ডা. সঞ্জীব কুমার বসু:
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার মূল ভিত্তি হচ্ছে মায়াজম। ডাঃ হ্যানিম্যান মানুষের রোগের মূল কারণ হিসাবে সোরা, সাইকোসিস ও সিফিলিস মায়াজমকে নির্দিষ্ট করেছেন। এরমধ্যে সোরাকে আদি ও অকৃত্রিম বলেছেন। আরও বলেছেন যে, এটা সর্বব্যাপী এবং সর্বরোগের মূলাধার। অন্য দুটি মায়াজম নিজেদের আচার আচরণের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে কিংবা বংশগত উপদ্রব হিসাবে অর্জিত হয়েছে।
সেইজন্য হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় মূলতঃ রোগীর মায়াজমগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর ওষুধ দেওয়া হয়। সমস্ত হোমিওপ্যাথিক মতে প্রস্তুত ওষুধে মায়াজমগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থাকে বা থাকতে হবে।
অনেক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকেরা এই ক্ষেত্রে অসুবিধায় পরেন। হোমিওপ্যাথিক মেটেরিয়া মেডিকায় ঐভাবে কোন মায়াজমজনিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিশ্লেষণ ওষুধগুলোর মধ্যে পাওয়া যায় না। রোগজনিত কারণে যে যে লক্ষণ উপস্থিত হয় এবং কিছুটা ওষুধের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় উল্লেখ পাওয়া যায় আমাদের তার উপরই নির্ভর করতে হয়।
ব্যবহারিক জীবনে ওষুধ নির্বাচনের সময় ওষুধটির মধ্যে কোন মায়াজমের বা কোন্ কোন্ মায়াজমের প্রভাব আছে তা বিশ্লেষণে অনেক সময় অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সেইজন্য আমাদের অর্থাৎ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের চোখের সামনে মায়াজমের চারিত্রিক রূপরেখা ধরে রাখা একান্তভাবে প্রয়োজনীয়। তাই মায়াজমগুলোর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছু সংক্ষিপ্ত ধ্যান ধারণা উপস্থিত করার চেষ্টা করছি।

সোরা:
সোরা উচ্চারণ করলে একটা চর্মগত রোগের অর্থাৎ চুলকানী, খোস, পাঁচড়া ইত্যাদি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু কেন এই খোস, পাঁচড়া এবং কেন একে আদিবিষ বলা হবে?
মানুষ, জীবজগত, পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনে গড়ে ওঠে। এটা আদি, অকৃত্রিম, মধুময় এবং এক সুন্দর বা সৌন্দর্যের আহ্বান। তবে কেন একে বিষ বলা হবে বা এর মধ্য থেকে বিষ উৎপন্ন হবে! সৃষ্টির মূল ভিত্তি যৌন চেতনা। যেখানে সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য মিলন, সেখানে সুন্দরের আবির্ভাব হবে। কিন্তু মানব মনে ঘাত, প্রতিঘাত, লোভ, ঈর্ষা ইত্যাদি যৌন চেতনাকে বিকৃত করে। সেই বিকৃত যৌন চেতনার মধ্যে যে মিলন হয় তা বিষ উৎপন্ন করে। সুন্দরের বদলে অসুন্দরকে আহ্বান করে। তারই ফলশ্রুতিঃ-
১। চিন্তাধারার উপর প্রভাব বিস্তার করে, মনের মধ্যে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, তা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ পায়।
২। মনে চঞ্চলতা প্রকাশ পায়। বৈপরীত্য চিন্তাধারার সৃষ্টি হয়। ক্ষণে ক্ষুব্ধ, ক্ষণে অনুতপ্ত, ক্ষণে উত্তেজিত, ক্ষণে অবসন্ন। অল্পে হাসি অল্পে কান্না। পর্যায়ক্রমে কাম, ক্রোধ, প্রেম, বৈরাগ্য, আসক্তি, ঝগড়া করার মনোবৃত্তি প্রকাশ হয়।
৩। খুব তাড়াতাড়ি ক্ষমা করে।
৪। হিসেব নিকাশের পরোয়া করে না।
