ডা. শাহীন মাহমুদ:
হোমিওপ্যাথি তার যাত্রা-শুরুর পর থেকেই, বিভিন্ন মহামারীতে লক্ষণীয় সফলতার সাথে চিকিৎসা করে এসেছে এবং তুলনাযোগ্য প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রচলিত চিকিৎসা ধারার তুলনায় তার সফলতা ছিলো আশ্চর্যজনক রকমের বেশি। মহাত্মা হ্যানিমান তার রচনাকৃত হোমিওপ্যাথির মূল গ্রন্থ ‘অর্গানন অব মেডিসিন’-এ মহামারী সম্বন্ধে বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন এবং হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতি মোতাবেক তিনি কীভাবে এর চিকিৎসা করতে হবে, সে ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছেন। কেবল তাত্ত্বিক ধারণা নয়, সর্বপ্রথম ১৮০০ সালে স্কারলেট ফিভারের মহামারীতে তিনি বেলেডোনা ঔষধটির রোগ প্রতিরোধে ব্যাপক সক্ষমতার বাস্তব প্রমাণ দিলেন। এবং পরবর্তীতে নেপোলিয়ান আর্মিতে হওয়া টাইফাস মহামারীতে তিনি নিজে চিকিৎসা করে নজির স্থাপন করলেন তার আরোগ্য ক্ষমতার শ্রেষ্ঠত্বের। এরপর থেকে বিগত ২০০ বৎসরে বিভিন্ন এপিডেমিকে হোমিওপ্যাথির ফলপ্রসূ ভূমিকার বহু নজির বিদ্যমান। আমি নিচে তার কিছুসংখ্যক দৃষ্টান্ত সংক্ষেপে উল্লেখ করছি-

১৮১৩ সালের টাইফাস ফিভার এপিডেমিক
১৮১৩ সালে নেপোলিয়ান আর্মি যখন রাশিয়া আক্রমণ করতে জার্মানির মধ্য যাচ্ছিলো, এসময় টাইফাস ফিভারের কবলে পড়ে থামতে বাধ্য হয়। হোমিওপ্যাথির প্রতিষ্ঠাতা ডা. হ্যানিমান জার্মানীর লিপজিগে তাদের ১৮০টি টাইফাস কেইসের চিকিৎসা করেন এবং কেবল দুইটি রোগীর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু বাদে আর সবাইকে আরোগ্য করতে সক্ষম হন। আর এই রোগেই, সেখানে যাদের তৎকালীন প্রচলিত ধারায় চিকিৎসা করা হয়- মৃত্যুহার ছিলো ৩০% এর উপরে।

১৮৩১ সালের অস্ট্রিয়ার কলেরা এপিডেমিক
১৮৩১ সালের কলেরা এপিডেমিকে আমরা হোমিওপ্যাথিক ঔষধের ব্যাপক কার্যকারিতার প্রমাণ দেখতে পাবো। ডা. কুইনের রিপোর্ট অনুযায়ী, তৎকালীন ১০টি হোমিওপ্যাথিক হসপিটালে মৃত্যুহার ছিলো সর্বোচ্চ ৯%। Admiral Mordoinow এর দেয়া হিসাব অনুযায়ী, রাশিয়াতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার অধীনে থাকা রোগীদের মৃত্যুহার ছিলো ১০% এরও কম। ডা. রোথের রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যাভারিয়াতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় মৃত্যুহার ছিলো ৭%। অন্যদিকে প্রচলিত ধারার চিকিৎসায় ইম্পেরিয়াল কাউন্সিল অব রাশিয়ার প্রচলিত ধারার চিকিৎসার অধীনে মৃত্যুহার ছিলো ৪০% এবং অসলার’স প্র্যাকটিস অব মেডিসিন অনুসরণে অন্যান্য স্থানে করা চিকিৎসায় মৃত্যুহার ছিলো প্রায় ৮০%।

১৮৪৯ সালের সিনসিনাটির কলেরা এপিডেমিক
ইউনাইটেড স্টেটসের ওহাইয়ো অঙ্গরাজ্যের সিনসিনাটিতে ১৮৪৯ সালে ঘটিত কলেরার মড়কে প্রাণরক্ষার হার ছিলো ৪০-৫২%, কিন্তু যারা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করেছেন তাদের ক্ষেত্রে ছিলো ৯৭%। এই পরিসংখ্যানটি তৎকালীন সময়ের স্থানীয় পত্রিকায়ও ছাপা হয়েছিলো।

