ডা. মাহবুব আলম মাহফুজ:
নভেল করোনা ভাইরাস সর্ম্পকে ইতোপূর্বে অজানা ছিল। যা সম্প্রতি চীনে অনেক মানুষের ফুসফুসের মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করেছে এবং অন্যান্য দেশেও এটি ধরা পড়েছে। চীনের উহানে গত ডিসেম্বর মাস থেকে সনাক্ত হওয়া ভাইরাসে আক্তান্ত হয়ে এ পর্যন্ত ৮০ জনের বেশী মানুষ মারা গেছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।
নভেল করোনা ভাইরাস-২০১৯ (২০১৯-nCoV) যা উহান করোনা ভাইরাস নামে পরিচিত। ইহা একটি সংক্রামক ভাইরাস যা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যেমে সংক্রমণ ঘটায় এবং একজন মানুষ থেকে অন্যজন মানুষের মাধ্যমে ছড়ায়। ধারণা করা হয়, করোনা ভাইরাস চীনের উহান শহরের একটি বন্যপ্রাণীর বাজার থেকে ছড়ায় এবং পরবর্তীতে মহামারী আকার ধারণ করে।

কীভাবে ছড়িয়েছে এই ভাইরাস?
প্রাণী থেকেই প্রথমে কোনও মানুষের দেহে ঢুকেছে তারপর মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়েছে। এর আগে সার্স (SARS) ভাইরাসের ক্ষেত্রে প্রথমে বাদুড় পরে গন্ধগোকুল থেকে মানুষের দেহে ঢোকার নজির রয়েছে। আর মার্স (MARS) ভাইরাস ছড়িয়েছিল উট থেকে। কিছু সামুদ্রিক প্রাণী যেমন বেলগা জাতীয় তিমি, বাদুড়, খরগোশ এবং সাপ করোনা ভাইরাস বহন করতে পারে। বর্তমানে বিদ্যমান ভাইরাসের সাথে করোনা ভাইরাসের জিনগত ভাবে SARS CoV এর সাথে ৭৯.৫% এবং ব্যাট করোনা ভাইরাসের সাথে ৯৯% মিল রয়েছে।
করোনা ভাইরাস কী?
করোনা ভাইরাস বলতে এক গোত্রের অনেকগুলো ভাইরাসকে বোঝায়, যা মূলত প্রাণীদের মধ্যে পাওয়া যায়। বার্ড ফ্লু তথা সার্স ভাইরাসও এই গোত্রের। হিউম্যান করোনা ভাইরাস এক ধরনের জুনোটিক রোগ এবং এই সংক্রমণটি প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাসটির অনেক রকম প্রজাতি আছে, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৭টি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। সেগুলো হচ্ছে-
- Human coronavirus 229E (HCoV-229E)
- Human coronavirus OC43 (HCoV-OC43)
- SARS-CoV
- Human coronavirus NL63 (HCoV-NL63)
- Human coronavirus HKU1
- Middle East respiratory syndrome coronavirus (MERS-CoV)
- Novel coronavirus (2019-nCoV)
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘ভাইরাসটি হয়তো মানুষের দেহকোষের ভেতরে ইতোমধ্যে মিউটেট করছে, অর্থাৎ গঠন পরিবর্তন করে নতুন রূপ নিচ্ছে এবং সংখ্যাবৃদ্ধি করছে। ফলে এটি আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।

কতটা ভয়ংকর এই ভাইরাস?
এই ভাইরাস মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমেই এটি একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে ছড়ায়। সাধারণ ফ্লু বা ঠান্ডা লাগার মতো করেই হাঁচি-কাশির মাধমে এ ভাইরাস ছড়ায়। তবে এর ফলে অরগ্যান ফেইলিওর বা দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়া, নিউমোনিয়া এবং মৃত্যু ঘটারও আশঙ্কা রয়েছে।
এখন পর্যন্ত আক্রান্তদের দুই শতাংশ মারা গেছে; হয়তো আরও মৃত্যু হতে পারে। তাছাড়া এমন মৃত্যুও হয়ে থাকতে পারে- যা চিহ্নিত হয়নি। তাই এ ভাইরাস ঠিক কতটা ভয়ংকর তা এখনও স্পষ্ট নয়।
এক দশক আগে সার্স (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) নামে যে ভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৮০০ লোকের মৃত্যু হয়েছিল, সেটিও ছিল এক ধরনের করোনা ভাইরাস। এতে আক্রান্ত হয়েছিল ৮ হাজারের বেশি মানুষ। অন্য একটি ভাইরাসজনিত রোগ ছিল মার্স বা মিডল ইস্টার্ন রেসপিরেটরি সিনড্রোম যা ২০১২ সালে ৮৫৮ জনের মৃত্যু ঘটায়।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণগুলি কী কী?
লক্ষণগুলি করোনা ভাইরাসগুলির ধরণের এবং সংক্রমণ কতটা গুরুতর তার উপর নিভর করে। এক্ষেত্রে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়। যারা হৃৎপিন্ড বা ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং বয়স্ক তাদের এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে এবং নিউমোনিয়া বা শ্বাসনালীর ব্যাধির মতো মারাত্মক অসুস্থতায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেশি থাকে।
ক) প্রায় ৯০% ২০১৯-nCoV সংক্রামণে জ্বর থাকে, যা আপনার নিউমোনিয়া হলে বেশি হতে পারে
খ) শ্লেষ্মা সহ কাশি
গ) নিঃশ্বাসের দুর্বলতা
ঘ) শ্বাস ও কাশির সময় বুকের ব্যথা বা শক্ত হওয়া
ঙ) সর্দি
চ) মাথা ব্যাথা
ছ) হাঁচি
জ) অবসাদ
ঞ) সামগ্রিকভাবে ভাল বোধ না করা।
ট) লিউকোপেনিয়া- শ্বেতকণিকার কাউন্ট কম থাকে বিশেষ করে লিম্ফোসাইট।

