ডা. শাহীন মাহমুদ:
এর আগের কয়েকটি লেখায় আমি হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধে জনমানুষের ভ্রান্ত ধারণা অপসারণের লক্ষ্যে কিছু কথা লিখেছিলাম। আজ আরেকটি সে রকমই একটি ভুল ধারণা নিয়ে আলোচনার লক্ষ্যে লেখাটা শুরু করছি। হোমিওপ্যাথরা বহুসংখ্যকবার এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন যে, হোমিওপ্যাথি সার্জারিকে সমর্থন করে কিনা?
হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধে সাধারণভাবে এ ধারণা প্রচলিত যে, হোমিওপ্যাথিতে সার্জারি বা শল্য চিকিৎসা নেই। এই ধারণা সমাজে এতটাই বদ্ধমূল যে, প্রচলিত ধারার চিকিৎসকরা কোন একটা টিউমার, বা এপেন্ডিসের প্রদাহ, গলব্লাডার বা কিডনীর ষ্টোন বা অন্য যে কোন ব্যাপারে সার্জারীর পরামর্শ দিলে, রোগীরা কোন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের কাছে যেতে ভয় পান- যদিও তাদের অনেকেরই ধারণা আছে যে- হোমিওপ্যাথিতে এগুলো সার্জারি ছাড়াই আরোগ্যের সম্ভাবনা আছে। তাদের ভয়টা অনেকটা এই রকম, “হোমিওপ্যাথিতে যেহেতু সার্জারী নেই, কাজেই অসুখটা না সারাতে পারলে, তা ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে এবং একপর্যায়ে জীবন সংশয় দেখা দেবে, কিন্তু হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক প্রয়োজনবোধে সময়মত সার্জারীর পরামর্শ দেবেন না বা প্যাথলজিক্যাল ডায়াগনোসিস করে আমার রোগের ক্ষতির মাত্রা, এর অগ্রগতি, অবনতির দিকে লক্ষ্য রাখবেন না। কাজেই নিজের জীবনের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি নেয়া চলে না।”
নিজের জীবনের ব্যাপারে ভয় ও সতর্কতা অত্যন্ত স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক ও যৌক্তিক একটা ব্যাপার। কিন্তু নিজের আরোগ্যের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে গিয়ে সর্বোত্তম আরোগ্যপদ্ধতি থেকে দূরে থাকা কোনমতেই যৌক্তিক নয় এবং এটা মানবজাতির এক ধরণের ক্ষতির আওতায় পড়ে।
হোমিওপ্যাথিতে সার্জারির অবস্থান সম্বন্ধে আলোচনার আগে, সার্জারিবিদ্যার নিজের বৈশিষ্ট্য ও চিকিৎসাবিদ্যায় এর অবস্থান সবার একটু জেনে নেয়া উচিৎ। প্রচলিত ধারার চিকিৎসকরা প্রভূত সরকারী সহযোগীতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, অর্থনৈতিক বাজেটে সমৃদ্ধতা, উন্নত শিক্ষাক্ষেত্র ও শিক্ষা-ব্যবস্থাপনা, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও হেলথ কমপ্লেক্সগুলোতে নিয়োগ- মোটকথা রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে সার্বিক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। ফলাফলস্বরূপ চিকিৎসাক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সমস্ত শল্যবিদ বা সার্জন প্রচলিত চিকিৎসাধারা থেকেই তৈরি হচ্ছেন। এছাড়াও বাংলাদেশে সমৃদ্ধ, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও নিয়মিত কোন হোমিওপ্যাথিক হাসপাতাল না থাকায়, সার্জারির সার্বিক তত্ত্বাবধায়ন- প্রি-অপারেটিভ, পোষ্ট অপারেটিভ প্রসিডিউর, ঔষধাদি ইত্যাদি ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথির কোন ব্যবহার হয় না, তার কোন সুযোগও নেই- যদিও হোমিওপ্যাথিতে এগুলোর ক্ষেত্রেও খুব ভালো সক্ষমতা বিদ্যমান এবং অন্যান্য দেশে এর ব্যাপক সফলতাও প্রমাণিত।
বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথির এই পশ্চাৎপদতার দরুণ, সবার বদ্ধমূল ধারণা- সার্জারি এলোপ্যাথিক চিকিৎসার অর্ন্তভুক্ত বিষয় ও সহযোগী কর্মপদ্ধতি। প্রকৃতপক্ষে, সার্জারি কোন চিকিৎসা পদ্ধতিরই অর্ন্তভুক্ত নয়। এটা চিকিৎসার একটা নিজস্ব নিরপেক্ষ ক্ষেত্র, যার শরণ রোগীর আরোগ্যের প্রয়োজনে, যে কোন প্যাথির যে কোন চিকিৎসক নিতে পারেন। এমনকি সার্জারিতে ব্যবহৃত কোন যন্ত্রপাতি বা অস্ত্র- কোন কিছুই কোন নির্দিষ্ট চিকিৎসাপদ্ধতি কর্তৃক সরবরাহকৃত বা এর অর্ন্তভুক্ত বলে দাবী করা নিষিদ্ধ।

কাজেই, সার্জারী- এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, ইউনানী, আয়ুর্বেদী যে কোন ধরণের চিকিৎসকই এটা ব্যবহার করতে পারেন কিন্তু এটা কোন প্যাথিরই নিজস্ব কর্মক্ষেত্র নয়। এ প্রসঙ্গে Dr. E. Balakrishnan এর মন্তব্য,
“সার্জারি কোন একটা চিকিৎসাব্যবস্থার নিজস্ব সম্পত্তি নয়। যখন কোন রোগীর রোগাক্রান্ত অঙ্গ থেকে উৎপন্ন যন্ত্রনা প্রশমন করার জন্য প্রযুক্তিগত ও যান্ত্রিক সহযোগীতার প্রয়োজন পড়ে, সেক্ষেত্রেই আমরা সার্জারীর শরণাপন্ন হই। চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষিত যে কোন ব্যক্তি, হোক সে হোমিওপ্যাথ, এলোপ্যাথ, আয়ুর্বেদিস্ট, যিনিই চিকিৎসার ক্ষেত্রে শল্যবিদ্যায় পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন করবেন এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবেন, তাকেই এ কাজের জন্য আমন্ত্রণ জানানো যায়। ১০০ বৎসর আগেও আমরা আয়ুর্বেদিক বহু চিকিৎসককেই দেখতে পাই যারা দক্ষ সার্জনও ছিলেন।”
মানুষের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রাধান্য হচ্ছে মানুষের জীবনের। তাই সবার আগে যে বিষয়টার দিকে লক্ষ্য করতে হয় তা হচ্ছে- রোগীর “জীবন রক্ষা”। এরকম জরুরী অবস্থায় কোন্ ঔষধে কি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে, রোগী কতটা দুর্বল হবে, রোগীর কতটা কষ্ট হবে, রোগী সম্পূর্ণ আরোগ্য হবে কিনা এসব কিছুই দ্রষ্টব্য নয়। সেখানে একটাই লক্ষ্য “রোগীকে এখন মরতে দেয়া যাবে না”।

কিন্তু এই জরুরী অবস্থা না থাকলে, উপরোক্ত বিষয়গুলোর প্রত্যেকটাই চিকিৎসাক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হবে। এই জরুরী ক্ষেত্রগুলোতে প্রয়োগযোগ্য খুব ভালো ঔষধই হোমিওপ্যাথিতে আছে, তা যে কোন ধরণের এমার্জেন্সিই হোক না কেন! কিন্তু সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধায়নের সুবিধা না থাকায়- এইসব বেশিরভাগ ঝুঁকিবহুল জরুরী ক্ষেত্রে বিচক্ষণ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকরা এই ধরণের রোগীর সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের কাঁধে রেখে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে চান না এবং হোমিওপ্যাথির এই সীমাবদ্ধ পরিসরে, এত স্বল্প সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্ত অবস্থানের ক্ষেত্রে এই দায়িত্ব নেবার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু তাই বলে, কোন জরুরী ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ফার্ষ্ট এইড, মেকানিক্যাল বা ম্যানুয়াল এমার্জেন্সি সাপোর্ট থেকে কিংবা প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সার্জারীর সহায়তা গ্রহণ করতে হোমিওপ্যাথিতে কোনভাবেই কোনরকম উদাসীনতা অবলম্বনের শিক্ষা দেয়া হয় না। বরং প্রত্যেকটা হোমিওপ্যাথকে এ ব্যাপারে সিলেবাসের অর্ন্তভুক্ত পাঠ্যক্রম অনুযায়ী শিক্ষা দেয়া হয়। হোমিওপ্যাথিক ডিগ্রিগুলোর দিকে তাকালে, আমি মনে করি কারো আর এ ব্যাপারে ভ্রান্তির কোন অবকাশ থাকবে না।
