ঠিক আগের পর্বে আমি Dominant Miasm সম্পর্কে কিছু কথা বলেছিলাম। এটা নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি আছে। হোমিওপ্যাথিক ওষুধের নির্বাচনে লক্ষণের মূল্যায়ন (Evaluation of symptoms) করার জন্যে Dominant Miasm টিকে চিহ্নিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হোমিও-কলার গুরুত্বপূর্ণ অথচ সর্বাপেক্ষা ভুল বোঝা এই সূক্ষ্ম অংশটি- সদৃশতম ওষুধ নির্বাচনের প্রাণ-ভ্রমরা।
ডা. অ্যালেন বলেছেন- সর্বাপেক্ষা অদ্ভুত, স্পষ্ট, তীব্র লক্ষণের মাধ্যমে Dominant Miasm টি প্রকাশ পায়। অর্গাননের ১৫৩ নং সূত্র অনুসারে এই অদ্ভুত, আশ্চর্যজনক লক্ষণটি চিনবো কি করে? এর আগের লেখায় Meteria Medica Pura এর অংশটি থেকে বলা যায়- কোন পরিবেশে কোন অবস্থায় বা পরিস্থিতিতে লক্ষণটি সৃষ্টি হয়েছে, যা আমাদের ভাবিয়ে তোলে বা দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এটি লক্ষণটির গুণগত (Rank) মানকে বোঝায়। রেপার্টরিতে যে ‘Grade’ দেখেন তা কিন্তু ‘Rank’ নয়। Gradation সংখ্যাকে নির্দেশ করে (See Kent’s philosophy, The value of symptoms, lecture- xxxiii) । Rank এর কথা প্রথম বলেন ডা. বোনিংহাউসেন।
সহজভাবে বোঝার জন্য একটি অন্য উদাহরণ দিচ্ছি। আপনার রাজ্য সরকারে সবাই এম.এল.এ., কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী এম. এল. এ. হলেও বিশেষ মর্যাদা (Rank) প্রাপ্ত। আপনার রোগীলিপির মধ্যে সবাই লক্ষণ কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীটি কে? এই মুখ্যমন্ত্রীকে খুঁজে নিতে হবে
এবার আরো সূক্ষ্মতর জায়গায় প্রবেশ করছি। ভুল করলে ক্ষমা করবেন। এই জায়গায় নিজেকে শিখে নিতে হয়। অবশ্যই ধাক্কা খেতে খেতে শিখতে হবে। এটি গভীর অনুভবের বিষয়। এটা ফিতা দিয়ে মাপা যায় না, আবার দাঁড়িপাল্লায়ও মাপা যায় না। যেমন ধরুন, ‘Sympathetic’ লক্ষণটি অনেক ওষুধে পাওয়া যায় । এখানে অনেক ওষুধ আছে। আমরা ওষুধ নির্বাচনে কয়েকটি ওষুধের তুলনামূলক আলোচনা করে একটি ওষুধ নির্বাচন করি। এটাতো করতেই হবে। কিন্তু এখানে একটি লক্ষণের মধ্যে ওষুধ গুলিকে যদি Rank ভিত্তিক তুলনা করতে পারি আমাদের ওষুধ নির্বাচন অনেক সহজ হয়ে যাবে। Rank ভিত্তিক কোন বই নেই, আপনাকে অভিজ্ঞতা ও অনুভবের মাধ্যমে বুঝতে হবে। বড় কঠিন জায়গা কিন্তু এখানে ঢুকতে পারলে আপনি পাবেন, Meritorious satisfaction of life। আমি একটু খোলসা করেই বলছি। Sympathetic লক্ষণের মধ্যে অনেক ওষুধ আছে। এর মধ্যে মাত্র কয়েকটি ওষুধ, যথা- Calc-carb, Carcinosin, Causticum, Phosphorus ইত্যাদি কয়েকটি ওষুধ আছে, যা প্রথম Rank এর অন্তর্গত।
ডা. জে. এন. কাঞ্জিলাল বলেছেন, লক্ষনটি রোগী ও ওষুধের উভয়েরই সমান মানের হতে হবে। তবেই প্রকৃত সদৃশটি নির্বাচন করতে পারবো। সহজ দুটি উদাহরণ দিয়ে আলোচনা করছি।
(ক) রেপার্টরিতে দেখুন ‘Sympathetic’ Rubric এ Causticum ও Natrum mur এর Gradation 2 অর্থাৎ মান সমান। কিন্তু Rank সমান নয়। এখানে Causticum এর Rank বেশি। তাহলে এই ভাবেও পার্থক্য করা যেতে পারে।
(খ) আবার অপমানের (Mortification, ailments after) ফলে রোগ সৃষ্টি হলে আমরা Natrum mur ও Staphisagria ওষুধ দুটির Gradation সমান বা First grade- কিন্তু Rank এক নয়।
আমরা ডা. কেন্টের মেটিরিয়া মেডিকা খুললে দেখতে পাবো, দুটি ওষুধেই তিনটি মায়াজম আছে। দুটিই Anti-psoric। এবার Staphisagria ওষুধটি দেখতে পাবো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত Oversensitive or Hypersensitive। যেহেতু Staph বেশি Sensitive, তাই বলা যায় Staphisagria তে সোরার প্রাধান্য Natrum mur এর তুলনায় বেশি। তাই অপমানের ক্ষেত্রে Staphisagria-র Rank বেশি। আশা করি Rank ও Grade এর মধ্যে পার্থক্য বোঝাতে পেরেছি।
I say to Dr. Hering, NO, the men who select the similar remedy and are who are ignorant of causes and effects are not true healers of the sick and have not the mind of the master.
