ডা. অমরনাথ চক্রবর্তী
(শুরুর পর্ব)
Task — A controversy has been prevailing in the homoeopathic school as to the exact meaning of the word Homoeopathy — whether it means only a special form of therapeutics or means a distinct system of medicine.
(একটা বিতর্ক প্রবলভাবে বিদ্যমান হোমিওপ্যাথিতে যে “হোমিওপ্যাথি” শব্দের প্রকৃতি অর্থ কী? এটা কি শুধু বিশেষ প্রকারের ওষুধ প্রয়োগে রোগ আরোগ্য অথবা এটি একটি স্বতন্ত্র বা মৌলিক চিকিৎসা পদ্ধতি?)
যতক্ষণ পর্যন্ত না এই বিতর্কের সমাধান হচ্ছে ততক্ষণ হোমিওপ্যাথির সার্বিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
THERAPEUTIC means, “a branch of medicine concerned with the treatment disease and action of remedial agents.”
অর্থাৎ থেরাপিউটিক বলতে বোঝায়, “একপ্রকার ঔষধ বিদ্যার শাখা- যা রোগের (রোগীর নয়) চিকিৎসা তথা ওষুধের ক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যদি হোমিওপ্যাথি শুধু থেরাপিউটিক বলা হয় – তাহলে তা হোমিওপ্যাথিকে সার্বিকভাবে প্রকাশ করবে না। (ধরুন রোগের নামে ওষুধ কি হোমিওপ্যাথিতে গ্রহণযোগ্য? এটা কি হোমিওপ্যাথির ক্ষেত্রে নীতি সম্মত?)
“SYSTEM OF MEDICINE” is an interdisciplinary field of study that looks at the systems of the human body as part of an integrated whole, incorporating bio – chemical, physiological, and environment interaction.
“সিস্টেম অভ্ মেডিসিন” বলতে বোঝায় চিকিৎসা শাস্ত্র সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে প্রাণরসায়ন, শারীরবৃত্তীয় এবং পরিবেশের মিথষ্ক্রিয়াকে দেহের অখন্ড সমগ্রের অংশরূপে বিবেচনা করা হয়। স়ংজ্ঞায় “Integrated whole বা অখন্ড সমগ্র ” কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোন চিকিৎসা পদ্ধতিকে বোঝার জন্য স়ংজ্ঞা অনুসারে বলা যায় হোমিওপ্যাথি একমাত্র নীতি নির্ভর অখন্ড সমগ্রের চিকিৎসা পদ্ধতি।
এমত অবস্থায় প্রচলিত বিতর্কের অবসানের জন্য হোমিওপ্যাথি শব্দের উৎপত্তি ও ইতিহাস জানার জন্য আমরা ইটাইমোলজি (Etymology) বা শব্দের প্রকৃতি – প্রত্যয় ও মূল – ব্যুৎপত্তি সংক্রান্ত শাস্ত্রের সাহায্য নিতে পারি। এছাড়াও আমরা নির্ভর করতে পারি হ্যানিম্যানের বিবৃতিকে যা তিনি অর্গাননে এই গুরুত্বপূর্ণ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছেন যুক্তিবাদী মননশীল মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্য। এই শব্দের মধ্যে দিয়ে তিনি এক গূঢ় ভাবার্থ বোঝাতে চেয়েছেন।
এবার হোমিওপ্যাথি শব্দকে বিশ্লেষণ করলে পাই – গ্রিক শব্দ হোমোইস (Homois) অর্থাৎ সদৃশ আবার পেথিয়া (Patheia) থেকে এসেছে প্যাথোজ (Pathos) যার অর্থ দৈহিক ও মানসিক দুঃখ কষ্ট অর্থাৎ অসুস্থ মানুষের দৈহিক ও মানসিক দুঃখ কষ্ট, ঐ রকম দুঃখ কষ্ট তৈরি করতে পারে এমন সদৃশ ওষুধের দ্বারা আরোগ্য হবে। এরূপ ব্যাখ্যার পরে আমাদের আর বিতর্কের সুযোগ নাই।
অর্গাননের প্রথম সূত্রটি হলো – চিকিৎসকের মহৎ এবং একমাত্র উদ্দেশ্য, রোগীকে পুনরায় স্বাস্থ্যে ফিরিয়ে আনা, অর্থাৎ নিরোগ করা।
সমস্যা হচ্ছে রোগী (sick) বলতে হোমিওপ্যাথিতে কি বোঝায়। একটু গভীর ও কুস়ংস্কারমুক্ত মন নিয়ে আমরা অর্গাননের সূত্র গুলি, ৩, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫ (বিশেষ করে শেষ সূত্রটি) বারবার পড়ে এবং বোঝার চেষ্টা করি- তাহলে আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারবো রোগী বলতে হ্যানিম্যান পৃথক কোন অস্তিত্বের রোগের কথা বলেন নাই।
