ডা. বিনোদ বিহারী ঘোষ:
[এটি ৩১/১২/৯৪ ইং তারিখে মহাজাতি সদন সেমিনার হলে “হোমিও সমীক্ষা” আয়োজিত বক্তব্যের সারসংক্ষেপ। ১০ ই জানুয়ারী, ১৯৯৬ সালে হোমিওপ্যাথিক ত্রৈমাসিক হোমিও সমীক্ষার ষোড়শ বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যায় পূর্ব প্রকাশিত হয়]
নির্দিষ্ট মায়াজমের বিশ্লেষণ, সংশোধনের জন্য সঠিক নির্বাচনের জ্ঞান ছাড়া চিররোগী চিকিৎসা বর্তমান কালপর্বে অসম্ভব। কারণ আপাত উপশম হলেও রোগটি অনুরূপ ভাবে বা ভিন্নরূপে পুনরাক্রমণ করে। হোমিও বিজ্ঞানের আরোগ্যের লক্ষ্য সম্পাদিত হয় না। ইহার একটি মাত্র কারণ যে আমরা ডা. হ্যানিম্যানের মৌলিক নির্দেশ অমান্য করি অথবা জানি না। দেখা যায় যে সঠিক ভাবে চলতে পারলে প্রকৃত আরোগ্য সম্ভব।
গোড়ার কথা:
হোমিওপ্যাথিকে বুঝতে হলে গোড়াপত্তন থেকে আলোচনা শুরু করা দরকার। ডা. হ্যানিম্যান এর পদ্ধতি মোতাবেক, কিছু সংখ্যক সুস্থ মানুষদের দু’দলে ভাগ করে নিতে হবে। একদল মানুষ চিহ্ন এবং লক্ষণ দ্বারা অসুস্থতা প্রকাশ করলো। আর একদল সুস্থ মানুষের উপর ঔষধ পরীক্ষণ হল। তারাও চিহ্ন এবং লক্ষণ দ্বারা তাদের ঔষধ জনিত অসুস্থতা প্রকাশ করল। ডা. হ্যানিম্যান বলেছেন প্রথম দলের লক্ষনাবলী প্রাকৃতিক রোগের লক্ষণ (Symptoms of Natural disease), অপরটি সুস্থ দেহে ঔষধজ লক্ষণের প্রকাশ (Symptoms of the Drug disease on healthy human being)। সদৃশ-নীতি অনুযায়ী অসুস্থকে আরোগ্যে নিতে হলে সুস্থদেহে পরীক্ষণ প্রাপ্ত লক্ষণাবলীর সঙ্গে মেলাতে হবে এবং রীতি অনুযায়ী ঔষধ প্রয়োগে আরোগ্য লাভে করবে। ইহাই রোগ আরোগ্যের শাশ্বত নীতি। সুতরাং দেখা যায় যে, রোগ আক্রমণের পূর্বে মানুষটি সুস্থ ছিল এবং অপর মানুষের মাধ্যমেই প্রুভিং হলো।
সদৃশ নীতি আবিষ্কারের প্রথম পর্ব:
১৭৯০ খৃস্টাব্দে হ্যানিম্যান চায়না দ্বারা তাঁর পরীক্ষা আরম্ভ করেন। সুদীর্ঘ ৫০ বছর ধরে ৯০ টি ঔষধ পরীক্ষা করেন এবং সুস্থ মানুষের উপর ইহার কার্যকারিতা বিষয়ে তার পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করেন। প্রথম দিকে প্রাপ্ত ঔষধগুলি দ্বারা অসুস্থদের চিকিৎসা আরম্ভ করেন এবং হোমিওপ্যাথির যথার্থতা প্রমাণিত হতে থাকে। কিন্তু তিনি লক্ষ্য করেন যে আরোগ্যপ্রাপ্ত মানুষ পুনরায় আক্রান্ত হচ্ছে অনুরূপ বা ভিন্নরূপ অসুস্থতায়। তিনি এই পর্যায়ে ৬৭টি ঔষধ প্রুভিং করেন এবং উক্ত ঔষধগুলি ব্যবহার করেও প্রকৃত আরোগ্য সম্ভব হল না।
দ্বিতীয় পর্ব:
