১৮৩২ সালে হ্যানিম্যানের অনুমোদন ও সুপারিশসহ বোনিংহাউসেন রেপার্টরি প্রকাশ হওয়ার পর হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা জগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। লক্ষণসমষ্টির উপর ভিত্তি করে ওষুধ নির্বাচনের যে অপূর্ব সুবিধা রেপার্টরি দ্বারা সম্পাদিত হয় তা বিশ্বের সকল হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের মনপুতঃ হয়। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞান উন্নয়নমূখী। অর্গানন অব মেডিসিন গ্রন্থের নির্দেশিত নিয়মে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ড্রাগ প্রুভিংয়ের মাধ্যমে, ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে ও খ্যাতনাম চিকিৎসকদের গবেষণার কল্যাণে নব নব ওষুধাবলী এবং পূর্বের ওষুধের বহু নতুন লক্ষণাবলী মেটেরিয়া মেডিকায় অর্ন্তভূক্ত হয়ে মেটেরিয়া মেডিকার কলেবর বৃদ্ধি পেতে থাকে, ফলে রেপার্টরিতে নতুন ওষুধ, নতুন ওষুধের লক্ষণাবলী অন্তর্ভূক্ত করার প্রয়োজনীয়তাও দেখা দেয়। এছাড়া বোনিংহাউসেন রেপার্টরির বহুবিধ ভুলত্রুটি ও সীমাবদ্ধতার কারণে এই রেপার্টরির সংশোধন করাও জরুরী হয়ে পড়ে। এসকল কারণে যুগোপযোগী রেপার্টরি প্রণয়নে বহু খ্যাতনামা চিকিৎসক এগিয়ে আসেন এবং নিজ নিজ প্রজ্ঞা, মেধা, দৃষ্টিভঙ্গি ও দুরদর্শিতা দ্বারা রেপার্টরি প্রণয়ন করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। এসকল প্রকাশিত রেপার্টরির মধ্যে কোন কোন রেপার্টরি আপন মহিমায় আজও সমুজ্জ্বল, আবার কোন রেপার্টরি কালের অতলে হারিয়ে গিয়েছে। আনুমানিক প্রায় ৩৫০টিরও অধিক রেপার্টরি প্রকাশিত হয়ে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শাস্ত্রকে সমৃদ্ধ করেছে। রেপার্টরির উন্নয়নে সে সকল মনীষীর অবদানকে হোমিওপ্যাথিক সমাজের চিরদিন স্মরণ রাখা প্রয়োজন।
হ্যানিম্যানের অনুমোদন ও সুপারিশকৃত বোনিংহাউসেন রেপার্টরির (Boenninghausen’s Therapeutic pocket Book) সীমাবদ্ধতাকে দূর করার জন্য অনেকেই প্রচেষ্ট চালান, যেমন Dr. T. F. Allen, Dr. H. A. Roberts, Dr. Annie C. Wilson, Dr. C. M. Bogar প্রমুখ। আনুমানিক প্রায় ৩৫০টির অধিক রেপার্টরি প্রকাশিত হলেও যে রেপার্টরিটি বিশ্বহোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় সবচেয়ে বেশি প্র্রশংসা ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে সেটি হচ্ছে কেন্ট রেপার্টরি। বিজ্ঞ কেন্ট দেখতে পান বোনিংহাউসেন রেপার্টরি ও বোনিংহাউসেন রেপার্টরিকে সংশোধন করে যে সকল রেপার্টরি রচিত হয়েছে সেগুলোতে এবং ডাঃ লিপের রেপার্টরি, ডাঃ জারের রেপার্টরি, ডাঃ লি এর রেপার্টরিসহ অন্যান্য প্রকাশিত রেপার্টরিগুলোতে যথেষ্ট ভুলত্রুটি রয়েছে, তথ্যগত ঘাটতি প্রচুর, যথেষ্ট মানসম্পন্ন নয়। তিনি দেখতে পান অন্যান্য রেপার্টরিগুলোর অধ্যায় ও লক্ষণ সাজানোর বিষয়টি সহজবোধ্য নয়। এমতাবস্থায় বিজ্ঞ কেন্ট তাঁর দূরদর্শিতা, মেটেরিয়া মেডিকায় অগাধ পান্ডিত্য, হোমিও দর্শনে বিশাল জ্ঞান, অর্গাননের মূলনীতির উপর অবিচল আস্থা, হোমিওপ্যাথিতে বৈপ্লবিক চিন্তাধারা ইত্যাদ বহুবিধ অতুলনীয় গুণাবলীর অধিকারী হয়ে নিজের ব্যবহারের জন্য রেপার্টরি রচনার কাজে হাত দেন। তিনি বোনিংহাউসেন রেপার্টরি ব্যবহারের জটিলতার অভিজ্ঞতা থেকে নিজেই সহজ ব্যবহারযোগ্য অসাধারণ এর রেপার্টরি রচনা করে বিশ্ববাসীকে উপহার দেন। তিনি তার রচিত রেপার্টরি রচনার কারণ সম্পর্কে বলেন – আমি এই রেপার্টরিটি আসলে প্রকাশের জন্য লিখিনি, বরং আমার নিজের জন্য, নিজের ব্যবহারের জন্য লিখেছি। আমি আমার চিকিৎসার চাহিদা অনুসারে এটা লেখা হয়েছে এবং এটি কেবলমাত্র আমার ব্যক্তিগত প্রয়োজনের ফল। তিনি আরও বলেন – আমি লক্ষণ তৈরী করিনি বরং আমি আমার জানা লক্ষণগুলোকে একটি ভাল কায়দায় সাজিয়ে ওষুধ তালিকা প্রদান করেছি। তিনি এ রেপার্টরিকে এমনভাবে সাজান যাতে করে এ পুস্তকে পরবর্তীতে নতুন লক্ষণ ও নতুন ওষুধকে অন্তর্ভূক্ত করা যায়। তিনি এ পুস্তককে আরও পূর্ণাঙ্গ ও আরও ব্যবহার উপযোগী করার জন্য সমসাময়িক চিকিৎসকদেরকে তাদের মূল্যবান পরামর্শ দেয়ার অনুরোধ জানান এবং এ পুস্তকে কোন ভুল নজরে আসলে তা সংশোধনের আহবান জানান। এ রেপার্টরি লিখতে গিয়ে তিনি প্রচন্ড কষ্ট স্বীকার করেন, তাঁর স্বাস্থ্যের যথেষ্ট অবনতি হয়, তিনি তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ১৮৯৭ সালে কেন্টের রেপার্টরি প্রথমে খন্ড খন্ড হয়ে প্রকাশিত হতে থাকে। ডাঃ কেন্টের স্ত্রী ডাঃ ক্লারা লুইসি এই রেপার্টরি রচনায় ডাঃ কেন্টকে অসামান্য সহযোগীতা করেন এবং কেন্টের মতো তিনিও স্বাস্থ্যভঙ্গ হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। বিদুষি এই মহিলার সহযোগিতা না পেলে কেন্ট রেপার্টরি হয়তো প্রকাশই পেতো না। কেন্টের মৃত্যু হয় ১৯১৬ সালে, রেপার্টরির তৃতীয় সংস্করণের পান্ডুলিপির সংশোধনীর কাজটি তিনিই সম্পাদন করেছিলেন।
কেন্ট রেপার্টরির তথ্য সংগ্রহের উৎস ডাঃ কেন্ট এই রেপার্টরি রচনার সময় বিশ্বাসযোগ্য বিভিন্ন উৎস হতে তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি হ্যানিম্যানের সকল প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত রচনা, মেটেরিয়া মেডিকা পিউরা, ক্রনিক ডিজিজ ইত্যাদি গ্রন্থ, বিভিন্ন ওষুধের মূল ড্রাগপ্রুভিং রেকর্ড, বিভিন্ন খ্যাতনামা চিকিৎসকদের ক্লিনিক্যাল সিম্পটম্পস, ডাঃ বোনিংহাউসেন, ডাঃ লিপে, ডাঃ লি এবং ডাঃ জার এর লিখিত রেপার্টরি, বিভিন্ন চিকিৎসকের প্রকাশিত ও অপকাশিত পান্ডুলিপি, ডাঃ এলেনের এনসাইক্লোপিডিয়া, ডাঃ বিগলারের ডাইরি, ডাঃ মিন্টোর ডিজেজেস অব ওমেন, ডাঃ গ্যার্ণেসীর হেমোরয়েড, ডাঃ বেল এর ডাইরিয়া, ডাঃ লি ও ডাঃ ক্লার্কের কফ সহ সমসাময়িক বহু পুস্তক থেকে। