অনুবাদ: ডা. শাহীন মাহমুদ
ঔষধ প্রয়োগের মূলনীতি হিসাবে যে চিকিৎসকই সদৃশবিধানকে গ্রহণ করবেন, সাধারণভাবে তাকেই হোমিওপ্যাথিক ফিজিশিয়ান বলা হয়। কিন্তু দৈনন্দিন অনুশীলনে এই বিধানের বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাদেরকে নিম্নোক্ত ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণি ও প্রকারের হোমিওপ্যাথ হিসাবে শ্রেণীকৃত করা যেতে পারে-
ক) আংশিক হোমিওপ্যাথবৃন্দ (Partial Homeopaths): তারা কেইসের কিছু লক্ষণের জন্য মাঝে মাঝে একটি বা একাধিক সদৃশ ঔষধ/ঔষধগুলো ব্যবহার করেন এবং অন্য লক্ষণ বা উপসর্গগুলোর জন্য অন্যান্য বিভিন্নপ্রকারের ঔষধপ্রয়োগবিদ্যার দ্বারা, বিশেষ করে প্রচলিত ধারার ঔষধ, যাকে এলোপ্যাথি বলা হয়- তার প্রয়োগে চিকিৎসা করার চেষ্টা করেন। তারা অর্গাননে প্রদত্ত হোমিওপ্যাথির কোন মূলনীতি বা পদ্ধতির তোয়াক্কা করেন না, এমনকি খোদ সদৃশবিধানটিও কেবল তাদের মুখের বুলির মাঝেই সীমাবদ্ধ।
খ) খাঁটি হোমিওপ্যাথবৃন্দ (Pure Homeopaths): তারা সদৃশবিধানকে পূর্ণাঙ্গরূপে গ্রহণ করেছেন বলে দাবী করেন, কিন্তু এই বিধানের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত অন্যান্য নীতিগুলোর প্রতি তাদের একটি শিথিল মনোভাব লক্ষ করা যায়। এই শ্রেণিতেও বিভিন্ন প্রকারের হোমিওপ্যাথগণ আছেন-
১. এদের অনেকে কেইসের বিভিন্ন লক্ষণাবলীকে বিভিন্ন সদৃশ ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা করার চেষ্টা করেন এবং একসাথে বা পর্যায়ক্রমিকভাবে একাধিক ঔষধ ব্যবহার করেন।
২. তাদের কেউ কেউ হোমিওপ্যাথির সমগ্রতা (Holistic) ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের (Individualistic) নীতিকে গ্রহণ করেন এবং একক সময়ে একটি ঔষধ প্রয়োগ করেন, কিন্তু এই মূলনীতিগুলোর সাথে সরাসরি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য নীতিগুলোর পরোয়া করেন না; যেরকম- ব্যবস্থাপত্রকৃত মাত্রার পর লক্ষণাবলীর গতি-প্রকৃতি, ঔষধের পুনরাবৃত্তি, ব্যবস্থাপত্র পরিবর্তন, পূর্বের ঔষধের যে কোন রকমের বিঘ্নতা সৃষ্টি, আরোগ্যের প্রতিবন্ধক উৎঘাটন, পরিপোষক কারণ বা এরকম ব্যাপারগুলোর পরোয়া করেন না।
৩. তাদের অনেকে রোগ ও আরোগ্যের জীবনীশক্তির শক্তিময়তার ধারণাটির (Dynamic Vitalistic Attitude) ব্যাপারে পিছিয়ে থাকেন, কাজেই ম্যাটেরিয়াল ডোজ, অঙ্গ-নির্দিষ্ট চিকিৎসা, রোগ-নির্দিষ্ট চিকিৎসা ইত্যাদি সংস্কারগুলো থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেন না।
