অনুবাদ: ডা. পি গুপ্ত
[ডা. এস. পি. দে-এর “Essays on Homoeopathy” থেকে ডা. পি গুপ্ত কর্তৃক অনুবাদকৃত]
মায়াজম বা মায়াজমা শব্দটি আজ অপ্রচলিত। হ্যানিমানের সময় এটা সংক্রামক প্রকৃতিযুক্ত একটি রোগের অজ্ঞাত কারণটিকে নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হতো। আমরা অর্গানন অব মেডিসিনের ৭৯ নং এফোরিজমে প্রথম এই শব্দটির সাক্ষাৎ পাই- যেখানে সিফিলিস প্রসঙ্গে হ্যানিমান বলছেন, “এ পর্যন্ত একমাত্র সিফিলিসকে কিছুমাত্রায় এমন একটি মায়াজমেটিক চিররোগ হিসাবে জানা যায়, যেখানে তা আরোগ্য করা না হলে কেবলমাত্র জীবন সংহার করেই তা নিবৃত্ত হয়”। এ রকম আরো দুটি মায়াজমসৃষ্ট চিররোগের সন্ধ্যান দান করার জন্য আমরা হ্যানিমানের কৃতিত্বের কাছে ঋণী। এরা হচ্ছে সোরা এবং সাইকোসিস। নির্দিষ্ট প্রকৃতির তরুণ সংক্রামক রোগগুলো, যেমন- হাম, বসন্ত, হুপিং কফ, মাম্পস ইত্যাদি ক্ষেত্রেও হ্যানিমান একই শব্দ ‘মায়াজম’ ব্যবহার করেছেন। হাম, গুটিবসন্ত, জলবসন্ত ইত্যাদি, তথা উদ্ভেদযুক্ত তরুণ রোগগুলোর কারণকে পরবর্তীতে তিনি “Half spiritual miasms” বলে সম্বোধন করেন, কারণ মানবসংস্থানে তাদের একটি স্বল্পকালীন পরজীবী স্থিতির পরে- এই মায়াজমগুলো লুপ্ত হয়। তিনি জলাতঙ্কের কারণকে অর্ধ-তরুণ মায়াজম (Half Acute Miasm) বলে আখ্যায়িত করেন, কারণ এই রোগপ্রদর্শনের শুরুর দিকে তা চিররোগ প্রকৃতির, সংস্থানে পূর্ণ বিকশিত হতে একটি দীর্ঘ সময় নেয়; কিন্তু একবার তার পূর্ণবিকাশ ঘটলে, রোগী অন্য যে কোন মারাত্মক তরুণ রোগের মতই তীব্র তরুণ লক্ষণগুলোসহ দ্রুত মৃত্যুবরণ করে।
আমরা তাকে ভ্যাকসিনেশনের ব্যাপারেও শব্দটি ব্যবহার করতে দেখি; জলবসন্তের মায়াজমের সাথে সাথে তিনি গুটিবসন্তের লসিকারসেও অন্য একটি মায়াজমের কথা উল্লেখ করেন- তাকে তিনি “Accessory miasm” বলে অভিহিত করেন, যা ভ্যাকসিনেশনের পরে একটি বিশেষ প্রকৃতির চর্মোদ্ভেদের জন্য দায়ী। কলেরার ব্যাপারেও তাকে শব্দটি আমরা ব্যবহার দেখি- যেখানে ১৮৩১ সালে কলেরার কারণের সপক্ষে রচিত প্রবন্ধে তিনি লেখেন, “(কলেরা) সম্ভবত এই লক্ষ লক্ষ মায়াজমেটিক সজীব সত্তা দ্বারা গঠিত”। সুতরাং তিনি মায়াজম শব্দটিকে তরুণ ও চির- উভয় প্রকৃতির সংক্রামক রোগগুলোর অজ্ঞাত কারণগুলোকে নির্দেশ করতে ব্যবহার করেছেন বলে আমরা দেখি। সংক্রামক চিররোগগুলো মূলত তিনটি….সোরা, সাইকোসিস এবং সিফিলিস, যেখানে তরুণ সংক্রামক রোগের সংখ্যা বহু- যেগুলোর জন্য তিনি কোন নতুন পরিভাষা ব্যবহার করেননি। চিররোগগুলোর তালিকটিতে তার যোগ করা সোরা এবং সাইকোসিস শব্দগুলোও তৎকালীন প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থার পরিভাষায় নতুন সংযোজন ছিলো, কিন্তু সেগুলো তার দীর্ঘসময়ের পর্যবেক্ষণকৃত বাস্তবতাগুলো থেকে আসা সিদ্ধান্তের ফলাফল। তিনি কলেরা, ফিক্সড মায়াজমেটিক ডিজিজ, হাফ-একিউট মায়াজমেটিক ডিজিজ, সোরা ইত্যাদি ব্যাপারগুলো সম্বন্ধে যে কথাগুলো বলেছিলেন, এই বিংশ শতাব্দীতে- মায়াজমগুলোর প্রকৃতির সাথে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের সাদৃশ্যের ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ বা বিতর্কের অবকাশ থাকতে পারে না।
