অনুবাদ: ডা. শাহীন মাহমুদ
[ঘটনাটি মূলত: ভ্যাকসিনোসিস ইফেক্ট ও তার চিকিত্সা পদ্ধতির প্রবক্তা এবং হোমিওপ্যাথিতে সবচাইতে বেশি ক্যান্সার আরোগ্যকারী বলে স্বীকৃত মহামতি ডা. বার্নেটের। তিনি তার এলোপ্যাথ ভাগ্নে, যাকে তিনি হোমিওপ্যাথি পড়তে উপদেশ প্রদান করার উত্তরে কিছুটা অসৌজন্যরূপেই অস্বীকৃতি জানান এবং ডা. বার্নেটকে “ভন্ড” বলে অভিহিত করেন, রেগে গিয়ে তার ‘রেগুলার’ না হয়ে হোমিওপ্যাথ হওয়ার অন্তত একটি যুক্তিসঙ্গত কারণ জানতে চান। ডা. বার্নেট তখন কিছু না বলে প্রতিবারে একটি করে ক্রমান্বয়ে ৫০টি কারণ তার কাছে চিঠি লিখে পাঠান। এটা সেই চিঠির প্রথম অংশের অনুবাদ। চিঠিটি পরবর্তীতে “Fifty Reasons for Being a Homoeopath” নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, প্রতিটি কারণই ক্রমান্বয়ে ভ্রাতুষ্পুত্রটির মনে রেখাপাত করে শুরু করে এবং ৫০টি কারণ অর্থাৎ সম্পূর্ণ চিঠিটি পাবার আগেই ভ্রাতুষ্পুত্রটি হোমিওপ্যাথিতে কনভার্ট হন।]
কয়েকবছর আগের এক একঘেয়ে নিরানন্দ বিকেল, যা ছিলো আমার বি… হাসপাতালে চাকুরির একটি নির্ধারিত অংশ। রোগী দেখার ঘরে বসে বসে ডেথ সার্টিফিকেট লিখছিলাম। হঠাৎ উঠে দাঁড়ালাম এবং নিজের মধ্যে ১৫ তম বারের মতো, এক নতুন অনুভূতির অস্তিত্ব অনুভব করলাম। আগে আমি এই অনুভূতিটার সাথে পরিচিত ছিলাম না, যা আজ অপরিহার্যরূপে উঠে এসেছে- আমার অসন্তুষ্ট ক্লিনিক্যাল রেজাল্টের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ। উঠে পায়চারি শুরু করলাম এবং একসময় পায়চারি থামিয়ে চেয়ারে বসে পড়লাম এবং ডুবে গেলাম অতীতের ফেলে আসা সবুজ ঘাস-জমিতে ঘুরে বেড়ানো, ছোটবেলায় পাখির বাসা ভেঙ্গে আনার আর মাছ ধরার স্বপ্নিল জগতে।
ঠিক তখনই একটা মৃতদেহকে সেখানে আনা হলো। আমি ঘুরে তাকালাম এবং বৃদ্ধ ডিসপেনসারকে বিরক্তিকর কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম “টিম, মৃতদেহটি কার?” উত্তর এলো, “লিটল জর্জ, স্যার”। এই লিটল জর্জ ছিলো একটি পরিত্যক্ত শিশু, যাকে দেখাশোনার কেউ ছিলোনা। কিন্তু আমরা তাকে পছন্দ করতাম, তাকে বাড়তি খালি বিছানায় থাকতে দিতাম, তাকে আদরে রাখতাম- যেভাবে কোন পোষা প্রাণীকে পেলে পুষে রাখা হয়। আসলে ওখানকার সবাই জর্জকে পছন্দ করতো, ভালোবাসতো।
এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটা অনেকটা এরকমভাবে ঘটে: একদিন একজন সদ্য-আগত রোগীর জন্য একটি বিছানা খুঁজছিলাম। এজন্য লিটল জর্জকে রুমের কোণার দিকের উষ্ণ বিছানাটি ছেড়ে অন্য একটিতে যেতে বলি, যার পাশে ছিলো শীতল জানালা। সে সেখানে রাত্রে থাকলো, ঠান্ডা লাগলো, প্লুরিসি হোলো এবং যার পরিণতি এইমাত্র টিম ঘোষণা করলো।
ভাবলাম, যদি জানালার ঠান্ডা বাতাস থেকে শুরু হওয়া তার জ্বরের শুরুতেই সেটিকে থামাতে পারতাম, হয়তো জর্জ আজ বেঁচে থাকতো। আমার সাথে আরো তিনজন চিকিত্সক, হাসপাতালে সমস্ত লোকজন ও সকল সামর্থ্য নিয়ে সম্মিলিতভাবে তার চিকিত্সা করেছি; তবুও প্লুরিসি তার জাল বিস্তার করেছে, প্লুরিসির পরে ড্রপসি দেখা দিয়েছে এবং বেচারা জর্জকে মরতে হয়েছে।
