পটাশিয়ামের অভাব কি?
পটাশিয়ামের অভাব বা ঘাটতি একটি বিরল অবস্থা, যা চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় হাইপোক্যালেমিয়া (Hypokalemia) নামে পরিচিত। শরীরে ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য রক্ষার জন্য যেসব খনিজ প্রয়োজন তার মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো পটাশিয়াম। এটা হৃদপিণ্ড, কিডনি, মস্তিষ্ক এবং পেশীর টিস্যুর কার্যক্ষমতা বাড়ানোর জন্য খুব প্রয়োজনীয়। এই অবস্থায় শরীরে নির্দিষ্ট লক্ষণ এবং উপসর্গ দেখা দেওয়ার মতো পটাশিয়ামের অভাব তৈরি হয়।
হাইপোক্যালেমিয়ার প্রধান লক্ষণ এবং উপসর্গগুলি কি কি:
রক্তে পটাশিয়ামের ঘাটতি হলে বিভিন্ন ধরনের মাথাব্যথা, বুক ধড়পড় এবং অন্যান্য অনেক প্রকারের জটিল সমস্যা হয়। পটাশিয়াম অভাবের প্রথম এবং সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গ হল সারা শরীরে দুর্বলতা এবং ক্লান্তি।এই অভাবের অন্যান্য বিশেষ উপসর্গগুলি হল:
- দুর্বলতা ও অবসন্নতার অনুভূতি
- খাবার হজমে সমস্যা।
- পেশীতে টান এবং আড়ষ্ঠতা।
- বুক ধড়ফড়ানি (লক্ষণীয় ভাবে দ্রুত, অনিয়মিত এবং জোরালো হৃদস্পন্দন) ।
- শ্বাস নিতে সমস্যা।
- অঙ্গ প্রত্যঙ্গে অসাড় অথবা ঝিঁঝিঁ ভাব
- কোষ্ঠকাঠিন্য
এর কারণগুলি কি কি হতে পারে:
নানান চিকিৎসাজনিত অবস্থা এবং যারা দীর্ঘদিন হাইপারটেনশন, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এই জাতীয় অটোইমিউন ডিজঅর্ডারে ভুগছেন এবং ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলে পটাশিয়ামের অভাব হতে পারে। বিশেষ করে, Furosemide ও Steroids এর ব্যবহার, Dialysis, Diabetes insipidus, Hyperaldosteronism, Hypomagnesemia ইত্যাদি অবস্থাগুলোতে এবং দেহে পুষ্টির ঘাটতিজনিত কারণে এই শরীরের এই ভারসাম্যহীন অবস্থাটি সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া ইদানিং অনেকেই আপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহারে খুব উৎসাহী হয়েছেন, যা দীর্ঘদিন ব্যবহারের হতে পারে হাইপোক্যালেমিয়া। এছাড়া আরও যে কারণগুলির কথা আমাদের চিন্তায় রাখতে হবে-
- ডায়রিয়া এবং বমির গুরুতর ঘটনা।
- বিপুল পরিমাণে রক্ত-হ্রাস।
- কিডনি খারাপ বা কিডনির বিকলতা।
- লিউকোমিয়া (ব্লাডক্যান্সারের একটি ধরন)।
- হাঁপানি এবং এমফিসেমার ব্যবহৃত ওষুধের ফলে পটাশিয়ামের ঘাটতি হতে পারে।
- খাবারে পর্যাপ্ত পটাশিয়ামের অভাব
- অতিরিক্ত ঘামের পর
- মাসল-ক্রাশ ইনজুরির পর
- অপারেশনের পর
- অতিরিক্ত প্রস্রাব
- প্যানক্রিয়াটিক ফিস্চুলা
- প্যানক্রিয়াটিক এডেনোমা
এর নির্ণয় এবং চিকিৎসা:
