গত পর্বে স্ত্রী প্রজননতন্ত্রের রোগাবস্থায় প্রকাশিত লক্ষণাবলীকে সহজে আয়ত্বের জন্য ৭টি প্রধান বিভাগে ভাগ করে নেয়া যায় বর্ণনা করে, সেই বিভাগগুলোর শিরোনামগুলো উল্লেখ করেছিলাম এবং প্রথম অভিযোগ ‘মাসিকের অনিয়মের অভিযোগ’ টির বিস্তারিত তথ্য আলোচনা করেছিলাম। গত পর্বে এটাও উল্লেখ করেছিলাম যে, অধিকাংশ রোগীনীতে এই ৭টি পয়েন্টের উপর ভিত্তি করে প্রশ্নউত্তরের মাধ্যমে কেইস টেকিং করলে পূর্ণাঙ্গ রোগীলিপি করা সহজ হয়। কাজেই আসুন, এবার বাদবাকী ৬টি বিভাগের সাথেও পরিচিত হই-
২। মাসিক ছাড়া অন্য স্রাবের অভিযোগ (Vaginal Discharge)
রোগীনী যোনি পথে মাসিক রক্তস্রাব ছাড়া অন্যকোন স্রাব নির্গত হওয়ার অভিযোগ করলে চিকিৎসক তার রোগাবস্থাকে যোনি পথে স্রাব ঘটিত অসুস্থতা (Vaginal Discharge) বলে চিহ্নিত করতে পারেন, এরা নিম্নরূপ হতে পারে –
ক) শ্বেতপ্রদর (Leucorrhoea) – যোনি পথে অস্বাভাবিক মাত্রায় স্রাব নির্গত হওয়া।
খ) ট্রাইকোমোনাস যোনিপ্রদাহ (Trichomonas vaginitis) – যোনি পথে বা জরায়ুতে ট্রাইকোমোনাস জীবানু সংক্রমণের ফলে চুলকানিযুক্ত অস্বস্থিকর শ্বেতপ্রদর বা সাদা স্রাবযুক্ত যোনি + জরায়ু প্রদাহ ।
গ) মনিলিয়াসিস সংক্রমণ (Moniliasis) – যোনি পথে বা জরায়ুতে মনিলিয়াসিস গোত্রের ফাংগাস সংক্রমণের ফলে চুলকানিযুক্ত অস্বস্থিকর শ্বেতপ্রদর বা সাদা স্রাবযুক্ত যোনি-জরায়ু প্রদাহ।
ঘ) পুঁজৎপাদক যোনিপ্রদাহ (Pyogenic vaginitis) – যোনিপথে পুঁজ স্রাবযুক্ত যোনি প্রদাহ।
ঙ) ক্যান্সার জনিত স্রাব (Neoplastic discharge) – স্ত্রী জননেন্দ্রিয়ে ক্যান্সার জনিত কারণে সাদা স্রাব বা রক্তময় স্রাব।
৩। তলপেটে বেদনার অভিযোগ (Pain in lower abdomen)
রোগীনী তলপেটে বা নিম্ন উদরে বেদনার অভিযোগ করলে চিকিৎসক নিম্ন উদরের বেদনাযুক্ত ব্যাধি (Pain in lower abdomen) বলে চিহ্নিত করতে পারেন, এরা নিম্নরূপ হতে পারে –
ক) কষ্টরজঃ বা বাধকবেদনা (Dysmenorrhoea) – বেদনাপূর্ণ মাসিক ঋতুস্রাব।
খ) গর্ভপাত (Abortion) – ২৮ সপ্তাহের পূর্বে গর্ভাবস্থা অব্যাহত রাখার ব্যর্থতা, ফলে গর্ভস্থ ভ্রুণ নষ্ট হয়ে যায়। এটি কয়েক প্রকার-
(১) আশংকাগ্রস্থ গর্ভপাত (Threatened abortion), যা চিকিৎসার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব
(২) অপ্রতিরোধ্য গর্ভপাত (Inevitable abortion), যা চিকিৎসার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় না, এটি অসম্পূর্ণ গর্ভপাত (Incomplete abortion) এবং সম্পূর্ণ গর্ভপাত (Complete abortion) হতে পারে।
