্নিভর করে ঔষধশক্তির মাত্রা নির্ধারিত হবে। হোমিওপ্যাথির একটি মৌলিক নীতি হচ্ছে রোগীর ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রতা নির্ধারণ। আমি মনে করি এই নীতিটি মাত্রা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বিবেচনায় আনতে হবে। কারণ প্রত্যেকটি রোগীর ক্ষেত্রে রোগের ধরণ, তীব্রতা ইত্যাদি অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন শক্তির, ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা নির্ধারিত হবে। তাই এই শক্তি মাত্রা নির্বাচন নিয়ে গোঁড়ামী করার কোন যুক্তি ও অবকাশ নেই।
Discussion about this post