Dr. P. Gupta:
হোমিওপ্যাথি- প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসা ব্যবস্থার পাশাপাশি চলমান বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থা (Alternative treatment system), যা এর জন্মের শুরু থেকেই বহুলভাবে বিতর্কিত। কিন্তু এই বহুল বিতর্ক এবং বরাবর সমাজ ও রাষ্ট্রের শক্তিশালী শ্রেণিগুলোর তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রায় ২৫০ বছর যাবৎ এর সফলভাবে টিকে থাকা, ক্রমাগত জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি এবং আরোগ্যের লক্ষ লক্ষ প্রমাণ, আজ আমাদের দৃষ্টি পরিপূর্ণভাবে আকর্ষণের দাবী রাখে। এ যাবৎ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি দেশেই এবং প্রতিটি সময়েই, বার বার এই ব্যবস্থাটিকে বন্ধ করতে, উৎখাত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে। শুরু থেকেই বার বার বিভিন্ন অভিযোগ ও তদন্তের মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যে চিকিৎসকই এই পদ্ধতিকে তদন্তের জন্য ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে গেছেন, তাদের অনেকেই পরবর্তীতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকেই তাদের আদর্শ ব্যবস্থারূপে গ্রহণ করেছেন, নিদেনপক্ষে এর কার্যকারীতার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছেন।
যাদেরকে হোমিওপ্যাথির স্তম্ভস্বরূপ ব্যক্তিত্ব হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যেমন- ডা. জে টি কেন্ট, ডা. সি হেরিং, ডা. ক্লার্ক, ডা. বয়েড, ডা. বার্নেট, ইন্ডিয়ায় ডা. রাজেন দত্ত, ডা. মাহেন্দ্রলাল সরকার, বর্তমান সময়ের ডা. এলফন গোকেন্স, ডা. রজার মরিসন, ডা. জোনাথন শোর ইত্যাদি পথিকৃতরা বেশিরভাগই প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে নিরাশ হয়ে এবং মানুষের আরোগ্যকারী উত্তম চিকিৎসাব্যবস্থার খোঁজ করতে এসেই হোমিওপ্যাথিতে পৌঁছেছেন। এদের মধ্যে আবার অনেকে শুরুতে হোমিওপ্যাথির তীব্র বিরোধিতাই করতেন এবং তদন্ত করতে এসেই হোমিওপ্যাথির আশ্রয় নেন। কারণ কোন বিচক্ষণ ব্যক্তিই সত্যকে অস্বীকার করতে পারেন না। তারপরও কিছু খোঁড়া যুক্তি নিয়ে এর বিরোধিতা আজও রয়ে গেছে। কিন্তু সে ব্যাপারে আলোচনার আগে, হোমিওপ্যাথির আবিষ্কার ও তার কতটা প্রয়োজন ছিলো- সম্পর্কে সংক্ষেপে একটা ধারণা নিয়ে নিই।
হোমিওপ্যাথি আবিষ্কারের কারণ:
হোমিওপ্যাথির আবিস্কর্তা তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত ধারার সফল চিকিৎসক ডা. ক্রিশ্চিয়ান ফ্রেডরিখ স্যামুয়েল হানিম্যান (Dr. Christian Friedrich Samuel Hahnemann) । এই বিচক্ষণ মানুষটির মধ্যে একজন বিজ্ঞানীর সর্বরকম বৈশিষ্ট্য তথা- অপরিসীম ধৈর্য্য, সত্য জানা ও মেনে নেয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা, গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, সূক্ষ্ম চিন্তাশক্তি, যৌক্তিক বিচারক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়গুলো পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান ছিলো। ছিলো ১১ টি ভাষার উপর পূর্ণ দক্ষতা, প্রাচীন (উনার সময় থেকে ২৫০০ বৎসর আগের সময় পর্যন্ত) চিকিৎসাশাস্ত্র ও সমকালীন চিকিৎসাতত্ত্ব ও শাস্ত্রগুলো সম্বন্ধে পরিপূর্ণ ধারণা, রসায়নশাস্ত্র, উদ্ভিদবিদ্যা, জীববিদ্যা, দর্শনশাস্ত্রে অগাধ পান্ডিত্য। তিনি জার্মানীর এনলার্জেন মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসা পদ্ধতির চূড়ান্ত ডিগ্রী, ডক্টরেট অব মেডিসিন (MD) লাভ করেন এবং তাঁর গবেষণাপত্র এবং অন্যান্য লেখাগুলোর জন্য তৎকালীন সময়ের আদর্শ ও অনুসরণীয় চিকিৎসক হিসেবে স্বীকৃত হন।
বর্তমানে যে হিপনোটিজম এবং মেডিটেশনের আরোগ্যক্ষমতার স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে, সে সময়ে ছিলো এর তীব্র বিরোধিতা। তৎকালীন বৈজ্ঞানিকদের দৃষ্টিতে এটা ছিলো প্রচন্ড অবৈজ্ঞানিক, রহস্যাবৃত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিকিৎসা (তখন এর নাম ছিলো মেসমেরিজম, ডা. মেসমারের নামানুসারে)। কিন্তু তখনও এই দূরদর্শী চিকিৎসক এর কার্যকারিতার স্বীকৃতি প্রদান দান করেন এবং এটাকে একটি বিকল্প ধারার চিকিৎসা হিসাবে এর সম্ভাব্যতা, সীমাবদ্ধতা ও যৌক্তিকতা ব্যাপারে পরিচ্ছন্ন সূত্র প্রদান করেন। উনিই প্রথম প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসা পদ্ধতিকে “এলোপ্যাথি” (Allopathy) হিসাবে নামকরণ করেন এবং সুস্থ মানবদেহে ঔষধ পরীক্ষণের (Drug proving) পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।

সর্বোপরি উনিই সেই চিকিৎসক, যিনি (সমকালীন চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসারে) সফলতার চূড়ান্ত অবস্থায় থাকাকালীন সময়ে ঘোষণা করেন,
“আমরা এমন সব ঔষধ- রোগীদের শরীরে প্রয়োগ করি, যেগুলো সম্বন্ধে খুব কমই জানি এবং এগুলো মানুষের শরীরে ঠিক কি ধরণের কাজ করে, এর অন্তর্নিহিত ক্রিয়াধারা কি- তার প্রায় কিছুই জানি না। কাজেই মানুষের চিকিৎসার নামে তার বৃহত্তর অনিষ্ট সাধনের থেকে অব্যাহতি পেতে হলে এই চিকিৎসাবৃত্তি পরিত্যাগ করা ছাড়া আমার আর কোন রাস্তা নেই। বরঞ্চ আমি মনে করি, আমি যে সমস্ত রোগীদের চিকিৎসা কোরেছি, তাদের যদি কোন ঔষধই প্রদান করা না হতো, তাহলে তারা এখন যা আছেন- তার চাইতে ভালো থাকতো।”
আর এ কারণে, এরপর তিনি একসময় চিকিৎসাবৃত্তিই পরিত্যাগ করেছিলেন।
আর এটাই হচ্ছে হোমিওপ্যাথি আবিষ্কারের মূলকথা। প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসা ব্যবস্থাতে ঔষধ আবিষ্কারে কোনকালেই চিরায়ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়নি, আজও হয় না। কোন একটা আবিষ্কারের মূল কার্যপদ্ধতি হচ্ছে- অনুমান, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ এবং এরপর সিদ্ধান্ত। এ পদ্ধতি যথাযথরূপে অবলম্বন করা হলে, একটা ঔষধ বাজারজাত করার ২ বৎসর পর তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া উপলব্ধি ও আবিষ্কার করে তা প্রত্যাহার করার কথা নয়- যা প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিতে অবিরতই হচ্ছে। কাজেই প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসাব্যবস্থার অবৈজ্ঞানিক, দৈবায়ত্ত পদ্ধতিটাকে কোন যুক্তিশীল, বিচক্ষণ মানুষই সমর্থন করতে পারেন না।
ডা. হানিম্যানও এই অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে সমর্থন করতে পারেননি বলেই, ঐ সময়ই চিকিৎসাবৃত্তি ত্যাগ করেন। এই প্রচন্ড মেধাবী ব্যক্তিটি প্রভূত অর্থ উপার্জন করার অপরিসীম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ভাষার বইয়ের অনুবাদ করে অতিকষ্টে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন এবং ১৭৯০ সালে, এমন একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা আবিষ্কার করতে সমর্থ হন, যার মূল কথা হচ্ছে
“The highest ideal of cure is rapid, gentle and permanent restoration of the health, or removal and annihilation of the disease in its whole extent, in the shortest, most reliable, and most harmless way, on easily comprehensible principles.”