ডা. হ্যানিম্যান চিকিৎসা কার্য চলাকালীন-ই গবেষণায় রত হলেন এবং দীর্ঘ ১২ বছর ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তিনি এই সিদ্ধান্তে এলেন যে, চিররোগের মূল কারণ হলো- সোরা, এবং সাইকোসিস ও সিফিলিস। এরা মিলিতভাবে বা এককভাবে রোগীর দেহে রোগ সৃষ্টির কারণ হয় অথবা প্রকৃত আরোগ্যে বাঁধা সৃষ্টি করে। এর নাম দিলেন মূল কারণ বা মায়াজম (Fundamental cause)। এই সব সাধারণ ঔষধে মায়াজম সংশোধন করা সম্ভব নয়- এটা বুঝেই, মায়াজম বিরোধী ঔষধের প্রুভিং শুরু করেন। এই সব গবেষণালব্ধ তত্ত্ব এবং তথ্য তাঁর সুবিখ্যাত “ক্রনিক ডিজিজ” পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেন।
[বলা হয় তিনি ৯০টি ঔষধ Proving করেছেন। মেটেরিয়া মেডিকা পিউরাতে আছে ৬৭টি এবং ক্রনিক ডিজিজে আছে ৪৮টি মোট – ১১৫টি । হয়ত তাঁর শিষ্যরা ২৫টি ঔষধের Proving করেছেন।]
মায়াজম আবিষ্কারের পর তিনি এবং তাঁর শিষ্যগণ চিররোগ আরোগ্যে ইপ্সিত আরোগ্য অর্জন করতে থাকেন। ১২ বছর গবেষণার ফলে মায়াজম আবিষ্কৃত হলো। এই সময় তিনি অনেক বিষয় পর্যবেক্ষণ করেন। ৩টি মূল কারণ ছাড়াও আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ক্রনিক ডিজিজে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যা আমরা সার্বিকভাবে নজর দিই না বা কাজে লাগাই না।
দ্বিতীয় পর্বে আরো কিছু বিসদৃশ ঔষধ ঘটিত রোগ:
“ক্রনিক ডিজিজ” এর প্রথম পাতায় তৃতীয় প্যারায় তিনি বলেছেন,
“এলোপ্যাথিক ঔষধের প্রতিক্রিয়ার ফলে অসংখ্য ব্যাধি হয় যা আরোগ্য অযোগ্য অবস্থায় চলে যায় এবং প্রাকৃতিক রোগ (Natural disease) থেকে আরও কঠিন হয়ে পড়ে।”
অর্গাননের ৭৫ সুত্রে বলা হয়েছে যে,
“মানব স্বাস্থ্য ক্ষয়কারী এলোপ্যাথিক চিকিৎসা সর্বাপেক্ষা শোচনীয় এবং দুরারোগ্য। ইহাদের মারাত্মক অবস্থাকে আরোগ্য সাধনের কোন ঔষধ আবিষ্কার বা নির্বাচন করা একান্ত দুঃসাধ্য।”
৭৬ সূত্রে বলা হয়েছে যে,
“কেবল মাত্র প্রাকৃতিক রোগ হতে হোমিওপ্যাথি মানুষকে মুক্ত করতে পারে। মানব দেহ এই সব ভূয়া চিকিৎসার ফলে যে বিকৃতি সাধিত হয়- তাহার প্রতিকার কেবল মাত্র জীবনীশক্তিই করতে পারে। ইহা সম্ভব একমাত্র জীবনীশক্তি যদি সবল থাকে।”
বিসদৃশ ঔষধের বিষক্রিয়া সম্বন্ধে সতর্কবাণীতে তিনি বলেছেন,
“এসব রোগীদের ঔষধ না দিয়ে কয়েক মাস গ্রামাঞ্চলে পাঠিয়ে দেবে। যদি জীবনীশক্তি সবল হতে থাকে, তবে সোরাবিরোধী ঔষধ দিয়ে তার বিষক্রিয়া মুক্ত করার চেষ্টা করা যেতে পারে।”
তারপর তিনি নবীনদের সতর্ক করে বলেছেন,
“তরুণ হোমিওপ্যাথ তোমরা অর্থ, যশ আকাঙ্ক্ষা করো, কিন্তু চূড়ান্ত অসাফল্য তোমাদের সব আশা নির্মূল করে দেবে- যদি এলোপ্যাথ ফেরত রোগির দায়িত্ব গ্রহণ করো!”