কাজেই আমরা বোধহয় মায়াজম শব্দটি হোমিওপ্যাথিক শাস্ত্র থেকে মুছে দিতে পারি। এটা অন্তত হোমিওপ্যাথির একটি বৃহৎ মতানৈক্যের সমাধানে সহায়তা করবে। মায়াজম এমন কিছু হতে পারে না, যার আদৌ কোন অস্তিত্ব নেই। হোমিওপ্যাথির পরবর্তী বিবাদ হচ্ছে মায়াজম এবং মায়াজমেটিক রোগ। আমাদের অনেকেই সোরা, সাইকোসিস এবং সিফিলিসকে মায়াজম বলে অভিহিত করেন। কিন্তু তিনি যতদূর পর্যন্ত বলেছেন, সেখানে কি বিতর্কের কোন অবকাশ থাকে? মায়াজমগুলো হচ্ছে কারণ (ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস) এবং রোগগুলি তাদের সৃষ্ট ফলাফল। সোরা, সাইকোসিস এবং সিফিলিস হচ্ছে যথাক্রমে সোরা, সাইকোসিস এবং সিফিলিস মায়াজম সৃষ্ট মায়াজমেটিক রোগ। তাহলে কেন আমরা সোরা, সাইকোসিস অথবা সিফিলিসকে মায়াজমেটিক রোগ বলে বিবেচনা করা উচিৎ? “Chronic Diseases”-এ এটা স্পষ্টভাবে লেখা আছে যে, এগুলো মায়াজম সৃষ্ট রোগ বা অসুস্থতা। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, হ্যানিমান এফোরিজম ৭৯-এ বলেন, “এ পর্যন্ত একমাত্র সিফিলিসকে কিছুমাত্রায় এমন একটি মায়াজমেটিক চিররোগ হিসাবে জানা যায়”।

এটা সত্য যে, অর্গানন এবং ক্রনিক ডিজিজের কিছু কিছু জায়গায় সোরা শব্দটি মায়াজমের সাথে সমার্থক হয়ে গেছে। কিন্তু সে সময়টিতে এটা অত্যন্ত সম্ভাব্য ছিলো যখন বেশিরভাগ রোগের কারণগুলি ছিলো অজানা এবং মায়াজম শব্দটি একটি অজ্ঞাত কারণকে চিহ্নিত করায় অনির্দিষ্টভাবে ব্যবহৃত হতো। স্বাভাবিকভাবেই স্বয়ং হ্যানিমানসহ চিকিৎসা-কর্তৃপক্ষগণের দ্বারা কল্পিত কারণ এবং তাদের ফল কখনো কখনো অলক্ষিতেই একাকার হয়ে যেতো। কিন্তু বর্তমান যুগের তথাকথিত বিজ্ঞানসমৃদ্ধ চিকিৎসক- আমাদের বেলায়? আমাদের কি টিউবারকুলোসিস ও টিউবারকুলার ব্যাসিলিকে একই ভাবা উচিৎ হবে? না, একদমই না- কারণ এবং তার ফল, কখনোই এক হতে পারে না। কাজেই আমাদের মাঝে আর এই বিতর্ক ঝুলে থাকা উচিৎ নয়।
এখন, এন্টি-মায়াজমেটিক ব্যবস্থাপত্রের প্রসঙ্গ। আমরা আমাদের শাস্ত্র থেকে মায়াজগুলোকে মুছে দিতে পারি কিন্তু আমরা কি মূল মায়াজমেটিক অবস্থা সোরা, সাইকোসিস এবং সিফিলিসকে উপেক্ষা করতে পারবো? মেডিসিন, প্যাথলজি, সার্জারি ইত্যাদি টেক্সট বইগুলোতে বর্ণিত তথাকথিত চিররোগগুলির মূল কারণগুলো- হয় প্রাপ্ত নয়তো অর্জিত- সোরা, সাইকোসিস এবং সিফিলিস। লক্ষণসমগ্রের ভিত্তিতে করা আমাদের ব্যবস্থাপত্রে এই মূল কারণকে অবজ্ঞা করে, আক্ষরিকভাবে আমরা সত্যিকারে আরোগ্যগুলো থেকে নিজেদের বঞ্চিত করছি। রোগগুলির প্রতি অত্যানুভূতিপ্রবণতার জন্য সোরা দায়ী। এমনকি সোরার উপস্থিতি ব্যতিরেকে সংস্থানে সত্যিকারের তরুণ রোগগুলিও ঘটতে পারে না। হোমিওপ্যাথিতে প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে এই তিনটি মূলকারণকে গ্রহণ ও তাদের ব্যাপারে যত্নশীল না হয়ে কোন উপায় নেই। চিররোগগুলোর ক্ষেত্রে এই সব একদৈশিক হোমিওপ্যাথির ফল আরোগ্য নয়- উপশম। যতদিন না মূল কারণগুলোকে জানতে পারলেন হ্যানিমান নিজেরও চিররোগ আরোগ্য করতে পারেন নি। তাহলে আমরা কিভাবে সোরা, সাইকোসিস এবং সিফিলিসের ধারণাগুলোতে বিশ্বাস না করে এই কেইসগুলোতে আরোগ্যের দাবী করতে