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি সাহায্য নেন ডাঃ সি.লিপের রেপার্টরি টু দি মোর ক্যারেক্টারিষ্টিক সিম্পটম্স অব দি মেটেরিয়া মেডিকা এবং ডাঃ ই. লি. এর রেপার্টরি অব দি ক্যারেকট্যারিষ্টিক সিম্পটম্পস, ক্লিনিক্যাল এন্ড প্যাথজেনিটিক অব দি হোমিওপ্যাথিক মেটেরিয়া মেডিকা এবং ডাঃ জেন্ট্রির ৬খন্ডে রচিত কনকরডেন্স রেপার্টরি থেকে। তিনি ডাঃ হেরিং এর প্রকাশিত গাইডিং সিম্পটম্পস থেকেও তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি সংগ্রহিত বিশ্বাসযোগ্যসূত্রের যাবতীয় তথ্যকে যাচাই বাছাই করে নিজের পরিকল্পনা মতে সাজিয়ে এই রেপার্টরি রচনা করেছিলেন।
অন্যদিকে কেন্টের সমসাময়িক সময়ে কেলভিন বি নার প্রকাশ করলেন নারের রেপার্টরি, ডা বরিক প্রকাশ করলেন মেটেরিয়া মেডিকা সংযুক্ত রেপার্টরি । আবার কেন্ট রেপার্টরিতে তথ্য সংযোজন করে আধুনিক রেপার্টরি রচনায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেন ভারতের ডা. সিভারমন এবং ডা. রমনলান প্যাটেল। এছাড়াও কেন্ট রেপার্টরিতে তথ্য সংযোজন করেন জষ্ট কুঞ্জলি, পিয়েরে স্মিট, বাংলাদেশের ডা. মুহাম্মদ আবুবকর। কেন্ট রেপার্টরিকে আপডেট করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করে জার্মানীর বার্থেল ও ক্লুন্কার লিখলেন সিন্থেটিক রেপার্টরি, ফ্রেডরিক স্রোয়েন্স সম্পাদনা করলেন সিন্থেসিস রেপার্টরি, রজার ভন জ্যান্ডভর্ট লিখলেন কমপ্লিট রেপার্টরি ও ইউনিভার্সাল রেপার্টরি।
কেন্ট রেপার্টরি ১৮৯৭ সনে প্রকাশিত হয়ে অদ্যাবধি বিশ্বহোমিওপ্যাথি জগতে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য, সুসংগঠিত, নির্ভরযোগ্য, সুবিন্যস্ত, সর্বাধিক নির্ভুল এবং সংক্ষিপ্ত পরিসরে সবচেয়ে বেশি তথ্যের সমাহারযুক্ত রেপার্টরি। কেন্ট রেপার্টরির তথ্যকে মূল উৎস হিসাবে বিবেচনা করেই রচিত হয়েছে চলমান সময়ের অধিকতর তথ্য সমৃদ্ধ আধুনিক রেপার্টরিসমূহ।
আধুনিক রেপার্টরিরসমূহ হচ্ছে –
১। সিন্থেসিস রেপার্টরি – সম্পাদক, ফ্রেড্রিক স্রোয়েন্স, ১০ম সংস্করণ
২। রবিন মারফীর রেপার্টরি, ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে ৪টি সংস্করণ
৩। কমপ্লিট রেপার্টরি, ৩টি সংস্করণ, লেখক – রজার ভ্যন জেন্ডভর্ট
৪। ইউনিভার্সাল রেপার্টরি, লেখক – রজার ভ্যন জেন্ডভর্ট
কেন্ট রেপার্টরিই হচ্ছে সিন্থেসিস রেপার্টরিসহ অন্যান্য আধুনিক রেপার্টরি রচনার প্রধান উৎস বা মাতৃ উৎস (Mother source) ।
কেন্ট রেপার্টরি সম্পর্কে বিশ্ববরেণ্য চিকিৎসকগণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। নিম্নে তার কিছু উদাহরণ দেয়া হল ।
১। Elizabeth Wright-Hubbard (1896-1967) – আমিরিকার এই প্রখ্যাত নারী হোমিওপ্যাথ ১৯৫৯ সন থেকে ১৯৬১ সন পর্যন্ত American Institute of Homeopathy এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি বলেন – Study the Kent Method first, last and all the time ।