আমরা জানি বেশির ভাগ জ্ঞানী বন্ধু রোগের জ্ঞান (knowledge of disease, Aph – 3) বলতে বোঝেন প্রাকটিস অভ্ মেডিসিন ও প্যাথলজির জ্ঞান। সম্ভবত আমার বন্ধুরা হ্যানিম্যানের সমসাময়িক চিকিৎসা পদ্ধতিকে (যার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে হোমিওপ্যাথির সৃষ্টি) উপেক্ষা করে এইরকম ভাবেন। এটা আমার পক্ষে সহজ কাজ নয় রোগী ও রোগের মধ্যে পার্থক্য করা। কিন্তু ব্যবহারিক সুবিধার জন্য আমাদের ভাবতেই হবে আমরা রোগী বা রোগের মধ্যে কোনটি বেছে নেব। প্রতিটি সূত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এখানে অসম্ভব। কিন্তু আমরা ব্যবহারিক সুবিধার জন্য সূত্র গুলির অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করে আমরা সঠিক সিদ্ধান্তে পোঁছাতে পারি। আমরা মনে করি অর্গানন হচ্ছে একমাত্র বিচারক যার উপর আমরা নির্ভর করতে পারি। এখন আমি সংক্ষেপে আমার বিদ্বান বন্ধুদের কাছে আমার চিন্তা-ভাবনা পেশ করছি।
সূত্র — ৩
Knowledge of disease, indication – বলতে বোঝায় কোন কোন লক্ষণে রোগ প্রকাশ পায় অর্থাৎ প্রাণশক্তি কীভাবে আভ্যন্তরীণ বিকৃতি সকল বাইরে প্রকাশ করে আরোগ্যকর ওষুধটির ইঙ্গিত দেয়।
সূত্র — ৬
সুস্থ অবস্থায় মানুষটির যে স্বাভাবিক অবস্থা ছিল এখন রোগে আক্রান্ত হবার পরে যে যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন রোগী নিজে অনুভব করছেন, চারপাশের লোকজন যা দেখেছেন এবং চিকিৎসক যা পর্যবেক্ষণ করেছেন এইসব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য লক্ষণ গুলিই সম্পূর্ণভাবে রোগ প্রকাশ করে। অর্থাৎ এই সব লক্ষণের সমষ্টির দ্বারা প্রকৃত ও বোধগম্য হয় এমন রোগের চিত্র অঙ্কিত হয়।
সূত্র — ৭
আমরা রোগের অস্বাভাবিক লক্ষণ সমূহ ছাড়া কিছুই উপলব্ধি করতে পারি না। সুতরাং সম্ভবপর রোগসৃজনী শক্তির অস্তিত্ব ও রোগ উৎপাদনের সহায়তাকারী অন্যান্য ঘটনা সমূহ বিবেচনা করলে অনুভব করা যায় রোগ ওষুধ প্রার্থনা করে এবং উপশমের জন্য সদৃশ ওষুধটির নির্বাচনের নির্দেশ দান করে।
সূত্র — ৮
(সূচিপত্র হতে) – যদি সব লক্ষণ দূর হয়ে যায় তবে বুঝতে হবে রোগ আভ্যন্তরীণভাবে আরোগ্য হয়েছে। পুরানো চিকিৎসা পদ্ধতি ইহা অস্বীকার করে অজ্ঞতার পরিচয় দেন মাত্র।
সূত্র –৯
সুস্থ অবস্থায় আত্মিক শক্তি (কর্তৃত্বকারি প্রাণশক্তি) দেহকে সঞ্জীবিত করে এবং নিয়ন্ত্রণ করে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে।
সূত্র — ১০
(সূচিপত্র থেকে) – এই আত্মিক প্রাণশক্তি না থাকলে এ দেহ মৃত।
সূত্র — ১১
যখন কোন ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন সর্বশরীরে বিরাজমান আত্মিক স্বয়ংক্রিয় প্রাণশক্তি জীবন নাশের জন্য উদ্যত রোগসৃজনী সূক্ষ্ম শক্তির দ্বারা বিশৃঙ্খল হয়। একমাত্র প্রাণশক্তিই বিশৃঙ্খল হয়ে অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি করে যার ফলে শরীরে নানারকম কষ্টদায়ক অনুভূতি ও নিয়ম বহির্ভূত প্রক্রিয়া উৎপন্ন হয় এবং তাকেই রোগ বলে।
সূত্র — ১২
রোগসৃজনী শক্তির দ্বারা আক্রান্ত প্রাণশক্তি নিজেই রোগ উৎপাদন করে। সুতরাং রোগজ যে বিকৃতি সমূহ আমাদের ইন্দ্রিয়গোচর হয় এবং একই সময়ে সমস্ত আভ্যন্তরীণ পরিবর্তন গুলিও প্রকাশ করে যা এক কথায় সমগ্র রোগটিকেই বোঝায়।
সূত্র — ১৩
(সূচিপত্র থেকে) – যে সকল রোগ শল্যচিকিৎসার যোগ্য নয় সেই সব রোগের ক্ষেত্রে মানবশরীরে ও প্রাণশক্তি হইতে পৃথক কোন বস্তু কল্পনা হচ্ছে অযৌক্তিক ভাবনা। এবং এই ভাবনা অ্যালোপ্যাথিকে এক দারুণ ক্ষতিকর চিকিৎসা পদ্ধতিতে পরিণত করেছে।
সূত্র — ১৪
সর্বপ্রকার আরোগ্যকর রোগ চিকিৎসকের কাছে আত্মপ্রকাশ করে কষ্টদায়ক সঙ্কেতচিহ্ন ও লক্ষণের দ্বারা।
সূত্র — ১৫