পারি? কিন্তু এন্টিমায়াজমেটিক প্রেসক্রাইবিং বলতে কেবলমাত্র মায়াজমেটিক ডায়াগনোসিসের ভিত্তিকে ব্যবস্থাপত্র প্রদান করা বোঝায় না। অর্জিত বা প্রাপ্ত মায়াজমেটিক প্রভাবগুলোসহ রোগীর লক্ষণের সামগ্রিকতার ভিত্তিতে তার ধাতু-প্রকৃতিগত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতার উপর ব্যবস্থাপত্র প্রদান করাকে বোঝায়। লক্ষণের সামগ্রিকতায় একটি রোগীর বোধসাধ্য সমস্তকিছুই অন্তর্ভুক্ত। আমাদের শুধুমাত্র এগুলোর ব্যাপারে সচেতন হবার প্রয়োজন হয়।
মায়াজমেটিক অবস্থাগুলোর (সোরা, সাইকোসিস এবং সিফিলিস) জন্য শত শত ঔষধ আছে। আমাদের লক্ষণের সামগ্রিকতা বিবেচনা করে একটি সদৃশতম ঔষধ বাছাই করতে হয়। সোরার জন্য সালফার, সাইকোসিসের জন্য থুজা এবং সিফিলিসের জন্য মার্কসলের রুটিনধরে ব্যবহারকে হোমিওপ্যাথি বলে বিবেচনা করা যায় না। সমস্ত কেইসে পূর্ণ স্বাতন্ত্রীকরণ অপরিহার্য। হ্যানিমান ৫নং এফোরিজমে বলেন যে, একজন রোগীকে
আরোগ্য করতে হলে- একটি তরুণ রোগে উত্তেজক কারণটিতে এবং চিররোগে মূল কারণটিতে আমাদের পৌঁছতে হবে। তিনি আরো বলেন যে, কেইসের সম্পূর্ণ বিবৃতি থেকে আমাদের মূল কারণটিকে খুঁজে বের করতে হবে। চলতি অবস্থাটির নিছক লক্ষণসম্বন্ধীয় বিবেচনাই যথেষ্ঠ নয়। সমস্যাটা হচ্ছে এখানে যে, মূল অবস্থাটির লক্ষণগুলো- রোগের নামকরণকৃত শ্রেণীর লক্ষণগুলোর সাথে মিশ্রিত অবস্থায় থাকে। পুরো ব্যাপারটির জন্য দায়ী মূল অবস্থাটিকে আমাদের চিহ্নিত করতে এবং তার স্বরূপ উন্মোচন করতে হয়। মায়াজমেটিক ডায়াগনোসিস সম্পন্ন করতে, রোগীর লক্ষণসমূহ এবং তার ইতিহাসে গভীর অনুসন্ধ্যান চালাতে হয়। এ কারণেই তিনি বলেন যে, আমরা নিছক লক্ষ করি না- আবিষ্কার করি। একটি ব্যাপার কেবলমাত্র তখনই আবিষ্কৃত হয়, যখন তা অজ্ঞাত। ‘Law of Similars’ পৃথিবীর একটি শাশ্বত সত্য কিন্তু তা অজ্ঞাত ছিলো। হ্যানিম্যানকে আবিষ্কার করতে হয়েছে এবং বাস্তব অনুশীলনে সত্যটিকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। একই ভাবে, প্রত্যেকটি দিনের অনুশীলনে বাস্তবায়িত করার জন্য আমাদের মায়াজমেটিক (অস্পষ্ট) ছায়াগুলোকে উৎঘাটন করতে হয়।
আমরা যা আশা করি, হোমিওপ্যাথি আমাদের তার চেয়ে বেশি দিতে পারে। কিন্তু (সেজন্য) হ্যানিমান প্রদত্ত মূলনীতিগুলোর সাথে কঠোরভাবে সমন্বয় রেখে আমাদের অনুশীলন করতে হয়। হ্যানিমান তার সারাটি জীবন জুড়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং সবশেষে পৃথিবীকে প্রদান করেছেন বাস্তব তথ্য। আমরা কি সেগুলোকে কোন পরখ না করেই অবজ্ঞা করতে পারি? না, পারি না। আমি তার মায়াজমেটিক তত্ত্বকে পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম এবং ধরা খেয়ে গেছে। আমার জীবনে আমি মায়াজমেটিক প্রেসক্রাইবিং থেকে দূরে সরতে ব্যর্থ হয়েছি। আমার ৪০ বৎসরের প্র্যাকটিসের জীবনে যে সামান্য সফলতা লাভ করেছি তার কারণ মায়াজমেটিক ধারণাটির উপর আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কিভাবে সেই আনন্দকে আমার সহকর্মীদের সাথে বাটোয়ারার আমন্ত্রণ প্রদান করা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করতে পারি?
Discussion about this post