২। বিশ্ববিখ্যাত হোমিওপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারক আমিরিকার Boericke & Tafel এর কর্ণধার ডাঃ বরিক বলেন – It is a great and useful thing, I wish we had it. ( কেন্ট রেপার্টরি প্রকাশের জন্য উনাকে করা অনুরোধে তিনি আর্থিক সংকটের অযুহাতে অসম্মতি জানিয়েছিলেন বলে তখনকার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকগণের তীব্র সমালোচনার পাত্র হয়েছিলেন। তিনি বরিক মেটেরিয়া মেডিকার লেখক উইলিয়াম বরিক নন )
৩। এ রেপার্টরির প্রথম আংশিক খন্ডাকারে প্রকাশিত হলে বোষ্টনের বোনিংহাউসেন ক্লাব এই বিশেষ অবদানের জন্য ডাঃ কেন্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রশংসাপত্র প্রেরণ করেন।
৪। যুক্তরাষ্ট্রের ডাঃ ষ্টুয়ার্ট ক্লোজ বলেন – এই বইয়ের পরিকল্পনা পরিষ্কার ও অত্যন্ত ধীশক্তিসম্পন্ন, এবং অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ও বিশ্বস্ততার সাথে করা হয়েছে। এটি একটি মহান কাজ।
৫। আমিরিকার কেন্ট হোমিওপ্যাথিক এসোসিয়েটস ১৯৯১ সনে এক বানীতে বলেন – এটার পরিষ্কার সংগঠিত অবস্থার জন্য প্রকাশের পর থেকেই অধিকাংশ হোমিওপ্যাথদের নিকট একটি প্রিয় রেপার্টরি।
৬। কানাডার ডাঃ এন্ড্রি সানি বলেন – কেন্ট কেবলমাত্র একখানা অধিক পূর্ণাঙ্গ রেপার্টরি উপহার দেননি বরং এটি হচ্ছে অধিকতর ব্যবহারিক, বিস্তৃত ও নির্ভরযোগ্য বই।
৭। যুক্তরাষ্ট্রের ডাঃ ই ডব্লিউ বেরিজ বলেন – কেন্টের রেপার্টরিটি কেবলমাত্র সদৃশ ওষুধ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় নয়, বরং ওষুধ নির্বাচনের সময় বাঁচাতেও অপরিহার্য।
৮। কেন্ট রেপার্টরির ৬ষ্ঠ আমিরিকান সংস্করণের প্রকাশক বলেন – যেখানেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার প্রচলন হয়েছে, সেখানেই ডাঃ কেন্টের রেপার্টরি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশ্বাস করি এই গ্রন্থটি তাঁদের রোগীদের আরোগ্য করার মহান কাজে অনেক বেশি সাহায্য করবে।
৯। ভারতেরর ডাঃ ডি. পি. রাস্তোগি ও ডাঃ আর. কে. মানচন্দ্র বলেন – ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ডাঃ কেন্টের রেপার্টরি আমাদের জন্য অশেষ পুরষ্কার হিসেবে কাজ করে।
১০। জেনেভার ডাঃ পিয়ের স্মিট এই বইকে সোনার মত মহামূল্যবান বলে আখ্যায়িত করেন।
১১। নয়াদিল্লির ডাঃ দিওয়ান হরিশ্চন্দ বলেন – ১৮৯৭ সালে ডাঃ কেন্টের রেপার্টরি যখন প্রকাশ পায়, এটা নিশ্চিন্তভাবেই সবচেয়ে ভাল রেপার্টরি বলে বুঝা যায়, আর এখন পর্যন্ত এই রেপার্টরি তার বিশেষ রাজকীয় মর্যাদা বজায় রাখতে পেরেছে।
কেন্ট রেপার্টরির আকর্ষণীয় দিক বা সুবিধাসমূহ:
