ডা. ইশরাত জাহান:
আমাদের হোমিওপ্যাথদের প্র্যাকটিসে ঘটা বহু পরিচিত একটি ঘটনার উল্লেখ করে শুরু করছি। রোগীকে এলোপ্যাথিক চিকিৎসক একটা সমস্যার জন্য অপারেশন করাতে বলেছে বলে- এসেছেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা নিতে। তাকে প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট দেখাতে বলায় তিনি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন! কারণটা আর কিছু নয়, সঙ্গে সে কোন রিপোর্ট, কাগজপত্র বা প্রেসক্রিপশন (ব্যবস্থাপত্র) কিছুই আনেন নি। তার বক্তব্য ছিল অনেকটা এরকম যে, “অপারেশনের ভয়ে হোমিওপ্যাথিতে এসেছি এলোপ্যাথি বাদ দিয়ে। হোমিওপ্যাথিতে কি আবার এসব লাগে নাকি!”
অর্থাৎ প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট শুধু এলোপ্যাথরাই দেখেন বা বোঝেন এবং তারাই কেবল প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট বা ডায়াগনোসিস করাতে বলেন। এটা যে শুধু সেই রোগীরই দৃষ্টিভঙ্গি এমন নয়। হোমিওপ্যাথি সম্পর্কে অসংখ্য মানুষের ধারণা এমনকি বহু চিকিৎসকেরও ঠিক এমনটাই। আমার অল্প সময়ের প্র্যাকটিসে আমি এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন বেশ বহুবার হয়েছি। অনেক রোগী পেয়েছি যারা প্যাথলজিক্যাল কোন টেস্ট করাতে বললে বা ডায়াগনোসিস করাতে দিলে আর আসেই না, আবার অনেকে অবাক হন এবং তা গোপন করারও চেষ্টা করেন না। এমনকি অনেক সময় অনেক প্রেগন্যান্ট মহিলাকে আল্টাসাউন্ড করাতেও বহুভাবে বোঝাতে হয়েছে যে, চিকিৎসক যে প্যাথিরই হোক, এটা চিকিৎসার অংশ।
মনে আছে, এক প্রেগন্যান্ট মহিলা বাথরুমে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে বলে আল্টাসাউন্ড করাতে বলার প্রত্যুত্তরে, তাদের বক্তব্য ছিল এই রকম যে, “কম পয়সার জন্য এলোপ্যাথি রেখে হোমিওপ্যাথিতে এসেছি, এখন আবার সেই এলোপ্যাথির মতোই পয়সা খরচ করে টেস্ট করাতে দেন কেন?” তাদের এই অজ্ঞতা যে শুধু হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধেই অজ্ঞতা তা নয় বরং চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কেও অজ্ঞতা। অনেকের মনে থাকে অবজ্ঞার ভাব। তারা মনে করেন- হোমিওপ্যাথরা আবার এসব ডায়াগনোসিসের কী বুঝে? তারা তো লেখাপড়া করেছে হোমিও লাইনে। অর্থাৎ বুঝাতে চায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিজ্ঞানের বাইরের বিষয়। যারা সচেতন তাদেরকে বিষয়টা হয়তো বোঝানো যায় কিন্তু চিকিৎসার ব্যাপারে যাদের সাধারণ ধারণা না আছে- তাদেরকে বুঝানো অনেক সময় কষ্টকর তো বটেই, আবার অনেক সময় একেবারে ব্যর্থ হতে হয়।
কিন্তু আমাদের আসলে যা জানা প্রয়োজন – প্যাথোলজি বা ডায়াগনোসিস শুধু এলোপ্যাথি কেন কোন প্যাথির জন্যই সুনির্দিষ্ট কোন সিস্টেম বা ব্যবস্থা নয় বরং এটি একটি সিস্টেম বা প্রযুক্তিগত কৌশল- যার মাধ্যমে চিকিৎসা সহজতর হয় এবং এটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি ব্যবহারিক শাখা মাত্র। বহু রোগের ক্ষেত্রে রোগীর আভ্যন্তরীণ অবস্থা জানাটা অত্যন্ত জরুরি। বহু ক্ষেত্রে তা প্রাণধারণের জন্য অপরিহার্য কর্মপদক্ষেপটিকে নিশ্চিত করে। টিটেনাস, বসন্ত, কলেরা ইত্যাদি রোগের ক্ষেত্রে প্যাথলজির গুরুত্ব অপরিসীম।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবস্থা এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে রোগীর পূর্ণাঙ্গ তথ্যই একজন চিকিৎসকের প্রয়োজন হয় এবং সেটা এলোপ্যাথির চাইতে বহু বেশি। এটি হলিস্টিক ট্রিটমেন্ট সিস্টেম- যেখানে চিকিৎসা একটা পূর্ণতা লাভ করে। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবস্থা একটি সুষ্ঠু, সুন্দর, শৃঙ্খলিত, অখণ্ড, সার্বিক, আদর্শ ব্যবস্থা- যেখানে মানুষকে অখণ্ডরূপে বিবেচনা করে পূর্ণ সুস্থতার ব্যবস্থাকে নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু তার মানে এটাও নয় যে, হোমিওপ্যাথিতে প্যাথলজিই সব।
