ডা. এ. বি. এম. শহীদুল্লাহ্:
হোমিওপ্যাথি একটি বিস্তৃত পরিসরের চিকিৎসাব্যবস্থা। এর ঘাটে ঘাটে লুকোনো আছে চমক। সুচারু, দক্ষ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসক তার চিকিৎসা পরিচালনা করেন বিভিন্ন প্রকারের কলা-কৌশলের সমন্বয় ঘটিয়ে। অনেক চিকিৎসকই শ্বাসকষ্ট শুনলেই ঢালাওভাবে নেট্রাম সালফ দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কেন এমনটা করেন বোঝা দুষ্কর! অথচ হোমিওপ্যাথির প্রতিটি ঔষধেরই সক্ষমতা আছে ম্যাজিক দেখানোর এবং লক্ষণসাদৃশ্য ও মূলনীতি বজায় থাকলে এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?
আমি আমার চিকিৎসা অভিজ্ঞতার এরকম একটি কলা ও তার চমকটিকেই আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাচ্ছি। ৪ দিন বয়সের এক বাচ্চাকে তার শ্বাসকষ্টের সমস্যার জন্য আমার কাছে নিয়ে আসা হয়। শিশুটির মায়ের কোষ্ঠ্যবদ্ধতা লক্ষণটি নাক্স-ভমের সাথে সাদৃশ্য থাকায় মা’কে নাক্স-ভম প্রেসক্রিপশন করি (উল্লেখ্য, সেটা শিশুটির নানুর কাছে বর্ণনা শুনে নিশ্চিত হয়েছিলাম- মা স্বাভাবিকভাবেই সেদিন ক্লিনিকে আসতে পারেনি)। শিশুটিকে কোন ঔষধ আলাদাভাবে দিইনি। কিন্তু মায়ের কোষ্ঠ্যবদ্ধতার সাথে সাথে, শিশুটির শ্বাসকষ্টও আরোগ্য হয়ে গেলো!
কিন্তু এর দু’মাস পরে আবারও শিশুটির শ্বাসকষ্টটি ফিরে এলো। এবং তার নানু শিশুটিকে নিয়ে আবার আমার নিকট আসলে, আমি ঐ দিন আর কাউকে কোন ঔষধ না দিয়ে শিশুটির মা’কে নিয়ে আসতে বলি। পরদিন মা’কে নিয়ে আসলে জানতে পারি এর মাঝে আমাকে না পেয়ে আমারই পাশের এক ডাক্তারেরে নিকট থেকে ঐ বাচ্চার জন্য ব্রায়ো, হিপার, স্পঞ্জিয়া ইত্যাদি ঔষধ এনে খাওয়ানো হয়েছে এবং তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি।
যাই হোক, ক্ষতি যে হয়নি এটাই যথেষ্ট। এবার আমি শিশুর তথ্যের সাথে সাথে শিশুটির মায়ের কেইসটিও রেকর্ড করলাম-
শিশুটির মায়ের নাম- মিসেস দু.। বয়স- ১৯ বৎসর। কেইস রেকর্ডের তারিখ ছিলো – ২৪/২/২০২০ ইং। বাচ্চার কাশি, শ্বাস নিতে কষ্ট, বুকের উঠানামা ইত্যাদি জানলাম ঠিকই; কিন্তু বিশেষ করে মায়ের লক্ষণের দিকে বেশী নজর দিলাম। জিজ্ঞেস করে মায়ের কাছ থেকে তার নিজের যে লক্ষণগুলো পেলাম এবং তা থেকে যে যে লক্ষণ গুলোকে কেন্দ্র করে ঔষধ নির্বাচন করলাম, তা হলো– মায়ের শুটকী মাছ পছন্দ, রুটি অপছন্দ, ভাতের পাতে অতিরিক্ত লবণ খাওয়ার অভ্যাস, পিপাসা স্বাভাবিক।
মা মানসিক লক্ষণে হাসি-খুশি মুখ, অথচ প্রচন্ড রাগী। শিশুটির নানুর ভাষ্যমতে, তার এতোই রাগ যে একটুতেই ২/৩ দিন রাগের জন্য ভাত খায় না খেয়ে কাটিয়ে দেয়। সাধলে রাগ আরো বেড়ে যায়। তাছাড়া মরা মানুষের স্বপ্ন, চোরের স্বপ্ন, অন্ধকারে ভয় ইত্যাদি লক্ষণ গুলো সংগ্রহ করার সময় আমি যখন শিশুটির মায়ের মুখাবয়ব লক্ষ করছিলাম- তখন দেখি মায়ের মুখ খানার মাঝে একটি বিরক্তিকর হাসি। ভাবে মনে হচ্ছিলো- শিশুর নানু যখন তার মেজাজ সম্বন্ধে আমার কাছে বর্ণনা দিচ্ছিলো, তখন থেকেই সে কিছুটা রাগ চেপে রেখে, বিরক্তি নিয়ে আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল। মুখভঙ্গিতে আমার কাছে তা স্পষ্ট ছিলো। আর আমি এই মানসিক লক্ষণটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, মা’কে নেট্রাম মিউর ২০০ শক্তি সূক্ষ্ম মাত্রায় প্রয়োগ করি। এবং দু’দিন পরেই সংবাদ পাই বাচ্চার শ্বাসকষ্ট কমেছে কিন্তু শরীরে জ্বর দেখা দিয়েছে। আমি লক্ষ করে দেখলাম, শিশুটির বুকের দুধ খাওয়া, ঘুমানো সবই ঠিক আছে, জ্বরের অন্য কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ নেই। আমিও আর নতুন কোনো ঔষধ না দিয়ে তাদের বিদায় দিলাম এবং তার দুইদিন পর সংবাদ পেলাম মা ও শিশু দু’জনেই সুস্থ আছে।
এখন এই ঘটনাটির মাধ্যমে কি প্রকাশ পাচ্ছে? আমরা কি হাঁপানির ঔষধ দেই, নাকি লক্ষণকে কেন্দ্র করে রোগীকে ঔষধ দেই? এখানে আসলে কি কি প্রমাণিত হলো? প্রমাণিত হলো এটাই যে, আমরা রোগীকে ঔষধ দেই এবং রোগীর সম্পূর্ণ সিস্টেমের সামঞ্জস্য বিধানই আমাদের মূল লক্ষ্য। আর তা-ই যদি হয়ে থাকে তবে হাঁপানিকে নেট্রাম সালফ নয়, অবশ্যই রোগীকে ঔষধ দেবো।
মা’কে ঔষধ প্রদানের মাধ্যমে শিশুর আরোগ্যের কথা এর আগেও আমাদের শাস্ত্রে আলোচিত হয়েছে এবং আমাদের শ্রদ্ধেয় পূর্বতন চিকিৎসকদের মধ্যে কেউ কেউ এমন আরোগ্য-বিবরণী উপস্থিত করেছেন। আবার অনেকে একে অযৌক্তিক বলে মতামত দিতেও কার্পণ্য করেন না। কিন্তু এই আরোগ্যের ঘটনার মাধ্যমে এই আলোচনাটি উত্থাপনের কারণ হচ্ছে- এই কলাটিকে বা ঔষধ-প্রয়োগপদ্ধতিকে বিবেচনার জন্য তুলে আনা।
গর্ভাবস্থায় মা ও শিশু আলাদা কোন ইউনিট নয়; জন্মের পরও যতক্ষণ শিশু মায়ের উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল থাকে এবং তার পুরো সিস্টেম যতক্ষণ পর্যন্ত মায়ের সিস্টেমটির সাথে সমন্বিত থাকে- ততক্ষণ এই প্রয়োগকলাটিকে ব্যবহার করার উপযোগিতাটিকে আমাদের বিবেচনা করতে হবে। তবে যদি কোন কারণে, দুজনের সিস্টেমের ভিন্নতা প্রত্যক্ষ হয়, তখন এই কলাটি প্রয়োগযোগ্য থাকে কিনা- সেটি নিয়েও আলোচনার অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি।
যাই হোক, আলোচ্য কেইসটিতে, আরো একটি প্রশ্ন অনেকের মনে জাগ্রত হতে পারে বিধায়- তা নিয়ে আলোচনা করেই আমার কথা সমাপ্ত করছি। প্রশ্নটি হচ্ছে- নাক্স-ভমে বাচ্চার একবার শ্বাসকষ্ট কমেছিল; তাহলে পরে আবার কেন ফিরে এলো? এর কারণ হচ্ছে, কোন কারণে প্রয়োগকৃত ঔষধ যদি মায়াজম সংশোধন করতে না পারে – তাদের দ্বারা রোগ সমূলে বিনাশ হয় না। শুধু রোগের তরুণ অবস্থার পরিবর্তন করতে পারে; কিন্তু পরে মায়াজমেটিক ঔষধ প্রয়োগ করে রোগীর সার্বিক সংশোধন আনতে হয়। এখানেও তা-ই হয়েছে। তবে কথা হলো, সার্বিক রোগলক্ষণ যে ঔষধকে নির্দেশ করবে- প্রাথমিক চিন্তায় সে ঔষধই প্রয়োগ করতে হবে (যদিও এ ব্যাপারে সামান্য মতভেদ বর্তমান আছে) এবং সে ঔষধে যদি সেই বিশেষ ক্ষেত্রটিতে মায়াজম সংশোধন করার ক্ষমতা না থাকে, তাহলে ঐ ঔষধে রোগের তরুণ অবস্থা বা প্রাথমিক অবস্থা কেটে যাবার পর, রোগীর ধাতুগত লক্ষণে ঔষধ প্রয়োগ করে রোগের পুণঃআক্রমণকে প্রতিহত করতে হবে।
Discussion about this post