১৮৫৪ সালে লন্ডনের কলেরা এপিডেমিক
ঐতিহাসিকভাবে এটা ছিলো প্রথম এপিডেমিক, যেটিতে তার প্রাদুর্ভাবের নির্দিষ্ট কারণ জানা গিয়েছিলো। আর সেই উৎসটি ছিলো একটি পাবলিক পানির পাম্প। পাম্পটি বন্ধ করে দেবার পর এপিডেমিকটিও থেমে যায়। কিন্তু এর মধ্যেই ১০,৭৩৮ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। হাউস অব কমন্স এই এপিডেমিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত বিভিন্ন চিকিৎসাপদ্ধতি সম্বন্ধে একটি রিপোর্ট প্রস্তুত করতে অনুরোধ করে। রিপোর্টটি যখন প্রকাশ করা হয়- সেখানে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার কথা বাদ রাখা হয়। হাউস অব লর্ডস থেকে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে, স্বীকার করা হয়- যদি হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতার তথ্যগুলো এতে যোগ করা হয়- তবে রিপোর্টের চেহারা বদলে যায়, যা জনমনে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে এবং এ কারণে হোমিওপ্যাথির আরোগ্য ফলাফলের তথ্যগুলো চেপে রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে সেই গুপ্ত রিপোর্ট প্রকাশ হলে জানা যায়- সেখানে এলোপ্যাথিক চিকিৎসায় মৃত্যুহার ছিলো ৫৯.২%, কিন্তু হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার অধীনে তা মাত্র ৯%।

১৮৫৫ সালে রিও–র কলেরা এপিডেমিক
আফ্রিকার Rio de Janeiro-তে হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতির দ্বারা ৩৮৮টি কেইসে ২% মৃত্যুহার নিয়ে চিকিৎসা করা হয়; যেখানে এলোপ্যাথিক তত্ত্বাবধায়নে মৃত্যুহার ছিলো ৪০%-৬০%।

১৮৬২ থেকে ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত চলা নিউইয়র্ক ডিফথেরিয়ার সংক্রমণ
ইউনাইটেড স্টেটসের নিউইয়র্কের ব্রুম কাউন্টিতে ১৮৬২ থেকে ১৮৬৪ পর্যন্ত তিন বছরব্যাপী চলা ডিফথেরিয়ার সংক্রমণে প্রচলিত ধারার চিকিৎসায় মৃত্যুহার ছিলো ৮৩.৬%, কিন্তু হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার অধীনে তা ছিলো ১৬.৪%। (Bradford)

১৮৭৮ সালের ইয়ালো ফিভার এপিডেমিক
সাউদার্ন ইউনাইটেড স্টেটসে ইয়ালো ফিভার এক্সপার্টদের নিয়ে গঠন করা কমিশনের হিসাব মোতাবেক, এর মৃত্যুহারের Mean Average-টি প্রকাশ করা হয়। সেখানে ৫,০০,০০০ রোগীতে অন্তত ১০,০০,০০০ প্রেসক্রিপশন করা হয়। এলোপ্যাথি ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের উভয় ধারা থেকেই অন্তত ১০০০ জন চিকিৎসক প্রেসক্রিপশন করেন। সেখানে এলোপ্যাথিতে মৃত্যুহার ছিলো ১৫.৫০% এবং হোমিওপ্যাথিতে ছিলো ৬%।

১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু এপিডেমিক
ওহাইয়োর ড্যেটনের Dr. T. A. McCann রিপোর্ট করেন যে, ২৪,০০০ কেইস এলোপ্যাথিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয়- যেখানে মৃত্যুহার ছিলো ২৮.২%, অন্যদিকে হোমিওপ্যাথিতে চিকিৎসা করা হয় ২৬,০০০ কেইসের- যেখানে মৃত্যুহার ১.০৫%। সর্বশেষে, এটি ফিলাডেলফিয়ার (হ্যানিমান কলেজ) থেকে হিসেব করা হয় ও Dr. Dean W. A. (Pearson of Philadelphia Hahnemann College) থেকে স্বাক্ষরিত হয়- যেখানে উপরোক্ত মৃত্যুহারসহ মোট সংখ্যাটি ছিলো ২৬৭৯৫ টি কেইস। ১৯২১ সালের মে মাসের সংখ্যায় দ্য জার্নাল অব দ্য আমেরিকান ইন্সটিটিউট অব হোমিওপ্যাথি এ সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য-উপাত্ত সহযোগে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।