হোমিওপ্যাথিতে এ ব্যাপারে নীতি হচ্ছে- প্যাথলজিকে আমরা উপেক্ষা করবো না, বরং এটি হচ্ছে সহায়ক। অনেক ক্ষেত্রে এটি আমাদের ঔষধ নির্বাচনকে সহজ করে তোলে। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের বহু কনফিউশানকেও দূর করতে সহযোগিতা করে থাকে। অনেক সময় আবার প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকে। যেমন ধরুন, আপনি ডায়াগনসিস করে এক রোগীর নিউমোনিয়ার রোগী পেলেন। এই নিউমোনিয়া হচ্ছে রোগীর বর্তমান অবস্থার একটি সাধারণ বিবরণ মাত্র। এবার এই রোগীর সার্বিক লক্ষণসমষ্টি বিবেচনা করতে গেলেন কিন্তু এ ক্ষেত্রে কিন্তু আপনাকে স্মরণ রাখতে হবে- লক্ষণের মূল আক্রমণস্থান, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ, রোগের অগ্রগতির ধরণ, নির্বাচিত ঔষধের গভীরতা ও প্রয়োগযোগ্যতা ইত্যাদি। আপনি চিন্তা করার অবকাশ পাবেন- রোগীর রোগের এই স্তরে গভীর এন্টি মায়াজমেটিক দিতে পারবেন, নাকি আগে দ্রুত উপশমের ব্যবস্থা করে নিতে হবে।
সরাসরি নিউমোনিয়াকে বিবেচনা করে রেপার্টরি বা প্র্যাকটিস অব মেডিসিন থেকে ঔষধ খুঁজতে যাওয়া মোটেও হোমিওপ্যাথিক নীতিসঙ্গত নয়। ধরা যাক, তবু আপনি এভাবেই ঔষধ খুঁজতে গেলেন। এবার বাউনিংহাউসেনের রেপার্টরিতে দেখতে পাবেন- এজন্য বিভিন্ন গ্রেডের ৩৪ টা ঔষধের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আপনাকে কিন্তু এই ৩৪ টা ঔষধ থেকে একটাকে নির্ণয় করতে হবে। এবার সেখানে আপনার প্যাথলজি বা রোগের ডায়াগনোসিস কি সাহায্য করবে? এবার আপনাকে আপনার হোমিওপ্যাথিক চিন্তাভাবনা, জ্ঞান, দর্শন, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি দিয়েই সেই সদৃশ ঔষধটি নির্ণয় করতে হবে।
কিন্তু আবার অন্য একটি ক্ষেত্র- একজন রোগী আপনার কাছে কাশি নিয়ে এসেছে তার আবার কাশির সাথে রক্ত আসে এবং তার ওজনও ধীরে ধীরে কমছে। সেক্ষেত্রে আপনি কিছুটা সন্দিহান হয়ে টেস্ট করিয়ে দেখলেন তার যক্ষ্মা ধরা পড়েছে সেক্ষেত্রে আপনার ধারণাটি স্পষ্ট হলো। এখানে আপনি এর কল্যাণে সঠিক একটা নির্দেশনা পেলেন, রোগীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থার নিশ্চিত জ্ঞানটি লাভ করলেন। কারণ অন্য কোন কারণ থেকেও প্রায় একই রকমের লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারতো।
হোমিওপ্যাথি কখনো এলোপ্যাথির মতো রোগের চিকিৎসা করে না ঠিকই কিন্তু লক্ষণের গুরুত্ব নিঃসন্দেহে হোমিওপ্যাথিতে অপরিহার্য। আমরা যদি সেই দিক থেকেও বিবেচনা করি- তাহলে দেখা যাচ্ছে, কোন ব্যক্তির মধ্যে রোগের লক্ষণাবলীর বা রোগের শেষ অবস্থার নিশ্চয়ই একটা উত্তেজক কারণ থাকে। এক্ষেত্রেও প্যাথলজি আমাদেরকে সেই উত্তেজকটিকে চিনতে বা জানতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। প্যাথলজির মাধ্যমে রোগীর অবস্থার গতি, প্রকৃতি ইত্যাদিও নির্ণয় করা যায়। বহু সময়ই কেবল লক্ষণের বাহ্যিক বিবেচনায় হয়তো আমার মধ্যে একটা অস্পষ্ট ধারণা তৈরি হতে কিংবা ভুল হবার সম্ভাবনা বেশি থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে প্যাথলজি একটা স্পষ্ট ধারণা নিতে সক্ষম।
