ডা. গোলাম রব্বানী রাসেল:
পার্থিব জীবনে আমরা যে কোন কাজই করি, তা জেনে বুঝে, যাচাই-বাছাই করে সম্পাদন করি। একজন পাগল মানুষকেও যদি জ্বলন্ত আগুনে ঝাপ দিতে বলা হয়, সে আগুনে ঝাপিয়ে পড়বে না। কারণ আগুনে পড়লে পুড়ে যাবে, মরে যাবে- এই বোধটুকু পাগলেরও থাকে।
দুনিয়ার জীবনে বসবাসের প্রয়োজনে এক শতক জমি ক্রয় করতে গিয়ে আগে আমরা ভালভাবে যাচাই করি, জমির দলিলপত্র ঠিক আছে কি-না? জমির দাগ নম্বর, খাজনা-খতিয়ান সব ঠিকঠাক আছে কি-না। মোটকথা সবকিছু যাচাই-বাছাই করে জমি খরিদ করা হয়। কিন্তু সামান্য মূল্যের জমির চাইতে লক্ষ-কোটি মূল্যের এই মানবদেহ অসুস্থ হলে কি যাচাই বাছাই করে চিকিৎসা গ্রহণ করবো না?
কিন্তু কিভাবে বুঝবেন আপনি সঠিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পাচ্ছেন কিনা বা যে চিকিৎসকের নিকট গিয়েছেন, তিনি সঠিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাটা সম্পর্কে জানেন কিনা কিংবা সঠিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা তিনি আপনাকে প্রদান করছেন কিনা?
প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলা চলে, এই প্রশ্নটি হোমিওপ্যাথির সবচাইতে মৌলিক বিষয়- এর সংজ্ঞায়নের সাথে জড়িত। আমাদের হোমিওপ্যাথদের মধ্যেই অনেককেই হুট করে যদি হোমিওপ্যাথি ও একজন হোমিওপ্যাথের সংজ্ঞা জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে হয়তো তাদের দ্বিধায় পড়তে দেখা যাবে, সেখানে রোগীরা সেই সংজ্ঞা আবিষ্কার করে চিকিৎসা নিতে যাবেন, তা আশা করা যায় না।
তথাপি, এই প্রশ্নটা বহুবার বহু স্থানে উচ্চারিত হয়েছে। যখনই আমার সাথে দূরের কোন রোগী তার সমস্যার জন্য যোগাযোগ করে এবং তাকে যখন বলি, নিকটস্থ কোন ‘ভালো’ হোমিওপ্যাথের নিকট চিকিৎসা নিন। তখনই তিনি অবধারিতভাবেই এই প্রশ্নটি করে বসেন, “ভালো চিকিৎসক, তা বুঝবো কিভাবে?”
প্রকৃতপক্ষে মানুষকে যে আরোগ্য করতে পারে সে-ই ভালো চিকিৎসক সন্দেহ নেই। কিন্তু ‘আরোগ্য’ ব্যাপারটিকে যত সরল মনে হচ্ছে- ব্যাপারটি তত সরলও নয়। বেশিরভাগ সময় ‘উপশম’-কেই রোগীগণ আরোগ্য ভেবে বসেন এবং স্বাস্থ্য, অর্থ, সময়, শ্রম – সর্বদিক দিয়ে ক্ষতির শিকার হন। প্রকৃতপক্ষে, হোমিওপ্যাথিতে চিকিৎসার মূলনীতিগুলোকে উপযুক্তরূপে অবলম্বন না করে চিকিৎসা করা হলে, আপাতদৃষ্টিতে সাময়িকভাবে যতই আরাম লাগুক- পরিশেষে রোগীর জন্য তা খারাপ ফলই বয়ে আনে। কাজেই, ভালো চিকিৎসক হিসাবে বিবেচনা করার জন্য- কে কতটা আরাম হয়েছে, তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন- কে কতটা হোমিওপ্যাথির মূলনীতি অনুসরণ করেন।
এখানেও প্রশ্ন থেকে যায়, রোগীদের পক্ষে কি হোমিওপ্যাথির মূলনীতিগুলো জানা সম্ভব? নাকি সেটা বাস্তব সম্মত? না, সেটা সম্ভবও নয়, বাস্তবসম্মতও নয়। আর এজন্যই এই লেখাটির অবতারণা।