অর্থাৎ,
“ক্ষতিহীন এবং সবচাইতে সহজবোধ্য ও বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে দ্রুত এবং অত্যন্ত নমনীয় ভাবে রোগকে সম্পূর্নরূপে নির্মূল ও উৎখাত করে রোগীর স্বাস্থ্যের পূর্ণ ও স্থায়ী পুনঃসংস্থাপন।” (Organon of Medicine, Aphorism- 2)
আর এর মাধ্যমেই তিনি করলেন- চিকিৎসা ব্যবস্থাতে অনুমান, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ ও সিদ্ধান্তের চিরায়ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রবর্তন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, আজও হোমিওপ্যাথিকেই অবৈজ্ঞানিক, পশ্চাৎপদ, প্রতারণামূলক চিকিৎসাপদ্ধতি হিসাবে প্রদর্শন করার প্রচেষ্টা বিদ্যমান। ব্যাপক অপপ্রচারের দরুন সাধারণ মানুষের মনেও এই ধারণাই প্রোথিত। যদিও গত কয়েক দশকে এর আরোগ্যক্ষমতার গুণে এ ব্যবস্থাটা বহুলভাবে প্রসার লাভ করেছে এবং জনমনে কিছুটা হলেও ভ্রান্ত ধারণাগুলো ম্লান হয়েছে। হোমিওপ্যাথি রোগ এবং ঔষধের কঠিন কঠিন গালভরা ল্যাটিন নাম দিয়ে সাজানো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয়, এটা হচ্ছে পদ্ধতিগত বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা। আর এ কারণেই ২৫০ বৎসর আগে আবিষ্কৃত ঔষধটিও একই গতিতে, একই শক্তিতে আধুনিক প্রাণঘাতি রোগগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, মানুষকে আরোগ্য (Cure) করছে। এই ঔষধের প্রতি শরীরের বা জীবাণুর প্রতিরোধক্ষমতাও (Drug-Resistance) তৈরি হয়নি, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও (Side-effect) কোনদিন সৃষ্টি হয় নি, কাজেই আজ পর্যন্ত একটা হোমিওপ্যাথিক ঔষধও বাজার থেকে প্রত্যাহার করার প্রয়োজন পড়েনি, বিকল্প ঔষধ আবিষ্কারের প্রয়োজনীতাও দেখা দেয়নি।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি:
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগবে, কি সেই বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা- যা ডা. হানিম্যান আবিষ্কার করেছেন? এবং কিসের ভিত্তিতে দাবী করছেন যে তাঁর চিকিৎসা ব্যবস্থাটিই বৈজ্ঞানিক সত্য?
এ প্রসঙ্গে বলতে গেলে, প্রথমেই বলতে হবে, কোন বৈজ্ঞানিক সত্যই মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না- পারে শুধু উৎঘাটন করতে, আবিষ্কার করতে। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, বস্তু-শক্তি-সময়ের আপেক্ষিকতা, নিউরনের কার্যপদ্ধতি, জিনেটিক কোড, গ্যাসের গতি, ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ডের বৈশিষ্ট্য, পরমাণুর গঠন, আলোর হিসাব- কোনকিছুই মানুষ সৃষ্টি করে নি। স্রষ্টা স্বয়ং সৃষ্টি করেছেন। এটা মহাবিজ্ঞানী স্রষ্টা মহাবিশ্বে যে বৈজ্ঞানিক শৃঙ্খলা তৈরি করে দিয়েছেন, যে ফিতরাত দিয়েছেন- তারই বিভিন্ন দিক। মানুষ এগুলো তাঁরই ইচ্ছায়, বিশেষ নির্দেশনায় জ্ঞানপ্রাপ্ত হবার পর তা ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রযুক্তি তৈরি করে, আরাম আয়েশের উপকরণ তৈরি করে, এই বিজ্ঞানগুলোকে ব্যবহার করেই সে প্রকৃতির অন্যান্য যে শৃংখলা থেকে তাদের প্রতিকূলতা আসতে পারে- তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
যেমন, খরার সময় কৃত্রিম বৃষ্টি আনয়নের যে পদ্ধতি, তা যৌগটির সাথে বায়ু ও পানির কি প্রতিক্রিয়া হবে সেটা আবিষ্কারের পরই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এই প্রতিক্রিয়ার পদ্ধতি কোন মানুষ সৃষ্টি করেনি- এই ভারসাম্য, এই প্রতিক্রিয়া পদ্ধতি স্রষ্টারই সৃষ্টি, আমরা এই সত্যটা জানার পর তা ব্যবহার করছি মাত্র। লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, এই প্রায়োগিক কাজগুলো কিন্তু মূল বৈজ্ঞানিক সত্যটার অনুকূলেই করতে হয়। কেউ যদি মাধ্যাকর্ষণ সূত্রটাকে অবজ্ঞা করে রকেট চালানোর চেষ্টা করে, তাহলে কি হবে? কিংবা আর্কিমিডিসের সূত্র হিসাবে না রেখে, যদি সাবমেরিন তৈরি করে পানিতে নামানো হয়, তাহলে তাকে কি বলবেন? সবাই বলবে এটা আত্মহত্যার নামান্তর, কেউই এটাকে বিজ্ঞান বলবেন না।

তাহলে বিধাতা যে মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তার আরোগ্যপদ্ধতির কি এই রকম কোন সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক ভিত্তি, প্রাকৃতিক নীতি কি তিনি সৃষ্টি করেন নি? এমন কোন প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা কি সৃষ্টি করেন নি, যা দিয়ে মানুষের মানসিক ও শারীরিক বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায়? যদি তা থেকে থাকে, তবে তাকে বলা হবে চিকিৎসাতত্ত্ব।
আর এখন যদি এই চিকিৎসাতত্ত্ব বাদ দিয়ে একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা দাঁড় করানো হয়, তাহলে তা কি আত্মহত্যার নামান্তর হবে না? এবার প্রতিষ্ঠিত ধারার চিকিৎসাগুরুদের কয়েকটি সাধারণ মূলনীতি ও তত্ত্ব সংক্রান্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে দেখুন; প্রশ্ন করে দেখুন- রোগ কী? আরোগ্য কী? রোগের কারণ কি? আরোগ্য পদ্ধতি কি? মোটকথা, চিকিৎসাতত্ত্ব কি? কোন প্রাকৃতিক শৃঙ্খলার সূত্র দিয়ে মানুষ রোগাক্রান্ত হয় এবং রোগ থেকে আরোগ্য হয়? কোন সুনির্দিষ্ট উত্তর কারো কাছ থেকেই পাবেন না।
আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, যুগে যুগে তারা নতুন নতুন তত্ত্ব হাজির করছেন, আগের তত্ত্ব বাতিল ঘোষণা করছেন। কিন্তু এখানে অবধারিতরূপে একটা প্রশ্ন এসে যায়- সত্যকে বা সত্যের উপর ভিত্তি করা তত্ত্বকে কি বাতিল করা যায়? আর্কিমিডিসের সূত্র, পিথাগোরাসের সূত্র, নিউটনের সূত্র, আইনষ্টাইনের সূত্রকে কি বাতিল করা গেছে? যদিও বা কোনদিন ভুল প্রমাণিত হয়ে বাতিল হয়- তাহলেও কি তাকে আপনি শাশ্বত, চিরন্তন, প্রাকৃতিক নীতি বলার কোন উপায় আপনার কাছে থাকবে?
