ভাষান্তর: ডা. মো. শাফায়াত হোসেন:
[আজকের লেখার শুরুতেই দুটি কথাঃ এই প্রবন্ধটি অনুবাদ ও সংকলন করেছিলেন আমাদের সবার প্রিয় ডাঃ মোঃ শাফায়েত হোসেন (BHMS)। তিনি বিশুদ্ধ ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথির একনিষ্ঠ ভক্ত ও অনুসারী ছিলেন, চর্চা করতেন হানেমানিয়ান হোমিওপ্যাথি, তিনি ছিলেন ডাঃ রহিম হোমিওপ্যাথি ফাউন্ডেশনের (DRHF) মেহেরপুর প্রতিনিধি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। গত ৩০শে মার্চ, ২০২০ তারিখে আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে, এই নশ্বর পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চিরতরে বিদায় নিয়েছেন। আজ তার সম্মানার্থে তার নিজের হাতে অনুবাদকৃত “Strategies Of Prescribing” নামক এই মূল্যবান প্রবন্ধটি হোমিওডাইজেস্ট এর পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে তার আত্মার মাগফেতার কামনা করছি।”— মোঃ ইমরান খান। (R&T department, DRHF)]
হোমিওপ্যাথিতে সর্বদা ঔষধ নির্বাচন করাটাই মূখ্য বিষয় নয়। হোমিওপ্যাথিতে বলা হয়, “A well taken case is half cured”. হোমিওপ্যাথিতে কেস টেকিং বা রোগীলিপি প্রস্তুত করার প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হল রোগীর জীবনি শক্তি বা ভাইটাল ফোর্স এর বিশৃংখলার প্রকৃতি ও এই বিশৃংখলার ব্যাপ্তি কতটুকু এবং এই বিশৃংখলার প্রভাবে রোগীর শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, Defense mechanism বা Immune system এর সমস্যা নির্ধারন করা। এই বিশৃংখলার ধরন, ব্যাপ্তি বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি আমরা বুঝতে পারি রোগীর সামগ্রীক লক্ষন সমষ্টির মাধ্যমে।
“লক্ষণ” বা “Symptom” বলতে প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থায় যা বোঝায় তার চাইতেও আমাদের কাছে অর্থাৎ হোমিওপ্যাথিতে এই “লক্ষণ” বা “Symptom” অনেক বেশী গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ বহন করে। প্রচলিত চিকিৎসার মত আমরা লক্ষণ সমূহের মাধ্যমে যে শুধুমাত্র রোগীর রোগটাকেই বুঝি এমন নয়, বরং এই রোগের সাথে রোগীর জীবনি শক্তি বা ভাইটাল ফোর্স কিভাবে Interact বা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করছে সেটিও বোঝার চেষ্টা করি। যেহেতু প্রত্যেক ব্যক্তির মন-মানসিকতা, পছন্দ-অপছন্দ, অভ্যাস, রোগাক্রান্ত হবার প্রবণতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, বংশগত ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রভৃতি হুবহু একই রকম হয় না, সেহেতু তাদের প্রত্যেকের প্রকাশিত লক্ষণ সমূহও একই রকম না হয়ে আলাদা আলাদা হয়ে থাকে।
