ডা. শাহীন মাহমুদ:
হোমিওপ্যাথির আরোগ্যক্ষমতা সুগভীর, সুবিস্তৃত ও বিচিত্র। বিচিত্র বলছি এই অর্থে যে, প্রাণ আছে- এমন সবকিছুতেই হোমিওপ্যাথি তার আরোগ্যক্ষমতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। আমার আগের একটি লেখায় আমি উল্লেখ করেছিলাম, কিভাবে হোমিওপ্যাথি তার জন্মের পর থেকেই মানুষ ছাড়াও অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদের উপর তার ইতিবাচক ক্রিয়াকে প্রকাশ করে চলেছে। প্রায় ২৫০ বৎসর আগে আবিষ্কৃত এই চিকিৎসাপদ্ধতির মৌলিক কোন একটা নিয়মের আজ পর্যন্ত কোন পরিবর্তন সাধন করার প্রয়োজন হয়নি- এটি যেমন তার শাশ্বত প্রাকৃতিক নিয়ম হবার উজ্জ্বল প্রমাণ তেমনি এর ব্যবহারিক প্রমাণের একটি বিশেষ দিক হচ্ছে পশু-পাখি ও উদ্ভিদের উপর তার আরোগ্যকারী ক্রিয়ার নিদর্শন। আজ আমার অভিজ্ঞতা থেকে এরকম কয়েকটি আরোগ্যের ঘটনার বর্ণনা দেবার ইচ্ছা পোষণ করছি।
প্রথমেই বলে নিচ্ছি, আমি ভেটেরিনারি চিকিৎসক নই। কিন্তু সত্যিকার দৃষ্টিকোণ থেকে, হোমিওপ্যাথিতে ভেটেরিনারি চিকিৎসক হবার আলাদাভাবে প্রয়োজনও হয় না। যে মূলনীতিগুলোর দ্বারা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পরিচালিত হয়, সেগুলোর অনুসরণ করলে- যে কোন প্রাণের, যে কোন অঙ্গের, অংশের চিকিৎসায় তা সমানভাবে কার্যকরী হবে। তবে, হ্যা- দেশ, সমাজ, সংস্কৃতি, জলবায়ু, জীবনযাত্রার ভিন্নতার জন্য যেমন রোগপ্রবণতা ও প্রয়োজনীয় ঔষধের ভিন্নতা দৃষ্ট হয়, তেমনি বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদ, এমনকি তাদের জাতি, বর্গ, গোত্রভেদেও এই ভিন্নতা দেখা দেয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। সাথে কেউ যদি সিরিয়াসভাবে এই চিকিৎসাগুলো করতে চায়, তবে পশু-পাখি-উদ্ভিদ সম্বন্ধে তার আরও কিছু বিশেষ জ্ঞান, তাদের রোগতত্ত্ব, স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে বিশেষভাবে পড়াশুনা করে নেবার অপরিহার্যতা রয়েছে। সাথে তাদের পর্যবেক্ষণ ও লক্ষণের বহিঃপ্রকাশের ধরণ-ধারণ সম্বন্ধেও আলাদাভাবে চিন্তা, ভাবনা, পড়াশুনা ও গবেষণা করতে হবে।
আমি ঠিক অতটা গুরুত্ব দিয়ে এই চিকিৎসাগুলো করিনি। আমার প্র্যাকটিসের জীবনে চলতে গিয়ে সামনে এসে পড়া কিছু কেইস আমি দেখেছি এবং হোমিওপ্যাথির ক্ষমতা ও বিচিত্রতা সম্বন্ধে প্রতিবার নতুন করে আশ্চর্য হয়েছি। পশু এবং পাখি – এই দুই প্রজাতির চিকিৎসা করার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। তন্মধ্যে সর্বপ্রথম যে প্রাণীটিকে আমি চিকিৎসা করি- তা ছিলো একটি ছাগল। তখন আমি ঢাকার চেম্বারে বসতাম। ২০১৩ সালের এরকমই একটা সময়। বাসা ও চেম্বার একই বাসার আলাদা আলাদা ইউনিটে ছিলো। ছাগলটিকে বাসার একটি অনুষ্ঠানে জবাই করার জন্য শীতের এরকম এক সময়েই কিনে আনা হয়েছিলো। আনা হয়েছিলো অনুষ্ঠানের বেশ কয়েদিন আগে, আর আনার পর পরই অ-ব্যবস্থাপনার দরুন সে অসুস্থ হওয়া শুরু করে। দুই-একদিন পরই নাকে পানি, মাঝে মাঝে হাঁচি দেখা দেয়। তারপরই তার গা কিছুটা উষ্ণ হয়ে পড়ে, সাথে শুরু হয় কাশি। মানুষের মতো লাগাতার খক-খক কাশি নয়- শুস্ক কাশি, বহুক্ষণ পর পর দু’একটি করে। ছাগলের কাশি- কোন আমলে নেবার প্রয়োজন মনে করিনি এবং এ ব্যাপারে কোনদিন মাথা না ঘামানোয়, এই লক্ষণগুলো যে প্রাণীটিকে নিউমোনিয়ার দিকে নিয়ে যেতে পারে- সে ব্যাপারটিও কখনো চিন্তায় আসে নি।