ভূমিকা : কেন্ট রেপার্টরি ১৮৯৭ সনে প্রকাশিত হয়ে অদ্যাবধি বিশ্বহোমিওপ্যাথি জগতে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য, সুসংগঠিত, নির্ভরযোগ্য, সুবিন্যস্ত, সর্বাধিক নির্ভুল এবং সংক্ষিপ্ত পরিসরে সবচেয়ে বেশি তথ্যের সমাহারযুক্ত রেপার্টরি। ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত যে সকল তথ্য হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার জন্য আহরিত হয়েছিল, ডাঃ কেন্ট তৎসমুদয়কে একত্রিত করে এই রেপার্টরি লিখেছিলেন (গত পর্বে কেন্ট রেপার্টরির তথ্যের উৎস নিয়ে লিখেছিলাম) । ডাঃ কেন্টের মৃত্যুর কারণে এই রেপার্টরির মৌলিক উন্নতির পথ রূদ্ধ হয়ে যায়। তাই অত্র নিবন্ধে যে সকল সুবিধার কথা বলা হবে তা ১৮৯৭ সালে কেন্ট রেপার্টরি কি কি সুবিধা দিতে পেরেছিল সেভাবেই বিবেচনা করতে হবে।
তবে হোমিওপ্যাথি শিক্ষার্থী ও চিকিৎসকদের জন্য সুখবর এই যে, কেন্ট রেপার্টরির তথ্যকে মূল উৎস (Mother Source) হিসাবে বিবেচনা করেই রচিত হয়েছে চলমান সময়ের অধিকতর তথ্য সমৃদ্ধ ইংরেজি ভাষায় রচিত আধুনিক রেপার্টরিসমূহ, (যাদের কোন বাংলা অনুবাদ এখনও হয়নি এবং হওয়ার সম্ভাবনাও খুবই কম)। আধুনিক এসকল রেপার্টরিসমূহ হোমিওপ্যাথিক সফটওয়ার এর জন্যই প্রধানত তৈরী হচ্ছে এবং কিছু দিন পর পরই আপডেট হচ্ছে এবং কম-বেশি প্রতিটি সংস্করণেই কিছু না কিছু পরিবর্তন করেই যাচ্ছে ।
প্রধানতঃ আধুনিক রেপার্টরিগুলো হচ্ছে –
১। সিন্থেসিস রেপার্টরি – সম্পাদক, ফ্রেড্রিক স্রোয়েন্স, ১০ম সংস্করণ
২। রবিন মারফীর রেপার্টরি, ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে ৪টি সংস্করণ
৩। কমপ্লিট রেপার্টরি, লেখক – রজার ভ্যন জেন্ডভর্ট,৩টি সংস্করণ
৪। ইউনিভার্সাল রেপার্টরি, লেখক – রজার ভ্যন জেন্ডভর্ট (এই রেপার্টরি বোগার বোনিংহাউসেন রেপার্টরিকে মূল উৎস হিসাবে ধরা হয়েছে এবং সেই রেপার্টরির সাজানোর ধারাকে অনুসরণ করে কেন্টের রেপার্টরির তথ্যকে ও অন্যান্য রেপার্টরির তথ্যকে অন্তর্ভূক্ত করে রচিত হয়েছে)
কেন্ট রেপার্টরিকে সম্পূর্ণভাবে অনুসরণকরে রচিত বলে সিন্থেসিস রেপার্টরি, রবিন মারফির রেপার্টরি ও কমপ্লিট রেপার্টরিকে Kent type General Repertories of Logical Utilitarian রেপার্টরি হিসেবে শ্রেণিবিভাগ করা হয়। অন্যদিকে ইউনিভার্সাল রেপার্টরি বোগার-বোনিংহাউসেন রেপার্টরির অনুসরণে সম্পাদিত হওয়ার কারণে Boenninghausen’s type General Repertories of Logical Utilitarian রেপার্টরি হিসেবে শ্রেণিবিভাগ করা হয়।
১৮৯৭ সালে কেন্ট রেপার্টরি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে সমগ্র বিশ্বে ২০১৯ সন পর্যন্ত যে নামে যেভাবে যত রেপার্টরি প্রকাশিত হয়েছে তাদের সবার প্রতক্ষ্য বা পরোক্ষ মাতৃউৎস / মূল উৎস (Mother Source) কেন্ট রেপার্টরি । এই একটি বাক্য থেকেই অনুধাবন করা যায় বিশ্ব হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা জগতে কেন্টের রেপার্টরির গুরুত্ব কতখানি। বিশ্বের যেখানেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা প্রচলিত আছে সেখানেই কেন্টের রেপার্টরিকে পরম মর্যাদার আসনে সমাসীন করা হয়েছে। ভারতের কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কেন্ট রেপার্টরির বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছেন, তন্মধ্যে মডার্ন পাবলিশার্স কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থটি কেন্ট রেপার্টরির ইংরেজি পুস্তকের হুবুহু পৃষ্ঠা অনুসারী বাংলা অনুবাদ। বাংলাদেশের ডা. মুহাম্মদ মাসুদ খান (মরহুম) সমগ্র কেন্ট রেপার্টরির সকল রুব্রিক, সাব-রুব্রিক ইংরেজি ও বাংলা অনুবাদ একই সাথে সম্পাদনা করে প্রকাশ করে অসাধারণ একটি কাজ করে গিয়ে বাংলাভাষী দূর্বল ইংরেজী জ্ঞানের লোকদের জন্য মহাউপকার করে গিয়েছেন (আল্লাহ উনাকে এই কাজের জন্য পরকালে উত্তম প্রতিদান প্রদান করুন)।
বেলজিয়ামের নামূর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে গণিতজ্ঞ ও সফটওয়্যার এক্সপার্ট প্রফেসর জিন ফিকিফিটের তত্ত্বাবধানে বিশ্বের প্রথম হোমিওপ্যাথিক সফটওয়্যার রাডার (RADAR) এর তথ্যের একমাত্র উৎস ছিল এই কেন্ট রেপার্টরি। শুধু কেন্ট রেপার্টরির তথ্যের সফটওয়্যার ভার্সান তৈরী করেই যাত্রা শুরু করেছিল রাডার হোমিওপ্যাথিক সফটওয়্যার। যদিও বর্তমানের রাডার হোমিওপ্যাথিক সফটওয়্যারে বিশ্বের প্রায় সকল খ্যাতনামা রেপার্টরি ও মেটেরিয়া মেডিকার তথ্যকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে ।
কেন্ট রেপার্টরির আকর্ষণীয় দিক বা সুবিধাসমূহ (১৮৯৭ সনের প্রকাশনা অনুসারে):-
১। সমগ্র কেন্ট রেপার্টরি ৩৭ টি পূর্ণাঙ্গ ও স্বতন্ত্র অধ্যায়ে বিভক্ত, প্রথম অধ্যায় মন (Mind), শেষ অধ্যায় (৩৭তম) সাধারণ লক্ষণ / সার্বদৈহিক অধ্যায় (Generalities), বাকি ৩৫টি অধ্যায় আঙ্গিক লক্ষণের অধ্যায় (Particular Part)। প্রতিটি অধ্যায়ে লক্ষণ শিরোনাম (Rubric)কে ইংরেজি বর্ণমালার ক্রমানুসারে, সকল সাব-রুব্রিককে একইভাবে ইংরেজি বর্ণমালার ক্রমানুসারে এবং নির্দেশিত ওষুধ তালিকাকে একইভাবে ইংরেজি বর্ণমালার ক্রমানুসারে আভিধানিক পদ্ধতিতে (A – Z) সাজানো হয়েছে (কয়েকটি অধ্যায়ে ব্যতিক্রম আছে)। এরূপ বিন্যাস কৌশলকে আদি-অন্ত বা প্রথম ও শেষ বা Alpha and Omega বলা হয় (গ্রিক বর্ণমালার প্রথম অক্ষর Alpha এবং শেষ অক্ষর Omega অনুসারে)। সমগ্র রেপার্টরি গ্রন্থটি সহজবোধ্য কিন্তু অসাধারণ কলাকৌশলের নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সাজানো হয়েছে, যা নিম্নের বিবরণ থেকে বিস্ময়ের উদ্রেক করে কিন্তু রেপার্টরিটির ব্যবহারকে সহজবোধ্য করে। কম্পিউটার আবিষ্কারের প্রায় ১০০ বছর পূর্বে কেন্ট রেপার্টরি লিখিত হলেও কম্পিউটার সফটওয়্যার তৈরীর সময় প্রোগ্রামারগণ কেন্টের মেধা ও রেপার্টরির তথ্য সাজানোর পদ্ধতি দেখে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন, বলা হয়ে থাকে যে – কম্পিউটার আবিষ্কার হওয়ার ১০০ বছর পূর্বেই কেন্ট হোমিওপ্যাথির কম্পিউটার প্রোগ্রাম লিখে গিয়েছেন ভবিষৎ প্রজন্মের জন্য।