সত্য সর্বসময়ই একক, শ্বাশ্বত, ধ্রুব, অপরিবর্তনীয় (Static) । একসময় পৃথিবীকে সমতল বলে ধারণা করা হতো, ধারণা করা হতো সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে। কিন্তু তখনও পৃথিবী গোলাকারই ছিলো এবং পৃথিবী সূর্যের চরিদিকেই ঘুরতো। গ্যালিলিওকে পুড়িয়ে মেরেও এই সত্যের ব্যতিক্রম হয়নি। এই সত্যকে আর আপডেট করার প্রয়োজন হয়নি, কারণ সত্যের আধুনিকায়ন হয় না। শুধু এর বিভিন্ন দিকগুলোকে (Facet) উদ্ভাসিত করা যায়। বাতিল হওয়া প্রাচীন ধারণাগুলো- পৃথিবী সমতল বা সূর্যের পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করার ধারণাগুলো যখন বাতিল হলো, তার আগ পর্যন্ত কিন্তু ওগুলোকেও বৈজ্ঞানিক সত্যই মনে করা হতো (যদিও এই ধারণাগুলো বর্তমান চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতোই- কোন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে করা ছিলো না)। আজ প্রতিষ্ঠিত ধারার চিকিৎসকরা, তাদের ঔষধপ্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান- নতুন নতুন তত্ত্ব, নতুন নতুন ঔষধ, নতুন চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা উদ্ভাবন করে সগর্বে দাবী করেন যে, তারা চিকিৎসাব্যবস্থার আধুনিকায়ন সম্পন্ন করছেন। কিন্তু এ কথা আশ্চর্য যে, এত মেধাবী লোকগুলো, এটা ভেবে দেখেন না যে- প্রকৃতপক্ষে এটা তাদের দুর্বলতারই নামান্তর, তাদের ভিত্তিহীনতারই প্রমাণ। এটা প্রমাণ করে যে, তারা চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রাকৃতিক, ধ্রুব, অপরিবর্তনীয়, শাশ্বত, বৈজ্ঞানিক মূলনীতি আবিষ্কার করতে সমর্থ হন নি।
আর এখানেই ডা. হানিম্যানের কৃতিত্ব। এই মহাবিজ্ঞানী প্রায় ২৫০ বৎসর আগে আবিষ্কার করেছেন (সম্পূর্ন যুক্তি, প্রমাণ, পর্যবেক্ষণ ফলাফল, অসংখ্য উদাহারণ সহকারে এবং সে অনুসারে মানুষকে সুস্থ করে দেখিয়ে)- মানুষের রোগের কারণ কি? রোগতত্ত্ব ও চিকিৎসাতত্ত্ব কি? আরোগ্য প্রক্রিয়া কি? আজ সমগ্র পৃথিবী জুড়ে যত হোমিওপ্যাথ আছেন, সবাইকে জিজ্ঞাসা কোরে দেখুন, সবাই একবাক্যে একই উত্তর দেবেন এবং সেই অনুসারে মানুষকে আরোগ্য করে দেখাবেন। ২৫০ বছরেও এই সত্যকে আপডেট করার প্রয়োজন হয়নি। এটা যদি পশ্চাৎপদতা হয়- তবে আর্কিমিডিস, নিউটন, নিলস বোর, পিথাগোরাস, গ্যালিলিও, কোপার্নিকাস, এরিষ্টটল, ফ্যারাডে এরা সবাই পশ্চাৎপদ, এদের তত্ত্বগুলোও ব্যবহার অযোগ্য ঘোষণা করে পরিহার করে দেখান।
মনে রাখবেন, ডা. হানিম্যান প্রতিষ্ঠিত ধারার চিকিৎসা ব্যবস্থা ত্যাগ করার কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন- ঔষধের ক্রিয়াধারা ও মানবশরীরে এর প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে অজ্ঞতাকে। এই অজ্ঞতা শুধু তার একার ছিলো না, কারণ উনি তখন ছিলেন সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক, এমনকি গোমেরনের ডিস্ট্রিক্ট মেডিক্যাল অফিসার। সমকালীন সময়ে তার লেখাগুলোকে চিকিৎসাক্ষেত্রে অনুসরণীয় নির্দেশিকা হিসাবে গ্রহণ করা হতো। এই অজ্ঞতা ছিলো পুরো ব্যবস্থাটার এবং তা আজো রয়ে গেছে। একটা ঔষধ সম্বন্ধে পূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে দেখুন, দেখবেন বলা হচ্ছে- এই ঔষধের এই এই এই স্বল্পমেয়াদী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, দীর্ঘমেয়াদী এই এই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এবং আরো কিছু অজ্ঞাত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পরে যখন এই অজ্ঞাত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলোর কিছু কিছু জ্ঞাত হয় এবং লাভের চাইতে লোকসানের পাল্লা ভারী হয়, কোথাও কোথাও প্রতিবাদ, মামলা হয়, এবং ঔষধটিকে বাতিল ঘোষণা করে প্রত্যাহার করা হয়। এরপর নতুন করে শুরু হয় ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞান বিজ্ঞান খেলা এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা সিন্ডিকেটের বিভিন্ন গুটি চালাচালি। আসুন তার কিছু বাস্তব অবস্থা আমরা অবলোকন করি, যেখানে তাদেরই কিছু উদ্ধৃতি আমার কথার সত্যতা প্রমাণ করছে :
প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসাব্যবস্থায় ঔষধশিল্প ও গবেষণার বর্তমান অবস্থা:
বর্তমান প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসা কার্যক্রম তিনটি আলাদা আলাদা শাখায় পরিচালিত হয়, যাদের নিজেদের মধ্যে সত্যিকারের তেমন কোন সংযোগ বা পারস্পরিক তথ্য আদানপ্রদানের ব্যবস্থা নেই। প্রত্যেকেই বলা চলে, স্বাধীনভাবে নিজ নিজ কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে এবং বরাবর নিজেদের মতো করে তার ফলাফল প্রকাশ করছে।
এই আলাদা আলাদা শাখা ৩টি হচ্ছে:
- হাসপাতাল ও জেনারেল প্র্যাকটিস হতে গবেষণাকৃত তথ্য ও ঔষধ
- শিক্ষাকেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্নাতকোত্তর গবেষণা
- পৃথক পৃথক গবেষণা কেন্দ্র
এই তিনটি শাখার মধ্যে, গবেষণা কেন্দ্রগুলোই মূলত এলোপ্যাথিক ঔষধ আবিষ্কার ও বাজারজাতকরণের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে অবস্থান করছে। এই কেন্দ্রগুলোর কাছে জনগণের প্রত্যাশাও অনেক উচ্চ। আধুনিক অতিব্যস্ত জীবনযাত্রায় লক্ষণের দ্রুত অপসারণের মাধ্যমে দ্রুত আরোগ্য প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্ত কার্যক্রমের প্রনোদনা হিসাবে কাজ করে। যে কোন প্রকারে নিত্য নতুন ঔষধের সরবরাহ ও আবিষ্কারে এই প্রতিষ্ঠানগুলো থাকে সদাই কর্মচঞ্চল। কিন্তু অপরদিকে, শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর দিকে তাকালে তুলনামূলকভাবে বরাবর আমরা একটা অচলাবস্থা, পক্ষাঘাতগ্রস্ততাই দেখতে পাই। তারা তাদের নিজেদের চিকিৎসা-সংক্রান্ত চিন্তা থেকে, তাদের নিজস্ব উদ্ভাবনী ক্ষমতা, নিজেদের কর্ম উদ্দীপনা থেকে নতুন গুরুত্বপূর্ণ কোন কিছু প্রদান করতে সচরাচর ব্যর্থই হয়েছে। নিজেদের এই হাস্যকর অবস্থার মধ্যেও, তারা বিকল্প চিকিৎসা আন্দোলন থেকে কোন উন্নত ধারণা প্রদান করা হলে এসব চিন্তাধারা বা ধারণাকে অতি তাত্ত্বিক, বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে অতিকল্পনাকারী তত্ত্ব, বাস্তবতাবিরোধী বিমূর্ত তত্ত্ব বলে হেয় প্রতিপন্ন করে চলেছেন এবং সেগেুলোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছেন।