যে সূক্ষ্ম শক্তি আমাদের শরীরের ভিতরে অদৃশ্য থেকে আমাদের সজীব রাখে সেই শক্তির বিকৃতির ফলে উদ্ভুত অসুস্থতা এবং সেই শক্তির দ্বারা উৎপাদিত বর্তমান ইন্দ্রিয়গোচর লক্ষণ সমূহ একক পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। তাহারা এক ও অভিন্ন।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, হোমিওপ্যাথিক রোগ সম্পর্কে ধারণা কখনোই প্রাকটিস অভ্ মেডিসিন ও প্যাথলজি নয় বরং প্রত্যেক রোগের অস্বাভাবিক লক্ষণ সমষ্টিই চিকিৎসক লক্ষ্য করেন এবং বিশেষ কৌশল দ্বারা রোগলক্ষণ দূর করে আরোগ্য সাধন করেন এবং পূর্বের স্বাস্থ্যে ফিরিয়ে আনেন।
রোগীকে বাদ দিয়ে রোগ একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন সত্তা বিশিষ্ট একটি বিষয়।
এটি অবশ্যই অ্যালোপ্যাথিক চিন্তাধারা। এখানে আমরা হোমিওপ্যাথিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে রোগের ধারণা সম্পর্কে আলোচনা করছি। কিছুক্ষণ আগে আমরা যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করতে পেরেছি যে- রোগ সম্পর্কে হোমিওপ্যাথিক এবং প্রচলিত প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতির ধারণা এক নয়। রোগীকে গ্রাহ্য না করে প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতি মনে করে রোগ একটি স্বতন্ত্র, স্বাধীন সত্তা-বিশিষ্ট বিষয়। এই কারণে তারা মনে করেন প্রতিটি রোগের জন্য আলাদা আলাদা চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রয়োজন।
তাদের বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট মাপের পরীক্ষাগারে প্রাপ্ত তথ্যের সাহায্যে রোগের নামকরণ করে বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগের দ্বারা চিকিৎসা ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা তারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তারা একটি ওষুধের কার্যকারিতা বিচার করেন নির্দিষ্ট রোগের উপরে ওষুধ প্রয়োগের পরে তাৎক্ষণিক ফলাফলের পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে। কিন্তু তারা কখনোই বিন্দুমাত্র ভাবেন না, একই দেহে বিভিন্ন ওষুধের পারস্পরিক ক্রিয়া একজন দুর্ভাগা রোগীর কতটা ক্ষতি করতে পারে! এটা আমার কাছে বিস্ময়কর- কেন তারা এরূপ বিবেচনা করেন! কেন তারা বিভিন্ন ওষুধের পারস্পরিক ক্রিয়াকে এড়িয়ে চলেন! এটা আমার জানা নেই।
তারা কখনোই বিবেচনা করেন না- মানুষ মন ও দেহের সমন্বয়ে গঠিত এক একক সত্তা। তারা দেহের পৃথক পৃথক অ়়ংশের জ্ঞান অতিশয় দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি করে চলেছেন। কিন্তু তারা তাদের অতিবৃহৎ নিষ্প্রাণ তথ্যভান্ডারকে একটি সজীব বস্তুর এককে সম্মিলিত করতে পারেন না। সেটাই তাদের ব্যর্থতা।
পক্ষান্তরে, হোমিওপ্যাথির তথ্য-ভান্ডার মেটিরিয়া মেডিকা পিউরা, হেরিং গাইডিং সিম্পটমস, অ্যালেন এনসাইক্লোপিডিয়া ইত্যাদির ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এইসব বই থেকে পাই- দেহের বিভিন্ন অংশ তথা মনের উপর ওষুধের কার্যকারিতার তথ্য। এখানে লক্ষ লক্ষ লক্ষণ আছে। আমাদের মহান শিক্ষক হ্যানিম্যানকে বলা যেতে পারে প্রতিভাধরদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের গুরুতর অমীমাংসিত বিষয়টি সমাধান করলেন লক্ষণের মূল্যায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে। লক্ষণের সঠিক মূল্যায়ন অসুস্থ মানুষের প্রকৃত বিমূর্ত চিত্র অঙ্কন করে শরীর ও মনের সমন্বয়ে।
(A thing —-) sufferer, nor to any material cause of disease, nor to any particular isolated symptom or morbid organ.
অর্থাৎ, (হোমিওপ্যাথিতে) রোগের বস্তুগত কারণ, কোন বিশেষ নির্দিষ্ট লক্ষণ বা রোগগ্রস্ত অঙ্গকে রোগের কারণ বলে ভাবা হয় না।