পৃথিবীতে প্রচলিত সবগুলো চিকিৎসাপদ্ধতিই সম্ভবত তার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচেষ্টা চালায় তার মাধ্যমে চিকিৎসাকৃত রোগীকে সর্বাপেক্ষা উন্নত ও আরোগ্যপ্রদ চিকিৎসা প্রদান করার- কিন্তু কতটুকু পারবে সেটা নির্ভর করে মূলত উক্ত চিকিৎসাব্যবস্থায় সেটা কতটুকু সম্ভব তার উপর। কারণ প্রত্যেক চিকিৎসাব্যবস্থারই সীমাবদ্ধতা আছে। রোগ যখন ব্যবস্থাটির এই পরিধি অতিক্রম করে তখন বাধ্য হোয়ে চিকিৎসককে ভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় এবং ক্ষেত্র অনুযায়ী সার্জারির দারস্থ হোতে হয়। হোমিওপ্যাথিও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু অন্যান্য চিকিৎসাব্যবস্থা থেকে এর পার্থক্য হচ্ছে, এর সীমাবদ্ধতা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। হোমিওপ্যাথি রোগীর শরীরে বহিঃপ্রকাশিত লক্ষণসমষ্টির সাদৃশ্যের উপর ভিত্তিতে চিকিৎসা করে এবং রোগীকে সবচাইতে দ্রুত, মৃদু উপায়ে, যথাসম্ভব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে, সম্পূর্ণরূপে বা সমূলে রোগকে উৎপাটন কোরে রোগীর স্বাস্থ্যের পুনঃসংস্থাপন করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। এবং এই পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে রোগারোগ্যের সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক সূত্রের উপর ভিত্তি করে। কাজেই, হোমিওপ্যাথিতে বেশিরভাগ রোগই ঔষধপ্রয়োগেই আরোগ্যযোগ্য বোলে প্রতীয়মান হয়।
Angioma/Hemangioma, Fissures, Ischiorectal Abscess, Duodenal ও Gastric ulcer, Gall bladder stones, Mastoid, Nasal Polyp, Nephrotomy, Piles, Prostate Problem, Renal Calculi, Sarcoma, Tonsils, Adenoid, Uterine fibroid, Uterine prolapse, Rectal prolapse ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোতে রোগীরা শল্যচিকিৎসার জন্য দৌড়ে যান কিন্তু এই রোগগুলো হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় নিরাপদে এবং সফলতার সাথে চিকিৎসা করা যেতে পারে এবং এর আরোগ্যে অসংখ্য রিপোর্ট সবিস্তারে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা-শাস্ত্রে বিদ্যমান। এসব ক্ষেত্রে সার্জারির মাধ্যমে অসুস্থ টিস্যু বা অঙ্গকে কেটে ফেলা হয় বা প্রতিস্থাপন করা হয়। কিন্তু এতে রোগীর ধাতুপ্রকৃতির (Constitution) ত্রুটিটির কোন যুক্তিসম্মত সমাধান বা আরোগ্য বা শোধন ঘটে না। যে পর্যন্ত না ধাতুপ্রকৃতির এই ত্রুটিযুক্ত অবস্থাটি বিচক্ষণ চিকিৎসাপদ্ধতির দ্বারা সংশোধন না করা হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই শারিরীক গঠনের পরিবর্তনসাধ্য অসুস্থতাটি বার বার ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকবেই।
একটা উদাহারণ দিয়ে ব্যাপারটা একটু পরিস্কার কোরছি। “Coronary Heart Disease” এর ক্ষেত্রে জরুরী অবস্থাটি প্রায়ই “Coronary By-pass” সার্জারির মাধ্যমে সমাধান করা হয়। এতে আসলে কি ঘটে ?