প্রতিরোধের উপায়:
- ভাইরাসটি নতুন হওয়াতে এখনই এর কোনও টিকা বা প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে মানুষকে হাত নিয়মিতরূপে ভালোভাবে ধোয়া নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছে।
- হাঁচি-কাশির সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখা
- ঠান্ডা ও ফ্লু আক্রান্ত মানুষ থেকে দূরে থাকার
- সার্জিক্যাল মুখোশ বা মাস্ক পড়া যেতে পারে।
- হাত সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে,
- বারবার হাত ধোয়া,
- হাত দিয়ে নাক-মুখ স্পর্শ না করা
আপাতত প্রতিকার হিসেবে এ ভাইরাস বহনকারীদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে বলছেন বিজ্ঞানীরা।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি কাদের বেশি?
যে কোনও ব্যক্তি করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কবলে পড়তে পারেন তবে ছোট বাচ্চারা সংক্রামিত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, শরত্কালে এবং শীতে সংক্রমণ বেশি দেখা যায়।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ কীভাবে নির্ণয় করা হয়?
আপনার লক্ষণগুলি জিজ্ঞাসা সহ আপনার চিকিৎসার ইতিহাস নিন-
- একটি শারীরিক পরীক্ষা করুন।
- রক্ত পরীক্ষা করা।
- থুথু পরীক্ষা করা।
- এক্স-রে করা।
নভেল করোনা ভাইরাসের জটিলতা:
- রেনাল ফেইলিউর।
- যে কোন অঙ্গের কর্মক্ষমতা বিনষ্ট হওয়া।
- মৃত্যুও হতে পারে।

সতর্কতামূলক স্বাস্থ্যবিধি:
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়া।
- প্রচুর পরিমাণ তরল খাবার দেয়া।
- স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।
- অন্যকে স্পর্শ করার পর হাত ধুয়ে নেয়া।
- আলাদা বাসনের ব্যবস্থা রাখা ইত্যাদি।
নভেল করোনা ভাইরাস সংক্রমণে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা:
নভেল করোনা ভাইরাস সংক্রমণে হোমিওপ্যাথিক ঔষধের লক্ষনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ এবং মহামারীর চিকিৎসা বিধান অনুসরণ করে চিকিৎসা করতে হবে।মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশে চীনের বাইরের কারো এখনো এই রোগটিকে চিকিৎসার কোন প্রত্যক্ষ ও বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। কেবলমাত্র বলা যেতে পারে- দক্ষ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের নির্দেশনা ও পর্যবেক্ষণের অধীনে নিম্নলিখিত ঔষধগুলোর প্রয়োজন হবার সম্ভাবনা রয়েছে-
- ARSENICUM ALBUM
- GELSEMIUM
- EUPATORIUM PERFOLIATUM
- ASPIDOSPERMA QUEBRACHO
- BLATTA ORIENTALIS
- ARALIA RACEMOSA
- BORRHEAVIA DIFFUSA
- OCCIMUM SANCTUM
- FERRUM PHOSPHORICUM
- KALIUM SULPHURICUM
- KALIUM MURIATICUM
- ANTIMONIUM TARTARICUM
- DROSERA ROTUNDIFOLIA
- SPONGIA TOSTA
- DULCAMARA

লেখক-পরিচিতি:
Dr. Mahbub Alam Mahfuz BHMS (DU)
Lecturer, Apex Homeopathic Medical College and Hospital Ex-House Physician, Govt Homeopathic Medical College and Hospital
Discussion about this post