হোমিওপ্যাথিতে আদর্শ কেস টেকিং বা আদর্শ রোগীলিপি বলতে মূলত বোঝানো হয় রোগীর সমস্ত লক্ষণ সমষ্টি সঠিকভাবে গ্রহন করে, রেপার্টরি ও মেটেরিয়া মেডিকার মাধ্যমে একটি সর্বোচ্চ সদৃশ ঔষধ নির্বাচন করা। যে ঔষধটি রোগীর Acute ও Chronic উভয়ক্ষেত্রেই সামগ্রীক লক্ষণ সমূহের সাথে মিলে যায় এবং সেই ঔষধটিই রোগীকে আরোগ্য করতে সক্ষম হয়।
কিন্তু সমস্যাটা হল সবসময় এই আদর্শ কেস টেকিং এবং রেপার্টারাইজেশান করেও সুস্পষ্ট ও নির্দিষ্ট একটি ঔষধ খুজে পাওয়া যায় না। প্রায়শই এমনটা দেখা যায় যে একজন চিকিৎসকের যথেষ্ঠ সময়, আন্তরিকতা ও নিখুঁত ভাবে কেস টেকিং করা ও রেপার্টারাইজেশান করার পরেও নির্দিষ্ট ঔষধটি খুজে পাওয়া যায় না। এটা যে শুধুমাত্র চিকিৎসকের ভুলের জন্য হয় তা নয়, অনেক সময় নানা ধরনের বিসদৃশ, ভুল চিকিৎসা গ্রহনের ফলে রোগ চাপা দেবার কারনে রোগীর ভাইটাল ফোর্স বেশী মাত্রায় বিশৃংখল হয়ে যায় ফলে রোগীর রোগের ধরনটাই এমন হয়ে যায় যে প্রাপ্ত সকল লক্ষণ সমষ্টি মিলিয়ে একটি নির্দিষ্ট ঔষধ নির্বাচন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এই জাতীয় কেস সমাধানের জন্য প্রফেসর জর্জ ভিথউলকাস Strategies to prescription (প্রেস্ক্রিপশনের কৌশল বা পদ্ধতি) এর কথা বলেছেন, যা International Academy of Classical Homeopathy (IACH) এর ই-লার্ণিং প্রোগামে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আমরা এখানে সংক্ষেপে এই পদ্ধতি গুলির দিকে আলোকপাত করছি।
১। Totality of Symptoms: (লক্ষণ সমষ্টি) এটিই ঔষধ প্রেস্ক্রিপশনের সর্বোত্তম ও আদর্শ পদ্ধতি বা কৌশল। হ্যানিম্যান আমাদের এই কৌশলটির মাধ্যমেই ঔষধ নির্বাচন করতে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন। Totality of Symptoms বলতে মূলত বোঝায়ঃ রোগীর সমস্ত লক্ষণের সমষ্টি বা যোগফলের ভিত্তিতে প্রতিটি লক্ষণের আলাদা আলাদা তীব্রতা (Intensity) অনুযায়ী রেপার্টরি করে নির্দিষ্ট একটি ঔষধ খুজে পাওয়া, যে ঔষধটি রোগীর সর্বোচ্চ সংখ্যাক লক্ষণকে কভার করে। এক্ষেত্রে একটি কথা মনে রাখা উচিৎ, যে সমস্ত ক্ষেত্রে Totality of Symptoms মিলিয়ে ঔষধ প্রয়োগ করা হয় সে সমস্ত ক্ষেত্রে রোগীর রোগারোগ্যের সম্ভাবনা বেশী থাকে।
২। Essence: (এসেন্স) কখনো কখনো টোটালিটি অব সিম্পটম একটি ঔষধকে নির্দেশ করলেও রোগীর মানসিক ও আবেগীক দিক বিবেচনা করে উক্ত ঔষধটি ঠিক উপযুক্ত বলে মনে হয় না। আমাদের মেটেরিয়া মেডিকার জ্ঞান দ্বারা আমরা বুঝতে পারি ঠিক এই মুহুর্তে টোটালিটি অফ সিমটম দ্বারা নির্দেশিত ঔষটি রোগীর জন্য ঠিক উপযুক্ত নয়। প্রত্যেক ঔষধের একধরনের Mental ও Emotional বৈশিষ্ট্য বা ধরন সম্পর্কে আমরা জানি, এর মাধ্যমে আমরা এটি বুঝতে পারি। সেজন্য সর্বোচ্চ সংখ্যক লক্ষণ কোন নির্দিষ্ট ঔষধের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও আমরা সেই ঔষধটাই প্রয়োগ করি যে ঔষধটির আবেগ অনুভুতির সাথে রোগীর আবেগ অনুভুতি মিলে যায়, যে ঔষধটির এসেন্স এর সাথে রোগীর এসেন্স মিলে যায়। যদিও উক্ত ঔষধটি হয়ত রোগীর খুবই অল্প সংখ্যক লক্ষণ কভার করে। এই এসেন্স মূলত কি? সহজ ভাষায় বলতে গেলে এসেন্স হল একধরনের মানসিক সিনড্রম। কয়েকটি মানসিক লক্ষণ মিলে একটি সিনড্রম বা মানসিক অবস্থা তৈরি করে যাকে এককথায় এসেন্স বলা যায়।
