শিক্ষকদেরও শিক্ষক বলে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ও বর্তমান সময়ের হোমিওপ্যাথিক বিপ্লবের পথিকৃৎ ডা. জর্জ ভিথউল্কাস এবং তাঁর রচনা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও কর্ম নিয়ে কথা বলতে যাওয়াটি আমি এক প্রকার বাহুল্য বলেই মনে করি। তাঁর কাজ সম্বন্ধে যারা জানেন- তাদের নিকট তার লেখা, রচনা ও গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা আলাদা কোন অর্থ বহন করে না। কিন্তু তথাপি, সবার প্রাপ্তিসাধ্য মহৎ কর্ম সম্বন্ধে আলোচনা করার, সে ব্যাপারে নিজের মতামতটি প্রকাশ করার লোভ সংবরণ করা কঠিন কাজ। আর এজন্য আমি আমার সদ্যপাঠকৃত ‘দি বেসিক প্রিন্সিপ্যালস অব হোমিওপ্যাথি’ গ্রন্থটির ব্যাপারে, আমার কিছু দেখা ও মতামত পর্যালোচনা করার লক্ষ্যেই এই লেখাটির অবতারণা। উল্লেখ্য, বইটি সম্প্রতি বাংলায় ভাষান্তর করেছেন, ডা. জর্জ ভিথউল্কাসের নিকট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও তাঁর সুযোগ্য ছাত্র ডা. ধীমান রায়- তার প্রতিষ্ঠিত ডা. রহিম ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এবং যেখানে তিনি ‘বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি অব ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথি (IACH)’ এর মাধ্যমে ডা. ভিথউল্কাসের শিক্ষা-কোর্স ও কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
বইটি পড়ে প্রথমেই আমার যে অনুভূতিটি হয়েছে, তা হচ্ছে- ডা. ভিথউল্কাস তাঁর সিংহাসন থেকে নেমে এসেছেন- আমাদের হোমিওপ্যাথ ও সাধারণ মানুষের সাথে হোমিওপ্যাথিকে যৌক্তিকভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে। এত অল্প কথায়, এত সুগভীর বক্তব্য তুলে ধরতে গেলে সেখানে যে পান্ডিত্যের প্রয়োজন হয়- সন্দেহ নেই সেটি ডা. ভিথউল্কাসের রয়েছে এবং তিনি এই গ্রন্থটির মাধ্যমে তাঁর সাক্ষরও সৃষ্টি হয়েছে।
আজ আমরা, হোমিওপ্যাথগণ একটি বিচিত্র ও বিভ্রান্তকারী সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। হোমিওপ্যাথি নিয়ে কথার, বক্তব্যের যেমন শেষ নেই- তেমন অন্ত নেই এর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিতর্কের। জ্ঞানের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে নির্বুদ্ধিতা, সত্যের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে ছড়িয়ে আছে বিভ্রান্তি। বাদ, মতবাদ, মতদ্বৈততার হৈ-হট্টগোলে অনেক সময়ই চাপা পড়ে যায়- সম্মুখে থাকা সহজ পথটি।
হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের, কিংবা আমাদের শিক্ষার্থী সমাজ, এমনকি নতুন চিকিৎসকগণ পর্যন্ত এই ডামাডোলে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধে ধারণা হয়ে পড়ে অস্পষ্ট। হোমিওপ্যাথির মূল বিষয়বস্তু, মূলনীতি, এর কার্যক্ষমতা, এর সীমাবদ্ধতা তখন আমাদের চোখে হয়ে পড়ে ধোঁয়াটে। আর তখনই প্রয়োজন হয়ে পড়ে- একটি পথপ্রদর্শকের, একটি দিক নির্দেশকের, যে আমাদের সচেতন করবে আমার সম্মুখে থাকা সহজ, পরিচ্ছন্ন পথটির দিকে। আর ডা. জর্জ ভিথউল্কাসের শিক্ষায় সংকলিত এই বইটির আমাদের সেই বৃহৎ কাজটি সাধন করার উপযুক্ত করেই প্রস্তুত করেছেন ডা. ধীমান রায়। ডা. ভিথোলকাস গ্রন্থটির প্রারম্ভেই বলে নিচ্ছেন-
হোমিওপ্যাথি কি এবং এর মূলভিত্তিগত ধারণা সম্পর্কে, সাধারণ মানুষ এবং যারা স্বাস্থ্যবিজ্ঞান বা চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাথে সংশ্লিষ্ট, উভয়কে অবহিত করতেই এই ছোট্ট বইটির লেখা। [ভূমিকা, পৃষ্ঠা – ০৪]