৫। খাবার গরম খেতে ভালবাসে, মিষ্টি ভালবাসে, দুধ সহ্য হয় না।
৬। রোগ যন্ত্রণাদায়ক কিন্তু সব সময় সমান যন্ত্রণা থাকেনা। যে কোন সময় বৃদ্ধি হয়।
৭। সব দিকই আক্রান্ত হয়।
৮। স্বপ্ন দেখে যেন প্রস্রাব বা মলত্যাগ করছে। গান গাইছে।
৯। গরমে উপশম।
১০। সর্ব রোগের মূলাধার—সর্বত্রই বর্তমান থাকে। সাধারণভাবে চুলকানি বা চর্মরোগের মধ্যে প্রকাশ পায়।
সোরা মায়াজম প্রভাবিত রোগী ভুল বা কু-চিকিৎসায় চর্মক্ষত, শোথ, অবিরাম জ্বর, হাঁপানি, সন্ন্যাসরোগ, পেটের রোগ, বাত, পক্ষাঘাত, রক্তস্রাব, উন্মাদ ইত্যাদিতে পরিণতি লাভ করে।
সাইকোসিস:
গনোকক্কাস এই মায়াজমটির মূল কারণ। দূষিত সহবাস বা রোগাক্রান্ত মানুষের সাথে যৌন সম্পর্ক মানবদেহে সাইকোসিস মায়াজমের প্রভাব বিস্তার করে। মূল আক্রমনস্থল বৃহদান্ত্র, সরলান্ত্র, মূত্রনালী, শ্বাসনালী ও সন্ধিস্থল। চরিত্রগতভাবেঃ-
১। বিস্মরণ হয় তবে তা সাময়িক।
২। সন্দিগ্ধ, শঙ্কিত, গোপনতা প্রিয়।
৩। চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলে।
৪। ক্ষমা করিতে ইতস্ততঃ করে, শর্ত দেয়।
৫। বদ্ধমূল ধারণা, যুক্তিতর্কে ধারণা পাল্টায় না।
৬। মনের সঙ্কীর্ণতাবশতঃ মন খুলে কথা বলতে পারে না। সন্দিগ্ধমন+সঙ্কোচ, পরায়ণ+মিথ্যাবাদী।
৭। অনুযোগ, অভিযোগে লোক বিরক্ত হয় কিন্তু পরামর্শ চেয়েও তা গ্রহণ করে না।
৮। হিসাবনিকাশ মিলিয়ে দেখে, নির্ভুল দেখলেও সংশয় যায় না।
৯। নোনতা প্রিয়। অল্প ঠান্ডা বা গরম খেতে ভালবাসে, চর্বিজাতীয় খাবার সহ্য হয়না।
১০। রোগ যন্ত্রণায় প্রনান্ত হয়, কিন্তু প্রাণ সংশয়ের ভয় থাকে না। বৃদ্ধিকাল পূর্বাহ্নে বা অপরাহ্নে। নড়াচড়ায় ভাল থাকে।
১১। আক্রমণ সাধারণভাবে বাঁ দিকে।
১২) উঁড়ে যাওয়া বা পড়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে।
গনোকক্কাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে বা ভুল বা কু-চিকিৎসার ফলে হিষ্টিরিয়া, হাঁপানি, মুত্রপথের সঙ্কোচন, মুত্রপাথরী, একশিরা, ফাইলেরিয়া, ডিপথেরিয়া, বসন্ত, যোনীপথের সঙ্কোচন, উচ্চ রক্তচাপ, সন্ন্যাস, বাত, টাইফয়েড, টিউমার, ছানি, বাধক, ঋতুকষ্ট, ক্রনিক আমাশা ইত্যাদি দেখা দেয়।
সিফিলিটিক:
কু সঙ্গে বা দুষ্ট সহবাসে মানব দেহ সিফিলিটিক মায়াজমের প্রভাবে পড়ে। সাধারণভাবে যকৃতের উপর প্রভাব বিস্তার করে। চরিত্রগতভাবেঃ
১। মুখ চোরা, মুখ খুলতে যেন কষ্ট হয়, বক্তব্য রাখতে হলে অতি অল্পে এবং তাড়াতাড়ি সেরে ফেলে।
২। হঠকারিতা, বিতৃষ্ণা, নৈরাশ্য ও মূর্খতা প্রকাশ পায়।
৩। ক্ষমা একেবারেই করতে পারে না।
৪। মনঃসংযোগ নেই। হিসাব নিকাশ কাতর।
৫। ভুলে যাওয়া।
৬। উৎসাহ নেই, আসক্তি নেই, রুক্ষ, আত্মগ্লানি, আত্মহত্যা করতে চায়।
৭। মাদকদ্রব্যে আসক্তি, মাখন বা দুধ খেতে চায়, মাংসে অরুচি।
৮। রোগ যন্ত্রণাদায়ক এবং প্রাণনাশক।
৯। সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত বৃদ্ধি।
১০। ডান দিকে সাধারণভাবে আক্রান্ত হয়।
১১। অতিরিক্ত উত্তাপ বা ঠান্ডা সহ্য হয় না।
১২। অগ্নিকান্ড, বিভীষিকা হত্যাকান্ড স্বপ্নে দেখে।
সিফিলিস বা সিফিলিটিক মায়াজম ঘটিত রোগ ঠিক মত চিকিৎসিত না হলে যকৃতের দোষ, অস্থিক্ষত, বধিরতা, তোতলামি, এপিলেপ্সি, পক্ষাঘাত, কার্বাঙ্কল, শ্বেতী, খর্বাকৃতি ইত্যাদি রোগে পরিণত হয়।

