ডা. গোলাম রব্বানী রাসেল:
বর্তমান সময়ে দেখা যায়, আমাদের বহুসংখ্যক চিকিৎসকই শক্তি ও মাত্রার ব্যাপারে বেশ কট্টরপন্থী মনোভাব সংরক্ষণ করেন। যারা শততমিক ঔষধ ব্যবহার করেন তারা বলেন – পঞ্চাশসহস্রতমিক ভালো না, আবার যারা পঞ্চাশসহস্রতমিক ব্যবহার করেন- তাদের অনেকে শততমিকদের দেখতেই পারেন না। স্যামুয়েল হ্যানিম্যান তার দি লেসার রাইটিংস এর ৭৬৪-৭৬৫ পৃষ্ঠায় বলেছেন যে, “রোগীদের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার জন্য সকল প্রকার ঔষধ প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে ত্রিশশক্তির ঊর্ধ্বে না যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেয়া হচ্ছে, এই উদ্দেশ্যে যে- হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকগণ স্বয়ং তাদের কর্মে একইরূপ ফলাফল নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে।”
হোমিওপ্যাথিক ঔষধের শক্তিবৃদ্ধিকরণের নতুন পদ্ধতির সুবিধা সম্পর্কে হ্যানিম্যান ২৭০ নম্বর সূত্রের ১৫৫ নম্বর পাদটীকায় খুবই যুক্তিসঙ্গত কথা বলেছেন। কারণ হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতি অনুসারে সফলতার সাথে রোগী চিকিৎসা করতে নিম্নোক্ত শর্তগুলো পালন করতে হয় :
১. ঔষধজনিত রোগবৃদ্ধি এড়িয়ে চলার জন্য ঔষধকে সম্পূর্ণ বস্তুমুক্ত করে সূক্ষ্মতম পর্যায়ে শক্তিবৃদ্ধি করতে হয় এবং খুব ক্ষুদ্রতম মাত্রায় প্রয়োগ করতে হয়।
২. ঔষধের প্রত্যেক মাত্রার শক্তি পরিবর্তন করে সেবন করতে হয়।
৩. খুব সামান্য কারণে শক্তিকৃত সূক্ষ্ম মাত্রার ঔষধের ক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায়। তাই অচিররোগে প্রতিদিন কয়েকবার করে এবং চিররোগে প্রতিদিন একবার করে অথবা একদিন বা দুই দিন পর পর একমাত্রা করে ঔষধ সেবন করলেই ভাল হয়। (নোসডের ক্ষেত্রে ভিন্ন কথা)
৪. ঔষধের এক শক্তির সাথে পরবর্তী শক্তির ব্যবধান যথেষ্ট হওয়া উচিত। তবে জীবনীশক্তিতে অসহনীয় তীক্ষ্মভাবে ক্রিয়া করে এমন ব্যবধান হওয়া উচিত নয়।
হোমিওপ্যাথিতে আরোগ্যের দ্রুততা এবং স্থায়ীত্ব যদি রোগীর জীবনীশক্তির সামর্থ্যের উপর নির্ভর করে এবং জীবনীশক্তির সামর্থ্যের সমান অনুপাতে হয়, তাহলে অবশ্যই ঔষধের শক্তিবৃদ্ধিকরণ পদ্ধতির ভূমিকা এক্ষেত্রে গৌণ হয়ে যায়। অতএব যে রোগীটি আগে আরোগ্য হবে, তা হবে তার জীবনীশক্তির সামর্থ্যের কারণে। এক্ষেত্রে ঔষধের শক্তিবৃদ্ধিকরণপদ্ধতির কোনোরূপ ভূমিকা থাকলেও তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কারণ একই রোগে আক্রান্ত দুজন রোগীর জীবনীশক্তি স্বতন্ত্র এবং স্ব-স্ব জীবনীশক্তির সামর্থ্যও স্বতন্ত্র। অপরদিকে জীবনীশক্তির সামর্থ্য পরিমাপযোগ্য নয় যে, তা আগে পরিমাপ করে নিয়ে পরে একই রোগে আক্রান্ত দুইজন রোগীকে দুটি পৃথক পদ্ধতিতে প্রস্তুতকৃত একই ঔষধের দুটি পৃথক শক্তি প্রয়োগ করব এবং পৃথকভাবে তাদের আরোগ্য ক্ষমতা নিরূপণ করব।
তথাপি নবআবিষ্কৃত পঞ্চাশ সহস্রতমিক পদ্ধতির নিজস্ব কিছু সুবিধা আছে :