“Apart from a surgical mortality rate of about 5% and an incidence of late closure of the by-pass graft of about 20%, the major complication of Coronary by-pass surgery is the development of a new myocardial infarction, in 10-12% of patients. In one study, two-thirds of patients, following surgery, had at least one new occlusion of a previously patent coronary artery as studied by coronary angiography.”
অর্থাৎ,
“প্রায় ৫% অস্ত্রচিকিৎসাকালীন মৃত্যুহার বাদেই, প্রায় ২০% রোগীর ক্ষেত্রে বাইপাসকৃত অংশটির জোড় নিতে বিলম্ব ঘটে এবং এর সবচেয়ে বড় জটিলতা হোচ্ছে, ১০-১২% রোগীর ক্ষেত্রে একটি নতুন মায়োকার্ডিয়াল ইনফারকশনের উদ্ভব হয়। একটি গবেষণা অনুসারে, এই সার্জারি করা প্রতি ৩ জন রোগীর মধ্যে ২ জনের ক্ষেত্রে করোনারি এনজিওগ্রাম করে পূর্বে সুসংরক্ষিত করোনারি আর্টারীতে অন্ততঃ একটি নতুন প্রতিবন্ধক দেখা যায়|”
[Current medical diagnosis and treatment – by Marcus A Krupp and Milton J Chatton]
উপরোক্ত মন্তব্য থেকেই এই হৃদরোগের আরোগ্যকল্পে “Coronary By-pass” এর ভূমিকা সুষ্পষ্ট হয়। এরকমভাবে অন্যান্য রোগলক্ষণগুলো, অর্থাৎ ইউটেরাইন টিউমার, ওভারিয়ান সিষ্ট ইত্যাদি জাতীয় শেষ ফলগুলো (End Products of Diseases) সার্জারির মাধ্যমে দূর করা হলেও ধাতুপ্রকৃতি সংক্রান্ত গন্ডগোল থেকেই যাবে। বংশগত প্রভাব এবং জীবনযাত্রার যে চোরাগর্ত ও ত্রুটি-বিচ্যুতি এই অবস্থার উদ্ভব ঘটাতে মূল ভূমিকা রাখে- সেগুলো সংশোধিত করতে এবং রোগীর আয়ুকে দীর্ঘ ও জীবনকে প্রশান্ত করতে চাইলে, যথাযথ আরোগ্যক্ষমতাসম্পন্ন চিকিৎসার মাধ্যমেই তা করতে হবে। অপরদিকে, এমন কোন রোগ নেই যেখানে রোগীর পর্যাপ্ত তথ্য পেলে, রোগী তার রোগের একদম প্রান্তসীমায় উপনীত না হোলে এবং আরোগ্যের পথে অতিরিক্ত বিঘ্ন না সৃষ্টি করলে কিংবা অতি-বয়সের কারণে নিরাময়যোগ্যতা হারিয়ে না ফেললে, ভালো হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের নিকট রোগটি আরোগ্যযোগ্য নয় বা আরোগ্যের ইতিহাস হোমিওপ্যাথিক শাস্ত্রে নেই।
কিন্তু আরোগ্য অসাধ্য ঐসব প্রতিকূল অবস্থাগুলো উপস্থিত হলে চিকিৎসককে রোগীর জন্য সর্বাপেক্ষা উপযোগী উপদেশ প্রদান করতে হবে এবং প্রয়োজনে সেটা সার্জারিও হতে পারে। আরোগ্যের এই ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধতা ও বিস্তৃত সম্ভাবনা থাকায় এবং উন্নত ঔষধপ্রয়োগবিদ্যা ও পর্যাপ্ত ঔষধ থাকায়, হোমিওপ্যাথিতে চিকিৎসার শুরুতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসককে সার্জারির দারস্থ হতে হয় না। হোমিওপ্যাথিতে চিকিৎসক