উপরে উল্লেখিত উপসর্গগুলি নিয়ে হাজির হলে চিকিৎসক কিছু পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিতে পারেন, যেমন – রক্ত পরীক্ষা, এর সাহায্যে রক্ত প্রবাহে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং অন্যান্য খনিজ উপাদানের মাত্রা দেখা যেতে পারে। হৃদপিণ্ডের অনিয়মিত স্পন্দনের ক্ষেত্রে, ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রামের (ইসিজি) পরামর্শ দেওয়া হতে পারে, কারণ পটাশিয়ামের ঘাটতি হৃদস্পন্দনে প্রভাব ফেলতে পারে। ECG তে পরিবর্তনগুলো দেখতে পাওয়া যায়- QRS prolongation, ST-segment ও T-wave depression, U-wave formation। এই অবস্থার চিকিৎসা সহজ এবং উপসর্গের দ্রুত উন্নতি দেখা যায়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অবস্থা এবং উপসর্গের উপস্থিতির উপর নির্ভর করে একজন চিকিৎসক বিভিন্ন ধরনের ওষুধের পরামর্শ দেবেন।যদি রক্তপ্রবাহে পটাশিয়ামের পরিমাণ বিপদজ্জনকভাবে কম না হয়, তবে ভয় না পেয়ে ভালো একজন হোমিওপ্যাথিক ও নেচারোপ্যাথিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন এবং ন্যাচারাল ফুড গাইডলাইন মেনে চললে পটাশিয়ামের ভারসাম্য ফিরে সুস্থতা লাভ করা যায়।
শরীরে পটাশিয়ামের পরিমাণ নির্ধারণের উপায়:
নিচের ফর্মুলা ব্যবহার করে শরীরে পটাশিয়ামের ঘাটতি নির্ণয় করা যায়-
Kdeficit (in mmol) = (Knormal lower limit − Kmeasured) × body weight (kg) × 0.4
দিনে কত খানি পটাশিয়াম শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় এটা সবারই জানা প্রয়োজন:
শরীরে ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য রক্ষা জন্য যেসব খনিজ প্রয়োজন তার মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো পটাশিয়াম।এটা হৃদপিণ্ড, কিডনি, মস্তিষ্ক এবং পেশীর টিস্যুর কার্যক্ষমতা বাড়ানোর জন্য খুব প্রয়োজনীয়।রক্তে পটাশিয়ামের ঘাটতি হলে বিভিন্ন ধরনের মাথাব্যথা, বুক ধড়পড় এবং অন্যান্য অনেক প্রকারের জটিল সমস্যা হয়।দিনে কতখানি পটাশিয়াম শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় এটা সবারই জানা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শরীর ভাল রাখতে দিনে ১হাজার ৬০০ থেকে ২হাজার মিলিগ্রাম পটাশিয়ামের প্রয়োজন। খাবার কিংবা সাপ্লিমেন্ট ওষুধ খেয়ে শরীরে পটাশিয়ামের ঘাটতি পূরণ করা যায়। তবে সাপ্লিমেন্টের চেয়ে পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়াটাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ। এক কাপ সাদা শিমের বিচিতে প্রায় সাড়ে ৩হাজার পটাশিয়াম এবং ৬৭৩ ক্যালরি থাকে।এটা প্রতিদিনের চাহিদার প্রায় ১০৪ ভাগ পটাশিয়ামের ঘাটতিপূরণ করে।
একা কাপ বরইতে ১হাজার ২৭৪ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম এবং ৪১৮ ক্যালরি থাকে। যা শরীরের প্রতিদিনের পটাশিয়ামের ঘাটতিরশতকরা ৩৬ ভাগ পুরণ করে। এছাড়া ভিটামিন এ থাকায় বরই দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে এবং চোখের নানান রোগ সারাতে সাহায্য করে। এক কাপ পালংশাকে ১৬৭ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম এবং শতকরা ৭ভাগ ক্যালরি থাকে। পালংশাক আয়রনেরও দারুণ উৎস।এটি চুলের স্বাস্থ্য ভাল রাখে এবং রক্তশূন্যতা পূরণে সাহায্য করে।