ছাগলের মতো ছাগল মনের সুখে কাশছিলো এবং আমার মতোই আমি চলছিলাম। কিন্তু ছোট আপা এসে বিপত্তি বাঁধালেন। বাসার সাথেই চেম্বার। ছোট আপা এসে বললেন, ‘ছাগল কাশছে, কষ্ট পাচ্ছে- তাকে ঔষধ দিন’। আপনাদের মতো আমিও নিজেকে মনে মনে ‘ছাগলের ডাক্তার’ সম্বোধন করে একচোট হেসে নিলাম। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই- ছোট আপার কথা! মানতেই হবে। এবং আমার প্রথম ভেটেরিনারি প্রেসক্রিপশনটা করলাম।
খুব বেশি কিছু দেখে বা চিন্তা করে ঔষধ দিই নি। আজ সত্য স্বীকার করতে আপত্তি নেই, সেদিন প্রেসক্রিপশনটা মূলত ছুতো ভাঙ্গাবার জন্যই করেছিলাম। তবে প্রেসক্রিপশনটা করেছিলাম, একটা কি-নোটের উপর নির্ভর করে। ছাগলের মুখে কিছুটা ফেনার মতো ছিলো, তবে তার মুখের পাশ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছিলো এবং তা ছিলো সুতার মতো লম্বা। হ্যা, ক্যালি বাইক্রোম ঔষধটি দিয়েছিলাম (পোটেন্সি ও ডোজিং-সিস্টেম মনে নেই) এবং ছাগলটি দুইদিনের ভালো হয়েছিলো এবং সেই সাথে আমার হয়েছিলো এ অভিজ্ঞতার হতেখড়ি।

এরপরের ঘটনাটা ২০১৪-১৫ সালের। আমাদের বহু পুরোনো এক রোগী- যার হোমিওপ্যাথির প্রতি অগাধ আস্থা। তার ছিলো কবুতর পোষার তীব্র বাতিক। উত্তরাতে তার বাসায় কবুতরের বিশাল সংগ্রহ। কিন্তু তিনি মুশকিলে পড়েছিলেন কবুতরের এভিয়ান পক্স নিয়ে। এটি একটি ভাইরাল সংক্রমণ, কাজেই এন্টিবায়োটিক অচল। এভিয়ান ভাইরাসের বেশ কয়েকটি জাত আছে – তার দুর্ভাগ্য, একটি বাজে জাতের সংক্রমণের কবলে পড়েছিলো তার কবুতরগুলো। তার দামী (৫০০০ টাকা জোড়া) ও শখের কবুতর একটা একটা করে (পাখির মতো!) মরছে। শরীর উষ্ণ, খাবার-দাবার বন্ধ, ডায়রিয়া ও চষ্ণুর আশে-পাশে, এমনকি মুখের ভেতর গোটার মতো উঠে- সবশেষে কবুতর মারা যায়।
কোন উপায়ন্তর না পেয়ে, একটা কবুতর নিয়ে একদিন চেম্বারে হাজির। একদম নিয়মমাফিক ভিজিট দিয়ে চিকিৎসা করাবেন। আমি আমার অভিজ্ঞার দৌরাত্ম্য বর্ণনা করার পরও, তিনি রাজি হলেন তার কবুতরগুলোর চিকিৎসা করাতে। যারা এরকম দামী কবুতর পোষেন- তারা জানেন। কবুতরগুলোর তারা আলাদা আলাদা নাম রাখেন। এবার একদম সিরিয়াসভাবে চিকিৎসা শুরু করলাম। প্রতিটি কবুতরের বিস্তারিত তথ্য আলাদা একটা খাতায় লিখে- নিয়মমাফিক ঔষধ দেয়া শুরু করলাম.. … …
খাতাটি এখন আমার কাছে নেই (কে জানতো এটা আবার কোনদিন লিখবো!)- এজন্য চিকিৎসার একদম খুঁটিনাটি দিতে পারছি না। কিন্তু চিকিৎসাটি মূলত হয়েছিলো নাইট্রিক এসিড ৩০ ও ২০০ শক্তিতে এবং আর্সেনিকাম এল্বামের (নাইট্রিক এসিডের সম্পূরক) প্রয়োজন হয়েছিলো। আমার কাছে চিকিৎসা নিতে আসার আগেই যে কবুতরটিতে রোগটি খুব বেশি এগিয়ে গিয়েছিলো- সেটিই একমাত্র মারা যায়; অন্যগুলো বেঁচে যায়। ভেবেছিলাম পরে এভিয়ান নোসোড সংগ্রহ করে রাখবো ও এ নিয়ে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবো কিন্তু নানা ব্যবস্ততায় সেটা আর হয়ে উঠেনি।