১. ঔষধকে বস্তুমুক্ত এবং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শক্তিতে পরিণত করতে পঞ্চাশ সহস্রতমিক পদ্ধতি শততমিক পদ্ধতি অপেক্ষা অগ্রগামী।
২. পঞ্চাশ সহস্রতমিক পদ্ধতিতে ক্রমবর্ধমান শক্তিতে ঔষধ প্রস্তুত এবং প্রয়োগ করা হয়, যেমন- ১/০, ২/০, ৩/০, ৪/০ ইত্যাদি। ফলে শক্তির এক ধাপের সাথে পরবর্তী ধাপের ব্যাপক ব্যবধান হয় না। কিন্তু শততমিক পদ্ধতিতে ত্রিশ, দুইশত, এক হাজার, দশ হাজার, পঞ্চাশ হাজার, এক লক্ষ, দশ লক্ষ ইত্যাদি ধাপে ঔষধের শক্তিবৃদ্ধি করে প্রয়োগ করা হয়। এতে পরস্পর দুই শক্তির মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান হয়।
৩. পঞ্চাশ সহস্রতমিক পদ্ধতিতে যে মাত্রায় ঔষধের সূক্ষ্মতা বৃদ্ধি পায় সে মাত্রায় শক্তি বৃদ্ধি হয় না। ফলে পঞ্চাশ সহস্রতমিক পদ্ধতিতে শক্তিকৃত ঔষধ সুবিধাজনকভাবে প্রতিদিন ব্যবহার করা যায়। অপরপক্ষে শততমিক পদ্ধতিতে শক্তির প্রত্যেক ধাপে ঔষধের পরিমাণ বেশি থাকে। ফলে তা ঘন-ঘন ব্যবহার করা যায় না। কারণ শততমিক ঔষধ ঘন-ঘন ব্যবহারের ফলে রোগীদেহে ঔষধের স্থূলত্ব বৃদ্ধি পায় এবং সংগত কারণেই তা ক্ষতিকর হয়। তাই শততমিক শক্তির ঔষধ চিররোগে এক মাত্রার অনেকদিন পর দ্বিতীয় মাত্রা দিতে হয়। কোনো কারণবশত প্রথম মাত্রার ক্রিয়া ঔষধ প্রদানের অব্যবহিত পরেই নষ্ট হয়ে গেলে তা চিকিৎসকের পক্ষে জানা সম্ভব হয় না। ফলে রোগীটি দীর্ঘদিন বিনা ঔষধে থাকতে পারে। এভাবে শততমিক শক্তির ঔষধে আরোগ্য বিলম্বিত হয়। কিন্তু পঞ্চাশ সহস্রতমিক শক্তির ঔষধ অধিকতর সূক্ষ্মতার কারণে চিররোগে প্রতিদিন ব্যবহার করা যায় এবং ঔষধের আরোগ্য ক্রিয়া অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। রোগী কখনো বিনা ঔষধে থাকে না। ফলে আরোগ্য দ্রুত সম্পন্ন হয়।
ডা. হিউজেস মহাত্মা হ্যানিম্যানের শক্তিবিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ধারা ১৭৯৬ থেকে ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত বর্ণনা করে মন্তব্য করেন যে, “আমরা হ্যানিম্যানকে দেখেছি তিনি অধ্যবসায়ের সাথে তার অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে নিম্ন থেকে ক্রমশ উচ্চ শক্তিতে অগ্রসর হয়েছেন কিন্তু কখনো পিছপা হননি।” আমরা দেখতে পাই যে, তিনি মাত্রাভেদে ঔষধের ক্রিয়ার ব্যাপক পার্থক্য দেখতে পেয়েছেন। ফলে তার নির্দেশনার মধ্যে ঔষধের শক্তি ও মাত্রা সম্পর্কে ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায় এবং ঔষধের মূল আরক থেকে ৩০ (ত্রিশ) শক্তি পর্যন্ত বিভিন্ন শক্তি ও মাত্রার স্বীকৃতি পাই। কিন্তু ১৮২৯ সালের কোনো এক সময় হ্যানিম্যান সকল ঔষধই ৩০ (ত্রিশ) শক্তিতে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত দেন এবং হ্যানিম্যান এর যুক্তি হিসাবে উল্লেখ করেন যে, সদৃশচিকিৎসাবিধানে ঔষধের শক্তি সম্পর্কে ঐক্য থাকা আবশ্যক।” [Pharmacodynammics, Richard Hughes Page-Appendix, 930-939]
ডা. কেন্ট তার ফিলসফির ২৫১ পৃষ্ঠায় ২৮১ নম্বর সূত্রের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করে বলেছেন যে,
