প্রায়ই বিতর্ক লাগে একটা বিষয় নিয়ে “আমরা লক্ষণের চিকিৎসা করি, রোগের চিকিৎসা করি না” (‘Treat the patient not the disease’) – এই কথার মানে কি দাঁড়ায়? আমাদের কি রোগ না জেনে শুধু মেটেরিয়া মেডিকার লক্ষণ জানলে হবে? কিন্তু তাহলে, লক্ষণ কাকে বলে এবং রোগ কাকে বলে?
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা মতে তাই-ই রোগ, যা জীবনীশক্তির বিশৃংখলার কারণে উপসর্গ হিসাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রকাশ পায়। আর লক্ষণ বলতে ঐসব উপসর্গগুলোকেই বুঝায়। তাহলে রোগের কারণেই শারীরিক ও মানসিক লক্ষণ প্রকাশ পায়। এসব লক্ষণগুলোর মধ্যে কিছু লক্ষণ আছে সাধারণ, আর কিছু আছে অসাধারণ/অদ্ভুত লক্ষণ। রোগ জানার জন্য সাধারণ লক্ষণ দরকার হয়, আর ঔষধ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন হয় অসাধারণ লক্ষণের।
অর্গানন অফ মেডিসিন এর তৃতীয় সূত্রে ডা. হ্যানিমান রোগ সম্পর্কে জানার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি চিকিৎসকদের যে বিষয়গুলোতে জ্ঞান থাকতে হবে বলে তাঁর সিদ্ধান্ত জানান,
“If the physician clearly perceives what has to be cured in disease, i.e., in each individual case of disease (Knowledge of the disease)………….. is a true physician.”
রোগ সম্পর্কে জানলে কোনটা সাধারণ লক্ষণ এবং কোনটা বিশেষ লক্ষণ এই বিষয়গুলো ভালোভাবে আয়ত্ত করা এবং রোগীর ব্যবস্থাপনা ও ভাবীফল কী হতে পারে তা নিয়ে আমরা নিশ্চিত হতে পারি। হোমিওপ্যাথিতে রোগের শ্রেণিবিভাগ প্রধানত চার ভাগে করা হয়েছে। যেমন:
১) স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে রোগ (Indisposition)
২) যান্ত্রিক কারণঘটিত রোগ (Mechanical injury)
৩) তীব্র রোগ (Acute disease)
৪) চিররোগ (Chronic disease)
উপরের ৪ শ্রেণিবিভাগকে যদি বুঝতে চান, বোঝার ক্ষেত্রটিতে রোগের নাম ধরে উদাহরণ দিয়ে বুঝলে বিষয়টা অনেক সময়ই পরিষ্কার হবে এবং প্রত্যেক শ্রেণির রোগের বৈশিষ্ট্যগুলো খুব সহজে আয়ত্তে আনতে পারবেন। ধরুন, কোভিড-১৯, এই রোগটা সারা বিশ্বে মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে। এই রোগের লক্ষণগুলো জানতে পারলে আপনার সুবিধা হবে, নাকি হবে না? রোগের গতিপ্রকৃতি জানলে, কোন কোন ঔষধ এইসব লক্ষণে কাজ করবে আপনার চিন্তায় চলে আসবে। সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়তে হয় কিছু রোগের ক্ষেত্রে প্যাথলজির আমূল পরিবর্তন ঘটে, ঐ সময় আপনার মাথায় এসব বিষয় না রাখলে আপনি রোগী মেরে ফেলবেন।
বোঝার সুবিধার্থে, মহাত্মা হ্যানিমানের এই টার্মগুলো ব্যবহারের আরেকটা উদাহরণ দিচ্ছি, খোদ মায়াজম নিয়ে আলোচনাকৃত ২০৫নং সূত্রের প্রথম ফুটনোটে তিনি ‘Blindness, Deafness, Insanity, Asthma, Dropsy, Apoplexy, etc’ শব্দগুলো উল্লেখ করছেন। ৮০ নং সূত্রে সোরা সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে উল্লেখ করছেন, ‘Neurasthenia, Hysteria, Hypochondria, Mania, Melancholia, Idiocy, Madness, Epilepsy And All Kinds Of Fits, Softening Of The Bones (Rachitis), Scrofula, Scoliasis And Kyphosis, Bone Caries, Cancer, Fungus Hematodes, Neoplasms, Gout, Hemorrhoids, Jaundice And Cyanosis, Dropsy, Amenorrhea, Hemorrhage Of The Stomach Nose, Lungs, Bladder, and Womb, Asthma and Sup-ion Of The Lungs, Impotence And Infertility, Migraine Deafness, Cataract And Amaurosis, Kidney Stones, Paralyses, Deficiencies Of The Senses, and Every Kind Of Pain, etc.,’ নামগুলো। মূলত এমন কোন ভালো চিকিৎসকের লেখাই আপনি দেখতে পাবেন না, যেখানে বোঝার সুবিধার্থে রোগের Nosological Terms ব্যবহার করেননি।
যাই হোক, গত বছর ডেংগু রোগের ক্ষেত্রে প্লাটিলেট কমে গিয়ে অনেক রোগী মারা যায়। ডেংগুতে প্লাটিলেট কমে যায়- এটা জানলে আমরা মেডিসিন সিলেকশন আরও গুরুত্বের সাথে করব এবং কি ব্যবস্থাপনা নিতে হবে তাও জেনে রাখব। আরেকটা উদাহরণ, ধরুন হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগীকে তৎক্ষনাৎ গ্লুকোজ সাপোর্ট দিতে হবে তা না হলে রোগী মারা যাবে। চিকিৎসা পেশায় আসলেন, আর রোগ সম্পর্কে ধারণা রাখবেন না- কি করে সম্ভব?