বর্তমান সময়ে দেখা যায়, বেশিরভাগ মানুষই চিকিৎসার নামে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের নিকটে গিয়েও প্রতারণার স্বীকার হচ্ছে। সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন- কোনো কিছু যাচাই বাছাই করে ভালোটা গ্রহণ ও মন্দটা পরিত্যাগ করার জন্য। কিন্তু পরম পরিতাপের বিষয়, আমরা বাজারে সাধারণত মাছ, আলু, তরিতরকারী কেনার জন্য গিয়ে যেরকম টিপে টিপে দেখি যে জিনিসটা ভালো আছে কিনা, কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে যেগুলোতে অতটা যাচাই বাছাই করি না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, চিকিৎসার জন্য যাবার পূর্বে আমাদের অনেকেই চিকিৎসক সম্পর্কে কোনো জানার চেষ্টা করি না, বা কোন যাচাই-বাছাই, চিন্তা ভাবনা ছাড়াই কারো কথায়ই প্ররোচিত হয়ে চিকিৎসা নেয়া শুরু করি। এবং এ ব্যাপারে কথা বলতে গেলেও অনেকে প্রশ্ন করেন, কিভাবে আমরা (রোগীরা) বুঝবো যে সঠিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পাচ্ছি কিনা কিংবা তিনি হোমিওপ্যাথি ভাল জানেন কিনা।
যদিও চিকিৎসকের চিকিৎসা বিষয়ক শিক্ষাটা আপাতদৃষ্টিতে জানা সম্ভব নয় তথাপি আমি আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, চিকিৎসকের নিজের ও তার কর্মধারার কিছু বৈশিষ্ট্য বা চিহ্ন আপনাদের সাথে শেয়ার করছি, যা দেখে আপনি বুঝতে পারবেন যে তিনি হোমিওপ্যাথির মূলনীতিগুলোর প্রতি কতটুকু নিবেদিত-
- প্রথমে হোমিও চিকিৎসকের চেম্বারে গিয়ে দেখবেন যে তাঁর চেম্বারে হোমিওপ্যাথি ব্যতীত কি কি ধরনের ঔষধ রাখা আছে (বড় বড় পেটেন্ট বোতল, আয়ূর্বেদী, হারবাল, টনিক, সিরাপ, ট্যাবলেট প্রভৃতি ঔষধ রয়েছে কিনা)। যদি থাকে তাহলে প্রথম দর্শনেই বুঝে যাবেন লোকটির প্রতারণা করার প্রবণতা থাকতে পারে।
- তিনি রোগীলিপি লিখে চিকিৎসা করেন, নাকি মুখে কথা শুনে কিংবা ছোট কোন নোটবুকে নোট রেখেই ঔষধ দিয়ে দেন। মনে রাখবেন, যথাযথ কেইস-টেকিং না করে যে পদ্ধতিতে রোগী দেখা হয়, সেটাতে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগ করলেও সেটা হোমিওপ্যাথি নয়।
- আপনি আপনার সমস্যা নিয়ে তার চিকিৎসার অধীনে যাবার পর, তিনি কি সেই ব্যাপারটিতেই সীমাবদ্ধ থাকলেন, নাকি আপনার অন্যান্য সমস্যাগুলো সহ, আপনার গঠন, ব্যক্তিত্ব, প্রবণতা, অভ্যাস-অনভ্যাস, সংবেদনশীলতা, ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা, বিতৃষ্ণা, পছন্দ-অপছন্দ, বংশগত রোগ প্রবণতা, আপনার জীবনের ও স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক-সম্বলিত ইতিহাস ইত্যাদি সার্বিক ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছেন? এগুলো ছাড়াও সাময়িকভাবে রোগীর উন্নতি হতে পারে, বা রোগী উপশম পেতে পারে কিন্তু অধিকাংশ সময়ই আখেরে তা ভালো ফল বয়ে আনে না। যাকে বলে সত্যিকারের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা- তার লক্ষ হচ্ছে, রোগীকে আরোগ্য করা। আর রোগীর সার্বিক তথ্য, সামগ্রিকতা না বুঝতে পারলে সেটা সম্ভব নয়।