বইটির বিষয়বস্তু সার্বিকভাবে হয়তো আমাদের অজানা নয় কিন্তু সেই বিষয়গুলোর গভীরতা ও সুস্পষ্টতার ব্যাপারটিতে যে আমাদের অনেকেরই ঘাটতি রয়ে গেছে- সে ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহও নেই। তাঁর গভীর প্রজ্ঞা এই পরিচিত বিষয়েও আরোপ করেছে সর্বোচ্চ ও অজানা গভীরতা। এজন্যই তিনি বইয়ের উপক্রমণিকাতেই হোমিওপ্যাথির চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠার সমাধানটি ও তাতে তাঁর ও আমাদের ভূমিকাটি অল্প কয়েকটি লাইনেই তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন-
মানুষ যখন আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, নিজের ব্যক্তিকেন্দ্রিক আনন্দ থেকে বের হয়ে এসে সমাজের মঙ্গলের জন্য কাজ করবে, তার চারপাশের মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসবে তখন সে তা জীবনের সত্যিকার অর্থ, জীবনের নিগূঢ় আনন্দ খুঁজে পাবে। তখন সামাজিক জীব হিসাবে তার জীবন সার্থক হয়ে উঠবে। আর এটাই এই বইয়ের মূল শিক্ষা তথা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য। আর ঠিক এ ধরনের একটি সমাজ ব্যবস্থা থেকে যে ব্যক্তিগত ভালোলাগার অনুভূতি বা সুস্থতাবোধ তৈরি হয় একমাত্র হোমিওপ্যাথি তা এনে দিতে পারে। এ ধরণের সামাজিক একটা অবস্থা যদি তৈরি করা যায় তবেই হোমিওপ্যাথি আবার ঝঙ্কার দিয়ে উঠবে এবং সমাজের মূল ধারার চিকিৎসা হিসাবে প্রশংসা পাবে।[উপক্রমণিকা, পৃষ্ঠা – ০৬]
তিনি সচেতন করেছেন আমাদের, হোমিওপ্যাথদের স্বকীয়তা নিয়ে,
‘হোমিওপ্যাথি, প্রচলিত (এ্যালোপ্যাথি) চিকিৎসার সম্পূর্ণ ভিন্ন দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত।’ [উপক্রমণিকা, পৃষ্ঠা – ০৬]
কাজেই, অন্য কোথাও না হাতরে আমাদের জ্ঞান যে আমাদের প্রাজ্ঞজনদের, আমাদের শিক্ষকদের নিকট থেকেই সংগ্রহ করে নিতে হবে- সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। ভূমিকা, উপক্রমণিকায় বলা এই গভীর কিছু কথার পরে, তিনি যে বিষয়গুলো নিয়ে বইটিতে আলোচনা করেছেন, তা হচ্ছে-
১. হোমিওপ্যাথির মৌলিক ধারণা
২. স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা ও পরিমাপ
৩. রোগ প্রবণতা
৪. হোমিওপ্যাথির দৃষ্টিতে প্যাথলজি
৫. ঔষধ নির্বাচন
৬. সহিংসতা ও বিকৃত যৌনতা
৭. রোগ প্রতিষেধক ঔষধ
৮. প্রশ্ন ও উত্তর
৯. ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথি কর্তৃক আরোগ্যকৃত কিছু কেস
১০. হোমিওপ্যাথি, হেল্থ অ্যান্ড হিউম্যানিটি (বক্তৃতা)
মূলত আলোচিত প্রতিটি বিষয় গভীর বিচক্ষণতার সাথে নির্বাচিত। প্রথমত হোমিওপ্যাথির মৌলিক ধারণা সম্বন্ধে যদি এককথায় কারো কাছে জানতে চাওয়া হয়- খুব কমজনই আছেন, যারা নিশ্চিতরূপে সুস্পষ্ট ধারণাটি দিতে পারবেন। আগেই বলেছি, আমাদের বর্তমান সময় ও তাতে বিরাজিত চাকচিক্যময় বহু মতবাদ আমাদের সেই ধারণার বুকটিতেই বোধহয় প্রথম আঘাতটি হানে। সেখানে অন্তত হোমিওপ্যাথির মূল কথা ও মূলনীতি সম্বন্ধে মননকে সুস্পষ্ট রাখার জন্য এর পর্যালোচনাটি আমাদের কাছে আজ জরুরি এবং সেটি কেবল একবার নয়- বারংবার। সেখানে তিনি সদৃশ বিধান, ঔষধের প্রুভিং, হানেমানের মূলনীতি (আনুষঙ্গিক কিছু অপরিহার্য নীতিসহ), রোগীকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত করা, শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (The Defense Mechanism), ঔষধের ন্যূনতম মাত্রা: প্রস্তুতি এবং মাত্রাবিজ্ঞান, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ও প্রচলিত