২।ইংরেজি বর্ণমালাক্রমিক বা আভিধানিক রীতি অনুসারে এই রেপার্টরির তথ্য সাজানো হয়েছে বিধায় মূল রুব্রিক, সাব-রুব্রিক এবং ওষুধ তালিকা খুঁজে পাওয়া সহজ। একজন শিক্ষার্থী বা চিকিৎসকের যদি অভিধান ব্যবহারের অভিজ্ঞতা থাকে তাহলেই এই রেপার্টরি ব্যবহার করতে সক্ষম হবেন। সকল রুব্রিক ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটার বা বড় হাতের অক্ষরে এবং বোল্ড বা মোটা অক্ষরে ছাপা হয়েছে। সাব-রুব্রিক সাধারণ ছাপার অক্ষরে এবং মূল রুব্রিকের লাইন থেকে ভেতরে ঢুকিয়ে লেখা হয়েছে। ফলে রুব্রিক ও সাব-রুব্রিক কোনটি অনুধাবন করা সহজ।
৩। কেন্ট রেপার্টরিতে নামের তালিকায় ৬৫০টি ওষুধের পূর্ণনাম ও সংক্ষিপ্ত রূপ দেয়া হয়েছে, ফলে ওষুধের সংক্ষিপ্ত রূপ ও পূর্ণরূপ সম্পর্কে ধারনা পাওয়া সহজ।
৪। কেন্ট রেপার্টরিতে রুব্রিক ও সাব-রুব্রিক এর সংখ্যা সর্বমোট ৬৪,২৩০টি (যদিও সাধারণভাবে বলা হয় কমবেশি ৭৫,০০০ রুব্রিক আছে)। হ্যানিম্যানের সময় (১৮০৫) হতে ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত সকল রেপার্টরির তথ্যের হিসেব অনুসারে এই পরিসংখ্যান সর্ববৃহৎ। (বর্তমান সময়ে প্রকাশিত আধুনিক কোন কোন রেপার্টরিতে কেন্ট রেপার্টরি হতে ২/৩ গুণ বেশি তথ্য অন্তর্ভূক্ত হয়েছে)
৫। কেন্ট রেপার্টরিতে রুব্রিকের বিপরীতে ওষুধ মূল্যায়নের জন্য তিন ধরনের বর্ণমালার টাইপ ব্যবহার করা হয়েছে। মোটা অক্ষর বা Bold type এ লেখা ওষুধের মান সবচেয়ে বেশি, গাণিতিক মান ৩, ১ম শ্রেণি (1st grade)। বাঁকা বা Italic এ লেখা ওষুধের মান মধ্যম মানের, গাণিতিক মান ২, ২য় শ্রেণি (2nd grade)। সাধারণ ছাপার অক্ষরে (small letter) বা রোমান লেটারে লেখা ওষুধের মান সবচেয়ে কম, গাণিতিক মান ১, ৩য় শ্রেণি (3rd grade)। ছাপার অক্ষরের এরূপ তারতম্যের জন্য ওষুধের মূল্যমান বা গুরুত্ব খুব সহজেই অনুধাবন করা যায় । প্রুভিং, রিপ্রুভিং ও ক্লিনিক্যালভাবে প্রমাণিত লক্ষলের ওষুধ ১ম শ্রেণির । প্রুভিং, রিপ্রুভিং এ দূর্বলভাবে পাওয়া লক্ষণের ওষুধের মূল্যমান ২য় শ্রেণির। কেবলমাত্র ক্লিনিক্যালভাবে পাওয়া লক্ষণের মূল্যমান ৩য় শ্রেণির।
৬। সমগ্র রেপার্টরিতে একই ধারায় রুব্রিক সাজানো হয়েছে। প্রথমে সময়, তারপর বর্ণমালাক্রমিক রুব্রিক, বেদনার ক্ষেত্রে প্রথমে পার্শ্ব, তারপর সময়, তারপর বর্ণমালাক্রমিক রুব্রিক, তারপর স্থান (Location), তারপর বেদনার বৈশিষ্ট্য (Character), তারপর বেদনার সম্প্রসারণ (Extension), এ রকম সুশৃংঙ্খল রীতিতে বিশাল রেপার্টরিটি সাজানো হয়েছে, যা কেন্টের নিপুন হাতের পরিচয় বহন করে। ফলে মানুষের দেহ-মনে প্রকাশিত প্রায় অধিকাংশ লক্ষণাবলীকে এই রেপার্টরিতে খুঁজে বের করে সদৃশ ওষুধ নির্বাচন করা যায়।