- তরুণ (জ্বর, ঠান্ডা, সর্দি কাশি, ডায়রিয়া, উদরাময় এরকম) রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসক অল্প কিছু কথা জিজ্ঞাসা করে ঔষধ দিতে পারেন- যদিও এরকম বহু ক্ষেত্রেও রোগীকে পুরোপুরি আরোগ্য করতে পূর্বে উল্লেখ করে আসা তথ্যগুলো প্রয়োজন হবে। কিন্তু ক্রনিক (সাধারণভাবে বোঝার জন্য উদাহরণ দিতে গেলে- অনেক দিন যাবৎ মাথাব্যথা, দীর্ঘদিনের আমাশয়, যে কোনো ধরনের বাত ও বাতজ্বর, টনসিলাইটিস, পলিপাস, পাইলস, ব্রাইটস্ ডিজিজ, টিউমার, আঁচিল, যে কোনো ধরনের চর্মরোগ, রিকেটস এরকম) রোগের ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক অবশ্যই আপনার (রোগীর) পূর্ণ কেইস হিস্ট্রি কাগজে (হয়তো কম্পিউটারে) লিপিবদ্ধ করবেন।
- এরপর লক্ষ করার বিষয়, রোগীকে স্টাডি করার জন্য তার কাছে কি পরিমাণে বইপুস্তক রয়েছে। সেটা অবশ্য তার কম্পিউটারেও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে তার কাছে কম্পিউটার ও তাতে রোগীকে স্টাডি করার ম্যাটেরিয়ালস আছে কিনা।
- আপনার সমস্ত বিস্তারিত জানার পর যদি দেখেন যে চিকিৎসক ঐ রোগীলিপিটা নিয়ে বিভিন্ন বই ঘাটাঘাটি করছেন তাহলে আপনি অনুগ্রহ (রোগী) অধৈর্য্য হবেন না, কারণ চিকিৎসক আপনাকে সঠিক ঔষধটা দেবার জন্যই এতো পরিশ্রম করছেন। এটি একজন চিকিৎসকের রোগী ও চিকিৎসার প্রতি গুরুত্বপ্রদান, রোগীকে ভালো করার চেষ্টাকে প্রতিফলিত করে। আরো মনে রাখবেন, হোমিওপ্যাথিতে যে যত বেশি জানবে, তার ঔষধ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে চিন্তার হার তত বৃদ্ধি পাবে, তারা আরো নিখূঁতভাবে দৃশ্যত প্রয়োগযোগ্য ঔষধগুলোর তুলনা করবেন- এটা প্রায় অলঙ্ঘনীয়ভাবে সত্য। কোন কোন রোগীতে তাদের দ্রুত হলেও হতে পারে কিন্তু সর্বসাকুল্যে তিনি এই কাজটি করেন কিনা- সেটা অবশ্যই লক্ষ করবেন।
- যারা প্রেসক্রিপশন লিখে দেন, সেই চিকিৎসকগণ বেশ ঘাটাঘাটির পর আপনাকে একটি ঔষধ বা কদাচিৎ দুটি ঔষধ (sl) দিলে, আপনি সেই চিকিৎসকের চিকিৎসা সানন্দে গ্রহণ করতে পারেন। যারা একসাথে অনেকগুলো ঔষধ দেন- তাদের এই কাজটি হোমিওপ্যাথির মূলনীতি অনুযায়ী সন্দেহজনক।
মনে রাখতে হবে, হোমিওপ্যাথির একটি মূলনীতি হচ্ছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতা। আর ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে ও উপসর্গের পার্থক্যের কারণে কাজের পদ্ধতিতে ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু চিকিৎসক নীতি হিসাবে কি অবলম্বন করেছেন বা মূলত তিনি উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো অবলম্বন করে চিকিৎসা করছেন কিনা- সেটা পর্যবেক্ষণ করে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আপনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সমর্থ হবেন।
Discussion about this post