ডা. মৃত্যুঞ্জয় পাঞ্জা, ডি.এম.এস:
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতিকে যদি একটি কথায় দাঁড় করানো যায় তবে তা হল স্বাতন্ত্রীকরণ বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রীকরণ। এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্রীকরণের মাধ্যমেই আমরা রোগীর প্রকৃত সাদৃশতম ওষুধটির সন্ধান পাই। তাই একথা বলা অত্যুক্তি হবেনা যে, চির বা অচির রোগী, জটিল বা দুরারোগ্য রোগী যে কোন রোগীই হোক না কেন তার উদ্দেশ্য আরোগ্য বা উপশম দেওয়া যাই হোকনা কেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্রীকরণ করা ছাড়া কিছু করা সম্ভব নয়। স্বাতন্ত্রীকরণ ব্যতিরেকে হোমিওপ্যাথির নামে অপ-হোমিওপ্যাথি করা হয়। যার ফলে ওষুধ নির্বাচনে আসে বিভিন্নতা, রোগারোগ্যে আসে বিফলতা ও জটিলতা, রোগী ও চিকিৎসক উভয়ের মনে আসে হতাশা, যার পরিণাম রোগী ও হোমিওপ্যাথি উভয়ের পক্ষেই মারাত্মক।
স্বাতন্ত্রীকরণ কি এবং কি ভাবে করা যায়? আমাদের প্রথম কাজ হবে রোগীকে দেখে ও পরীক্ষা করে একটি সুন্দর রোগীলিপি তৈরি করা। যার মধ্যে থাকবে রোগী যে রোগে ভুগছে তার সমস্ত লক্ষণ এবং রোগীর নিজস্ব বা ব্যক্তিগত লক্ষণসমূহ বা সাধারণত রোগী যে রোগে ভুগছে তার মধ্যে থাকেনা। এই শেষোক্ত লক্ষণগুলিই আমাদের ওষুধ নির্বাচনে বা রোগী আরোগ্য ক্ষেত্রে বেশী সহায়ক। কারণ, এই লক্ষণগুলিই রোগীর স্বাতন্ত্রজ্ঞাপক, যা অন্য রোগী থেকে তাকে পৃথক করতে সাহায্য করে। ধরা যাক, কোন রোগীর লক্ষণ পাওয়া গেল জ্বর, কাশি, বুকে ব্যাথা, ফুসফুস বা তার কোন অংশ শক্ত হয়ে যাওয়া, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি দ্রুততর হওয়া ইত্যাদি। এখন এই লক্ষণগুলির দ্বারা নিউমোনিয়া চেনা কোন অসুবিধা হয়না, কারণ এগুলি সবই নিউমোনিয়ার সাধারণ লক্ষণ। কিন্তু এই লক্ষণগুলির দ্বারা ওষুধ নির্বাচন করা যায় না, যেহেতু প্রত্যেক নিউমোনিয়া রোগীতেই এই লক্ষণ পাওয়া যায়। তাই রোগীর স্বাতন্ত্রীকরণ ঐ লক্ষণগুলির দ্বারা সম্ভব নয়। কিন্তু ঐ রোগীর মধ্যে ডান ফুসফুসই আক্রান্ত হওয়া এবং বিকেল ৪ টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সব কষ্টের বৃদ্ধি হওয়া, রোগীর মিষ্টি খাওয়ার ও গরম খাদ্য ও পানীয়ের আকাঙ্ক্ষা থাকে এবং নাকের পাতাগুলি ওঠানামা করে, তাহলে এই লক্ষণগুলি আমাদের রোগীটিকে স্বাতন্ত্রীকরণ করতে সাহায্য করে এবং লাইকোপোডিয়াম নির্বাচন করতে কোনই অসুবিধা হয়না। আবার ঐ রোগীর যদি শেষের লক্ষণগুলির পরিবর্তে পাওয়া যায় ঠান্ডা খাদ্য ও পানিয়ে প্রবল আকাঙ্ক্ষা, ডানদিকে ব্যাতিত শুতে না পারা এবং ঝড় ও বজ্রপাতের প্রচন্ড ভয় তাহলে যেহেতু এই লক্ষণগুলি নিউমোনিয়ার সাধারণ লক্ষণ নয়, তাই এই লক্ষণগুলিই রোগীর স্বাতন্ত্রজ্ঞাপক এবং এই রোগী ফসফরাস প্রয়োগে আরোগ্যে হবে। তাই আমরা যত ভালভাবে এই স্বাতন্ত্রজ্ঞাপক লক্ষণগুলি সংগ্রহ করতে পারব রোগী আরোগ্যের ক্ষেত্রে তত বেশী সফল হব।