আর একইভাবে, তাদের চিকিৎসক সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও দেখতে পাই এক নিদারুন জড়ত্ব। প্রখ্যাত চিকিৎসক ও গবেষক রিচার্ড স্মিথ বলেন,
“Medical history is often presented as a series of discoveries and developments, but most of it consists of journeys up cul de sacs”
[Journal of medical ethics, 1992, 18, 117-118, 13]
অর্থাৎ,
“চিকিৎসার ইতিহাসে পুনঃ পুনঃ আবিষ্কার ও ক্রমোন্নয়নের এক ক্রমধারা প্রদর্শন করে গেছে কিন্তু এই উন্নয়নের বেশিরভাগ পরিভ্রমণই শেষপর্যন্ত কানাগলিতে গিয়ে শেষ হয়েছে।”
[Journal of medical ethics, 1992, 18, 117-118, 13]
ক্লিনিক্যাল মেডিসিনে, ঔষধপ্রয়োগবিদ্যার ক্ষেত্রে হতাশাজনকরূপে বার বার এই কানাগলির মুখোমুখি হওয়া সত্বেও গবেষণাকেন্দ্র থেকে প্রবর্তিত ঔষধগুলোর অকার্যকারিতার ব্যাপারে তারা কদাচিৎ কোন অসন্তুষ্টিজনক শব্দ উচ্চারণ করেছেন। নিজেদের অভিযোগ উত্থাপনে ব্যর্থ হয়ে কিংবা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসাসমাজকে বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখী করতে বিরত থাকার অবৈধ সহানুভূতির কারণে, এই তিনটি শাখার মধ্যে যে অতি গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয় প্রয়োজন ছিলো তা সম্পন্ন হয়নি, যা এই চলমান পরিস্থিতির উদ্ভবকে ব্যর্থ করতে পারতো।
এখন গবেষণা কেন্দ্রগুলোর ঔষধবিদ্যার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব নিশ্চিত হয়েছে, পরিণত হয়েছে চিকিৎসা কর্তৃপক্ষে এবং তাদের আবিষ্কারকেই নিরঙ্কুশ ও চূড়ান্ত হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তাদের আবিষ্কারসমূহকে এতটাই আস্থা ও গুরুত্বের সাথে নেয়া হয় যে, কোন কারণে কোন চিকিৎসক তাদের প্রস্তাবিত পদ্ধতে প্রত্যাখ্যান করলে- সে নিশ্চিতভাবেই পেশাগত ঝুঁকির মুখোমুখী হবে, এমনকি তার লাইসেন্সও বাতিল হতে পারে।
একটা উদাহারণ দিয়ে ব্যাপারটা পরিষ্কার করছি। ম্যাকগিল ক্যান্সার সেন্টারের ১১৮ জন চিকিৎসককে নিয়ে একটি প্রশ্নোত্তরের ভিত্তিতে গবেষণা সম্পন্ন করা হয়। যেখানে প্রতি ৪ জন চিকিৎসকের ৩ জন চিকিৎসক নিজেদের বা তাদের পরিবারের কারো ক্যান্সার হলে, পুরো মানুষটির ইমিউনিটি সিস্টেমের উপর কেমোথেরাপির ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার দরুন তা নিতে অস্বীকৃতি জানাবেন বলে উল্লেখ করেন। (S.D. Wells, 25 amazing and disturbing facts about the hidden history of medicine)
সমস্ত ক্যান্সারের মধ্যে মাত্র ২-৪% ক্যান্সার রোগীর ক্যান্সারে প্রতিক্রিয়া আনতে কেমোথেরাপি ক্রিয়াশীল হয় এবং কেবলমাত্র এখানেই, অর্থাৎ এই সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রটিতেই কেমোথেরাপি প্রযোজ্য বলে জানা সত্ত্বেও- আজ প্রায় সব ক্যান্সারের রোগীকে এই কেমোথেরাপি ব্যবস্থাপত্র প্রদান করা হচ্ছে। এরপরও বর্তমানে কোন চিকিৎসকই কি ক্যান্সারের রোগীকে কেমোথেরাপি প্রেসক্রিপশন না করার সাহস পাবেন? যদিও এটা নিশ্চিত যে, কিছু সময় পর তাদের আরো হাজারো পদ্ধতির মতো এই ধরণের চিকিৎসাপদ্ধতিও ফ্যাশন বহির্ভূত হবে এবং সম্ভবত নিষিদ্ধও হবে। এটা মানবজাতির জন্য এত বেশি ব্যথা ও যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ানো সত্ত্বেও, কেউ এই অসঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে কি? প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসাব্যবস্থা এই গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে অতি সামান্য বিবেচনা, মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার এবং অগাধ ভক্তি, প্রেম ও আরাধনা ঢেলে যাচ্ছেন। যদিওবা কিছু প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি এই অসঙ্গতিপুর্ণ চিকিৎসাচর্চার ঝুঁকির ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপণ করছেন, সাথে সাথে তাদের যে রক্ষণশীল চিকিৎসক সম্প্রদায়ের সাথে আছেন, তাদের দ্বারাই একঘরে হয়ে পড়ছেন।
কিন্তু অপরদিকে গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে এক আত্মহারা স্বার্থান্ধ প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিকে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ঔষধ আবিষ্কারের ক্ষেত্রটাতে হারাতেই হবে। এই কাজটা কিন্তু সহজ নয়। কারণ জীবাণুগুলো এতটাই বিধ্বংসী ও বিভ্রান্তিসৃষ্টিকারী যে, কোন বিচক্ষণ গবেষকই এর আরোগ্যের বা আরোগ্যকারী ঔষধের ব্যাপারে কোন স্থির আশ্বাস বা সুনিশ্চিত পূর্বানুমান করতে সাহস করবেন না। গবেষণাকেন্দ্রগুলোতে তারা এলোমেলোভাবে, ঔষধ আবিষ্কারের কোন সুনির্দিষ্ট, প্রাকৃতিক, মৌলিক নীতি ছাড়াই বিভিন্ন ঔষধ পরীক্ষা করেন এবং কোনটা এই জীবানুগুলোক হত্যা বা দূর করতে পারে তা খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা চালান। লক্ষ করার বিষয়, এ পদ্ধতিতে, যে সমস্ত ঔষধের আবিষ্কারকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয় বা হতো- সেগুলো আসলে দৈবক্রমেই প্রাপ্ত হোয়েছে। যেমন- পেনিসিলিন, এসপিরিন ইত্যাদি।
