ডা. গোলাম রাব্বানী রাসেল:
মহাত্মা হ্যানিম্যানের “অর্গানন অভ্ মেডিসিন” আত্ত্বস্থ করার পর মেটেরিয়া মেডিকা পাঠ করা মোটেও কঠিন কোনো কাজ হবে না। কিন্তু কঠিন হচ্ছে অর্গাননটা বুঝে আত্ত্বস্থ করা।
অনেকে বলে থাকেন যে, আমি মেটেরিয়া মেডিকার যে ঔষধটিই পড়ি সেটিই অন্য ঔষধের সাথে মিল মনে হয়, একটি ঔষধ যতোই পড়ি ততোই ভুলি কিভাবে এই সমস্যাগুলো দূর করবো ?
আপনি যখন মেটেরিয়া মেডিকার ঔষধগুলো পড়বেন তখন প্রত্যেকটা ঔষধকে আলাদা আলাদা মানুষ মনে করবেন। একজন মানুষের যেমন মন, মাথা, চোখ, নাক, কান, মুখমন্ডল, গলা, পাকস্থলী ইত্যাদি রয়েছে, তেমনি একটি ঔষধেরও এসব রয়েছে। পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষ গঠনগত দিক থেকে সাধারণভাবে একই কিন্তু স্বভাব, চলন, কথাবার্তার ধরন, চিন্তাচেতনা, জ্ঞান, বুদ্ধি, ভয়, সাহসিকতা ইত্যাদি কোনো কিছুর যেমন মিল নেই- ঠিক তেমনি একটি ঔষধের সাথে অপর ঔষধের লক্ষণ-সৃজনী ক্ষমতার দিক থেকেও অন্য ঔষধের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। মেটেরিয়া মেডিকা পড়ার ক্ষেত্রে সবসময় খেয়াল রাখতে হবে, সেটি যেন মৌলিক মেটেরিয়া মেডিকা হয়। কারণ যারা ঔষধ পরীক্ষা করেনি তারা যদি মেটেরিয়া মেডিকা লিখেন, তাহলে ভুল হবার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। মহাত্মা হ্যানিম্যানের পরে ডা. হেরিং-কে দ্বিতীয় হ্যানিম্যান বলা হয়, কারণ ডা. হেরিং না থাকলে হোমিওপ্যাথি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেত।
হ্যানিম্যানের মেটেরিয়া মেডিকা পিউরাকে তখনই বান্ডিল অভ্ বুশেস (Bundle of bushes) বলা হয়েছে। কারণ হ্যানিম্যান তাঁর ছাত্রদের দিয়ে যে ঔষধগুলো প্রুভিং করিয়েছিলেন সেগুলোকে স্থান দিয়েছিলেন তাঁরই রচিত মেটেরিয়া মেডিকা পিউরাতে। আর ছাত্ররা হ্যানিম্যানকে খুশি করার জন্য অনেক অতিরঞ্জিত কথার বলেছিল, যা কখনোই বিশুদ্ধ মেটেরিয়া মেডিকায় স্থান পাওয়ার কথা নয়। এরপর ডা. হেরিং সমস্ত ঔষধই পুনরায় পরীক্ষা করে তাঁর নিজের গাইডিং সিম্পটমে স্থান দিয়েছেন।
ডা. হেরিং তাঁর রচিত মেটেরিয়া মেডিকা “The Guiding Symptoms of Our Materia Medica” এর “Preface” এ বলেছেন যে,
“একটি আসনের তিনটি পায়া, গণিতশাস্ত্র অনুসারে, যে কোনো বস্তুর ভার বহন করার জন্য যথেষ্ট হয়। আমরা ধরে নেই যে, আরোগ্যকে খুব সম্ভাবনীয় করার জন্য তিনটি চরিত্রগত লক্ষণ যথেষ্ট।”
তিনি আরো বলেন, আমরা ঔষধসমূহ সুস্থ শরীরে পরীক্ষা করে তাদের লক্ষণ সংগ্রহ করেছি, আরোগ্যে তাদের সত্যতা পরীক্ষা করেছি এবং পরিশেষে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ লিপিবদ্ধ করেছি। কাজেই তার ভাষায়,
“Finally we obtained the characteristic, the ripe fruit hanging upon the tree.”
অর্থাৎ,
“আমরা সর্বশেষ ঔষধের চরিত্রগত লক্ষণ এমন অবস্থায় পেয়েছি, যেন গাছে ঝুলন্ত পাকা ফল।”
(দ্রষ্টব্য, Preface, The Guiding Symptoms of our Materia Medica. By C. Hering, M.D.)