সাম্প্রতিক ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া এপিডেমিকেও হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা জনমনে সুবিদিত। আমরা সহজেই দেখতে পাবো, অতীতের বিভিন্ন প্রাণঘাতী মহামারীতে হোমিওপ্যাথির অবস্থান ও তার ফলাফল: ১৯১৮ সালের পৃথিবীব্যাপী ইনফ্লুয়েঞ্জার মড়কে সারা পৃথিবীতে প্রায় ২২ মিলিয়ন লোক মারা যায় এবং যার মধ্যে ৫,০০,০০০ লোক ছিলো ইউনাইটেড স্টেটসের। প্রচলিত ধারায় যাদের চিকিৎসা করা হয়, তাদের ৩০% এর উপরে লোক মারা যায়, যেখানে হোমিওপ্যাথি দ্বারা চিকিৎকৃত লোকের ৯৮% লোক সুস্থ হয়। আমরা আরো দেখতে পাচ্ছি, ১৮৬০ সাল থেকে ১৯০০ সালের গোড়ার দিক পর্যন্ত সময়ে ইউরোপে যে কলেরা এবং টাইফাসের মড়কগুলো দেখা দেয়, সেখানে যারা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা গ্রহণ করেছিলেন তাদের আরোগ্যের হার প্রচলিত চিকিৎসায় চিকিৎসিত ব্যক্তির চাইতে ৫০% এরও বেশি।
এবার যদি আমরা রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথির দৃষ্টান্তগুলোর অনুসন্ধান করতে চাই, সেখানে দেখতে পাবো- ১৯৫৭ সালে বুয়েনাস এয়ারসে সংঘটিত পোলিও-র মড়কে হাজার হাজার লোককে Lathyrus নামে একটি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ দেয়া হয়, যাদের মধ্যে একজনেরও পোলিও হয়েছে বলে রিপোর্ট পাওয়া যায় নি। ১৯৭৪ সালে ব্রাজিলের মেনিনগোকক্কাল মেনিনজাইটিসের এপিডেমিকে ১৮৬৪০ জন শিশুকে একটি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ রোগ-প্রতিরোধের জন্য দেয়া হয়। তাদের মধ্যে মাত্র ৪টি শিশুর মেনিনজাইটিস দেখা দেয়। ১৯০২ সালে ইউনাইটেড স্টেটসের লোয়া-তে স্মলপক্স এর এপিডেমিক দেখা দেয় এবং সেখানে ১৫ জন চিকিৎসক রোগটি প্রতিরোধের লক্ষ্যে ২৮০৬ জন রোগীকে Variolinum নামের একটি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রদান করেন। রোগ প্রতিরোধের হার ছিলো ৯৭%। আর ১৮০০ সালের স্কারলেট ফিভারে হ্যানিমান প্রদত্ত বেলেডোনার ফলাফল তো আগেই উল্লেখ করেছি।
মোদ্দাকথাটি হচ্ছে, হোমিওপ্যাথি তার জন্মের পর থেকেই মহামারী প্রতিরোধ ও প্রতিহত করণে সফলতার সাথে তার সক্ষমতার প্রমাণ দিয়ে আসছে। এটি একবারের ঘটনা নয়, বার বার সে তার আরোগ্যক্ষমতার বাস্তব দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করে এসেছে। এই প্রবন্ধটিতে কেবল এর একটি অতি-সংক্ষিপ্ত শিরোনাম দেয়া হয়েছে বলা চলে। কেউ যদি বিস্তারিত জানতে চান তাহলে Thomas Lindsley Bradford (M.D.) এর ‘The Logic of Figures or Comparative Results of Homeopathic and Other Treatments’ গ্রন্থটি পড়ে দেখতে পারেন। সেখানে জেনারেল স্ট্যাটিসটিকস, বিভিন্ন সময়ে দেখা দেয়া কলেরা, স্কারলেট ফিভার, ইয়ালো ফিভার, নিউমোনিয়া, টাইফাস ফিভার, ডিফথেরিয়া, শিশুরোগ, উন্মত্ততা ইত্যাদি এপিডেমিক ও রোগগুলোর বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত, পরিসংখ্যান, বিভিন্ন হাসপাতালের রিপোর্ট ও তথ্যসূত্রসহ যে প্রমাণ ও বর্ণনা উপস্থাপন করা হয়েছে- তা দেখলে আশ্চর্য হয়ে ভাবতে হয়, আমাদের চোখের সামনে মানুষের আরোগ্যকারী এই উপায় থাকা সত্ত্বেও কেন আমরা তাকে যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদান করছি না?
আজকে আমাদের মাঝে যে করোনা দুর্যোগ উপস্থিত হয়েছে, আমাদের জীবন আজ যে ঝুঁকিতে ভীতসন্ত্রস্ত্র হয়ে আছে- সেখানে কি সময় হয়নি হোমিওপ্যাথিককে তার অতীত সমৃদ্ধির মতো বর্তমানেও চমৎকার কার্যকারিতা প্রদর্শন করে, হাজার হাজার মানুষের সুস্থতা নিশ্চিত করতে সুযোগ দেবার?
তথ্যসূত্র:
1. The Logic of Figures or Comparative Results of Homeopathic and Other Treatments – Edited by Thomas Lindsley Bradford (M.D.)
2. Yellow Fever and its Homeopathic Treatment, Holcome, (1856)
3. The Efficacy of Crotalus Horridus in Yellow Fever, C. Neidhard, (1860)
4. “Slave mortality during the cholera epidemic in Rio de Janeiro (1855-1856): a preliminary analysis,” by Kaori Kodama, Tânia Salgado Pimenta, Francisco Inácio Bastos, and Jaime Gregorio Bellido, was published in the journal História, Ciências, Saúde Manguinhos, v. 19, supplement, Dec. 2012.
5. “Nineteenth-century controlled trials to test whether belladonna prevents scarlet fever”:R Soc Med 2009: 102: 548–550. DOI 10.1258/jrsm.2009.09k040
Discussion about this post