অর্থাৎ থেরাপিউটিক এজেন্টগুলো সৃষ্টির এই পুরো প্রক্রিয়াটা কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম ও নীতির দ্বারা বা কোন যৌক্তিক পদ্ধতির দ্বারা পরিচালিত হয় নি বরং প্রায় ক্ষেত্রেই চালিত হয়েছে কোন এক ব্যক্তির তার ল্যাবরেটরীতে আকস্মিকভাবে ঘটা কিছু ঘটনার পর্যবেক্ষণ থেকে। যেখানে অন্য সব বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রগুলোতে তাদের গবেষণা কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম ও নীতির দ্বারা পরিচালিত হয় এবং এই নীতিগুলোও একটি সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন করে এবং প্রাকৃতিক কিছু মৌলিক সূত্রের উপর ভিত্তি করে নির্বাচন করা হয়- সেখানে বেশিরভাগ চিকিৎসা গবেষণাগুলোই কিছু অনির্দিষ্ট, দৈবায়ত্ত পদ্ধতিতে এলোমেলোভাবে চালিত হচ্ছে। সুতরাং ঔষধবিজ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা না বলে বরং ‘হঠকারী’ বলাই বেশি যুক্তিসঙ্গত।
এই সমালোচনা হয়তো অনেকের কাছে পক্ষপাতদুষ্ট বিচার বলে মনে হচ্ছে; কিন্তু এরপরও এটা সত্যই থেকে যাবে যে, ঔষধবিজ্ঞানের বেশিরভাগ অগ্রগতির জন্য তারা, গবেষণাগার থেকে আকস্মিকভাবে প্রাপ্ত অগ্রগতির প্রতি ঋনী। নুতন ঔষধ বাজারজাত হয় এবং গবেষণাকেন্দ্রটির গবেষণায় প্রাপ্ত ঔষধটির উপযোগিতা উদঘাটনের বিজ্ঞাপনের ভিত্তিতে এই নতুন ঔষধটি চিকিৎসাক্ষেত্রগুলোতে গৃহিত হয়। এই গবেষণলব্ধ ফলাফল কোন কোন প্রাকৃতিক নিয়মের সাথে সম্পূরক হতে হবে এরকম কোন সুনির্দিষ্ট মৌলিক নীতি এখানে নেই। আর এই রকম কোন নিয়মাবলীকে অগ্রাহ্য করে গবেষক ও ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানীর কর্তৃপক্ষগণ কোন শাস্তির ভয় বা অনুশোচনার ভয় ছাড়াই তাদের তারাহুরো করে আবিষ্কৃত ঔষধটি বাজারজাত করে যাচ্ছেন। যদিও এই শাস্তি অনেক পরে প্রায়শঃই সেই সমস্ত রোগীকে সহ্য করতে হয়, যারা এই নতুন ঔষধটি ব্যবহার করে তার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার ফলাফল বহন করে। আর এই ফলাফল কেমন হতে পারে তার একটা উদাহারণ দিচ্ছি। জীবনযাত্রায় অতি উন্নত, চিকিৎসাব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র বলে বিবেচিত ইউনাইটেড স্টেটসের একটি চিত্রের মাধ্যমে। সেখানে –

- প্রতি বৎসর ২৫০০০০ আমেরিকান ব্যবস্থাপত্রপ্রদত্ত ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দরুন হাসপাতালে ভর্তি হন।
- ২০১১ সালে মোট ৩ বিলিয়ন ব্যবস্থাপত্র প্রদান করা হয়েছে।
- ৬০০০০ এর উপর আমেরিকান ২০১১ সালে প্রদানকৃত ব্যবস্থাপত্রের (যেমন- Stelazine or Haldol) পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দরুন পারকিনসন রোগটিতে আক্রান্ত হয়েছে।
- হাসপাতালে ভুল ঔষধ প্রদান করার কারণে প্রতি বৎসর গড়ে প্রায় ৭০০০ লোক মারা যাচ্ছে।
- শুধুমাত্র সংক্রামক রোগের প্রভাবে হাসপাতালে প্রতি বৎসর ৮০০০০ এর উপর লোক মারা যাচ্ছে। (যেখানে প্রদত্ত ঔষধগুলো শুধুমাত্র সত্যিকারের সমস্যার বদলে বহিঃপ্রকাশিত লক্ষণকে অবদমিত করতে সমর্থ হয়েছে)
- প্রতি বৎসর ১০০০০০ লোক ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াতে মারা যাচ্ছে। (এখানে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত হৃদরোগ ও এ সংক্রান্ত আত্মহত্যাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে)
- ক্রনিক রোগাক্রমণ ও তাতে মৃত্যুর সম্ভাবনা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
[S.D. Wells, 25 amazing and disturbing facts about the hidden history of medicine, এবং http://www.websites-host.com/drugs.html,http://www.health-care-reform.net/causedeath.htm, http://www.cancure.org/medical_errors.htm, http://www.naturalnews.com/011764.html ]
সিলভারম্যানের “Pills, Profits & Politics” বইটিতে আমরা একটা প্রোজ্জ্বল আলোচ্য অংশ দেখতে পাই, যেখানে একটি বৃহৎ ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির প্রাক্তন গবেষণা পরিচালক ডা. ডেল কোনসোল একটি সিনেট কমিটির সামনে সাক্ষী দেন :
“বহু সংখ্যক উৎপাদিত দ্রব্যগুলো দেখে এটা পরিষ্কার যে, প্রকল্প পর্যায়ে এগুলো থেকে কোন উপযোগীতা আশা করা হয় না। এই প্রকল্পগুলো যা নিশ্চিত করে তা হচ্ছে বিক্রয়ের আশ্বাস। এগুলো থেকে (স্বাস্থ্যের জন্য হিতকর) কিছু পাওয়া যাবে এ আশায় এ(ই গবেষণা)গুলো চালিয়ে যাওয়া হয় না…….. এগুলো চালিয়ে যাওয়া হয় কারণ এগুলো থেকে মুনাফা আসবে…… যেহেতু নিত্য নতুন বস্তুর প্রতি (সমাজের) অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা সৃষ্টি হয়েছে, কাজেই ঔষধগুলো মেয়েদের পোষাক পাল্টানোর মতো করে পাল্টানো হচ্ছে। এবং এই দ্রুত ফ্যাসন পরিবর্তনের উদ্দেশ্য হচ্ছে (মুনাফা তৈরীর প্রতিযোগিতায়) গতিশীলতা রক্ষা, (ভেষজ-বিজ্ঞানে) কোন উন্নয়ন নয়। সামান্য ভাগ্য, যথাযথ সময় এবং চমৎকার প্রচারাভিযানের মাধ্যমে এক ব্যাগ এসাফিটিডা, একটা স্বতন্ত্র কেমিক্যাল সাইড-চেইন দিয়ে একটি বিস্ময়কর ঔষধরূপে প্রদর্শিত করা যায়। এই বিভ্রান্তি হয়তো বেশিদিন টেকে না কিন্তু বার বার এই পরিবর্তনের ফল হিসাবে (এই একই দ্রব্য বাজারে) যথেষ্ট সময় টিকে থাকবে। কোম্পানিগুলো শুরুতেই যা জানতো, চিকিৎকরাও একটা সময় সেই সত্যটা বুঝতে পারে কিন্তু ততদিনে কোম্পানি সেই পুরাতন ঔষধটির বদলে আরো দুইটি নতুন প্রোডাক্ট উপস্থিত কোরেছে……. ঔষধপ্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো এরকমভাবে শোষণের ব্যাপারে অনন্য, যা দেখতে একটি মহৎ উদ্দেশ্যের পরিপন্থী।” (SILVERMAN M, LEE PR: Pills, Profits & Politics. University of California Press, 1974)