বৃদ্ধ টিম একজন পোড়খাওয়া অভিজ্ঞ মানুষ এবং আমি তাকে কারো মৃত্যুতে সামান্যতম অনুতাপ করতে কিংবা এসব সময়ে কখনো কোন আবেগ বা অনুভূতি প্রকাশ করতে দেখিনি। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, আজ সে-ও জর্জের মৃত্যুতে- অন্তত একবিন্দু হলেও অশ্রুপাত করছে। কারণ দেখলাম, সে যে বোতলগুলো পরিষ্কার করছিলো তার তলার দিকে অপ্রয়োজনে এবং অভ্যাসের বিরুদ্ধে অতি মনোযোগ দিয়ে দৃষ্টিটাকে আবদ্ধ রেখেছে। যা হবার তা হয়েছে, জর্জ আর নেই কিন্তু আমি তার মৃত্যুটাকে মেনেও নিতে পারছিলাম না। বার বার মনে হচ্ছিলো, এই বয়সে তার এভাবে মরার কথা ছিলো না। এবং এই অনুভুতিটা আমাকে হতাশায়, দুঃখে, ব্যর্থতার গ্লানিতে- প্রায় মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলছিলো।
সেই সন্ধ্যায় রয়্যাল ইনফার্মারিতে থাকা আমার এক চিকিত্সক বন্ধু, আমার সাথে ডিনার করতে আসলো এবং আমি তাকে আমার সমস্যার কথা খুলে বললাম। এবং সেইসাথে তাকে আমার আমেরিকা চলে যাবার এবং কৃষিকাজে মনোনিবেশ করার আগ্রহের কথা জানালাম। বললাম, তাতে অন্তত আমি প্রকৃতির সাথে পুরোদস্তুর সম্পৃক্ত একটা জীবন যাপন করতে পারবো।
সে প্রথমে আমাকে হোমিওপ্যাথি পড়তে বললো এবং আমি অসম্মত হওয়ায়, আমাকে তা ভ্রান্ত প্রমাণ করতে অনুরোধ করলো এবং অবশেষে আমাকে অনুরোধ করলো, হোমিওপ্যাথি পড়ার পর, যদি তা আপাতদৃষ্টিতে সত্য বলে মনে হয়, তাহলে হাসপাতালে তা পরীক্ষা করে দেখতে।
অনেক সন্দেহ এবং তার চেয়েও বেশি ভয় নিয়ে আমি হিউজেসের “ফামার্কো–ডায়নামিকস এন্ড থেরাপিউটিকস” বইটি সংগ্রহ করলাম। ভয় পাচ্ছিলাম– কারণ আমার মনে হচ্ছিলো যেন আমি কোন অপরাধ সংঘটন করছি। এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যে আমি এর মূল বিষয়গুলো পড়া শেষ করলাম এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, হয় বাস্তবে হোমিওপ্যাথি একটা অতি বিশাল ব্যাপার অথবা ডা. হিউজেস একটি অতি বড় ভ…….। না, শব্দটি অনুপযোগী। কিন্তু শব্দটি পছন্দ না হলেও এত বড় একটা ব্যাপারে আমার সামনে ধারণা করার জন্য কোন মধ্যপন্থা ছিলো না। হয় এটা ঈশ্বর প্রদত্ত স্পষ্ট সত্য অথবা ডাহা মিথ্যা।
অবশ্য এটাও ভাবছিলাম, ডা. হিউজেস লোকটি বোকা হোতে পারেন না, কারণ এরকম একটি বই একজন বোকা মানুষের পক্ষে লেখা সম্পূর্ণ অসম্ভব। আর সে যেভাবে উদার মনে, সুন্দর বাচনভঙ্গিতে কথাগুলো বলেছেন, তা আমার নৈরাশ্যের খোলসটাকে ভেঙ্গে- আমাকে মুহুর্তের জন্য হলেও তা থেকে বের কোরে আনতে পেরেছিলো। কিন্তু তারপরই আবার এই ক্রিয়ার বিপরীত প্রতিক্রিয়াটি দেখা দিলো। মনে প্রশ্ন জাগলো, “এর আগেও কি আমি বিখ্যাত সব অমোঘ ঔষধ এবং চিকিত্সা পরিকল্পনা নিয়ে চেষ্টা করে ভয়াবহরূপে হতাশ হইনি?”