“আমরা কখনো দাবী করি না যে, প্রত্যেক শক্তি প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য উপযোগী হবে। শক্তি অবশ্যই রোগীর অবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে।”
ডা. হেরিংস, ডা. লিপি, ডা. কেন্ট, ডা. ফেরিংটন, ডা. ডানহাম, ডা. ন্যাশ, ডা. এলেন, ইত্যাদি খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসকগণ একচেটিয়াভাবে শততমিক শক্তির ঔষধ ব্যবহার করেছেন। তাদের সফলতার হার অনেক বেশি। অতএব তাদেরকে অস্বীকার করলে হোমিওপ্যাথির ভিত্তিমূলক ঐতিহ্যকেই অস্বীকার করা হবে। শততমিক ৩০ (ত্রিশ) ও তদোর্ধ্ব শক্তির ঔষধ থেকে কোনো প্রকার উগ্রক্রিয়ার ঘটনা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া যায় নি। আমরা তাদের লেখা থেকে বিস্ময়কর আরোগ্যের ইতিহাস জানতে পারি। তা আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার জন্য সহায়ক হয়। অপরদিকে আমাদের মেটিরিয়া মেডিকা সৃষ্টি হয়েছে এবং হচ্ছে শততমিক পদ্ধতি অনুসারে শক্তিকৃত ঔষধের ক্রিয়াভিত্তিক (অর্গানন, সূত্র-১২৮ দ্রষ্টব্য)। অতএব আমরা হোমিওপ্যাথিতে শততমিক শক্তির উপর দাঁড়িয়ে কি করে ঔষধের শক্তি বৃদ্ধির শততমিক প্রযুক্তিকে অস্বীকার করি?
তবে এ-কথা স্বীকার করতেই হবে যে ঔষধের সূক্ষ্মতা এবং শক্তিবৃদ্ধি করার জন্য শততমিক পদ্ধতি অপেক্ষা পঞ্চাশ সহস্রতমিক পদ্ধতি প্রযুক্তিগতভাবে উত্তম এবং এ-পদ্ধতির ঔষধ রোগীতে ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও কিছু সুবিধা আছে। হ্যানিম্যান ২৭০ নম্বর সূত্রের বিভিন্ন পাদটীকায় তা ব্যাখ্যা করেছেন এবং আমি অত্র সূত্রের ব্যাখ্যায় এ-পদ্ধতির পক্ষে উপরে কিছু যুক্তি দেখিয়েছি। কিন্তু আমি শততমিক পদ্ধতির দীর্ঘ দুইশত বছরের অর্জনকে অস্বীকার করি না। কারণ আমি ঔষধ সূক্ষ্মকরণের দুটি পদ্ধতিরই প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। কিন্তু দুটি পদ্ধতির শক্তিকৃত ঔষধ রোগীতে ব্যবহার করে তুলনামূলক সফলতা আমি নিরূপণ করতে পারি না। কারণ হোমিওপ্যাথিতে স্বতন্ত্রকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক রোগীর সাথে অন্য রোগীর স্বতন্ত্রতা পৃথক পদ্ধতির দুটি শক্তির সাফল্য তুলনা করার ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাড়ায়। কোনো এক রোগী শততমিক শক্তির ঔষধে দুই বছরে সুস্থ হলো, অপর একজন রোগী পঞ্চাশ সহস্রতমিক শক্তির ঔষধে দেড় বছরে আরোগ্য হলো বলে একথা বলা যাবে না যে, পঞ্চাশ সহস্রতমিক পদ্ধতি উত্তম। কারণ রোগীর সুস্থতা অর্জন শুধুমাত্র ঔষধশক্তির উপর নির্ভর করে না, রোগীর জীবনীশক্তির সামর্থ্য, রোগীর স্বাস্থ্যবিধি পালন ইত্যাদি বিষয়ের উপরেও নির্ভর করে। কাজেই আমার মতে, যখন যে রোগী যে পদ্ধতির শক্তিকৃত ঔষধে আরোগ্যলাভ করে তখন সেই রোগীর জন্য সেই পদ্ধতির ঔষধই উত্তম।
তথ্য
সংগ্রহে:
অর্গানন
অভ্ মেডিসিন, স্যামূয়েল হ্যানিম্যান।
[অনুবাদক ও ভাষ্যকার, ডা. রেজাউল করিম]