চিকিৎসকের দ্বন্দ-সংঘাত, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের মধ্যে অন্তঃদ্বন্দ সহ আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি সেখানে তুলে ধরেছেন- প্রচলিত (এলোপ্যাথি) ও হোমিওপ্যাথিক দৃষ্টিভঙ্গির সংঘাত এবং তার উপযুক্ততার প্রশ্নটিকে। তিনি সতর্ক করেছেন- আমাদের হোমিওপ্যাথদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে, হোমিওপ্যাথির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে এবং সুস্পষ্টতার খাতিরে তালিকা সংযোজন করেছেন- কোথায় হোমিওপ্যাথি সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য করতে সক্ষম এবং কোথায় এর সীমাবদ্ধতাকে আমাদের স্মরণ রাখতে হবে- সেই সমস্ত রোগজ ক্ষেত্রের।
আমি আমার একটি বইতেও উল্লেখ করেছি, এ যাবৎ পর্যন্ত স্বাস্থ্যের সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত ও সুগভীর সংজ্ঞা প্রদান করেছেন ডা. জর্জ ভিথউল্কাস। একটি সংজ্ঞা হচ্ছে- সংজ্ঞায়িত বিষয়টির বৈশিষ্ট্যগুচ্ছের শিরোনাম; আর বিষয়টিকে সেখানে এতটাই সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হবে- যার উপর ভিত্তি করে সেই বিষয় বা বস্তুটির অবস্থা-নির্ণয়, পরিমাপ, ক্রিয়াফলের সম্ভাব্যতা নির্দেশ করা সম্ভব হবে; আর কেবল তখনই সেই বিষয়টি হয়ে উঠতে পারে বিজ্ঞান পদবাচ্যের যোগ্য। ডা. জর্জ ভিথউল্কাসের সংজ্ঞাটি এই সবগুলো শর্তই পূরণ করতে সক্ষম, আর এজন্যই তিনি বিবৃত করতে পেরেছেন- মানুষের স্বাস্থ্যগত অবস্থা পরিমাপের উপায়। আমাদের অনেকেরই হয়তো তাঁর মূল গ্রন্থগুলো থেকে এই বিষয়গুলোর ধারণা নেয়াটি বহু কারণেই কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে – যা তিনি সংক্ষেপে ও সহজবোধ্যরূপে তুলে ধরেছেন এই বইটিতে। বাস্তব কেইস ও ঔষধের মূল বৈশিষ্ট্যের সমন্বিত বর্ণনার মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেছেন – রোগ প্রবণতা, হোমিওপ্যাথির দৃষ্টিতে প্যাথলজি, ঔষধ নির্বাচন, সহিংসতা ও বিকৃত যৌনতা – এই বিষয়গুলিকে।
সেই সাথে, বইটির ‘রোগ প্রতিষেধক ঔষধ’ শিরোনামের আলোচনাটি একটি চমৎকার ধারণার উপর সংযোজন। সেখানে এর মূলকথাগুলোর পরে তিনি উদাহরণ দিয়ে তুলে ধরেছেন- কিভাবে ক্রনিক রোগে প্যাথলজি প্রদর্শনেরও বহু আগে সে সম্বন্ধে আগাম ধারণা করা সম্ভব। সন্দেহ নেই, অনেক চিকিৎসকের জন্যই এটি নতুন আলোকে ও গভীরভাবে লক্ষণগুলোকে বিবেচনা করার ক্ষেত্রটির ব্যাপারে একটি নতুন অর্ন্তদৃষ্টি দান করবে।
হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধে চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষের ধারণা লাভ করার সরলতম পদ্ধতি হচ্ছে- প্রশ্ন ও উত্তরের ভিত্তিতে আলোচনা। এটা উপলব্ধি করেই আমি আমার ‘হোমিওপ্যাথিক কেইস টেকিং ও ফলো-আপ ম্যানেজমেন্ট’ বইটিতে এই আঙ্গিকে আলোচনা করেছিলাম। সন্দেহ নেই, আমার চাইতে বহুগুণে অতুলনীয় প্রাজ্ঞজন জর্জ ভিথউল্কাসও এর গুরুত্ব জানেন। তার প্রমাণ বইটিতে তিনি বেশ কিছুসংখ্যক মৌলিক প্রশ্নের মাধ্যমে তাঁর সেই জ্ঞানটিকে এবং হোমিওপ্যাথির বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে ধারণাটিকে তিনি পরিচ্ছন্নরূপে তুলে ধরেছেন। তার প্রশ্নের গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য আমি তিনটি প্রশ্নকে এখানে উল্লেখ করছি, যেগুলো হয়তো কম-বেশি সবাইকেই চিন্তা করার অবকাশ দেবে –
১. ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথি কি? “মডার্ন” হোমিওপ্যাথি থেকে এর পার্থক্য কোথায়?