(৩) লুক্কায়িত গর্ভপাত (Missed abortion) – এতে ২৮ সপ্তাহের পূর্বে গর্ভস্থ ভ্রুণ মারা যায়, কিন্তু জরায়ু তাকে বের করে দিতে না পারার কারণে মৃত ভ্রুণ জরায়ুতেই অবস্থান করে।
(৪) সংক্রমণযুক্ত গর্ভপাত (Septic abortion) – গর্ভপাতের পর জরায়ুতে সংক্রমণ হয়ে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়।
(৫) অভ্যাসগত গর্ভপাত (Habitual abortion) – যখন পর পর তিন বার স্বতোজাত গর্ভপাত ঘটে।
গ) জরায়ু বর্হিভুত গর্ভধারণ (Ectopic pregnancy) – যখন জরায়ুর বাইরে টিউবে বা ওভারীতে ডিম্বানু সংস্থাপন হয়।
ঘ) এন্ডোমেট্রিওসিস (Endometriosis) – জরায়ু গহ্বর আবরণী ঝিল্লি জরায়ুর অভ্যন্তরে বা পেলভিক অরগানের মধ্যে থাকলে তাকে এন্ডোমেট্রিওসিস বলা হয়।
ঙ) মূত্রাশয় প্রদাহ (Cystitis) – নানাবিধ কারণে ব্লাডার প্রদাহিত হতে পারে এবং তা স্ত্রী জননেন্দ্রিয়ে বিস্তার লাভ করতে পারে।
চ) জরায়ু-যোনিপথের প্রলাপ্স (Uterovaginal prolapse)- জরায়ু নিজ অবস্থানে না থেকে নিচের দিকে নেমে আসে এবং এতে যোনিপথেরও স্থান বিচ্যুতি ঘটে।
৪। তলপেটে চাকা থাকার অভিযোগ (Swelling or mass in the lower abdomen)
রোগীনী তলপেটে অস্বাভাবিক স্ফীতি বা চাকা (Swelling or mass in the lower abdomen) থাকার অনুভুতির কথা অভিযোগ করলে, তা নিম্নরূপ এক বা একাধিক কারণে হতে পারে –
ক) জরায়ুর ফাইব্রোমায়োমা (Fibromyoma of uterus)
খ) ডিম্বাশয়ের টিউমার (Ovarian tumour)
গ) এন্ডোমেট্রিয়ামের টিউমার (Endometriotic tumour)
ঘ) টিউব-ডিম্বাশয়ের চাকা (Tubo-ovarian mass)
ঙ) জরায়ু বর্হিভুত গর্ভধারণ (Ectopic pregnancy)
চ) জরায়ুর মধ্যে মাসিকের রক্ত জমাটবদ্ধতা জনিত রক্তপিন্ড (Haematometra)
৫। যোনি পথে কিছু নেমে আসার অভিযোগ (Something coming out per vagina)
রোগীনী যোনি পথে কোন কিছু যেন নিচে নেমে আসছে (Something coming out per vagina) এরূপ অনুভুতিযুক্ত অভিযোগের কথা জানালে তা নিম্নরূপ কারণ জনিত ব্যাধি হতে পারে-
ক) জরায়ু-যোনিপথের প্রলাপ্স (Uterovaginal prolapse)
খ) জরায়ু গাত্র উদ্ভুত পলিপ (Momatous polyp)
গ) জরায়ুর পুরাতন প্রকৃতির উল্টানো অবস্থা (Chronic inversion of the uterus)
ঘ) জরায়ুগ্রীবার অস্বাভাবিক লম্বা হওয়া (Elongated cervix)
ঙ) বহিঃজননেন্দ্রিয়ের টিউমার (Valval tumours)
৬। গর্ভ সম্পর্কিত অভিযোগ বা ধাত্রীবিদ্যাগত অসুস্থতা (Obstetrics complain or disorder)