এবার মূল প্রসঙ্গে আসি ‘Treat the patient not the disease’ বলতে কি বুঝি? ধরুন, চার জন রোগী আপনার কাছে আসল। আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে প্রত্যেকেরই সর্দি কাশি, জ্বর-জ্বরভাব, জ্বর, শরীর ব্যাথা ইত্যাদি উপসর্গ আছে- যা ইনফ্লুয়েঞ্জার লক্ষণ। প্রথম রোগীর ক্ষেত্রে ঠান্ডা, সর্দি, জ্বর, হাঁচি, শরীর ব্যথা আছে, জ্বরে অস্থিরতা আছে, চুপচাপ থাকতে পারে না, জিহ্বার ডগা লাল, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র অনুযায়ী রাসটক্স প্রেসস্ক্রাইব করলেন। আবার ২য় রোগীর ক্ষেত্রে ঠান্ডা, সর্দি, জ্বর, শরীর ব্যথাও আছে, জ্বরে চুপচাপ পড়ে থাকে, পিপাসা নেই, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র হিসাব করে জেলস প্রেস্ক্রাইব করলেন। ৩য় রোগীতে ইনফ্লুয়েঞ্জার লক্ষণসহ বিশেষ লক্ষণ পেলেন প্রচন্ড মাথাব্যথা, চোখ-মুখ লাল, জ্বর উঠানামা করে- এইসব লক্ষণে বেলাডোনা প্রেসস্ক্রাইব করলেন। চতুর্থ রোগীতে ইনফ্লুয়েঞ্জার লক্ষণসহ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র পর্যবেক্ষণ করে লক্ষণ পেলেন- রোগী চুপচাপ পড়ে আছে, মাথাব্যথা নড়াচড়া করলে বেড়ে যায়, প্রচুর পানির পিপাসাসহ গলা-ঠোট শুকিয়ে যায়, মেডিসিন দিলেন- ব্রায়োনিয়া। উপরের সবকটা রোগীর রোগ ছিল ইনফ্লুয়েঞ্জা কিন্তু ব্যক্তিস্বাতন্ত্র নির্ণয় করে, প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা মেডিসিন নির্বাচন করা হল।
এখানে মেডিসিন প্রেসক্রাইব করার ক্ষেত্রে এলোপ্যাথির সাথে হোমিওপ্যাথির পার্থক্য কোথায়? এলোপ্যাথিতে নির্দিষ্ট রোগের চিকিৎসায় নির্দিষ্ট কিছু মেডিসিন আছে, আর হোমিওপ্যাথির ক্ষেত্রে প্রত্যেক রোগের বিপরীতে অনেক ঔষধ আছে- যা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র হিসাব করে দিতে হয়। তাহলে পরিষ্কার ভাষায় বলি এলোপ্যাথিতে রোগের চিকিৎসা করা হয়, আর হোমিওপ্যাথিতেও রোগের চিকিৎসা করা হয়- তবে রোগীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের ভিত্তিতে। রোগের যে নামকরণ করা হয়েছে তা উচ্চারণ করা মানেই তার ভিত্তিতে চিকিৎসা করা নয়। চিকিৎসা আমাদের রোগীর সার্বিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতেই করতে হবে কিন্তু দ্রুততম সময়ে বোঝার জন্য, শ্রেণিকরণ করার জন্য ও সে অনুযায়ী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে এর নোসোলজিক্যাল টার্মগুলোকে বর্জন করারও কোন যুক্তি নেই। রোগের চিকিৎসা বোঝায় এগুলোকে আলাদা আলাদা রোগ কল্পনা করে চিকিৎসা করাকে, নাম উচ্চারণ করে গভীরে প্রবেশ করাটিকে নয়। কাজেই, উত্তমরূপে রোগীর চিকিৎসা করতে গেলেও, এই শ্রেণিবিভাগগুলো সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
Discussion about this post