ডা. অমরনাথ চক্রবর্তী:
[প্রবন্ধটি ডা. অমরনাথ চক্রবর্তী স্যারের একটি ধারাবাহিক লেখার অংশবিশেষ। মূল লেখাটি বৃহৎ পরিসরের ও বিভিন্নতা থাকার দরুন প্রথম আলোচ্য বিষয়টিকে তুলে ধরা হলো। ক্রমান্বয় তাঁর অন্যান্য আলোচনাকেও প্রবন্ধাকারে প্রকাশ করার প্রত্যাশা রাখছি।]
ডাঃ জে এন কাঞ্জিলাল হোমিও জগতে একজন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তার জন্মভূমি বাংলাদেশে আর কর্মভূমি পশ্চিম বাংলা তথা ভারতবর্ষ তথা সারা বিশ্ব। আজ তার লেখা “DOES HOMOEOPATHIC METHOD OF TREATMENT REALLY REQUIRE LONGER TIME FOR CURE?” -এই লেখাটি পড়ে যা শিখেছি তা আমি সরল ভাষায় তুলে ধরবো।
একটি কথা সব সময় শোনা যায় বা শুনতে হয় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় রোগ আরোগ্য হতে বেশি সময় লাগে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে একমত হয়ে অনেক চিকিৎসক মনে করেন এটা সর্বৈব ঠিক। আমরা একটু বিচার করে দেখি। “CURE” শব্দটি বলতে আমরা সাধারন ভাবে বুঝি কষ্টদায়ক লক্ষণগুলির দ্রুত অপসারণ। কিন্তু প্রাচীন পীড়ার ক্ষেত্রে এমন ঘটলে বিষয়টা খুব সন্দেহজনক। এক্ষেত্রে এটা PALLIATION বা SUPPRESSION হয়। দুটি ক্ষেত্রেই রোগী আরাম পায়- ফলে পরে কিছু হলে, সেই রোগী সেই চিকিৎসকের কাছে আবার ফিরে আসে।
দুটি ক্ষেত্রেই ওষুধ ভুল নির্বাচনের ফলে এরূপ ঘটে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে রোগ আরো জটিল এবং আরো গভীরে আক্রমণ করে। তরুণ রোগে ওষুধটি দ্রুত কাজ করবে যদি ওষুধের নির্বাচন, মাত্রা, শক্তি ঠিক ঠিক হয়। এরকম ঠিক হলে অতি দ্রুত আরোগ্য হবে। কিন্তু আমাদের অক্ষমতার জন্য বদনাম দূর হয় না। হোমিওপ্যাথি ওষুধ পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ওষূধ তাই অপব্যবহার সম্পর্কে আমাদের সতর্ক হতে হবে।
DOES HOMOEOPATHIC METHOD OF TREATMENT REALLY REQUIRE LONGER TIME FOR CURE?
Dr. J. N. KANJILAL
CURE বলতে প্রকৃতপক্ষে যা বোঝায় তা সাধারন মানুষ বোঝেন না। দ্রুত আরোগ্যের জন্য ছুটে বেড়াচ্ছেন এক চিকিৎসক থেকে অন্য চিকিৎসকের কাছে। তরুন রোগের ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট সময়ে রোগ সাধারণত আরোগ্য হয়। রোগী চিকিৎসক বদল করলে যে চিকিৎসকের হাতে রোগের অন্ত হয় তিনি হন ভগবান- আর বাকী সব ভিলেন।
দ্রুত কথাটি আপেক্ষিক। এই ধরণের চাহিদার পেছনে চালিকা শক্তি হচ্ছে স্বার্থ অর্থাৎ পরীক্ষা, পূজা ইত্যাদি। অল্প কিছু ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন আছে রোগীর বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং সেটা চিকিৎসকের সিদ্ধান্তে হবে- রোগীর সিদ্ধান্তে নয়। অনেক সময় রোগী আব্দার করেন- এখন কমিয়ে দিন, পরে তার সুবিধা অনুসারে ভেতর থেকে ধীরে-সুস্থে CURE করবেন। এটাতো চাহিদা যোগানের গল্প- মানুষটা এখানে বাদ।
হোমিও চিকিৎসকেরা আবার সামাজিক কুসংস্কারের শিকারও হন। তখন CALCUTTA FEVER এর প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। এটা ভাইরাস জ্বর। অনেকে একমাস পর্যন্ত জ্বরে ভুগতো। একটি ২০/২২ বছরের মেয়েকে নিয়ে তার মা আসেন। ২০ দিন হয়ে গেল জ্বর কিছুতেই ছাড়ছে না। গরীব বলায় কম টাকায় দেখে ওষুধ দিয়ে দুই দিনে আরোগ্য করি। এর কিছুদিন পরে আমাকে রাস্তায় ধরে তার মা বললেন, “ডাক্তার বাবু, ছোট মেয়ের ওই জ্বর হয়েছে পরীক্ষা ছিল বলে আপনার কাছে যায়নি, হোমিওপ্যাথিতে দেরী হবে বলে বড় ডাক্তার দেখাল কিন্তু কোন কাজ হলনা আর পরীক্ষাও দিতে পারল না। পরীক্ষা হলে অজ্ঞান হয়েছিল। জ্বর ৩ এর নীচে নামছিল না। আপনি জ্বরের ওষুধটা বলে দিন না কমলে PG তে দেখাবো। রাগে-অপমানে বিদ্ধ হয়ে বললাম কালকে চেম্বারে দেখাবেন -এবার পুরো ভিজিট লাগবে।
ডা. কে সি দাস বলতেন, হোমিও ডাক্তার দেখলেই অনেকের পকেট ফুটো হয়ে যায়। তবে সত্যই গরীব হলে কম নিবি বা বিনা পয়সায় করবি। এই রোগীটি চারদিন পরে এসেছিল। একেও আরোগ্য করেছিলাম। এভাবে সামাজিক কুসংস্কারের শিকার আমাদের হতে হয়। যোগ্য কাজ করেও অপমানিত হতে হয়। আবার দ্রুত কাজ দিলেও রক্ষা নেই। পরের বারে বলবো। তাই বলি এই সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করতে হবে একসাথে। কি বন্ধুরা পাশে থাকবেন তো???