৩। Key-Notes: (কী-নোট) অনেক সময় আমরা কোন রোগীর কেস টেকিং করার সময় দেখতে পাই রোগী অসাধারন (Peculiar)/ বিরল (Rare)/ অদ্ভুদ (Strange) কিছু লক্ষণ প্রকাশ করে। আমরা জানি এই ধরনের লক্ষণ হয়ত একটি মাত্র ঔষধে বা খুব অল্প সংখ্যক ঔষধের মধ্যে পাওয়া যায়। তখন আমরা এই সমস্ত অদ্ভুদ লক্ষণের উপর ভিত্তি করে ঔষধ নির্বাচন করে থাকি যে বিষয়ে হ্যানিম্যান আমাদের অর্গাননের ১৫৩ নং এপোরিজমে নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। যদি কোন রোগীর মধ্যে Totality of Symptoms এবং Essence এর কোনটিই না পাওয়া যায় তখন আমাদের এই “কী-নোট” ভিত্তিক প্রেস্ক্রিপশন করা উচিৎ।
৪। Causation: (কারণ) কিছু অল্পসংখ্যক কেসের ক্ষেত্রে এমনটাও দেখা যে সেখানে টোটালিটি অফ সিমটম, এসেন্স, কী-নোট কোনটাই পরিষ্কার করে একটি ঔষকে নির্দেশ করছে না, এবং কেন এমন হচ্ছে সেটি বুঝতে পারাও খুব কঠিন হয়ে পড়ে। এ সমস্ত ক্ষেত্রে তখন আমাদের পুনরায় কেসটি ইনভেস্টিগেশানের প্রয়োজন পড়ে অর্থাৎ রোগীর এই রোগের পিছনে কোন সুনিশ্চিত কারন আছে কিনা তা খুজে বের করতে হয়। যেমনঃ কোন শারীরিক বা প্রচন্ড মানসিক আঘাত, হতাশা, রক্তক্ষরণ প্রভৃতি যেখানে রোগী তার সমস্ত সমস্যার মূল কারনকে তার ঐ ঘটনার (Incident) সাথে সম্পর্কযুক্ত করে তোলে অর্থাৎ ঐ ঘটনার (Incident) পর থেকেই তার যাবতীয় সমস্যার শুরু হয়। এই সমস্ত ক্ষেত্রে আমরা এই কারন গুলির উপর ভিত্তি করে প্রেসক্রিপশন করবো এবং সেখান থেকেই কেস নেব।
৫। Essentials: (এসেন্সিয়াল) কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় পূর্বের বর্ণনাকৃত সব ধরনের পদ্ধতিগুলিই ব্যার্থ হচ্ছে এবং এর কোন সুস্পষ্ট সমাধান ও পাওয়া যাচ্ছে না তখন প্রায়শই আমরা দেখতে পাই যে, রোগীর বর্তমান রোগের কষ্টকর লক্ষণ গুলি কোন একটি ঔষধের সাথে মিলে যায়, যেমনঃ কোন রোগী কান পাকার (Otitis) সাথে মাড়ীর সমস্যায় ভুগছে এটা আমাদের মার্কুরিয়াস সলকে মনে করিয়ে দেয়। এমন ধরনের লক্ষণ আমরা মেটেরিয়া মেডিকা থেকে স্পষ্টভাবে পেয়ে থাকি যা আমাদের ঔষধ নির্বাচনে সাহায্য করে। তবে এই পদ্ধতি শুধুমাত্র তখনই প্রযোজ্য হয় যখন রোগীর কাছে থেকে শুধুমাত্র এই ধরনের তথ্য ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। অন্য আরো কিছু উদাহরন যেমনঃ রক্তক্ষরণ প্রবণতার সাথে Fatty degeneration of liver এটা ফসফরাসে, গ্রন্থি স্ফিতির সাথে Hypothyroidism এটা ক্যাল্কেরিয়া কার্বে পাওয়া যায়।