৪. খাঁটি হোমিওপ্যাথদের মধ্যে কেবল একটি অল্প সংখ্যা পরিপূর্ণচিত্তে হোমিওপ্যাথির মূলনীতিগুলোকে গ্রহণ করেন (Simi, Mono, Mini); স্বাস্থ্য, রোগ ও আরোগ্যের ব্যাপারে সত্যিকারের যৌক্তিক চিন্তার (ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতা, সমগ্রতা ও জীবনীশক্তিময়তা) বিকাশ ঘটান এবং তাদের অনুশীলনে এই মূলনীতি ও ধারণাগুলো অনুসরণ করতে চেষ্টা করেন। তারা সদৃশতম ঔষধ নির্বাচনে পর্যাপ্তরূপে পারঙ্গম, ব্যবস্থাপত্রকৃত ঔষধের ব্যাপারে তাদের যথেষ্ঠ প্রত্যয় রয়েছে এবং ঔষধের ক্রিয়া সম্পন্ন হতে দেবার সম্পূর্ণ সময়টা প্রদান করার মতো যথেষ্ঠ ধৈর্য্য তাদের রয়েছে। কিন্তু এই গ্রুপের মধ্যেও দুইটি উপ-বিভাগ রয়েছে-
- অতি-খাঁটি হোমিওপ্যাথ (The Ultrapuritan Section): তারা কেবলমাত্র এককভাবে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগের মধ্যেই নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন এবং অন্য যে কোন প্রকারের আনুষাঙ্গিক সহযোগী উপায়গুলো গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান- এমনকি কোন ধরণের আরোগ্য-প্রতিবন্ধকতা বা পরিপোষক কারণকে দূর করার স্বার্থে হলেও। এটা সৌভাগ্য যে, তাদের এই একচোখা দৃষ্টিভঙ্গি বৃহৎ-সংখ্যক কেইসে সফলতার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না, বিশেষ করে একিউট কেইসগুলোতে কিন্তু তারা বহু বিপর্যয়কারী এবং অনুপেক্ষণীয় ব্যর্থতারও সম্মুখীন হন, বিশেষ করে ক্রনিক কেইসগুলোতে। তারা অর্গাননের খাঁটি অনুসারী হবার দাবী করেন কিন্তু তারা বোধহয় কেইসের অপরিহার্য চাহিদা বা প্রকারভেদ অনুযায়ী, বিভিন্ন আনুষাঙ্গিক সহায়তাকারী উপায় ও স্বাস্থ্যবিধিগুলোর ব্যাপারটিতে অর্গাননের শিক্ষাকে উপেক্ষা করছেন অথবা ভুল ব্যাখ্যা করছেন।
- বিজ্ঞানভিত্তিক হোমিওপ্যাথ (The Scientific Section): তারা অর্গাননের শিক্ষাকে তাদের নিত্যদিনকার অনুশীলনে কঠোরভাবে ও সতর্কতার সাথে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর নির্ভর করে ও যৌক্তিক চিন্তায় অনুসরণ করে থাকেন। তারা নিঃসন্দেহে হোমিওপ্যাথিক ঔষধপ্রয়োগবিদ্যা পূর্ণাঙ্গরূপে ও বিশেষভাবে অনুসরণ করেন কিন্তু একই সময়ে তারা প্যাথলজিক্যাল ডায়াগনোসিস, আরোগ্যের প্রতিবন্ধক, পরিপোষক কারণ ইত্যাদি ব্যাপারগুলোতে সতর্ক মনোযোগ প্রদান করেন এবং চিকিৎসাকৃত স্বতন্ত্র রোগীর প্রকার, সংবেদনশীলতা, অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তার সাথে সামঞ্জস্যশীল উপযুক্ত সহযোগী উপায় ও স্বাস্থ্যবিধিতেও প্রাপ্য গুরুত্বারোপ করেন।
এটি সুস্পষ্ট যে, এই শেষ প্রকারের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকগণই কেবলমাত্র অসুস্থ মানব-সম্প্রদায়কে হোমিওপ্যাথির সর্বোচ্চ উপযোগিতা প্রদান করতে সমর্থ এবং অন্যান্য চিকিৎসাপদ্ধতি ও অন্য প্রকারের হোমিওপ্যাথদের সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান ও ক্রমজটিলতাপ্রাপ্ত ভগ্নস্বাস্থ্য থেকে তাদেরকে রক্ষা করতে পারেন।
Discussion about this post