সোরা সিফিলিস বা সাইকোসিস মায়াজম ঘটিত রোগ যে সব সময় নিজদোষে অর্জিত হয় তা নয়। বেশির ভাগ সময় পূর্বপুরুষ হইতে বংশ পরম্পরায় সংগৃহীত হয়। মাতা-পিতার মিলিত ক্রোমোজমের মধ্য দিয়ে গর্ভসঞ্চার হয় এবং ক্রমোজমের মাধ্যমে উভয়ের গুণাবলী ও দোষসকল সন্তানের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। সরাসরি স্বয়ং মাতা পিতা দোষযুক্ত নাও থাকিতে পারেন। উহারাও আপন পূর্বপুরুষ হইতে ইহা সংগ্রহ করিতে পারেন। চিকিৎসায় সম্পুর্ণভাবে বিষমুক্ত না হইলে পরবর্তী প্রজন্মের পর প্রজন্ম ইহার ফল চলতেই থাকে এবং আরও জটিল থেকে জটিলতর অবস্থার দিকে এগিয়ে চলে।
রোগীদেহে মায়াজম নির্ণয়ের ক্ষেত্রে নাড়ীর গতি প্রকৃতি বিশেষভাবে সাহায্য করতে পারে। তবে নাড়ীর গতিপ্রকৃতি নির্বাচন বিশেষ অনুশীলনযোগ্য। নাড়ী দেখার নিয়ম অনুযায়ী, বেশ কিছুক্ষন আঙ্গুল ৩টির সাহায্যে নাড়ী গতি অনুভব করার চেষ্টা করা হয় তবে আস্তে আস্তে নাড়ীর গতি অনুভুত হবে। নাড়ীর ৪ রকম গতি পাওয়া যায়।
১) কেঁচোর চলার মত গতি— অর্থাৎ আঙ্গুলিতে অনুভূত হবে— নাড়ী প্রথমে একটু এগিয়ে আবার পিছন থেকে ঠেলে দিয়ে আবার সামনের ভাগ এগিয়ে যাচ্ছে। এই গতি একটা সমতা যুক্ত শরীরে পাওয়া যায় এটা আপাত সুস্থ রোগীর নাড়ী। এই নাড়ীর গতিতে জড়তা থাকেনা।
২) সাপের চলার মত বাঁকা— অর্থাৎ এঁকে বেঁকে এগিয়ে চলে— এই গতির বৈশিষ্ট্য মূলতঃ যৌনচেতনার বিকৃতির মধ্যে দিয়ে চিন্তাধারার উপর প্রভাব বিস্তার করে। মানসিক চঞ্চলতা যা সার্বিক মায়াজমের রোগীর নির্দেশক। মানসিক বৈপরিত্য দেখা দেয়। মানসিক উদ্গারতা। কোনও কিছু হিসাবের মধ্যে যায়না বা গ্রাহ্য করে না। রোগ যন্ত্রণা থাকে তবে সব সময় সমানভাবে নয়। রোগযন্ত্রণা বৃদ্ধির কোন নির্দিষ্ট সময় নাই। রোগ গরমে ভাল থাকে। মিষ্টি এবং গরম খেতে ভালবাসে। দুধ সহ্য হয় না।
৩) চঞ্চলা গতি— যেন নাড়ী লাফিয়ে লাফিয়ে চলে—অনেকটা ব্যাঙের চলার মত গতি যা সিফিলিটিক মায়াজমের নির্দেশক। বৈশিষ্ট্য প্রভাব লিভারের উপরে। Introvert চুপচাপ থাকে। বক্তব্য সংক্ষেপে ও তাড়াতাড়ি বলে। উদারতা নেই। হঠকারী, ঘৃণা, কিছু পরিমাণে বোকা। মনযোগ সহকারে কিছু করতে পারেনা। রোগ বৃদ্ধি সূর্যাস্তের পর ও সূর্যাস্তের আগে, আক্রমণ সাধারণভাবে ডান দিকে। অতিরিক্ত ঠান্ডা ও গরম সহ্য হয় না। প্রধানতঃ ক্ষয়কারী রোগের আধার। ক্ষতিকর খাবার ও পানীয় পছন্দ, মাংসে অরুচি। চর্বিজাতীয় খাবার ও দুধ পছন্দ। ভীতিকর স্বপ্ন দেখে।
৪) নাড়ীর গতি যেন পিছন দিকে হেলে চলে— অনেকটা পায়রার চলার মত গতি। যা সাইকোটিক মায়াজমের নির্দেশক। শঙ্কিত ও ভুলো মন। গোপনতা ও সন্দেহবাতিকতা। কথা স্পষ্ট নয়। মানসিক উদারতা শর্তাধীন। কোন কিছুই বিশ্বাস করতে চায় না। অবরোধকারী রোগ। বৃদ্ধিকাল দুপুরের বা মধ্যরাতের পর। আক্রমণ সাধারণভাবে বাঁ দিকে। রোগযন্ত্রণা নড়াচড়ায় ভাল থাকে। যন্ত্রণা সময় সময় প্রানান্তকারী। দীর্ঘদিন ভোগায়। নোনতা, মাঝারি ঠান্ডা। গরম প্রিয়। চর্বিজাতীয় খাবার সহ্য হয় না।
উপযুক্ত বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে যথাক্রমে সোরা, সিফিলিস ও সাইকোসিস মায়াজমকে পাওয়া যায়। আমার চিকিৎসা-ব্যবহারিক জীবনে—রোগীলিপি নেবার সঙ্গে সঙ্গে মায়াজম বিশ্লেষণ উভয়ভাবেই করে প্রভূত উপকৃত হয়েছি।
Discussion about this post