দ্রুত আরোগ্য করেও অসম্মানের হাত থেকে হোমিও চিকিৎসকদের রক্ষা নেই। একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা সংক্ষেপে বলছি। বাচ্চাটির মা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। বাবা ওষুধের দোকান ও পলিক্লিনিক চালান। গত ০৭/১০/২০১৭ তারিখ, আমার এক চিকিৎসক দাদার বিশেষ অনুরোধে দশ বছরের ওই বাচ্চা মেয়েকে দেখি। মেয়েটি পড়াশোনায় যেমন ভাল, ঠিক তেমনি ভাল নাচে। মেয়েটি একটি টিভি চ্যানেলে নাচের জন্য নির্বাচিত হয়। কয়েকটি অসাধারণ নাচও করে- যা প্রচারও হয়। তার নাচের সঙ্গী মেয়েটিকে নাচ না পারার জন্য নাচের শিক্ষক প্রচণ্ড মারধর করে। সেটা দেখার পর মেয়েটি পরের দিন অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাচ্চাটি বাড়ি ফিরে আসে। বাচ্চাটির সবসময় বমিভাব এবং মাঝে মাঝে বমি। ধীরে ধীরে কথা বলা, বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ। মাসখানেকের মধ্যে খাওয়া প্রায় বন্ধ। চেহারা ভেঙে গেছে। চোখের তলায় কালি। ঘুম প্রায় নাই। বাচ্চাটি সবসময় মোবাইলে গেম খেলে। সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় যখন-তখন বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। এমন কি এক দিন রাত্রি বেলায় পালিয়ে যায়। বন্ধুদের সঙ্গেও কথা বলতো না ইত্যাদি। মেয়েটির যথাসাধ্য চিকিৎসা করা হয়েছিল কোনো ফল হয়নি, উত্তরোত্তর খারাপ হয়েছে।
আমি ও আমার ভাতৃসম চিকিৎসক পাঁচ ঘন্টা পরিশ্রম করে ওষুধ নির্বাচন করি। বলি কোনো পরিবর্তন হলে জানাবেন।
গত ২৭-১০-২০১৭ তারিখে আমার চিকিৎসক দাদা ফোন করে বলছেন, চক্রবর্তী ম্যাজিক হয়ে গেছে। মেয়েটি এখন বিদ্যালয়ে যাচ্ছে, পড়াশোনা করছে, নাচ করছে , বন্ধুদের সঙ্গে খেলছে ইত্যাদি। আমি বললাম একথা তো আমাকে জানানোর কথা। তখন চিকিৎসক দাদাটি বললেন, ওরা পরে জানাবে। আমি প্রশ্ন করলাম কেন? তার উত্তরে দাদাটি বললেন আসলে ওরা এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। স্থায়ী হয় কিনা দেখে পরে ফোন করবে। আজ এই লেখা পর্যন্ত ফোন পাইনি। এটা কি আমার প্রাপ্য? আমি আত্ম-প্রচারের জন্য এই ঘটনা বলছি না। আমি বিশ্বাস করি আমার চিকিৎসক বন্ধুদের জীবনে এরকম অনেক ম্যাজিক আরোগ্য আছে। আশা করি আপনাদের এরকম তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়নি।
এখানে ডাঃ কাঞ্জিলাল খুব সুন্দর ভাবে বুঝিয়েছেন। আমাশয়ের রোগী তারাতারি সুস্থ হবার জন্য অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা গ্রহণ করে। চিকিৎসকেরা তাদের নির্দিষ্ট ওষুধের দ্বারা রোগীকে দ্রুত সুস্থ করে তোলেন। কিন্তু কিছুদিন পরে সামান্য অনিয়মে পুনরায় আক্রান্ত হয়। এইভাবে মাঝে মাঝে তিনি আক্রান্ত হন। ফলে ওষুধের মাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ওষুধ তখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্থ ব্যবস্থায় পরিণত হয়। আর চিকিৎসকের RECURRING INCOME -এর ব্যবস্থা হয়। এই ‘বৈজ্ঞানিক’ চিকিৎসার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ভালবাসায় বোনাস হিসাবে পায় কোষ্ঠকাঠিন্য, বদহজম, অনিয়মিত পায়খানা, গ্যাস, অম্বল ইত্যাদি। রোগী বিভিন্ন রোগের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ওষুধ গ্রহণ করছে- ফলে আশীর্বাদস্বরূপ বোনাস হিসাবে আরও জটিল রোগ উপহার পায়। এই ভাবে মানুষের কষ্ট চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে। তিনি তার অসাধারণ কাব্যিক ভাষায় বলেছেন-
FOR EACH OF WHICH HE HAS TO TAKE THIS OR THAT MEDICINE- MORE OR LESS PERPETUALLY- – ULTIMATELY TURNING HIMSELF INTO A KALEIDOSCOPE OF DISORDER-FROM VARIOUS DRUGS AS WE’LL AS ACTUAL DISEASE.
