জানা ও জানানো- দু’ধরনের কাজের সাথেই সম্পৃক্ত থাকায়, আমাদের হোমিওপ্যাথির মূল গ্রন্থ অর্গানন অভ্ মেডিসিনের বাংলা ও ইংরেজি সব লেখকের অনুবাদই সংগ্রহ করার চেষ্টা করি। কিন্তু অর্গাননের অনুবাদগুলো নিয়ে বেশ একটু আফসোসের মাঝেই ছিলাম। বাংলাভাষায় অর্গাননের প্রায় সব অনুবাদই সাধু ভাষায়। আর এই স্টাইলে লিখতে গেলে তৎভব আর তৎসম শব্দের বহুল ব্যবহার করতে অনুবাদক বাধ্য- যে ব্যাপারটি আমাদের বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থী ও পাঠকদের কাছে নিঃসন্দেহে কষ্টকর। মনে মনে ভাবছিলাম, এই অসুবিধা দূর করার জন্য অর্গাননের অনুবাদের কাজে হাত দেবো। কিন্তু এই ভীষণ কর্মটি শুরু করার সাহস পাচ্ছিলাম না।
অবশেষে কয়েকদিন আগে, মনির ভাইয়ের কাছ থেকে ডা. রেজাউল করিম স্যারের অর্গাননের অনুবাদটি সংগ্রহ করলাম (তখনও জানতাম না- এর লেখক, তত্ত্বাবধায়ক সবই টাঙ্গাইলের)। এবং বইটি পড়ে মন প্রফুল্ল হয়ে গেলো। প্রথম কারণটি ছিলো-
১. চলিত ভাষায় অর্গানন পড়ার ইচ্ছাটা স্যারের মহান প্রচেষ্টার দরুণ পূরণ হলো
২. অর্গানন অভ্ মেডিসিনের প্রাঞ্জল, পরিচ্ছন্ন, সুস্পষ্ট একটি ঝরঝরে অনুবাদ পেলাম
৩. প্রচণ্ড পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা সম্বলিত ভাষ্য। হোমিওপ্যাথির প্রতিটি আঙ্গিকে স্যারের বহুবিধ জ্ঞানের গভীরতা এতে মূর্ত হয়েছে।
৪. ব্যাপক এক পরিশ্রমের হাত থেকে এই প্রবীণ, শ্রদ্ধেয় লেখকটি আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন।
সেই সাথে আরো ভালো লেগেছে- গতানুগতিক অবস্থার চাইতে এর প্রুফিং, কাগজের মান, বাঁধাইয়ের মান এসবকিছুর ক্ষেত্রেই এত উন্নত ব্যবস্থাপনা দেখে।
বইটিতে স্যার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন- একটি এফোরিজমের সবগুলো আঙ্গিককে তার প্রাঞ্জল আলোচনার ধারাবাহিকতায় ফুঁটিয়ে তোলার জন্য। এই কাজে শ্রমের কোন ঘাটতি স্যার রাখেননি। এমনকি প্রয়োজন হলে রেপার্টরাইজেশনসহ বিস্তারিত কেইস বর্ণনা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার সাথে, পাদটীকাগুলোতে নাম্বারিং করার পদ্ধতিটিও চমৎকার। পুরো বইয়ের নোটগুলোকে সংখ্যার ক্রমধারাবাহিকতায় নাম্বারিং করেছেন এবং পাদটিকাকেও সেই নাম্বার অনুসারে উল্লেখ করেছেন। এর দরুন পাদটিকা নিয়ে গোলমাল হবারও কোন সম্ভাবনা আর থাকলো না। সেই সাথে আরেকটি চমৎকার সৃজনশীল সংযোজন হচ্ছে বইয়ের শেষে থাকা ইনডেক্স বা ‘সূত্রে ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ উক্তিসমূহের সূচীপত্র’। ভাষ্যতে দেয়া কোটেশনগুলোর রেফারেন্স এখানে দিয়ে দেয়ায় সেই বিষয় সম্বন্ধে অন্যান্য বহু পথিকৃতের মন্তব্য ও মতামতগুলো পাওয়াটা এতে সুলভ হয়ে গেছে। পাঠক ও শিক্ষার্থী সে ব্যাপারে আরো গভীর স্টাডি করতে চাইলে, সেই কাজটি অনায়াসে করার পথ উন্মুক্ত হয়ে গেছে।
এবার আসি অনুবাদের প্রসঙ্গটিতে। টুকটাক কিছু অনুবাদ আমিও যেহেতু করি, কাজেই আমার কিছুটা ধারণা আছে, অর্গানন অভ্ মেডিসিনের, বা প্রাচীন জার্মানির থেকে আসা যে কোন লেখা অনুবাদ করা কি ব্যাপক একটা ঝক্কির ব্যাপার। পৃথিবীতে কোন জাতি এরকম জটিলতম বাক্য-সংগঠন করে কিনা, আমার জানা নেই। একারণে বাক্যের গঠন ঠিক রেখে এবং সেই সাথে ভাব ও অর্থকে অবিকৃত রেখে অনুবাদ করার কাজটি অনেকটা এভারেস্টে উঠার মতোই দূরুহ ব্যাপার ছিলো- এবং সেই প্রায়-অসম্ভব কাজটিই স্যার এখানে সম্ভব করে দেখিয়েছেন। অনুবাদ-গ্রন্থটির বহু জায়গা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আমি স্যারের অনুবাদের চমৎকারিত্বটি দেখাতে পারতাম, কিন্তু সেটা করতে গেলে এটি একটি রচনায় পরিণত হবে- একারণে এই কাজটি থেকে নিবৃত্ত রইলাম।