আর এক্ষেত্রে এরপর, গবেষকের ঔষধটির ব্যাপারে এই সুধারণা ততক্ষণ পর্যন্ত নিরঙ্কুস ও প্রশ্নাতীত হিসাবে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত ঔষধটি একটি সত্যিকারের বিপর্যয়সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর দ্রব্য হিসাবে আবিষ্কৃত না হয় অথবা এর দীর্ঘকালীন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যে রোগ আরোগ্যকল্পে তা প্রয়োগ করা হয়েছিলো তার চাইতে খারাপ বলে উন্মোচিত না হয়। এর প্রমাণ হিসাবে দুয়েকটা উদাহারণই বিবেচক ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট হবে বলে মনে করি-
শুধুমাত্র ইউনাইটেড ষ্টেটসে প্রতিবছর ১৫০০০০০ থেকে ৩০০০০০০০ রোগী হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ঔষধের প্রতিকুল প্রতিক্রিয়ার দরুন। কোন কোন হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীর ২০% পর্যন্ত রোগীর রোগগুলি ঔষধ থেকে সৃষ্ট এবং ১৯৬৫ সালের পয়লা জুলাই থেকে ১ বৎসর সময়ের মধ্যে মন্ট্রিয়াল জেনারেল হাসপাতালের পাবলিক মেডিক্যাল সার্ভিসে মোট মৃত্যুসংখ্যার ২৫% মৃত্যু, ঔষধের বিরুপ প্রতিক্রিয়ার কারণে।” (MARTIN EW et al: Hazards of Medication. Toronto: J. B. Lippincott Co., 1971)
প্রতি পাঁচজন রোগীর মধ্যে অন্ততঃ দুইজন রোগী তাদের চিকিৎসকদের নিকট থেকে যে ঔষধ গ্রহণ করে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভুগে থাকেন। (MARTY CR: British Medical Journal, 10 November 1979; 6199: 1194, WEITZ M: Health Shock: A Guide to Ineffective and Hazardous)
এবং হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রতি ১২ জন রোগীর মধ্যে একজন, তাদের চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহৃত ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে ভর্তি হয়ে থাকে। (OWEN D: In Sickness and In Health. London: Quartet, 1976)
আমি এটা অস্বীকার করছি না যে, এই সমস্ত ক্ষিপ্ত এবং প্রক্ষিপ্ত গবেষণা আমাদের মানবশরীরের কার্যপ্রণালী সম্বন্ধে কিছু কৌতুহলোদ্দীপক অর্ন্তদৃষ্টি দান করে কিন্তু এটা কোন নিরাপদ পদ্ধতিতে ঔষধ প্রদান করতে কিংবা এমন কোন ঔষধ আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হোয়েছে- যা কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই মানুষকে আরোগ্য করতে পারে।
আর এভাবেই প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসাব্যবস্থা আজ নিজেকে এমন একটা দুর্বল অবস্থায় নিজেকে নিয়ে গেছে, যেখানে বস্তুত প্রাথমিক গবেষণাগুলোও মানুষের স্বাস্থ্য বা রোগকে সত্যিকারভাবে প্রভাবিত করে এমন কোন মৌলিক প্রাকৃতিক নিয়ম বা নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেনি। কিন্তু অপরদিকে এই ধরনের নিয়ম বা নীতির আবিষ্কার দিনকে দিন অধিক থেকে অধিকতরো প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রায় প্রত্যেকটা বিজ্ঞানই প্রাকৃতিক নীতির উপর গড়ে উঠেছে এবং এজন্যই কেউ সেই নীতিগুলোকে অগ্রাহ্য করার সামর্থ্য রাখে না, কেবলমাত্র এই আধুনিক ‘প্রচলিত চিকিৎসাবিজ্ঞানটি’ ছাড়া। যে অবস্থাটির ব্যাপারে ড. ইলিয়াস যেরোনি বলেন,
“If we keep practicing medicine as we know it today, healthcare will become an unbearable burden on all modern societies in a very near future.”
অর্থাৎ,
“বর্তমানে আমরা যেভাবে চিকিৎসাচর্চা করছি তা যদি এভাবে চলতে থাকে, তবে খুব নিকট ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যসেবা প্রত্যেকটি আধুনিক সমাজের জন্য একটি অসহ্য বোঁঝায় পরিণত হবে।”
[Comment in “The Creative Destruction of Medicine”, Elias Zerhouni, M.D., President Global R&D Sanofi and former director US National Institutes of Health]

এবার এর সাথে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনা:
আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার সর্বাধিক প্রচলিত দুটি ধারার দুটি উদ্ধৃতি আমি উল্লেখ করছি। প্রথমটি হচ্ছে বর্তমান প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থার:
“The purpose of drug therapy is to cure or ameliorate disease or to alleviate symptoms. However, all drugs have adverse effects and before a drug is prescribed clinicians need to weigh the potential benefit of therapy against the potential for doing harm. A good Prescriber: prescribe only when necessary, having carefully assessed the balance of benefit and harm.”
অর্থাৎ,
“ঔষধ প্রয়োগবিদ্যার উদ্দেশ্য হোচ্ছে, রোগীকে আরোগ্য করা অথবা তার অসুখকে হ্রাস করা অথবা তার লক্ষণগুলোকে হ্রাস করা। কিন্তু, সব ঔষধেরই বিরূপ ও প্রতিকূল প্রভাব বিদ্যমান এবং চিকিৎসককে ব্যবস্থাপত্র প্রদানের পূর্বে এর সম্ভাব্য উপকারের সাথে সম্ভাব্য ক্ষতির তুলনা করতে হবে। একজন ভালো ব্যবস্থাপত্র প্রদানকারী: উপকার ও ক্ষতির মাত্রা সতর্কভাবে বিবেচনা করে, শুধুমাত্র প্রয়োজন হলেই ব্যবস্থাপত্র প্রদান করবে।”
(Davidson’s principles and practice of medicine by Sir Stanley Davidson, 21st edition)
আর দ্বিতীয়টি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাব্যবস্থার:
“The physician’s high and only mission is to restore the sick to health, to cure, as it is termed. The highest ideal of cure is rapid, gentle and permanent restoration of the health, or removal and annihilation of the disease in its whole extent, in the shortest, most reliable, and most harmless way, on easily comprehensive principles.”