[Beheading of the hydraheaded”, Jain, page 26, 27]
এই ভাবে বিভিন্ন জায়গায় বিসদৃশ ঔষধ সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে রোগী এলে বিদেয় করে দেয়া সম্ভব না হওয়ায় আমাদের পূর্বসূরীগণ কিছু সোরা বিরোধী এবং অন্য ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা করে সুফল পেতে থাকেন এবং এইভাবে পরবর্তী বছরগুলি চলতে থাকে। কিন্তু বর্তমান অ্যান্টিবায়োটিক, স্টেরয়েডের যুগে সালফার, নাক্স, ক্যাম্ফর কাজ করছে না। চিন্তাশীল হোমিওপ্যাথগণ ঔষধের বিষক্রিয়া, পার্শ্বক্রিয়া সংশোধনের জন্য ব্যবহৃত ঔষধটিকে হোমিও রীতি অনুযায়ী শক্তিকৃত করে ব্যবহার করছেন এবং ছদ্ম আবরণ উন্মুক্ত হয়ে প্রাকৃতিক রোগের লক্ষণাবলী সঠিকভাবে পাওয়া যাচ্ছে। অথবা চিররোগ সদৃশ অবস্থা পরিষ্কার হয়ে রোগী প্রকৃত আরোগ্য লাভ করছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ প্রয়োজন যে, এলোপ্যাথগণ একই সংগে অনেক ঔষধ ব্যবহার করেন কিন্তু রোগীর দেহে যে ঔষধটির লক্ষণ প্রকাশিত হয়- সে ঔষধটিই শক্তিকৃত করে দিতে হয়। বর্তমান চিকিৎসা ক্ষেত্রে আমাদের এ বিষয়টি উপেক্ষা করলে সঠিকভাবে রোগীকে আরোগ্যের দিকে নিয়ে যেতে পারবো না।
পরিবেশ এবং খাদ্য সামগ্রী – এক ভয়াবহ চিত্র:
বিসদৃশ ঔষধঘটিত অসুস্থতা আলোচনা প্রসঙ্গে পরিবেশ এবং বর্তমান যুগের খাদ্য সামগ্রীর রসায়ন ঘটিত অবস্থা বহু গুরুতর রোগের সৃষ্টি করছে। যদিও এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ আছে, আমরা সাধারণ ভাবে কিছু উল্লেখ করছি। দূষিত আবহাওয়া শ্বাসযন্ত্রের বহু রোগের কারণ হয়। শহর বন্দরে উনান, পেট্রল, ডিজেল-জাত ধোঁয়া কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন-মনো অক্সাইড নির্গত করে বায়ু মণ্ডলকে কলুষিত করে, কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া আকাশসীমাকে কলুষিত করে। অক্সিজেন সমৃদ্ধ বাতাসের অভাব মানুষকে স্থায়ীভাবে হাঁপানি, টিবির কবলে নিয়ে যাচ্ছে।
খাদ্যে ভেজালজনিত অবস্থা ছাড়াও কীট-নাশক এবং সার নিয়মিত খাদ্য-সম্ভারকে পুষ্টির বদলে বিষে পরিণত করছে। ভারতের প্রতিটি মানুষকে আয়োডিনযুক্ত লবণ খেতে বাধ্য করা হচ্ছে। বর্তমানে থাইরয়েডের সমস্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, Iodized salt একক কারণ হতে পারে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। যদিও এলোপ্যাথরা হরমোন দ্বারা চিকিৎসাকে একটি বিশেষ মাত্রা দিচ্ছেন। হয়ত বা তার ফলে থাইরয়েডের সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়াও ডিম, মাংস প্রভৃতিকে হরমোন খাদ্য দ্বারা উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যবস্থা নিয়েছেন ব্যবসায়ীগণ।