তিনি আরো বলেছেন যে,
“চরিত্রগত লক্ষণের সংজ্ঞার্থ যদি করা হয়, ‘যে লক্ষণ একের অধিক ঔষধে পাওয়া যায় না’ তাহলে তা সম্পূর্ণ অশুদ্ধ।” কারণ বিশুদ্ধভাবে পরীক্ষিত ঔষধের সকল লক্ষণই তার চরিত্রগত লক্ষণ।
সেই সাথে তিনি আরো সুস্পষ্ট করেন,
“যদি সুস্থ ব্যক্তিদের উপর ঔষধ পরীক্ষায় একইরূপ অথবা সদৃশ লক্ষণসমূহ প্রকাশিত হয় তাহলে তারা খুব সম্ভব উক্ত ঔষধ কর্তৃক সৃষ্ট লক্ষণ বলেই বিবেচ্য এবং পরীক্ষায় লক্ষণসমূহ বার বার প্রকাশিত হলে তার সম্ভাব্যতা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। আমাদের মেটিরিয়া মেডিকার প্রথম নির্মাতাগণ কতো উৎকন্ঠার সাথে পরীক্ষাসমূহের মুদ্রণ অনুসন্ধান করেছেন অন্যদের লক্ষণসমূহের সাথে তাদের নিজেদের লক্ষণসমূহ তুলনা করার লক্ষ্যে, প্রত্যেকটি সমর্থন থেকে তারা আনন্দ লাভ করেছেন !”
অতএব অর্গাননের নির্দেশনা মোতাবেক রোগীলিপি বিশ্লেষণ করে রোগের অধিক আকর্ষণীয়, অসাধারণ, বিরল এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লক্ষণ খুঁজে নিতে হবে। তাহলেই সদৃশ ঔষধ নির্বাচন করা সহজ হবে।
এ-কাজটি আপাত দৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও বাস্তবে খুব কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। বাস্তবে যেমন বিচিত্র স্বভাবের মানুষ আছে, তেমনি বিচিত্র ধরনের রোগী আছে। কেউ বেশি কথা বলে, কেউ কম কথা বলে, কেউ অতিরঞ্জিত কথা বলে ইত্যাদি। রোগীর আচরণ, কথা বলার ভাবভঙ্গি, রোগীর হাঁটা, চলা, বসা ইত্যাদি অবস্থা অনেক সময় লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে। রোগীর মানসিক ও দৈহিক সামগ্রিক অবস্থা, রোগীর পরিবেশ, জীবনযাত্রা, বংশগত ইতিহাস, ইত্যাদি-বিষয় রোগীর নিকট থেকে অবগত হতে হবে। তারপর উক্ত রোগীলিপি থেকে রোগের চরিত্রগত লক্ষণগুলো বেছে নিতে হবে। কারণ চরিত্রগত লক্ষণের মাধ্যমে ব্যাধি স্বতন্ত্র রূপে প্রকাশিত হয়। ব্যাধির স্বতন্ত্র রূপ যখন নিরূপিত হয় তখনই কেবল তার জন্য একটি সদৃশ ঔষধ নির্বাচন করা যায়।
ডা. হেরিং তাঁর ‘গাইডিং সিম্পটমস’ গ্রন্থের প্রথম খন্ডের “PREFACE”-এ বলেছেন যে,
“আমার সারাজীবনের রীতি ছিল- সত্য হিসাবে কখনো কোনো কিছুকে গ্রহণ না করা, যতক্ষণ পর্যন্ত না এটি এর বিজ্ঞানের গন্ডিতে যতদূর সম্ভব গাণিতিক সত্য হিসাবে প্রমাণিত হয়; এবং পক্ষান্তরে, মিথ্যা হিসাবে কোনো কিছু বর্জন করি নি, যতদিন পর্যন্ত না এর মিথ্যার শক্তিশালী প্রমাণ পেয়েছি।”
হোমিওপ্যাথিক বিজ্ঞান “অর্গানন অভ্ মেডিসিন” আমাদের শিক্ষা দেয় যে, প্রত্যেক রোগীতে রোগের চরিত্রগত লক্ষণসমষ্টির সাথে সদৃশ লক্ষণবিশিষ্ট একটি মাত্র ঔষধই নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রাধান্য লাভ করে। দ্রুত ও স্থায়ীভাবে রোগ আরোগ্যের জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। কাজেই কোনো ঔষধ সম্পর্কে চিকিৎসকের মনে কোনোরূপ পক্ষপাতিত্ব থাকা উচিত নয়। তিনি সর্বদা নিরপেক্ষভাবে অর্গাননের নিয়মনীতি মোতাবেক কাজ করবেন। কারণ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের কাছে অর্গানন একটি আয়নাস্বরূপ। তিনি এর মধ্য দিয়ে রোগীর যা কিছু দেখবেন তা অবশ্যই নির্ভুল হবে এবং তদনুসারে যা করবেন তা অবশ্যই সঠিক হবে।
Discussion about this post