রোগীলিপির মধ্যে যে লক্ষণগুলি নেওয়া অবশ্যই উচিৎ সেগুলি হলো- রোগীর মানসিক লক্ষণসমূহ, তার মেজাজ, বিশেষ কোন জিনিষের প্রতি ভয়, সাহসিকতা, শোক-দু:খ, অপমান, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, বৃত্তি-শক্তি, উদাসীনতা, হাসি-কান্না, বিষন্নতা, উত্তেজনা, হতাশা, বিশেষ কোন খাদ্য সহ্য করতে না পারা, পিপাসা, ঘাম, মল, মূত্র, ঋতুস্রাব ইত্যাদি। তারপর স্থানিক লক্ষণসমূহ অর্থাৎ যে লক্ষণ কোন বিশেষ স্থান বা অঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
রোগের সাধারণ লক্ষণগুলি যে ঔষধ নির্বাচনে একেবারে প্রয়োজন হয় না তা কিন্তু নয়। অনেক সময়েই এই লক্ষণগুলির সঠিক বিশ্লেষণে এগুলি অসাধারণ ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে তখন এই লক্ষণগুলির মাধ্যমেই রোগীর স্বাতন্ত্রীকরণ সম্ভব হয় এবং ওষুধ নির্বাচনে প্রভূত সাহায্য করে। যেমন রোগী যে রোগে ভুগছে তার কারণ, স্থান, কষ্টের প্রকৃত অনুভূতি, হ্রাস-বৃদ্ধি, সহগামী লক্ষণ ইত্যাদি।
স্বাতন্ত্রীকরণ করার সময় আমরা লক্ষণগুলির মূল্যায়নের মাধ্যমেই করে থাকি, কারণ প্রত্যেকটি লক্ষণ সমান মূল্যবান হয় না। গুরুত্ব অনুসারে প্রথম মানসিক লক্ষণ, তারপর সার্বদৈহিক লক্ষণ এবং শেষে স্থানিক লক্ষণের স্থান। এর মধ্যে যেসব লক্ষণ অসাধারণ, বিরল, অদ্ভূত, বিষ্ময়কর সেগুলির মূল্যই সর্বাধিক। এই স্বাতন্ত্রীকরণ কোন রোগীতে কীভাবে কোথায় পাওয়া যাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। প্রত্যেকটি রোগী তার একটি নিজস্ব জগত নিয়ে হাজির হয়। রোগ একই হলেও তাদের বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক বা স্বাতন্ত্রজ্ঞাপক লক্ষণগুলিই একের সাথে অন্যের পার্থক্য করে দেয়। তাই দক্ষ শিকারীর মত, প্রত্যেকটি রোগীর থেকে আমাদের এইসব লক্ষণ গুলি খুঁজে বের করতে হবে, এবং সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে রোগী স্বাতন্ত্রীকরণ করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন হোমিওপ্যাথির আকর গ্রন্থগুলিকে নিষ্ঠাসহকারে বারংবার পড়া, নিরলস অধ্যাবসায় এবং গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। তা যদি পারা যায়, তবে রোগে জর্জ্জরিত মানব সমাজের মুক্তির যে গুরুদায়িত্ব আমাদের উপর ন্যস্ত আছে তা আমরা নিষ্ঠার সাথে পালন করতে সক্ষম হব এবং সফল ও সার্থক হোমিওপ্যাথ হিসাবে নিজেদের গর্বিত মনে করতে পারব।
Discussion about this post