সার, কীটনাশক সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে “মাটির প্রথম স্তর ধ্বংস হয়ে গেছে সার এবং কীট নাশকের কল্যাণে। জমিকে উর্বর করার জন্য ক্রমাগত বেশি এবং মারাত্মক রসায়ন ব্যবহার করা হচ্ছে। ফল, সব্জি এবং শস্য সংরক্ষণের জন্য শুধু কীটনাশক বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে তা নয়, বীজগুলিকে ক্রিয়োজোটে সিক্ত করে নেয়া হচ্ছে। এই সব ক্ষেত্রে Lead, Arsenate, Copper sulphate, Sulphur, Bordeaux mixture, Paris green এবং আরো অনেক রসায়ণ যেমন 2-4-D, D. D. T. প্রভৃতি ব্যবহার করা হচ্ছে।
ফলে আমরা যে সব রোগীদের বর্তমানে দেখছি তারা প্রাকৃতিক রোগের (Natural disease) লক্ষণ দিচ্ছে না। দিচ্ছে এই সব রসায়ণগুলির লক্ষণ যা আমরা দৈনিক খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছি। (Dr H W Eikenbarry, MD in “The Homoeopathic Prestige”, March, 1994, page- 116).
এসব ক্ষেত্রেও চিকিৎসক যদি নিয়ম মাফিক চিন্তা করেন এবং যা করা হয়, তাতে কোন লাভ হচ্ছে না। এ সমস্যার সমাধান কি ভাবে হতে পারে সে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন।
ফিক্সড্ মায়াজমের দুর্বোধ্য গভীরতা:
চিররোগ সংক্রমণ থেকেই হয়ে থাকে। সোরা অতিদ্রুত সংক্রমণ হয়। সিফিলিস কলুষিত যৌন সম্ভোগ থেকে সংক্রমণ হয়। পরবর্তী সময় এই সংক্রমণের কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ না থাকলেও কিছু অবস্থার সৃষ্টি করে, যা থেকে আমরা মায়াজমগুলিকে চিহ্নিত করতে পারি। এই অবস্থাকে বলা হয় বিশেষ মায়াজমের অবস্থা (Miasmatic state)। এরা প্রচ্ছন্ন (Latent ) অথবা গৌণভাবে (Secondary) প্রকাশিত হয়। প্রচ্ছন্ন বা গৌণ মায়াজমেটিক অবস্থার প্রকাশ লক্ষণ দ্বারা সূচিত হয়- যেসব ডা. হ্যানিম্যান এবং তাঁর শিষ্যগণ পৃথক করতে সক্ষম হয়েছেন।