গর্ভাবস্থায় বা প্রসবের পরে নানা রকম অসুস্থতার কথা জানালে তা ধাত্রীবিদ্যাগত অসুস্থতা (Obstetrics complain or disorder) বলে শ্রেণীবিভাগ করা হয়, এরা নিম্নরূপ হতে পারে-
ক) প্রাতঃকালীন বমন (Morning sickness of Vomiting of pregnancy)
খ) অস্বাভাবিক ভয়ানক বমন (Hyperemesis gravidarum)
গ) রক্তাপ্লতা (Anaemia of pregnancy)
ঘ) গর্ভাবস্থায় বিষক্রিয়া (Toxemia of pregnancy- Pre-eclampsia, Eclampsia)
ঙ) গর্ভাবস্থায় প্রসবপূর্ব রক্তস্রাব (Antepartem Haemorrhage-Placenta praevia)
চ) প্রসূতিকালের অসুস্থতা (Puerperium)
ছ) প্রসব পরবর্তী রক্তস্রাব (Post partum Haemorrhage)
জ) প্রসব পরবর্তী জ্বরাবস্থা (Puerperul pyrexia)
ঝ) প্রসব পরবর্তী সংক্রমণ (Puerperul sepsis)
৭। মাসিক চিরস্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরের অভিযোগ (Menopausal Complaints)
মাসিক চিরস্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার (Menopause) পরের অভিযোগসমূহকে দুটি ভাগে ভাগ করে নেয়া যায়-
i) স্ত্রীজননেন্দ্রিয় থেকে রক্তস্রাব জনিত অসুস্থতা, এবং
ii) রক্তস্রাববিহীন অসুস্থতা
ক) স্ত্রীজননেন্দ্রিয় থেকে রক্তস্রাব হলে (Post menopausal bleeding) তা বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন-
(১) ডিস্ফাংশানাল ইউটেরাইন ব্লিডিং (Dysfunctional Uterine Bleeding -DUB)
(২) জরায়ু গ্রীবার ক্যান্সার (Carcinoma of cervix)
(৩) জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়াম পেশীর ক্যান্সার (Endometrial Carcinoma)
(৪) জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়াম এর পলিপ (Endometrial Carcinoma)
(৫) আঘাতজনিত ক্ষতাবস্থার জন্য (Tramatic Ulcer)
খ) রক্তস্রাববিহীন অসুস্থতা- রোগীর মাসিক চিরস্থায়ী ভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নানা রকম অসুস্থাবস্থা দেখা যেতে পারে, তাদেরকে রজঃনিবৃত্তিকালীন উপসর্গ (Menopausal or Climacteric symptoms) বলা হয়।
স্ত্রীজননেন্দ্রিয়ের অসুস্থতার উল্লেখিত ৭টি প্রধান বিভাগের অভিযোগ ও অসুস্থতা ছাড়াও আরও বহুবিধ রোগাবস্থাকে স্ত্রীজননেন্দ্রিয় বিষয়ক অসুস্থতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যেমন –
১। গর্ভধারণে অক্ষমতা ও স্বাভাবিক দাম্পত্য সর্ম্পক পরিচালনায় অক্ষমতা (Failure to conceive) – তা নিম্নরূপ কারণ হতে উদ্ভুত হতে পারে –
ক) বন্ধ্যাত্ব (Sterility) – স্ত্রীরোগীর অসুস্থতার জন্য
খ) ধ্বজভঙ্গ (Impotency) – পুরুষ রোগীর অসুস্থতার জন্য