তবে বহুদিন ধরে বহু চিকিৎসক ও শিক্ষার্থী আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন যে, অর্গাননের কার অনুবাদটি সবচেয়ে ভালো হবে। আমি আসলে সুস্পষ্ট কোন উত্তর এতদিন দিতে পারিনি। এবার অকুণ্ঠচিত্তে ও নির্দ্বিধায়েই বলতে তাদের বলতে পারবো- সর্বপ্রথম ডা. রেজাউল করিম স্যারের অনুবাদটি পড়ুন।
স্যার এখানে প্রতিটি এফোরিজমের বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অর্গানন অভ মেডিসিনের মতো একটি গ্রন্থ, যেটিতে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধীশক্তিসম্পন্ন লেখকদের অন্যতম মহাত্মা ডা. হ্যানিমান তাঁর বিশাল চিকিৎসাপদ্ধতির সারাংশকে বিধৃত করেছেন- তাকে ব্যাখ্যা করাটা সরল হবে না। এবং যেভাবেই তা সম্পন্ন করা হোক, ব্যাখ্যাতে মতানৈক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক। শক্তি, মাত্রা বা এরকম কিছু সূক্ষ্ম ব্যাপারে স্যারের ব্যাখ্যার সাথে হয়তো অনেকের মতপার্থক্য হতে পারে- আমাদের এতগুলো সেক্টের মাঝে তা না হওয়াটাই বরঞ্চ অস্বাভাবিক। কিন্তু মূল এফোরিজমগুলো ভাব ও অর্থের নিজস্ব স্টাইলে এমন প্রাঞ্জল প্রকাশ কেবল প্রশংসা নয়, নিঃসন্দেহে তাঁর শ্রমের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধার্পণেরও দাবীদার।
আমি স্যারের প্রতি সেই কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। ধন্যবাদ জানাচ্ছি, ডা. গোলাম রব্বানী রাসেলকে পুরো বইয়ের তত্ত্বাবধায়নের কাজটি এত সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য ও অর্গানন অভ্ মেডিসিনের একটি আধুনিক রূপ আমাদের সামনে উপহার দেবার জন্য। বইটি এখন আমার নিত্যসঙ্গী হয়েই আছে। আমি মনে করি, বাংলাভাষী প্রতিটি হোমিওপ্যাথের নিকট এই অনুবাদটির একটি কপি থাকা উচিৎ, আর শিক্ষার্থীদের জন্য এটি অপরিহার্য।
সেই সাথে, এত পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাজটি টাঙ্গাইলের দুই ব্যক্তিত্ব ডা. রেজাউল করিম স্যার ও ডা. গোলাম রব্বানী রাসেলের দ্বারা সম্পন্ন হওয়ায় ব্যক্তিগতভাবে আমি গর্ববোধ করছি। তিনি বইটিতে যে গ্রন্থ ও ব্যাপারগুলোর রেফারেন্স টেনেছেন-
(১) ডা. এইচ সি এলেন নোসডস, জ্বর চিকিৎসা।
(২) ডা. কেন্ট’স ফিলসফি-শক্তির ব্যাখ্যা, মেটিরিয়া মেডিকা।
(৩) ডা. টেষ্টি হোমিওপ্যাথিক মেটিরিয়া মেডিকা-হ্যানিম্যানের দর্শন সম্পর্কে ।
(৪) ডা. ডানহাম-সায়েন্স অভ্ হোমিওপ্যাথি। মেটিরিয়া মেডিকাতে একই নামভূক্ত ব্যাধিও স্বতন্ত্র।
(৫) ডা. ফ্যারিংটন- দুটি উপাদানের সমন্বয়ে রোগের জন্ম।
(৬) ডা. জে.বি.বেল ডায়রিয়া ঔষধের লক্ষণ তালিকায় রোগের নিদানগত লক্ষণ থাকা জরুরী নয়।
(৭) ডা. রবিন মার্ফি রেপার্টরি, কেন্টের রেপার্টরি সম্বন্ধে মতামত।
(৮) ডা. হেরিংস গাইডিং সিম্পটম রোগের ৩টি চরিত্রগত লক্ষণই যথেষ্ট। আরোগ্য-নীতি বা ধারা ।
(৯) ডা. কেন্ট এর মেটেরিয়া মেডিকা, ফিলসফি, লেসার রাইটিংস, রেপার্টরী ।
(১০) ডা. স্যামুয়েল হ্যানিমানের দি লেসার রাইটিং, অর্গানন, ক্রনিক ডিজিজ, মেটিরিয়া মেডিকা।
(১১) এছাড়াও ডা. ক্লার্ক, ডা. টেস্টি, ডা. ডানহাম, ডা. পুলফোর্ড, ডা. ফেরিংটন, ডা. জে সি বার্নেট, ডা. হিউজেস প্রভৃতি চিকিৎসকদের পুস্তক থেকে বিভিন্ন উক্তি সংযোজন করা হয়েছে এই অর্গানন অভ্ মেডিসিন নামক বইটিতে।
Discussion about this post