অর্থাৎ,
“চিকিৎসকের সর্বোচ্চ এবং একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে, রোগীকে অসুস্থতা থেকে সুস্থতায় পুনঃস্থাপিত করা, যাকে বলা হয়- আরোগ্য। আরোগ্যের চূড়ান্ত ও আদর্শ নিদর্শন হচ্ছেঃ
- দ্রত
- সবচাইতে বিশ্বাসযোগ্য
- এবং সবচাইতে ক্ষতিহীন উপায়ে
- অত্যনত্ম মৃদুভাবে (কোনরকম উগ্রতা ব্যতিরেকে)
- সহজ ও বোধগম্য উপায়ে
- স্বাস্থ্যের সম্পূর্ণরূপে পুনঃসংস্থাপন
- এবং রোগকে স্থায়ীভাবে সমূলে উৎপাটন”
(Organon of Medicine by Dr. Samuel Hahnemann, Aphorism – 1 & 2)
প্রথমটি হচ্ছে, প্রতিষ্ঠিত ধারার চিকিৎসাপদ্ধতির বিশ্বজুড়ে সমাদৃত প্র্যাকটিস অফ মেডিসিনের টেক্সটবুক থেকে “What makes a good Prescriber?” শিরোনামের অধীনে লিখিত উত্তর, যে শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তাদের প্রত্যেকটা চিকিৎসক তৈরী হচ্ছেন। আর দ্বিতীয়টি, প্রায় ২৫০ বৎসর আগে ডা. হানিম্যানের লেখা হোমিওপ্যাথির মূলগ্রন্থের প্রথম ২টি সূত্র, যা আজও একইভাবে প্রত্যেকটা খাঁটি হোমিওপ্যাথ অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন।
দুটো উদ্ধৃতিই শুনতে সুন্দর এবং শুধু পড়ার জন্য পড়ে গেলে হয়তো একই রকম শোনা যাবে। কিন্তু খেয়াল করলে দেখবেন, এতে কিছু মৌলিক পার্থক্যও আছে। যেমন, দ্বিতীয় উদ্ধৃতির কোথাও লক্ষণের বা রোগের হ্রাসকে চিকিৎসার উদ্দেশ্য বলে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে না- রোগের স্থায়ীভাবে সমূলে উৎপাটন এবং শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্যের সর্ম্পূণরূপে স্থায়ী পুনঃসংস্থাপনকে বলা হচ্ছে আরোগ্য। তাও আবার ঔষধ প্রয়োগে রোগীর উপকার-ক্ষতির তুলনামূলক বিচার করে নয় বরং সবচাইতে ক্ষতিহীন উপায়ে, এবং কোনরকম উগ্রতা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া, রোগীর শরীরে বা মনে কোনরকম আলোড়ন সৃষ্টি না করে দ্রত আরোগ্যের কথা বলা হোচ্ছে।
যাই হোক, উদ্ধৃতিদুটো উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আরোগ্যের আদর্শরূপ হিসেবে কোনটাকে গ্রহণ করে আলোচনা করবো সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া। আমার মনে হয়, কোন গ্রন্থে কোন উদ্ধৃতি আছে সেটা উল্লেখ না করলে প্রত্যেক মানুষই তার নিজের চিকিৎসার জন্য দ্বিতীয় উদ্ধৃতিকেই আদর্শ আরোগ্য ব্যবস্থা বলে গ্রহণ করতেন, অর্থাৎ হোমিওপ্যাথির আরোগ্যপদ্ধতিকেই শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃতি দিতেন। কাজেই, আরোগ্য কেমন হওয়া উচিৎ সে প্রশ্নের উত্তরে আমি বলবো, যে চিকিৎসাব্যবস্থাই দ্বিতীয় উদ্ধৃতির শর্তগুলো পূরণ করতে পারবে তাকেই আদর্শ আরোগ্য প্রদানকারী চিকিৎসাব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করা যায় এবং জানামতে, হোমিওপ্যাথিই একমাত্র চিকিৎসাব্যবস্থা, যে এর সবগুলো শর্ত পূরণ করতে পারে। কাজেই আদর্শ আরোগ্য বুঝতে হোমিওপ্যাথির এই আরোগ্যের শর্তগুলোকেই আরেকটু ভালোভাবে বুঝতে হবে, তাতে হয়তো হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধে কিছু বিভ্রান্তিরও অপনোদন হবে। আরোগ্যের প্রথম শর্ত হচ্ছে-
দ্রত আরোগ্য লাভঃ হোমিওপ্যাথির ব্যাপারে একটা কথা সার্বজনীনভাবে প্রতিষ্ঠিত যে- হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ধীরে কাজ করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, হোমিওপ্যাথির আবিষ্কর্তা আরোগ্যের প্রথম শর্ত হিসেবে ঠিক এর উল্টো কথাই বোলছেন। তিনি তার গ্রন্থের প্রাথমিক সূত্রের, প্রথম কথাই বোলছেন, আরোগ্য দ্রত হতে হবে। ব্যাপারটা কেমন গোলমেলে হয়ে গেলো না? কিন্তু, ব্যাপারটা আসলে এতটা জটিল কোনকালেই ছিলো না। যে কোন তরুণ রোগে (Acute Diseases), হোক তা Typhoid, Cholera, Measles, Rubella, Diarrhea, Dysentery, Dengue, Acute gonorrhea, Acute Syphilis, সে যাই হোক না কেন, হোমিওপ্যাথিতে সঠিক ঔষধ নিবাচিত হোলে তা অন্যান্য প্যাথির চাইতে অন্তত ৫গুণ দ্রত রোগটিকে আরোগ্য করবে এবং তাও কোন অবশিষ্ট লক্ষণ (Sequelae) ছাড়া। আর যে সমস্ত রোগ পুরাতন বা চিররোগ, যেমন- Chronic Mental Disorder, Hypertension, Asthma, Diabetes, Rheumatism, Hemorrhoids, Fistulae, Hypothyroid, Hyperthyroid, বিভিন্ন Systemic Diseases (Diseases of Kidney, Heart, Lungs, Liver, Gall-bladder, Pancreas etc.) ইত্যাদি রোগ, যেখানে অন্যান্য ব্যবস্থাতে সারাজীবন ঔষধ খেয়ে যেতে হয় এবং তাও আবার অবিরত লাভ-ক্ষতির তুলনামূলক বিচার করে করে, ঔষধ ও মাত্রা পরিবর্তন করে করে। সেখানে যদি ক্রমাগত উন্নতি প্রদান করে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ২ বছর, ৩ বছর, এমনকি ১০ বছরও সময় নেয়, এবং রোগীর স্বাস্থ্যের সামগ্রিক উন্নয়ন করে, রোগীকে আরোগ্য করে- তাকে কি ধীরে কাজ করা বলা যাবে ? কিংবা দেরীতে আরোগ্য হচ্ছে বলা কি ঠিক হবে? আরোগ্য হবার পর রোগীর মুখ থেকে ‘মিরাকল’ শব্দটা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাতে যতবার উচ্চারিত হোয়েছে- অন্য কোন পদ্ধতিতে তার কিয়দংশবারও হয় নি, আর সেটা এমনি এমনি নয়। তবে, যথার্থরূপে প্রশিক্ষিত নন, এমন হোমিও ডাক্তারদের ভুল চিকিৎসার দরুন বা সঠিক ঔষধ নির্বাচনের ব্যর্থতার দরুন যদি কারো আরোগ্য দেরী হয়, সেটার দায় তো আর এই চিকিৎসাপদ্ধতি নিতে পারে না।