এখানে তিনি ডা. হেরিং এর উদ্দেশ্যে বলছেন, সদৃশ ওষুষটি নির্বাচন করবো অথচ কারণ ও ফল সম্পর্কে কোন ধারণা থাকবে না- সে কখনোই প্রকৃত আরোগ্যকারী চিকিৎসক হতে পারেন না। কারণতত্ত্বকে বাদ দিয়ে কারণের ফলকে দূর করা যাবে, এই ভাবনা হ্যানিম্যানের মাথায় ছিল না। এ বিষয়ে ডা. কেন্টও হেরিং এর সমালোচনা করেছেন।
আমার গুরু ডা. কাঞ্জিলাল বলেন, ‘কারো কাছে একটি শব্দ শিখলে আগে সেটা স্বীকার করবি।’ তাই হোমিওপ্যাথিতে হেরিং এর অবদান সম্পর্কে দুই একটি কথা বলছি। আমেরিকায় হোমিওপ্যাথি প্রসারে তার বিরাট অবদান আছে। আমার গুরু ডা. দাসের কাছে শোনা কথা কিছু কিছু মনে পড়ছে। শল্য চিকিৎসা করতে গিয়ে তার হাত কেটে যায়। সেই হাতে সেপসিস হবার জন্য হাত কেটে বাদ দেবার প্রয়োজন হয়। কিন্তু আর্সেনিক অ্যালবাম তাকে রক্ষা করে। তিনি সেই হাত হোমিওপ্যাথিকে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি অনেক ওষুধ পরীক্ষণ করেছিলেন। ল্যাকেসিস পরীক্ষণ করে জীবনে আর টাই বাধতে পারেন নি। তার সর্বশ্রেষ্ট কাজ হচ্ছে হেরিং গাইডিং সিম্পটমস। হেরিং এর আরোগ্যের লক্ষণও একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
হেরিং মায়াজম তত্ত্ব মানতেন না। এই জন্যই তিনি সমালোচিত হয়েছেন। যেমন ধরুন, কাঁদলে কষ্টের উপশম। আমরা লক্ষণের গভীরে প্রবেশ করে বলি এটা সোরার লক্ষণ, তা তিনি মানতেন না। তিনি শুধু লক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতেন।
His is a true system of medicine, but there are thousands of men and women who become familiar with but a few remedies or a few pages of our materia medica, and go out to fight against the complexity of disease, which are due to the combinations of psora, syphilis and sycosis, and have no knowledge of the character and habits of the enemy. Their work is often hidden for years, so latent and pent–up are these forces in the organism.
হ্যানিম্যানের হোমিওপ্যাথি নির্ভুল চিকিৎসা পদ্ধতি। ডা. অ্যালেনের এই দাবী বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ ও শাশ্বত দর্শনের মিলিত সদর্থক ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে। সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে এই যে, হ্যানিম্যানের মায়াজম তত্ত্বকে আর কেউ এত বলিষ্ঠভাবে বলেননি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার বর্তমান উপলব্ধি হ্যানিম্যানের সব পর্যবেক্ষণ সত্য- যা আগে বুঝতে পারিনি। এর জন্য আমার নির্বুদ্ধিতাই দায়ী।
হোমিওপ্যাথির দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী হাজার হাজার চিকিৎসক যারা মেটিরিয়া মেডিকার অল্প কয়েকটি পাতা পড়ে যখন জটিল রোগের চিকিৎসা করতে যান। জটিল রোগ সৃষ্টি হয় সোরার সঙ্গে অন্য দুইটি মায়াজম সাইকোসিস ও সিফিলিসের মিশ্রণের ফলে। সোরা সর্বক্ষেত্রেই থাকবে ফলে খাঁটি সোরা পাওয়া গেলেও খাঁটি সাইকোসিস বা সিফিলিস পাওয়া যায় না- এদের সঙ্গে সোরা সক্রিয় বা সুপ্ত অবস্থায় মিশ্রিত থাকে। বর্তমানে সব জটিল রোগেই এই তিন মূর্তি উপস্থিত থাকে। রোগীকে সার্বিকভাবে বুঝতে প্রত্যেক লক্ষণকে মায়াজমের ভিত্তিতে চুলচেরা বিচার করতে হবে। যদি আমরা শুধু লক্ষণকে দেখে ওষুধ নির্বাচন করি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুল করবো; যদি মায়াজমকে বিবেচনার মধ্যে না আনি। এবিষয়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ আপনাদের অভিজ্ঞতার কথা বলুন, কারণ এই ক্ষেত্রটি একান্তভাবে হোমিওপ্যাথির নিজস্ব ক্ষেত্র।
Desire for travelling, লক্ষণটি খাঁটি সোরা, কারণ সোরার পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্য এখানে বর্তমান। আপনাদের প্রতিদিনের একটি সাধারণ অভিজ্ঞতাকে আমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার বিশ্লেষণ করে আপনাদের দরবারে তুলে ধরছি। ভুল করলে সংশোধন করে দেবেন।
ভয় পাওয়া সোরার একটি লক্ষণ। ভয় বলতে আমরা বুঝি, Emotion of Retreat অর্থাৎ ভয়ের (Will) দ্বারা পরিচালিত হয়ে আমরা পিছিয়ে আসি। আমাদের যে কাজ করায় তাকেই- ইচ্ছা বা Will বলে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ভয় সোরা হবে কেন?