কাজেই আমার পুরোনো সন্দেহবাদ আমাকে পুনরায় দখল করলো। ভাবতে লাগলাম, “এটা কি সত্য হতে পারে? না, অসম্ভব। আমি মেডিকেল স্কুলে পড়েছি, সেখানে বাঘা বাঘা শিক্ষকের কাছে যে সত্যটা শিখেছি, জেনেছি, তা হচ্ছে- হোমিওপ্যাথি চিকিত্সাবিজ্ঞানের অনৈতিকতাবাদ। নাহ, আর যাই হই, আমি হোমিওপ্যাথ হতে পারবো না; বরং এটা আমি মৃত্যুপথযাত্রী রোগীদের উপর প্রয়োগ করবো, প্রমাণ করবো যে– এটা একটা ঘৃণিত মিথ্যা এবং ‘সম্মানিত পেশা বলে দাবী করা’ এদের মিথ্যা মুখোসটা উন্মোচন করবো”।
তবে আমি তখনও জর্জের ভাগ্য নিয়ে মর্মাহত ও বিচলিত ছিলাম, কাজেই হোমিওপ্যাথরা এ ব্যাপারে কি বলে, তা পড়ে দেখছিলাম এবং সেখানে দেখলাম তারা দাবী করে, “এ ধরণের জ্বরগুলো তারা একোনাইট দিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই সারাতে পারে”। আমি ভাবলাম, “আহ, যদি এটা সত্য হতো, জ্বরের একদম শুরুতে লিটল জর্জকে এই ঔষধটা দেয়া হলে হয়তো তার জীবন বাঁচতো”।
বেশ, ঠান্ডা জ্বরের প্রকোপ এখানে যথেষ্ঠ রকম এবং অধিকন্তু অসুখের সম্পূর্ণ আত্মপ্রকাশের আগ পর্যন্ত শিশুদেরকে আমাদের একটা ওয়ার্ডে রাখা হয় এবং তারপর নিউমোনিয়া, প্লুরিসি, রিউমাটিজম, গ্যাসট্রাইটিস, মিসেলস- যার যেমন রোগ, সে অনুযায়ী বিভিন্ন ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। কাজেই এটার কাজ পরীক্ষা করার যথেষ্ঠ সুযোগ আমার আছে।
আমি আমার রোগী দেখার রুমে ফ্লেমিং-এর কিছু একোনাইটের টিংচার নিয়ে গেলাম এবং বড় এক বোতলে পানির সাথে ঔষধের কিছুটা মেশালাম এবং সেই শিশুদের ওয়ার্ডের নার্সকে নির্দেশনা দিলাম, ওয়ার্ডের একপাশের সব শিশুকে কক্ষে আনামাত্রই সেটা দিতে।
কক্ষের অন্যপাশের শিশুরা একোনাইট সল্যুশন দেয়া হলো না কিন্তু তারা প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী কর্তৃপক্ষের অর্থডক্স পদ্ধতিতে চিকিত্সা পেলো। আমার পরের দিনের প্রাত্যাহিক পরিদর্শনে আমি দেখলাম, যেপাশে একোনাইট দেয়া হয়েছিলো সে পাশের প্রত্যেকটা শিশুই জ্বরমুক্ত এবং প্রায় প্রত্যেকটি শিশুই বিছানার উপর বসে খেলছে, শুধু একজনের হাম দেখা দিয়েছে এবং তাকে নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে পাঠানো হয়েছে। আমি ভাবলাম, একোনাইট হাম সারাতে পারে না।
সেই শিশুদের সবাইকে একদিন বা দুইদিন রাখা হলো, এরপর যার যার বাড়ীতে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হোলো। কিন্তু যাদের একোনাইট দেয়া হয় নি- তাদের অবস্থা ছিলো বাজে। অন্তত তাদের জ্বর চলতে থাকলো এবং স্থানীয় প্রদাহ, সর্দি, হাম ইত্যাদির প্রকোপে হাসপাতালে রাখতেই হলো।