কলাতে ৪৮৭মিলিগ্রাম পটাশিয়াম এবং ১২১ ক্যালরি থাকে।এটি প্রাণশক্তি বাড়াতেও দারুন কাজ করে। এতে থাকা ফাইবার হজম শক্তি বাড়ায়। মিষ্টি আলুও পটাশিয়ামের দারুন উৎস। এতে ৪৪৮ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম ও ১১৪ ক্যালরি থাকে। গাজরের রসে ৬০০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম ও ৪৬ ক্যালরি থাকে। শরীরের পটামিয়ামের ঘাটতি পূরণে নিয়মিত গাজর খেতে পারেন। এছাড়া ডাবের পানি, বাদাম এগুলোও শরীরে পটাশিয়ামের চাহিদা পূরণ করতে সহাযতা করে। নিয়মিত পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খেলে হার্ট ভাল থাকবে, মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করবে। এছাড়া এধরনের খাবার হৃদরোগ এবং উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি কমাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
হাইপোক্যালামিয়াতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা:
ন্যাচারাল ফুড গাইডলাইন হাইপোক্যালামিক রোগীকে অবশ্যই দ্রুত সহযোগিতা প্রদান করবে এবং উপসর্গগুলোর ত্বরিৎ উপশম প্রদান করবে কিন্তু এর পাশাপাশি প্রয়োজন অনুযায়ী হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা রোগীর সমস্যাটির স্থায়ী সমাধান প্রদান করতে পারে। যেহেতু হোমিওপ্যাথিতে রোগীর সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে, তার এই অবস্থা বা ভারসাম্যহীনতাটি সৃষ্টি হবার কারণ উৎঘাটন করে তার পূর্ণাঙ্গ সমাধানের লক্ষ্যে ঔষধ প্রদান করা হয়- কাজেই কেবলমাত্র হাইপোক্যালামিয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট ঔষধ হোমিওপ্যাথিক শাস্ত্র মোতাবেক উল্লেখ করা সঙ্গত নয়। যদিও সিন্থেসিস রেপার্টরিতে এ ব্যাপারে একটি নির্দিষ্ট ক্লিনিক্যাল রুব্রিক রয়েছে-
Generals: Laboratory findings: Potassium level, reduced: Cortico, Cortiso
এটি একটি ছোট ক্লিনিক্যাল রুব্রিক- কাজেই ঔষধ নির্বাচনে কোনভাবেই সহায়ক নয়। বরঞ্চ বর্তমানের ইমিইনোসাপ্রেসেন্ট ড্রাগের সাথে এই অবস্থা সৃষ্টির সম্পর্ককেই বরঞ্চ এই রুব্রিকটি নিশ্চিত করে।
হোমিওপ্যাথিক শাস্ত্র মোতাবেক, হাইপোক্যালামিয়া মূলত তার মূল রোগ কর্তৃক সৃষ্ট একটি সেকেন্ডারি অবস্থা। কাজেই, যে উপসর্গের পরিপ্রেক্ষিতে এই অবস্থাটি সৃষ্টি হয়েছে এবং রোগীর মাঝে যে যে লক্ষণ ও চিহ্নের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে- তার সামগ্রিক সুষম চিত্রটি উপযুক্ত কেইস-টেকিংয়ের মাধ্যমে অঙ্কন করে তার সদৃশ ঔষধটি প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে মূলত রোগীর জন্য হোমিওপ্যাথিক কন্সটিটিউশনাল থেরাপি কিংবা এন্টিমায়াজমেটিক থেরাপির প্রয়োজন হয়। আর এর ফলে রোগীর সার্বিক অবস্থার উন্নতি সহ, দেহের সর্বপ্রকার ভারসাম্য ও পুষ্টিগ্রহণ (Potassium Synthesis) জনিত সমস্যা দূর হয়ে- রোগীর এই অবস্থাটির নির্মল আরোগ্য সম্পাদন হয়।
লেখক: মেডিকেল নিউট্রিশনিস্ট ও লাইফ স্টাইল মডিফায়ার
ডিএইচএমএস (ইউএইচএমসি), পিডিসিসি (বিএইচইউ), সিডিই (ইন্ডিয়া), সিবিসি (মালয়েশিয়া)। কনসালটেন্ট (হোমিওপ্যাথি ও নেচারোপ্যাথি)
Discussion about this post