একজন চিকিৎসকের কখনই এমনটা মনে করা উচিৎ নয় যে তিনি এর যে কোন একটি কৌশলকেই বেছে নিবেন এবং সর্বদা সকল রোগীর ক্ষেত্রে সেই একটি কৌশলটিই প্রয়োগ করবেন। প্রতিদিনের প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে এটা অবশ্যই আমাদের মনেরাখা উচিৎ যে, প্রথমেই রোগীর পূর্ণাঙ্গ কেস টেকিং করার পর আমাদের বুঝতে হবে যে এই পাচটি কৌশলের মধ্যে এই কেসে কি আছে আর কি নেই, এবং সেই অনুযায়ী যে কোন একটি কৌশল প্রয়োগ করা উচিৎ। সব সময় প্রত্যেক রোগীর ক্ষেত্রে যে এই ৫টি কৌশলের মধ্যে যে কোন একটি বিদ্যমান থাকবে এমন কোন কথা নেই। অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রে ঔষধ নির্বাচনের সময় আপনি এই কৌশলগুলির মধ্যে একাধিক কৌশল খুজে পেতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে এই কৌশল গুলির মধ্যে Hierarchical order (অনুক্রমভিত্তিক শৃঙ্খলা) বিদ্যমান। যদি কোন রোগীর মধ্যে এই ৫টি কৌশল এর সবগুলাই বিদ্যমান থাকে তাহলে আমাদের অবশ্যই প্রথম কৌশল Totality of Symptoms এর দিকেই বেশী গুরুত্ব দিতে হবে, যদি কোন রোগীর মধ্যে Essence ও Causation দুইটাই পাওয়া যায় তাহলে আমাদের Essence এর মাধ্যমে ঔষধ নির্বাচন করা উচিৎ অর্থাৎ একই রোগীর ক্ষেত্রে একাধিক কৌশলের মধ্যে সর্বদা উচ্চ পর্যায়ের কৌশলটির দিকেই বেশী গুরুত্ব দিয়ে ঔষধ নির্বাচন করা উচিৎ। এই কৌশলগুলি কোন Approach বা Method ধরনের কিছু নয়। এগুলি রোগীর উপর নির্ভর করে। এর মধ্যে থেকে যে কোন একটি কৌশল বেছে নেবার কোন সুযোগ নেই, সুতরাং কোন চিকিৎসকের এমনটা বলা উচিৎ নয় যে তিনি অমুক Method ব্যবহার করে রোগীর চিকিৎসা করে থাকেন। সারা পৃথিবীতে যত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক আছেন বিশেষ করে যারা ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথি প্রাকটিস করেন তারা জেনে বা না জেনে এই কৌশল গুলির মধ্য থেকে যে কোন একটি কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে ঔষধ প্রেসক্রাইব করে থাকেন। কিন্তু আমরা যদি সচেতন হয়ে এই কৌশল গুলি সম্পর্কে জেনে বুঝে প্র্যাকটিস করি তাহলে আমাদের সঠিক ঔষধটি নির্বাচনের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে আমরা সহজেই আমাদের নির্বাচিত ঔষধটির কার্যকারিতা সম্পর্কে বুঝতে পারবো, রোগারোগ্যের ক্ষেত্রে ভাইটাল ফোর্স এই Stimulation টি কতটুকু Positively গ্রহন করেছে সে সম্পর্কে, সর্বোপরি আমাদের রোগীর Journey of cure সম্পর্কে আমরা আরো ভালোভাবে বুঝতে পারবো।
ডাঃ মোঃ শাফায়েত হোসেন (BHMS)
Govt. Homoeopathic Medical College & Hospital , Dhaka
Meherpur Representative (DRHF)
Discussion about this post