২. হোমিওপ্যাথিক ঔষধ কি সম্পূর্ণ পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ামুক্ত ও নিরাপদ?
৩. একই সময়ে, একই সাথে একাধিক হোমিওপ্যাথিক ঔষধ গ্রহণ করা যাবে কি?
তিনি বইটিতে হোমিওপ্যাথির বিস্ময়কর সফলতাকে যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি যৌক্তিকভাবে তুলে ধরেছেন এর সীমাবদ্ধতাকে। এ দু’টির ভারসাম্যপূর্ণ জ্ঞানের অভাব- আমাদের হোমিওপ্যাথিক সমাজটিকেই কি ভীষণরকম ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তাঁর ভাষাতে প্রদান করেছেন সেই রূপরেখা-
“এটা প্রায় সর্বজন বিদিত যে, হোমিওপ্যাথিতে এডভান্স প্যাথলজি বা মারাত্মক রোগের তীব্র অবস্থায় যেমন- ক্যান্সার, হৃদরোগ, শিশুদের সেরিব্রেরাল পলসি এবং অটিজম, বংশগত বা ক্রনিক এপিলেপ্সি, সিজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে সময় সময় ভালো ফল পাওয়া যায়, তার মানে এই না যে এই সব রোগ হোমিওপ্যাথিতে হর-হামেশাই আরোগ্য হয়, বা সম্পূর্ণ আরোগ্য করা সম্ভব হয়। অতি উৎসাহী ও অনভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক এই সব রোগে অল্প কিছু সাফল্য ফলাও করে জনসমক্ষে প্রচার করে। মূলত এই সব সাফল্য আসে দীর্ঘদিনের চিকিৎসায় এবং ওই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের ঐ বিশেষ রোগে ব্যক্তিগত বিশেষ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার কারণে।” [এডভান্স প্যাথলজি, মারাত্মক রোগের শেষ অবস্থায় হোমিওপ্যাথি, পৃষ্ঠা- ১৮]
তিনি আরো বলেন-
“হোমিওপ্যাথিতে আর যাই হোক “প্যানাসিয়া” বা “সর্বরোগের মহা ঔষধ” ধরনের কিছু নেই; প্রতিটি কেস বা রোগী এক একটি নতুন চ্যালেঞ্জ………..হোমিওপ্যাথিতে এই স্বতন্ত্রকরণ বা প্রতিটা রোগীকে আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তাই হোমিওপ্যাথি শেখা ও প্রয়োগকে একটি জটিল পদ্ধতিতে পরিণত করেছে, আর এ কারণেই সুশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকে পার্থক্য নিরূপিত হয়েছে। হোমিওপ্যাথি শিক্ষায় উচ্চ পর্যায়ের আইন প্রণয়ন ও লক্ষ্য নির্ধারণ প্রতিটি দেশের দায়িত্ব।” [এডভান্স প্যাথলজি, মারাত্মক রোগের শেষ অবস্থায় হোমিওপ্যাথি, পৃষ্ঠা- ১৮]
এই বিষয়গুলোতে অস্পষ্টতা একদিকে যেমন রোগীর জন্য সময়-শ্রম-অর্থের ক্ষতিকারক, হোমিওপ্যাথিকে করে দুর্নামের ভাগীদার আর চিকিৎসককে ক্রমান্বয়ে করে ভগ্নোমনোরথ, হোমিওপ্যাথির প্রতি আত্মবিশ্বাসহীন। আর এজন্যই এই বিষয়গুলো সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা নেয়াটি অতীব জরুরি। তথাপি এর সফলতার সম্ভাবনাকেও আমাদের একই সাথে বিবেচনায় রাখতে হবে। আমাদের যোগ্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সেই সম্ভাবনাকে করতে হবে বিস্তৃত ও তাকে বাস্তবতায় পর্যবসিত করাটিই হবে আমাদের লক্ষ্য। আর সেই উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখেই বোধহয়, তিনি বইটিতে তুলে ধরেছেন এ্যাডভান্স প্যাথলজির কিছু চমৎকার ও বিস্ময়কর কেইস ও তার আরোগ্যের ঘটনা। আমার মনে হয়, বহু চিকিৎসক ও হোমিওপ্যাথিক শিক্ষার্থীদের নিকট এই কেইসগুলো একটি বিশেষ প্রণোদনা হিসাবে কাজ করবে এবং হোমিওপ্যাথির সম্ভাবনার বাস্তব রূপটিকে তাদের মনে অঙ্কিত করবে।