চান, রোগীর দুর্ভোগ ও ভোগান্তিকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আরোগ্যের লক্ষ্যে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে। প্রকৃতপক্ষে কিন্তু সমস্যাটা শুরু হয় তখনই। কারণ অন্য প্যাথির বা প্রচলিত ধারার চাকচিক্যময় পদ্ধতি যেখানে ইংরেজী, বাংলা এবং ল্যাটিনে রোগীকে হলফ করে বলে দিয়েছে যে, রোগীর আর ঔষধের মাধ্যমে ভালো হবার সম্ভাবনা নেই, তাকে সার্জারি করতেই হবে। সেখানে এই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকরা এর ঠিক বিপরীত কথাই বলছেন !
একটা কথা ভুললে চলবে না, হোমিওপ্যাথির আবিস্কর্তা ডা. স্যামুয়েল হানিম্যান নিজে তৎকালীন সময়ের যথেষ্ট প্রশিক্ষিত একজন চিকিৎসক ছিলেন এবং হোমিওপ্যাথিতে সার্জারির প্রয়োজনীতা ও এর ক্ষেত্র সম্বন্ধে তিনি সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করে গেছেন । এমনকি কোন্ কোন্ ক্ষেত্রগুলোতে শুরুতেই সার্জারি কোরতে হবে বা কোন্ সমস্যাগুলো শল্যবিদ্যার মাধ্যমেই শুধু চিকিৎসাযোগ্য, তাও তিনি সুষ্পষ্টভাবে বিবৃত করে গেছেন (Organon of Medicine, Aphorism-186) । এছাড়াও আধুনিক রোগ, নতুন নতুন সমস্যা, সার্জারীর ক্ষেত্রগুলো সম্বন্ধে আমরা অবিরতই অবগত হচ্ছি। কাজেই কারোরই এ ব্যাপারে কোন রকমের ভ্রান্তির অবকাশ থাকার কথা নয়।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, প্রয়োজন না হলে কেন সার্জারি করবো? ইউনাইটেড স্টেটসে বসবাসরত ও অনুশীলনরত আর্ন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসক, বিখ্যাত অবষ্টেট্রিশিয়ান, গাইনোকোলজিষ্ট এবং নিউন্যাটোলজিষ্ট, ডা. আনন্দ জারেন তার জীবনে শুধুমাত্র হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ব্যবহার কোরে ৭০০ সফল স্বাভাবিক প্রসবকার্য সমাধা কোরেছেন, এবং যার প্রত্যেকটা কেইসের বিস্তারিত রেকর্ড সংরক্ষণ করা হয়েছে। প্রসবের আগে, পরে বা সময়ে কখনোই তার কোন এলোপ্যাথিক বা অন্য কোন ঔষধ প্রয়োজন পড়েনি। এই কেইসগুলোর অনেকগুলোর মধ্যেই বিভিন্নধর্মী জটিলতা দেখা দিয়েছে, যে সমস্যাগুলোর উদ্ভব হলে, অন্যান্য প্যাথিতে সার্জারি ছাড়া আর কোন গত্যন্তর থাকতো না কিন্তু তিনি সেগুলো যদি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ দিয়েই সমাধান কোরতে পারেন, তাহোলে কেন তিনি সিজারিয়ান সেকশনে যাবেন? আর যেগুলো ঔষধ দিয়ে সমাধান সম্ভব ছিলো না, (এই ৭০০ কেইসের বাইরে) সেখানে তিনি ঔষধের বোতল হাতে দাঁড়িয়ে থাকেননি- সার্জারিই করেছেন। একটু মনোযোগ দিয়ে খোঁজ করলেই দেখবেন এই উদাহারণ শুধু এই সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে নয়, চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রত্যেকটা বিভাগের (Department) ব্যাপারেই দেয়া যায়।