কিন্তু ফিক্সড মায়াজম সম্বন্ধে ডা. হ্যানিম্যান যে সকল রোগের নাম বলেছেন তাদের যাপ্য ক্রিয়াকান্ড পরিষ্কার ভাবে লক্ষণ দিয়ে ধরা খুবই কষ্টকর। এই কারণেই হয়ত বা এর গভীরতা সম্বন্ধে আমরা বিশেষ নজর দেই না। ডা. এম. এল. টাইলার এ সম্বন্ধে অনেক আলোচনা করেছেন। আমরা তাঁর লেখার কিছু অংশ উল্লেখ করছি। ডা. টাইলার বলেছেন তাঁর মর্বিলিনাম ঔষধটি প্রসঙ্গে ডা. হ্যানিম্যানের বক্তব্য উদ্ধৃতি দিয়ে। (যা “ক্রনিক ডিসিজ” ভলুম-১ এ আছে)।
ডা. হ্যানিম্যানের বক্তব্য
“সর্বপ্রকার চিররোগে উৎপত্তি যা মূলত বিশেষ একটি সংক্রমন দ্বারা সংগঠিত হয়। এই সংক্রমণ ও তার জীবাণুর ক্ষতিকর শাখা প্রশাখা মানব দেহে বিস্তার লাভ করে এবং বৃদ্ধি পেতে থাকে অবিরত ভাবে তার কোন শেষ নেই।”
“কিছু রোগ, যেমন গুটি বসন্ত, হাম, প্রকৃত স্কার্লেট ফিভার, যৌন রোগ, উল শ্রমিকদের চুলকানি, রেবিজ সংক্রমণ, হুপিং কাশি ইত্যাদি এক ধরণের বিশেষ নির্দিষ্ট জীবাণু দ্বারা সংক্রমণ ঘটে- যার চরিত্র বরাবর একই ধরণের থাকে। তারা সর্বদাই একই ধরনের থাকে বলে, সবসময়ই তাদের চেনা যায়। তাদের নামকরণ করা যায়।”
এই সব রোগের সংক্রমণ মুহুর্ত মধ্যে সংগঠিত হয়। এর পর ডা. টাইলার বলেছেন যে,
“কিছু তরুণ রোগ সম্পূর্ণভাবে আরোগ্য হয় না, আংশিকভাবে সুস্থ হয় এবং রুগ্নতা এবং আঘাতকে ঈষৎ পরিবর্তন করে যাপ্য অবস্থায় থাকে। পুরোপুরি সুস্থ ভাবে ভবিষ্যতে কখনো থাকে না।”
এই ধরণের অভিমত ডা. ডি. এম. ফাউবেস্টার, ডা. এস. পি. দে প্রভৃতি বার বার ব্যক্ত করেছেন। তা হ’লে দেখা যাচ্ছে যে আপাত রোগমুক্তি ঘটলেও এই সব ফিক্সড মায়াজম ঘটিত রোগের সমারোগ্য অবশিষ্টাংশ রোগীর দেহে থেকে ক্রনিক রোগ সদৃশ লক্ষণাবলী প্রকাশ করে- যা কখনই প্রাকৃতিক রোগ লক্ষণ নয়। এই কারণেই এই সব লক্ষণের সমষ্টির ভিত্তিতে ঔষধ প্রয়োগে কখনোই রোগীকে আরোগ্য করে না।
পরিবর্তিত অবস্থা:
ডা. হ্যানিম্যান তিনটি মায়াজম ছাড়াও উপরোক্ত তত্ত্বগুলি সম্বন্ধেও আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু আমরা মোটেই গুরুত্ব দিয়ে দেখি নাই সুদীর্ঘ সময়। ফলে যেন মায়াজম তত্ত্ব আবিষ্কারে পূর্ব অবস্থা ঘিরে আসছে। চিররোগসমূহ আপাত আরোগ্য হয়েও ঘুরে ঘুরে ফিরে আসছে। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে,
১) প্রাকৃতিক রোগের লক্ষণাবলী ছদ্ম আবরণে আচ্ছন্ন থাকছে।
২) সুস্থদেহে প্রুভিং এর প্রাপ্ত লক্ষণাবলী সেই কারণেই সদৃশ মনে হলেও সদৃশ হচ্ছে না।
৩) ফলস্বরূপ অর্গাননের ২নং সূত্র অনুযায়ী আরোগ্য হচ্ছে না।
৪) ঘটনাগুলি এমন হবার কারণ আমরা ডা. হ্যানিম্যানের নির্দেশ মানছি না। অথবা বুঝে নিতে পারছি না। এবং আমাদের সে চেষ্টাও নেই।