অবশেষে, বইটি তিনি সমাপ্ত করেছেন- ১৯৮৪ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার সিটির সেন্ট্রাল হল-এ এক বিশাল উৎসুক জনতার সামনে দেয়া যুগান্তকারী বক্তৃতা ‘হোমিওপ্যাথি, হেল্থ অ্যান্ড হিউম্যানিটি’-এর মাধ্যমে। এই আলোচনাটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ এবং বক্তৃতায় আলোচিত কথাগুলোতে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার গভীরতা এতটাই বেশি যে, এর কিয়দংশ নিয়ে আলোচনা করাটিতে এর কেবল মানহানিই ঘটবে; আগ্রহী পাঠকদের জন্য তা বিশেষ আকর্ষণ হিসাবেই আমি তা নিয়ে আলোচনা করা থেকে নিবৃত্ত করছি। কেবল প্রজ্ঞাবান শিক্ষক ডা. জর্জ ভিথউল্কাসের সর্বশেষের কথাগুলোকে আমি এখানে উল্লেখ করছি, যা আমার মনে একটি বিশেষ শিক্ষা হিসাবে সর্বসময় অনুরণিত হবে-
“আমরা এটা বলছি না যে, শুধুমাত্র আমাদের কাছেই রয়েছে পরিপূর্ণ সত্যের জ্ঞান, আমরা এটা বলতে চাই যে, আমাদের এই জ্ঞানকে, এই বিজ্ঞানকে (হোমিওপ্যাথি) সম্পূর্ণভাবে জানার জন্য আমাদের এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। আমরা শুধু বলতে চাই, আমাদের কাছে রয়েছে এমন এক জ্ঞান- যদি আপনারা সেই জ্ঞানের সংস্পর্শে আসতেন, যদি আপনারা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সেই জ্ঞানকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারতেন… তবে নিঃসন্দেহে, কোনো রকম দ্বিধা-দ্বন্দ ছাড়াই স্বীকার করে নিতেন এটাই হলো মহান প্রকৃত সত্যের দৈবিক জ্ঞান।”
আমাদের হোমিওপ্যাথিক সমাজ ও সাধারণ মানুষের জন্য মহান শিক্ষক ডা. জর্জ ভিথউল্কাসের এই শ্রমটির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করছি এবং আমাদের এত সুন্দর একটি উপহার প্রদান করার জন্য তাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। সেই সাথে আমি বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি প্রকৃত ধারার ক্লাসিক্যাল চিকিৎসক, ডা. জর্জ ভিথউল্কাসের সুযোগ্য ছাত্র ডা. ধীমান রায়কে, যিনি বইটির ভাষান্তর করেছেন, সংকলন করেছেন, প্রচ্ছদ করেছেন এবং অবশেষে প্রকাশনার দায়িত্ব নিয়ে আমাদের সর্বশ্রেণির চিকিৎসকের কাছে ডা. ভিথউল্কাসের এই মহামূল্যবান কথাগুলো পৌঁছে দেবার বন্দোবস্ত করেছেন। উল্লেখ্য, আমার দেখা এ যাবৎ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ইন্ডিয়ার হোমিওপ্যাথিক বইগুলোর মধ্যে এই বইটির প্রচ্ছদ, সজ্জাকরণ, ছাপার কাগজ, রং-নির্বাচন, বাইন্ডিং সমস্ত কিছুতে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মানটিই বেছে নিয়েছেন। এতটা যত্ন নিয়ে, এত চমৎকার বই আর এর আগে কেউ করেছেন বলে আমি দেখিনি। আমি আশা করবো, আমাদের হোমিওপ্যাথিক সমাজ বইটির গুরুত্ব যথাযথরূপ উপলব্ধি ও মূল্যায়ন করতে সমর্থ হবেন।
[Reviewed by Dr. Shaheen Mahmud]
Discussion about this post