সবচাইতে বিশ্বাসযোগ্য,সহজ ও বোধগম্য উপায়ে আরোগ্য লাভঃ বোধগম্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ভর করে, কোনকিছু কতটা যৌক্তিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে তার উপর। যদি জিজ্ঞেস করা করা হয়, তাবিজ-কবচ বা ঝাঁড়-ফুঁক কোন সূত্র (Theory) অনুসারে, প্রকৃতির কোন নীতির উপর ভিত্তি করে কাজ করে কেউ কি বোলতে পারবেন? যেহেতু সেটা বলা সম্ভব নয়, কাজেই একে আদর্শ এবং বৈজ্ঞানিক আরোগ্যপদ্ধতিও বলা যাবে না। কোন এক অবোধগম্য, রহস্যময় পদ্ধতিতে হয়তো এতে কেউ কেউ আরোগ্য হন কিন্তু মানবজাতি একে তার ত্রাণকারী পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না। অভিকর্ষ শক্তি, আলো, শব্দ, বায়ু, সমুদ্রের স্রোত- মহাসৃষ্টির প্রত্যেকটা বস্তু বা বিষয়ই সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক নীতি বা প্রাকৃতিক বিধানের শৃঙ্খলা মেনে চলে। এই বিধানগুলোর জ্ঞানই হচ্ছে বিজ্ঞান। মানুষও স্রষ্টার- মহাসৃষ্টি এবং প্রকৃতির অংশ। তার শরীরও প্রাকৃতিক নীতি বা বিধান মেনে চলে এবং প্রাকৃতিক অন্যান্য বিধানগুলোর সাথে সমন্বয় করে চলে। তার সুস্থ থাকা ও সুস্থ হওয়াও এই প্রাকৃতিক বিধানের অনুকূলে, যৌক্তিক ও বোধগম্য বিজ্ঞানের মাধ্যমেই হতে হবে। কাজেই আপনার আরোগ্যের জন্য এই বিশ্বাসযোগ্যতা ও বোধগম্যতা একটা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। হোমিওপ্যাথি আরোগ্যের প্রাকৃতিক সূত্র আবিষ্কার করেছে এবং সম্পূর্ণরূপে তাকে অনুসরণ করে চলে। আর যে কারণে, এত বছর পরও তার মূলনীতি, ঔষধ, আরোগ্যপদ্ধতি কোনকিছুতেই কোন পরিবর্তন আনতে হয় নি।
কোনরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া, সবচাইতে ক্ষতিহীনভাবে আরোগ্যঃ আপনি আপনার ঘর সাজাতে গিয়ে কি ভালো জানালা, দরজা ভেঙ্গে ফেলবেন? চর্মরোগ সারাতে গিয়ে যদি সার্বিক শারিরীক দুর্বলতা দেখা দেয়, তাহোলে কি ঘটনাটা ঐরকমই দাঁড়ায় না? দরজা, জানালা ছাড়া সুন্দর ঘরে যেমন চোর ডাকাতের আক্রমণের সম্ভাবনা বেশী, দুর্বল শরীরেই তো তেমন অসুখের আক্রমণ বেশী হবে, তাই না? আসলে, প্রাকৃতিক বিধানে কোন বিশৃঙ্খলা নেই। প্রাকৃতিক বিধান অনুসারে চিকিৎসা করলে, তাতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও থাকতে পারে না। হোমিওপ্যাথি- লাভক্ষতির তুলনা করে করে ঔষধ প্রদানের ধারণাকে স্বীকৃতি দেয় না কিংবা হার্টের রোগের চিকিৎসা কোরতে গিয়ে কিডনী রোগাক্রান্ত কোরে, পুরুষত্বহানি করে, মারতে মারতে বাঁচিয়ে রাখার পদ্ধতিকে আরোগ্যপদ্ধতি বলে না। অত্যন্ত মৃদু উপায়ে এবং অল্প ঔষধে মানুষকে তার নিজের শরীরেরই প্রাকৃতিক বিধান, আরোগ্যক্ষমতার উপর ভিত্তি করে আরোগ্য করার পদ্ধতিকেই সমর্থন করে। কিন্তু হাস্যকর বিষয়, বর্তমান সময়ের বস্তুবাদী জটিল মানসিকতাসম্পন্ন মানবজাতির এই সহজ কথাটি বুঝতেই কষ্ট হয়। তারা এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন অল্প ঔষধকেই সন্দেহের চোখে দেখেন। কেউ কেউ এই হোমিওপ্যাথিক ঔষধকে নিছক চিনির দানা, কেউ নিছক এলকোহল বলে প্রচারণা চালান। কিন্তু এটা কি কেউ ভেবে দেখেছেন, চিনির দানা আর এলকোহল তো সব প্যাথির সব চিকিৎসকের ঘরেই রয়েছে, তাহোলে তারা কেন তাদের চিনির দানা আর এলকোহল দিয়ে ক্রনিক সব রোগের মূল উৎপাটনের কাজে হোমিওপ্যাথির মতো সফলতা আনতে পারছেন না ? হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারদের চেয়ে তাদের প্রতি তো রোগীদের আস্থা ও বিশ্বাস অনেক বেশী।
রোগকে সমূলে উৎপাটন করে, স্বাস্থ্যের স্থায়ী ও সম্পূর্ণ পুনঃসংস্থাপনঃ হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধে এই একটি ইতিবাচক কথা সর্বজন প্রতিষ্ঠিত যে, হোমিওপ্যাথি (ধীরে কাজ করে কিন্তু) রোগকে মূল থেকে দূর করে। কিন্তু পরিহাসের বিষয়, যারা এ কথা বলেন, তারাও সম্ভবতঃ এটা চিন্তা করে দেখেন না যে, রোগ যদি মূল থেকেই দূর না হয়- তাহোলে সেটা আরোগ্য হয় কিভাবে? আর এত এত আধুনিক চাকচিক্যময় চিকিৎসাপদ্ধতি, যারা প্রতি বৎসর তাদের চিকিৎসাব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করে চলেছেন, তারা রোগকে মূল থেকে উৎপাটন করতে পারছেন না, অথচ কিনা প্রায় ২৫০ বৎসর আগে আবিষ্কৃত চিকিৎসাপদ্ধতি এবং যার মূলনীতি কিনা একবারও আধুনিকায়ন করা হয় নি- সে একই ভাবে যুগে যুগে রোগকে মূল থেকে উৎপাটন করে যাচ্ছে! সে যাই হোক, আদর্শ চিকিৎসাপদ্ধতির মূল লক্ষ্য তো এটাই হওয়া উচিৎ। আর রোগ সমূলে উৎপাটিত হলেই স্বাস্থ্যের সম্পূর্ণ ও স্থায়ী পুনঃসংস্থান সম্ভব। কাজেই মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ আরোগ্যের জন্য এ দাবী ও শর্ত যথার্থ।
শেষ কথা:
কোন বিজ্ঞানই তার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে তার গবেষণা ও আবিষ্কার সমাপ্ত করতে পারে না। আর লক্ষ্যে পৌঁছানোর পর তার প্রায়োগিক দিকের উৎকর্ষ সাধনের কাজটাই তখন মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। আরোগ্য কিভাবে হবে এবং কেমন হবে, তার রূপরেখা বহু আগেই আবিষ্কৃত। এখন কাজ হচ্ছে তার সফল প্রয়োগ- যে কাজটাই বিভিন্নভাবে অবহেলিত। এর কতকটা রোগীদের সচেতনতার অভাবও বটে। আর অসচেতনতার একটি মূল কারণ হচ্ছে- অজ্ঞতা। এখন এদুটো পদ্ধতির তুলনা করে, অন্তত এটুকু জানা হোলো, চিকিৎসাবিজ্ঞানে কতটুকু যৌক্তিক আরোগ্যের কথা উল্লেখ করা আছে। এবার রোগীদের কাজ হচ্ছে- নিজেদের চিকিৎসাক্ষেত্রে এই রকম যুক্তিসংগত আরোগ্যের দাবী করা। যে চিকিৎসা মানুষকে তার কষ্টকর লক্ষণ থেকে স্থায়ীভাবে মুক্ত করতে পারে না, রোগীর এক দুর্ভোগ দূর করতে গিয়ে আরেক দুর্ভোগের সৃষ্টি কোরবে, এমনতরো চিকিৎসাকে আরোগ্যের হাতিয়ার মনে করে রোগের সাথে যুদ্ধ করতে গেলে সেই যুদ্ধে ভরাডুবি অবশ্যম্ভাবী, আর এর প্রমাণ আমাদের নিজেদের স্বাস্থ্য, আমাদের সন্তানদের স্বাস্থ্য এবং বংশানুক্রমে ক্রমাগত আমাদের স্বাস্থ্যগত দুর্দশার ইতিহাস।
এই হচ্ছে প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থার ভেতরের নগ্নরূপ- যাকে উপরে চকচকে করে সাজিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে; আর অন্যদিকে হোমিওপ্যাথির প্রকৃত চেহারাকে মিথ্যের চাদরে ঢেকে রাখা হয়েছে – তাকে পশ্চাৎপদ, ছদ্মবিজ্ঞান, কুসংস্কার বলে প্রচার করা হচ্ছে। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি- এই প্রচলিত ব্যবস্থা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। এরপরও কি সময় আসেনি, হোমিওপ্যাথির বৈজ্ঞানিক সত্যটিকে মেনে নেবার? এখনো কি মিথ্যে অহংকারে নিজেকে ধ্বংসের পথে ঠেলে না দিয়ে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের মূল, শাশ্বত, চিরন্তন, মৌলিক ও প্রাকৃতিক নিয়ম, বিধান ও তত্ত্বকে বেছে নেবার সময় কি আসেনি?!!!

Discussion about this post