৫) এই সব বাঁধা সৃষ্টিকারী উপাদানগুলি কারণ তত্ত্বের অঙ্গীভুত যা অতীত এবং পারিবারিক ইতিহাসেই আছে।
৬) প্রসঙ্গত কারণতত্ত্ব সম্বন্ধে ডা. হ্যানিম্যান বিশেষ নজর দিতে বলেছেন। এবং বলেছেন যে ‘কারণ’ একটি প্রধান চরিত্রগত লক্ষণ।
প্রথমেই আমরা কারণ নিয়ে চিকিৎসা শুরু করব (Cause first)। চরিত্রগত লক্ষণই হবে লক্ষণসমষ্টির মূল কথা (সূত্র ১৫৩)। ডা. হ্যানিম্যানের নির্দেশে ডা. বোনিংহোসেন যে লিস্ট দিয়েছিলেন তাতে চরিত্রগত লক্ষণের ৭টি উপাদান আছে। গঠন, অনুভূতি, স্থান, কারণ, হ্রাস-বৃদ্ধি সময় অনুযায়ী এবং অবস্থা অনুযায়ী ও সহযোগী লক্ষণ (Lesser Writings) । ক্রনিক ডিজিজের ১২১ পাতায় দেখা যায়, তিনি লিখেছেন- Internal cause and cause of continuance এর উপর বেশি নজর দিতে। আমরা এসব গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করি না।
আমাদের করণীয় কাজ:
আমরা দেখেছি, আমাদের সহযোগী চিকিৎসকগণ দেখেছেন যে, অতীত ইতিহাসের গুরুত্ব অপরিসীম। এই পরিপ্রেক্ষিতে ঔষধ নির্বাচনের ফলাফল কি হয় তা আমরা আলোচনা করব-
১) অতীত ইতিহাসের সূত্র ধরে ঔষধ নির্বাচন হলে এবং সঠিক মাত্রা ও শক্তিতে প্রয়োগ হলে প্রায়ই রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময় মায়াজম বিরোধী এবং ধাতু প্রকৃতি অনুযায়ী ঔষধ প্রয়োগে স্থায়ী আরোগ্য হয়।
২) অতীত রোগের অনারোগ্য অবশিষ্টাংশ যাপ্য অবস্থায় থেকে প্রকৃত রোগের লক্ষণ প্রকাশ হতে দেয় না। অতীতের সূত্র ধরে ঔষধ দিলে যাপ্য অবস্থা অপসারিত হয়ে প্রকৃত রোগ লক্ষণ প্রকাশ পায়, তখন লক্ষণ সমষ্টির ভিত্তিতে ঔষধ নির্বাচন হলে রোগী আরোগ্যের দিকে যেতে থাকে।
৩) একটি রোগীর অতীত ইতিহাসে অনেক ঘটনা থাকতে পারে। যেমন অর্জিত মায়াজম ছাড়াও হাম, বসন্ত, মাম্পস, ডিপথেরিয়া, টাইফয়েড,ম্যালেরিয়া, র্যাবিস সংক্রমণ, আঘাত, অস্ত্রপচার, আগুনে পোড়া, এলোপ্যাথিক ঔষধের বিষক্রিয়া, ক্রমাগত গর্ভপাত ইত্যাদি। প্রায়ই রোগীদের মধ্যে একটির বেশি সংক্রমণ থাকে। আমরা তৎকালীন লক্ষণগুলি বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারব কোন্ রোগটি যাপ্য অবস্থায় রোগীর দেহে বিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। সে সূত্র ধরেই নির্বাচন হবে।
৪) রোগীর দেহে অন্য সংক্রমণের ইতিহাস থাকলে উক্তটিরও সংশোধন দরকার হবে প্রয়োজন মত। ঔষধ প্রয়োগ ক্ষেত্রে সময়ের ব্যবধানে পুনঃ প্রয়োগ দরকার হয়।