৭। এই রেপার্টরি এমনই তথ্য ও কৌশলে পরিপূর্ণ যে, এই রেপার্টরি দ্বারা তরুন পীড়া, ক্রনিক পীড়া, একদৈশিক পীড়া, মহামারী, মানসিক ব্যাধি ও লক্ষণ, আঙ্গিক ব্যাধি ও লক্ষণ, সার্বদৈহিক ব্যাধি ও লক্ষণ, স্ত্রীরোগ ও লক্ষণ, পুংজননতন্ত্রের রোগ ও লক্ষণ, শিশুরোগ ও লক্ষণ ইত্যাদি সকল প্রকার ব্যাধির লক্ষণ এর সদৃশ ওষুধ তালিকা পাওয়া যায়। এই রেপার্টরির সহায়তায় একক লক্ষণ দ্বারাও যেমন ওষুধ নির্বাচনের দিক নির্দেশনা পাওয়া যায়, তেমনি একাধিক লক্ষণের সমন্বয়ের মাধ্যমে গাণিতিক হিসাবের রেপার্টরাইজেশান করে রোগীচিত্রের সর্বাধিক সদৃশ ওষুধ নির্বাচনের সহায়তা পাওয়া যায়।
৮। এই রেপার্টরি বর্ণমালা ক্রমিক ও সুনির্দিষ্ট রীতিতে সাজানো হওয়ায় ভবিষ্যতে নতুন রুব্রিক বা লক্ষণ, নতুন আবিষ্কৃত ওষুধ অন্তর্ভূক্ত করার সুবিধা সম্বলিত হওয়ায় বিশাল বিশাল আধুনিক রেপার্টরিসমূহ এই রেপার্টরির সকল তথ্যকে ধারন করা সম্ভব হয়েছে ও অধিকতর উপযোগী রেপার্টরি রচনা করা সম্ভব হয়েছে।
৯। এ্ই রেপার্টরি সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের প্রখ্যাত নারী চিকিৎসক Dr. E. W. Hubbard এর মন্তব্য অনুধাবন করলেই ডাঃ কেন্টের সৃষ্টির মূল্যায়ন করা যায়, তিনি বলেন – Study the Kent Method first, last and all the time, অর্থাৎ কেন্টের পদ্ধতিকে সর্বপ্রথমে অনুধাবন কর, সবশেষে অনুধাবন কর এবং সর্বদা অনুধাবন কর। ডাঃ কেন্ট ছিলেন ডাঃ হ্যানিম্যানের যথার্থ অনুসারী ও হ্যানিম্যানের কর্মের সঠিক ব্যাখ্যা দানকারী এবং হ্যানিম্যানের বর্ণিত সঠিক সদৃশ ওষুধ নির্বাচনের ব্যবহারিক পথ নির্দেশদানকারী।
১০। ডাঃ কেন্ট একজীবনে হোমিওপ্যাথির জন্য যা করে গিয়েছেন, রেপার্টরি রচনার যে ধারা সৃষ্টি করেছেন তা এক অবিস্মরণীয় কীর্তি। যতদিন এই পৃথিবীতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা থাকবে ততদিন ডাঃ কেন্টের রেপার্টরি রচনার ধারা অব্যাহত থাকবে, কেন্টের অসমাপ্ত কাজ সম্পাদিত হতে থাকবে এবং হোমিওপ্যাথির তথ্য জগৎ অধিকতর সমৃদ্ধ হতে থাকবে।
জয় হোক হ্যানিম্যানের, জয় হোক হোমিওপ্যাথির, জয় হোক মহামতি ডাঃ জেমস টাইলার কেন্টের।
তথ্যসূত্র:
১। কেইস টেকিং ও রেপার্টরি পর্যালোচনা – লেখক, ডাঃ শাহ ফরিদুল ইসলাম, প্রাক্তন অধ্যাপক, বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা।
২। কেন্ট রেপার্টরির কথা – লেখক, ডাঃ গুরুদাস সরকার, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, সরকারী হোমিওপ্যাথিক ডিগ্রী কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা । লেখাটি বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
৩। রেপার্টরি শিক্ষা ও কম্পিউটারাইজড হোমিওপ্যাথি, প্রকাশ কাল জুন, ২০০৩, গ্রন্থটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫১৬ – লেখক, ডাঃ এ. কে. এম. রুহুল আমিন।
Discussion about this post