এবার এক শিশু বিশেষজ্ঞের কথা বলি। তিনি ক্রনিক আমাশয়ের জন্য এসেছেন। দিনে ৪/৫ বার যেতেই হয়। হাসপাতালে নাইট ডিউটি থাকলে ৯/১০ বারও যেতে হয়। তাই পকেটে ওষুধ থাকে সবসময়। তার আমাশয় ছাড়াও বাম নিলয় বৃদ্ধি, যৌন ক্ষমতা প্রায় নেই- তার সঙ্গে গ্যাস, অম্বল ইত্যাদি। হোমিওপ্যাথি তার অমৃত থেকে কাউকে বঞ্চিত করে না। তিনি এখন বেশ ভাল আছেন। তাই সুযোগকে কাজে লাগানোর দক্ষতা অর্জন করতে হবে আর তা আমাদের মতো বিনিময়ের মাধ্যমেই একমাত্র সম্ভব।
ঠিক এই ধরনের ঘটনার সাদৃশ্য আছে অন্যান্য রোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রেও যথা বাত, একজিমা, হাঁপানি ইত্যাদি। এই ধরনের কোনো ক্রনিক রোগ বা তরুণ রোগের দ্রুত আরোগ্যের (???) জন্য দমনমূলক চিকিৎসা পদ্ধতি বেশি জনপ্রিয়। এর ফলে মানুষের জটিল রোগ সৃষ্টি হয় আর তার সঙ্গে ওষুধের বিষক্রিয়ার ফলে বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগপ্রবণতার সৃষ্টি হয়। সবচেয়ে মুশকিল হচ্ছে প্রকৃত রোগের সঙ্গে কৃত্রিম ঔষধ রোগের মিশ্রণ আর আধুনিক (NOT REASON GIFTED NOR HIGHER PURPOSE OF LIFE) জীবনশৈলী প্রকৃতপক্ষেই মানুষের অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরোগ্যের অবস্থায় আছে এমন জটিল রোগের ক্ষেত্রে সদৃশতম ওষুধটি প্রয়োগ করলে দেখতে পাওয়া যায় পুরানো রোগ ফিরে (কেন্টের ১১ তম পর্যবেক্ষণ) আসে ক্রমানুসারে অর্থাৎ শেষের রোগটি প্রথমে সর্বাপেক্ষা পুরানোটি সবার শেষে সারবে। আমি বহু বহু রোগীর ক্ষেত্রে দেখেছি রোগী বলছেন, এবারতো ওই রোগটা ফিরে আসবে। অনেক খরচা করে রোগটি সারিয়েছিলাম। তাহলে রোগী সাধারণ বুদ্ধিতেই বুঝতে পারেন অন্য চিকিৎসায় রোগ সারেনা। মানুষকে হোমিওপ্যাথির পক্ষে আনার সুবর্ণ সুযোগের ঠিক ঠিক ব্যবহার আমরা কি করতে পারছি? আমাদের মিডিয়ার দরকার হবেনা- মানুষের দাবীতে সরকার হোমিওপ্যাথিকে সার্বজনীন সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা পদ্ধতি বলে মানতে বাধ্য হবে। আমি এরূপ স্বপ্ন দেখি। আমার বন্ধুরাও কি দেখেন? অতীব দুঃখের বিষয় আজকাল কিছু হোমিও চিকিৎসক (হোমিওপ্যাথ নয়) রোগের নামের (Nosological Terms) ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা করছেন। এরা কি হোমিওপ্যাথির উপকার করছেন? বিচারের ভার আমার বন্ধুদের উপর ছেড়ে দিলাম।
Discussion about this post