আর দিনের পর দিন, দিনের পর দিন এভাবেই চলতে থাকলো। যারা একোনাইট পেতো তারা ২৪ ঘন্টা বা ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ভালো হয়ে যেতো; শুধু সেই কেইসগুলো বাদে, যেক্ষেত্রে তাদের দৃশ্যত সাধারণ জ্বর অন্য কোন বিশেষ রোগ, যেমন- হাম, স্কারলেটিনা, বাতজ্বর ইত্যাদির প্রারম্ভিক অবস্থা ছিলো: সেখানে একোনাইটে খুব কমই কাজ হতো। তথাপি সেখানে সিংহভাগ কেইসই ছিলো প্রকৃত জ্বরের এবং একোনাইট তাত্ক্ষণিকভাবে একটা বৃহৎ অংশকে সুস্থ করে ফেলতো।
বড় বোতলে কি আছে সে সম্বন্ধে আমি নার্সকে কিছুই বলিনি। আর এ কারণে, সে কয়েকদিনের মধ্যেই এর একটা নামকরণ করে ফেললো, “ডা. বার্নেটের জ্বরের বোতল”।
যা হোক, ঘটনা পরিক্রমা দেখে, কিছু দিনের জন্য আমি একদম হতবিহ্বল হয়ে গেলাম এবং দিনের বেলায় আমার হাতে কোন সময় না থাকায়, রাত্রের বেশিরভাগ সময়ই হোমিওপ্যাথি পড়ে ব্যয় করতে লাগলাম।
একদিন আমি আমার প্রাত্যাহিক পরিদর্শনে যেতে পারলাম না। সম্ভবত আমি দুই দিন অর্থাৎ রবিবার ও সোমবার পরিদর্শনে যাইনি এবং এরপর মঙ্গলবার ভোরে যখন শিশুদের ওয়ার্ডে গেলাম, নার্সকে এবং ওয়ার্ডটাকে দেখে বেশ চুপচাপ মনে হলো। তাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করায় সে জানালো, কিছু কর্তব্যের বাধ্যবাধকতার কারণে, সবগুলো কেইসকেই ডিসচার্জ করা হোয়েছে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “বেশ, কি করে এটা সম্ভব হলো?”
সে উত্তর দিলো, “ডাক্তার, তুমি রবিবার এবং কাল আসোনি, আর এই ফাঁকে আমি তোমার জ্বরের ঔষধটি সবগুলো শিশুকেই দিয়েছি। আসলে আমি তোমার এই নিষ্ঠুর পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে আর সহ্য করতে পারছিলাম না”।
আমি কিছুক্ষণ নীরব থেকে শুধু বললাম, “বেশ, এখন থেকে এখানে যারা আসবে সব শিশুকেই ঔষধটি দিও”। চাকুরিটি ছাড়ার আগ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়াটা চলছিলো এবং এই একোনাইট প্রদানের ফলাফল ছিলো জ্বর এবং সাধারণত তার কবল থেকে দ্রুত মুক্তি এবং দ্রুত স্বাস্থ্যে প্রত্যাবর্তন।
যাই হোক, এটা শুধু মাত্র আমার যাত্রারম্ভের ঘটনা। আমি তোমাকে শুরুর, নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনাগুলোর এবং এর সাথে সম্পর্কযুক্ত ব্যাপারগুলো সম্বন্ধে বিস্তারিত জানাচ্ছি, যাতে তুমি প্রতারিত না হও এবং আজ আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে এসে দাঁড়াতে পারো। হয়তো এত বিস্তারিত বর্ণনা তোমার জন্য অপরিহার্য ছিলো না- কিন্তু এটাও সত্য যে, এই প্রথম ঘটনাটা অর্থাৎ “একোনাইটে জ্বর সারে”- এই ব্যাপারটাই ছিলো আমার হোমিওপ্যাথ হওয়ার প্রথম কারণ।
তোমার কি ‘রেগুলার’ হওয়ার পেছনে এরকম একটা ভালো কারণ আছে?
Discussion about this post