গ) চরমপূলক লাভে ব্যর্থতা (Failure of orgasm) – স্বামী-স্ত্রীর মনোদৈহিক সমস্যার জন্য
ঘ) বেদনাদায়ক যৌনসঙ্গম (Dyspareunia)
ঙ) সংক্রামক ব্যাধি বা অন্য কোন ব্যাধি যেমন- সিফিলিস, গনোরিয়া, যক্ষা, ডায়বেটিস ইত্যাদি ।
২। মূত্রত্যাগের বিবিধ অসুস্থতা (Difficulty in micturition): তা হতে পারে –
ক) মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণজনিত ব্যাধি (Urinary tract infection -UTI)
খ) মূত্রধারণে অক্ষমতা (Incontinence of urine)
৩। স্ত্রীজননেন্দ্রিয়ের কদাচিৎ পাওয়া যায় এরূপ কয়েকটি অসুস্থতা –
ক) জরায়ুগ্রীবার আড়ষ্টতা (Cervical stenosis)
গ) জরায়ুর রক্তস্বল্পতা ও বিশুস্কতা জনিত শীর্ণতা (Uterine hypoplasia and Ischaemia)
ঘ) বস্তিকোটরের ক্রনিক পুঁজৎপাদক ফোঁড়া (Chronic pelvic cellulitis)
ঙ) বস্তিকোটরের পেরিটোনিয়ামের প্রদাহ (Pelvic peritonitis)
চ) ডিম্বাশয় ও ডিম্বনালীর ক্রনিক প্রদাহ (Chronic sulphingo-oophoritis)
ছ) হাইডেটিফরম মোল (Hydatidiform mole)
৪। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আরোগ্যযোগ্য কয়েকটি স্ত্রীজননেন্দ্রিয়ের অসুস্থতা (স্বাভাবিক ঔষধ প্রয়োগে চিকিৎসা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এখানে অকার্যকর) –
ক) জরায়ুর গ্রীবায় ছিদ্রপথ না থাকা (Non-canalization of cervix)
খ) সতিচ্ছেদ বা হাইমেনে ছিদ্র না থাকা (Imperforated hymen)
গ) যোনিপথের নিম্নদেশে বিভেদক পর্দা থাকা (Septum at the lower part of vagina)
ঘ) হাইডেটিফরম মোল (Hydatidiform mole) – সম্পূর্ণ বের না হলে।
ঙ) স্ত্রীজননেন্দ্রিয়ের প্রলাপ্স (Genital prolapse)- রোগী যদি ৪৫ উর্দ্ধ বয়সের হয় বা ৩য় ডিগ্রি প্রলাপ্স হয়।
চ) যোনিপথ ও মূত্রনালীর ফিশ্চুলা (Urogenital fistula / Vesico-vaginal fistula, V.V.F.) – ঔষধ প্রয়োগে আরোগ্য না হলে।
ছ) জরায়ুর গঠনগত অপূর্ণতা (Faulty uterine development)
স্ত্রীপ্রজননতন্ত্রের অভিযোগ, অসুস্থতা – তথা সমস্যাবলী সম্বন্ধে আমরা হয়তো আগের পর্বসহ উপরোক্ত আলোচনাটিতে একটি ধারণা লাভ করতে পেরেছি। কিন্তু চিকিৎসকের মূল উদ্দেশ্য আরোগ্য করা এবং উপর্যুক্ত আলোচনার লক্ষ্যও সেটিই। কাজেই, এখন উক্ত সমস্যাগুলোর আরোগ্যকারী চিকিৎসা ও তার মূলনীতি প্রসঙ্গে আগামী পর্বে আলোচনা করতে যাচ্ছি এবং সেই সাথে আগামী পর্বে আমি স্ত্রীপ্রজননতন্ত্রের অসুস্থতার একটি সংক্ষিপ্ত রেপার্টরি প্রদান করার ইচ্ছা রাখি।
Discussion about this post