পিছিয়ে আসা অর্থাৎ সাহস বা আত্মবিশ্বাসের অভাব। অভাব সোরার বৈশিষ্ট্য। জানা সত্ত্বেও, পরীক্ষার ক্ষেত্রে পারবো না, এটা সাহস বা আত্মবিশ্বাসের অভাবকে সূচিত করে। তবে এই একটি লক্ষণের ওপর ভিত্তি করে ওষুধ দেওয়া উচিৎ নয়। সবসময় সার্বিকভাবে দিতে হবে। আলোচনার সুবিধার জন্য আমি একটির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবো।
পরীক্ষার কথা মনে পড়লে বুক ধড়পড় করে, অন্যকাজে ব্যস্ত থাকলে ভাল থাকি ইত্যাদি- এটা সোরার রোগী। একে বোঝাতে হবে এবং উৎসাহ দিয়ে Antipsoric দেওয়া যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে বোঝান বা উৎসাহতে ভাল কাজ হয়, কারণ সোরার রোগী বাধ্য।সোরার সঙ্গে সাইকোসিস মিশ্রিত থাকলে থাকলে, সোরার ভয়টিকে বহুগুণ বেড়ে (Overconstruction) যাবে। যাকে রোগী বলেন টেনশন। এই টেনশন কেমন হয়? পরীক্ষার তারিখ শোনার পর থেকে ক্রমশ বাড়তে থাকবে। ক্রমশ খাওয়া, ঘুম উধাও হয়ে বিভিন্ন প্রকার লক্ষণ (Reflex Symptoms) প্রকাশ পায়। এখানে একটা বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পাচ্ছে, একটানা টেনশন। সোরার পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্যকে চাপা দিয়ে একটানা চলছে। একে ইংরেজিতে বলে Persistency। এই পরীক্ষা-ভীতিতে সাইকোসিসের প্রাধান্যের জন্য Anti-sycotic দিতে হবে।
পরীক্ষা দিতে যাবার আগে হঠাৎ অনেকের হাত-পা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যায়, চোখ কোটরে ঢুকে যায় ইত্যাদি। অনেকে পরীক্ষায় বসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে (পরীক্ষার আগে সুস্থই ছিল)। Fluid loss না থাকা সত্ত্বেও বরফের মতো শীতলতা হচ্ছে Perverted Physiological Process এর জন্য। এটা একমাত্র সিফিলিস মায়াজম করে। ‘হঠাৎ’ (Sudden) বৈশিষ্ট্যটি সিফিলিস মায়াজমের। মনের ক্ষেত্রে ‘হঠাৎ’ বৈশিষ্ট্যটিকে বলে ‘Impulsive’, যথা- সিফিলিসের প্রাধান্যযুক্ত রোগী হঠাৎ রেগে যায়, মারপিট করে- এমন কি খুনও করে ফেলতে পারে ইত্যাদি। এক্ষেত্রে সোরা এবং সিফিলিস মিশ্রিত ওষুধ বা সিফিলিস নাশক ওষুধ নির্বাচন করতে হবে। আমি শুধু ইঙ্গিত দিলাম আপনারা তো সবই জানেন।
পরীক্ষাভীতি এই লক্ষণটি আপনি পাবেন রেপার্টরিতে- ANTICIPATION, complaints from. এছাড়াও মেটিরিয়া মেডিকাতে পাবেন। এবার ওষুধগুলিকে Dominant Miasm অনুসারে তিন ভাগে ভাগ করতে হবে। কাজটা নতুনদের পক্ষে বেশ কঠিন। তাহলে বন্ধু, শুধু লক্ষণ ও তার Gradation বিচার করে ওষুধ দিলে ভুল কোথায় হবে- আশা করি আমাদের বন্ধুদের বোঝাতে পেরেছি। এই সব রোগশক্তি মানুষের ভেতরে দীর্ঘদিন লুকিয়ে থাকে। তাই বলা যায়, মায়াজম না বুঝলে জটিল রোগের চিকিৎসা সম্ভব নয়।
Discussion about this post