অনেক ক্ষেত্রে আবার এর উল্টোটাও ঘটে থাকে। সেটা কেমন! আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান মন, আবেগ, আত্মার কথা বিবেচনা করে না। অথচ এমন অনেক রোগীও রয়েছেন যাদের টেস্ট রিপোর্ট স্বাভাবিক কিন্তু তারা বিভিন্ন লক্ষণাবলীতে, উপসর্গে ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। এক্ষেত্রে এসব চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে হোমিওপ্যাথির চিন্তাধারার ভিন্নতা দেখা যাবে। এলোপ্যাথিতে যা রোগ হোমিওপ্যাথিতে তা রোগের শেষ অবস্থা বা রোগের ফল হিসেবে গণ্য। এলোপ্যাথিকরা এই ক্ষেত্রটিতে যেখানে বলবে- “আপনার কোন রোগ নেই, বিশ্রাম নিন, খান, ঘুমান, দুশ্চিন্তা করবেন না” কিংবা অনেককে হয়তো বলে দেন, এটা আপনার ‘মনের রোগ’। সেখানে হোমিওপ্যাথি এই অবস্থাটিকেও রোগের প্রারম্ভিক অবস্থা বলে চিহ্নিত করতে পারে। তার সম্পূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করে আরোগ্যকারী ঔষধ নির্বাচন করে- এই উপসর্গ থেকে রোগীর মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে। বস্তুত প্যাথলজিক্যাল ডায়াগনোসিসে কোন অস্বাভাবিকতা পাওয়া গেলে- হোমিওপ্যাথিতে সেটাকে রোগ নয়, বরঞ্চ রোগের শেষ ফল বা এগিয়ে যাবার পরে প্রকাশিত বহিঃপ্রকাশ বলে বিবেচনা করে। আর এজন্যই আমি হোমিওপ্যাথিকে একটি সার্বিক ও পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা বলে অবহিত করেছি এবং প্যাথলজিকে এর সহায়ক হিসেবে গণ্য করেছি।
হোমিওপ্যাথির মূলনীতিগুলোর একটি হচ্ছে- ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যতা অর্থ্যাৎ প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যেই তাদের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা দ্বারা প্রত্যেককে যেমন পৃথক করা যায়- তেমনি ঔষধ নির্বাচনেও ভিন্নতা থাকে। যেমন ধরুন, একটা পরিবারে সকলের একসাথে ভাইরাল ফিবার বা সিজনাল জ্বর হলো। সেক্ষেত্রে যে কোনো এলোপ্যাথ সাধারণত সকলকে একই ঔষধই দিবেন। কিন্তু ঐ একই প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট দেখে বা একই কারণে কোন হোমিওপ্যাথ কিন্তু আলাদাভাবে সকলের কেস হিস্ট্রি নিয়ে, আলাদাভাবে রোগলিপি তৈরি করে সেভাবেই ঔষধ নির্বাচন করবেন। সেক্ষেত্রে ঔষধ এক বা একাধিক যে কোনটাই হতে পারে কিন্তু নির্ভর করবে রোগীর উপর- রোগের উপর নয়।
হোমিওপ্যাথি – “Treat the patient, not the disease- but know the disease.” এই নীতিটি মেনে চলে। কাজেই সেই ‘Know the disease’ – টুকুতে প্যাথলজি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকগণ সে অনুযায়ী রোগীর চিকিৎসা করে থাকেন- রোগের নয়। মূলত রোগীদের মাঝে ‘হোমিওপ্যাথিতে প্যাথলজি নেই’ – এই ধারণাটি এমনি এমনি সৃষ্টি হয়নি। এটি এলোপ্যাথ বা অন্য কোন প্যাথির চিকিৎসকরাও রোগীর মধ্যে সৃষ্টি করে দেয়নি। রোগীদের মাঝে এই ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে- আমাদের নিকট থেকেই; অতীতে আমাদের কথা ও কাজের ভিত্তিতেই। কাজেই, এই অজ্ঞতার শেকড় খুঁজলে সেটা আমাদের মধ্যেই ফিরে আসবে। এ কারণে, প্রথমে আমাদের চিকিৎসক সমাজের উচিৎ- এ ব্যাপারে নিজের ধারণাকে স্বচ্ছ করা। এর ক্ষেত্র, প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব, সীমাবদ্ধতা, ব্যবহারকে উত্তমরূপে আয়ত্ত্ব করা এবং দৈনন্দিন প্র্যাকটিস জীবনে তার সফল বাস্তবায়ন ঘটানোর মাধ্যমে এ সম্বন্ধে নিজেদের ও রোগীদের বিভ্রান্তির অপনোদন ঘটানো।
Discussion about this post