তৃতীয় ঘটনাটি বেশ মর্মান্তিক। ২০১৫ সাল। বাসায় বেশ কয়েকটি (দেশি) কুকুর জুটেছে। বাইরের উঠোনেই থাকতো- আমরাও খাওয়াতাম, নিজেরাও খাদ্য-সংগ্রহ অভিযানে মাঝে মাঝে বেরোতো। এমনই এক অভিযানে গিয়ে একটা কুকুর আহত হয়। তার পেছনের দিকের বামপাশে গাড়ির ধাক্কা লাগে। সেদিকের অংশ অনেকটা থেতলানো-মত, পা ভাঙ্গা অবস্থা নিয়ে ছেঁচড়ে উঠোনে এসে পড়লো- বেশ কয়েক জায়গায় বাজেভাবে ছিলে গেছে। পড়েই কাঁপা শুরু করলো। মাটিতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে চোখ বন্ধ করে কাঁপতে লাগলো; দেখে মনে হচ্ছে, তার সারা শরীরের পেশিগুলোতে স্পাজম হচ্ছে। আগের দু’টো ঘটনায় সামান্য অভিজ্ঞতা ও ব্যাপক সাহস ইতোমধ্যে হয়েছে। তৎক্ষণাৎ চেম্বার থেকে একোনাইট – 1M এক ডোজ মুখে নিয়ে ফেললাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যে কাপাকাপি ছেড়ে চোখ তুলে অসহায় দৃষ্টিতে চোখ মেলে চাইলো ও ঘাড় উঁচু করলো। হোমিওপ্যাথিক কলেজ আমাকে সার্জারি শেখায় নি বলে তার ভাঙ্গা পায়ের আর কিছু করতে পারি নি কিন্তু আর্নিকা ও ক্যালেন্ডুলার দিয়ে আর কোন বিপত্তি ও ভেটেরিনারির সাহায্য ছাড়াই তাকে চলে-ফিরে খাবার মতো অবস্থায় নিয়ে আসতে পেরেছিলাম।
টাঙ্গাইল আসার পর আর কোন পশু-পাখি আমার ধার-কাছ মাড়ায়নি। কিন্তু এরা এখন আমার ছাত্রদের বেশ পছন্দ করতে শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। আমার বন্ধু ও ছাত্র মো. রাশেদুল ইসলাম নাফে। এরও কবুতর ও মুরগী পোষার শখ (তবে তা বোধহয় কাউকে কোন টিপস না দিয়ে মূলত নিজের উদরখানা পূর্তি করার উদ্দেশ্যেই)। একদিন এসে তার সফলতার আনন্দসংবাদ দান করলো। তার ভবিষ্যত খাদ্যগুচ্ছের মধ্য থেকে একটা কবুতর-খাদ্য ব্যাপক ঘাড় ত্যাড়ামি শুরু করেছে। অর্থাৎ Torticollis বা Wry neck। সে নিজে নিজে ইতোমধ্যে হায়োসায়েমাস দিয়েছিলো এবং তার খাদ্যের তবিয়ত ও ভবিষ্যত ঠিক হয়ে গেছে। চিকিৎসাটা আমি করিনি, তাই বিস্তারিতও বলতে পারবো না- তবে যতটা শুনেছি ডানদিকে ঘাড় বাকিয়ে চক্কর কাটতো। হায়োসায়েমাস দেয়ায় এখন সম্পূর্ণ আরোগ্য।

আমাদের দেশে হোমিওপ্যাথিক ভেটেরিনারি চিকিৎসক নেই। কিন্তু আমি মনে করি, এরকম ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বহু চিকিৎসকেরই আছে। আর যাদের নেই তাদের এই অভিজ্ঞতা অর্জনের নিতান্ত প্রয়োজন আছে। জীবসেবার কথা যদি বাদও দিই- এতে একদিকে যেমন হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ও প্লাসিবো সম্বন্ধে শোনা বিভ্রান্তিকর গুজবগুলোর ব্যাপারে নিজেদের মনের কোণে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার দূর হয়, তেমনি বন্ধ হয় হোমিওপ্যাথিকে প্লাসিবো দাবীকারীদের মুখ। এছাড়া এদেশে পশু-পাখি পালনটি নিছক সামান্য কোন ঘটনা নয়। এই ব্যাপারটিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সঠিক উপায়ে অনুশীলন করতে পারলে- তা একটি সময় আমাদের অর্থনৈতিক ও পশু-উৎপাদন ক্ষেত্রটিতে যথেষ্ট অবদান রাখার সম্ভাবনা রয়েছে। আর এই কারণগুলোর জন্যই আমার সামান্য অভিজ্ঞতাকে এভাবে বর্ণনা করা।