৫) বিসদৃশ ঔষধের ক্ষেত্রে যা করা দরকার। যে ঔষধটির লক্ষণ পাওয়া যাবে সেটিকে শক্তিকৃত করে প্রয়োগ করতে হবে। এলোপ্যাথিক ঔষধের প্রুভিং হয়েছে। তা ছাড়া প্রতি ঔষধের বিষক্রিয়া, পার্শ্বক্রিয়ার কিছু লক্ষণ পাওয়া সম্ভব।
প্রয়োগ–রীতি সম্বন্ধে কিছু বক্তব্য:
১) বিশেষ রোগটি হবার পর থেকেই শরীর অসুস্থ যাচ্ছে অথবা বর্তমান রোগটি হয়েছে।
২) অতীত ইতিহাসে উল্লেখিত রোগ অথবা রোগগুলি থাকলে যে রোগের চরিত্র চেহারা কিছুটা সাদৃশ থাকবে সে ক্ষেত্রে উক্ত রোগটির নোসোডস্ দিতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে হামের পর চর্মরোগ অথবা পরবর্তী সময়ে দীর্ঘকাল ব্যাপী চর্মরোগ চলতে থাকলে Morbilinum দিতে হবে। চর্মের উপরই হামের প্রকাশ বেশি থাকে। তেমনি মাম্পসের প্রভাব গলার নিকটবর্তী গ্লান্ডগুলির উপর বেশি থাকে। এসব ক্ষেত্রে Parotidinum দিতে হয়। ডিপথেরিয়ার পরবর্তী অবস্থায় লেরিংস, ফেরিংস, টনসিল, ট্রাকিয়া প্রভৃতির বিক্রিয়ায় Diphtherinum দিতে হবে। এই ভাবে অবস্থা বিচার করে আমরা নির্বাচন করব।
৩) যদি দেখা যায় যে রোগ লক্ষণ প্রকাশে বাধা সৃষ্টি হয়েছে অথবা প্রকৃত নির্বাচন করা যাচ্ছে না অথবা নির্বাচিত ঔষধ ঠিক মত কাজ করছে না সেখানে অতীত ইতিহাসের উক্ত রোগ গুলি কিছু থাকলে তার নোসোডস্ দিতে হবে।
৪) বর্তমানে নানা প্রকারের টীকা প্রথা চালু থাকার ফলে টীকা জনিত প্রতিক্রিয়া বাধা সৃষ্টি করতে পারে। সে সব ক্ষেত্রেও নোসোডস্ গুলি ব্যবহার করতে হতে পারে।
৫) কুকুরের কামড় অথবা বিড়াল, ইঁদুর, বানরের কামরের ইতিহাস থাকলে অথবা/ এবং রেবিজ সিরাম ইঞ্জেকসনের ইতিহাস থাকলে Lyssin দিতে হবে।
৬) ডা. টাইলরের বক্তব্য, হাম মানুষের জীবনে হয়েই থাকে, হয়ত ধরা পড়ে না । দীর্ঘস্থায়ী অনারোগ্যতার ক্ষেত্রে Morbilinum চিন্তা করা হয়।
৭) শুধু নোসোডস্ এ রোগ আরোগ্য হয়ে যায় না। বাঁধা অপসারিত হয়, অথবা আঘাত রোগলক্ষণ নির্মূল হয়ে যায়। কিন্তু পরে মূল মায়াজম সংশোধনকারী এবং চেহারা চরিত্র (Constitution) মত ঔষধ দিতে হয় স্থায়ী আরোগ্যের জন্য।
উপসংহার:
নির্দিষ্ট মায়াজম সম্বন্ধে আলোচনা হলো। আমাদের অভিজ্ঞতা এই শিক্ষাই দেয় যে বর্তমান যুগের রোগ সমুহের জটিল অবস্থা আরোগ্য সম্ভব করে তুলতে হলে এই ধারায় চিন্তা না করে উপায় নেই।
Discussion about this post