তথাপি, এই ভ্রান্তির পেছনে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক সমাজেরও কিছু দায় রয়েছে। এমনও অনেক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক আছেন, যারা রোগীর প্যাথলজিক্যাল ডায়াগনোসিসকেই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বহির্ভূত কাজ বলে মনে করেন (আল্লাহই ভালো জানেন, তারা কার শিক্ষায় শিক্ষিত!)। এমনকি আমার এক চিকিৎসক বন্ধু তার স্ত্রীর প্রেগনেন্সিকালীন সময়ে শুধুমাত্র গোঁড়ামীর বশে, স্ত্রীর আল্ট্রাসাউন্ড করতে কিংবা কোন এমার্জেন্সী প্রসিডিউর অবলম্বন করতে অস্বীকৃতি জানান। বেচারি স্ত্রীর প্রচন্ড উচ্চরক্তচাপ দেখা দেয়, প্রি-এক্লাম্পশিয়ার লক্ষণের আবির্ভাব হয় এবং এবোরশন হয়ে যায়। এ ধরণের হঠকারী ও অবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপ একদিকে যেমন রোগীর জীবন-হানিকর, ঝুঁকিপূর্ণ, অন্যদিকে তা হোমিওপ্যাথির সুনাম নষ্ট করে এর বিরোধিতাকারীদের শক্তিবৃদ্ধিতেই সহায়তা করে।
কিন্তু রোগীদের মনে রাখতে হবে, কোন একজন চিকিৎসকের হঠকারীতার মাধ্যমে তার চিকিৎসাব্যবস্থার স্বরূপ প্রকাশিত হয় না, এবং এটা হলে, এলোপ্যাথিক চিকিৎসা অনেক আগেই নিষিদ্ধ হয়ে যেতো। এক্ষেত্রে যা হয় তা হচ্ছে- ব্যবস্থাটা সম্বন্ধে একটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি, যার ফলশ্রুতিতে আজকের এই লেখাটির প্রয়োজন সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সার্জারীর ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথির দৃষ্টিভঙ্গি Elizabeth W. Hubbard এর একটি কথায় স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠে
“In mechanical conditions, such as cleft palate, club-foot, and in emergencies too far advanced for treatment by medication, or in accidents, surgery are invaluable. But the plea of the true homeopath is ever for the chronic remedy first.”
কাজেই, রোগী এবং যে সমস্ত চিকিৎসকবৃন্দের মধ্যে এখনও যারা এই ভ্রান্তির মধ্যে আছেন যে, হোমিওপ্যাথিতে সার্জারী নেই, এরপর আশা করি তারা নিজেদের ভ্রান্ত ধারণা সংশোধন করে নিয়ে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারবেন। আর স্মরণে রাখবেন Dr. T. Doglas Ross এর প্রণিধানযোগ্য মন্তব্য,
“Hahnemann himself was an enthusiast for surgery and it is ridiculous that Homeopathy should be looked on as inimical to surgery when all we practise is a wise conservatism with regard to it.”
