আমেরিকান হোমিওপ্যাথির জনক হিসেবে পরিচিত Dr.Constantine Hering জন্মগ্রহণ করেন ১৮০০ সালের পহেলা জানুয়ারি Saxony এর Oschatz শহরের (বর্তমানে যেটি পূর্ব জার্মানি) এক রক্ষণশীল পরিবারে।
১৮১৭ সালে তিনি তিন বছরের জন্য Saxony-র রাজধানী Dreseden এ Surgical Academy-তে যোগদান করেন এবং ১৮২০ সালে চিকিৎসাবিদ্যার উপর পড়াশোনার উদ্দেশ্যে Leipzig University যান। সেখানে তিনি Dr. Henrich Robbi-র একজন সহকারী ছাত্র হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। Dr. Henrich Robbi ছিলেন একজন হোমিও বিদ্বেষী। ওই সময় হ্যানিম্যান ছিলেন প্রচলিত আরোগ্য ব্যবস্থা ও গোঁড়ামীর চক্ষুশূল। কারণ অর্গানন ছিল তাদের প্রচলিত ব্যবস্থাটির কাছে একটা চ্যালেঞ্জের মতো। Dr. Robbi ছিলো হ্যানিম্যানের একজন কট্টর সমালোচক এবং তিনি অন্যান্য চিকিৎসকদের মতোই হোমিওপ্যাথি আর হ্যানিম্যানকে নিয়ে বিদ্রুপ করে বেড়াতো।
১৮২১ সালে হ্যানিম্যানের বিরুদ্ধে প্রচারণা যখন চরমে, তখন C. Baumgartner (যিনি ছিলেন Leipzig এর একজন স্বনামধন্য প্রকাশক) হোমিওপ্যাথির বিরুদ্ধে যুক্তি ও প্রমাণ সম্বলিত একটি বই চাইলেন। এমন একটা বই যা হোমিওপ্যাথি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। Dr. Robbi কে বইটি লিখার দায়িত্ব দেওয়া হলে তিনি এর জন্য কিছুটা সময় চেয়ে নিলেন এবং কাজটির জন্য তার তরুণ ও প্রচণ্ড মেধাবী সহকারী ছাত্র হেরিংয়ের নাম সুপারিশ করলেন। হেরিং ডা. হ্যানিমান ও হোমিওপ্যাথির বিরূদ্ধে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের কাজটি শুরু করলেন এবং আনুমানিক ১৮২২ সালের শীতের দিকে কাজটি শেষ করলেন। হেরিং তার লেখালেখির জন্য হ্যানিম্যানের কাজগুলো ঘাটতে গিয়ে “Nota bene for my reviewers” আর্টিকেলটিতে থাকা হ্যানিম্যানের বিখ্যাত উক্তিগুলো তার চোখে পড়লো, যেখানে তিনি তার সমালোচকদের নিয়ে তাদের উদ্দেশ্যেই কিছু কথা বলেছিলেন এবং যা ছিল Materia madica pura-র ৩য় খণ্ডের মুখবন্ধে-
“The doctrine appeals not only chiefly, but solely to the verdict of experience – ‘repeat the experiments’, repeat them carefully and accurately and you will find the doctrine confirmed at every step’ – and it does what no medical doctrine, no system of physic, no so-called therapeutics ever did or could do, it insists upon being judged by the result.”
-Dr. Constantine Hering (MD)
অর্থাৎ ডা. হ্যানিমান বলছেন-
পরীক্ষাগুলোর পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে মতবাদটি ভূয়োদর্শনের বিচারক্ষমতার কাছে কেবল তাকে মূখ্য হিসাবে নয়, একমাত্র উপায়-স্বরূপ সমর্থন প্রার্থনা করে- সেগুলোকে সতর্কতার সাথে নিখুতভাবে পুনরাবৃত্তি করার মাধ্যমে আপনি প্রতিটি ধাপে মতবাদটির সত্যতা নিশ্চিত করতে পারবেন- যা প্রাপ্ত ফলাফলকে বিচার করার উপর জোর প্রদান করে এবং যে কাজটি কোন চিকিৎসা-মতবাদ, কোন চিকিৎসাপদ্ধতি, তথাকথিত কোন ঔষধ-প্রয়োগবিজ্ঞান আজ অব্দি করেনি বা করতে পারেনি।
ডা. হেরিং এই চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করলেন এবং প্রথম ধাপে তিনি Cinchona নিয়ে নিজেই পরীক্ষা চালালেন। ফলাফল আসলো যেমনটা পূর্বাভাস হ্যানিম্যান আগেই দিয়েছিলেন। ডা. হেরিং হোমিওপ্যাথির সত্যতা অবলোকন করতে শুরু করলেন। হোমিওপ্যাথির মেটেরিয়া মেডিকার উপর পড়াশোনা তাকে হ্যানিম্যানের সিদ্ধান্তগুলোর বিষয়ে আরো নিশ্চিত করলো।
হোমিওপ্যাথির বিরুদ্ধে তার লিখা বইটি আর প্রকাশের আলো দেখতে পেলো না। ১৮২৪ সালের শীতের দিকে ডা. হেরিং একদিন মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে তার নিজের ডান হাতের তর্জনী কেটে ফেললেন। ক্ষতটি আস্তে আস্তে গ্যাংগ্রিনে পরিণত হলো। তখনকার সময়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ ক্ষতগুলো প্রাণনাশক ছিল। প্রচলিত ঔষধগুলো কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারল না। হেরিং এবং একই সাথে হোমিওপ্যাথিরও সৌভাগ্য যে, Kummer নামের হ্যানিম্যানের এক ছাত্র হেরিংকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা নিতে রাজি করালেন এবং তাকে Arsenic Album দিলেন। মাত্র কয়েকটা ডোজের পরই তিনি উন্নতি বুঝতে পারলেন এবং ক্রমান্বয়ে তার গ্যাংগ্রিন পুরোপুরি ভালো হয়ে গেল। ডা. হেরিং বিস্মিত হলেন এবং হোমিওপ্যাথির প্রতি তার অপরিসীম আগ্রহ সঞ্চার হলো।
তিনি আরো শিক্ষা লাভের জন্য হ্যানিম্যানের সাথে যোগাযোগ করলেন। হোমিওপ্যাথির বিরূদ্ধে লেখালেখির পরিবর্তে তিনি তার নিয়তি-নির্দিষ্ট হোমিওপ্যাথির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ একজন প্রবক্তায় পরিণত হতে, তৎক্ষণাৎ চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করলেন। তিনি সর্বোচ্চ সম্মানের সাথে Wuerburg University থেকে MD. ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন। তার থিসিসের বিষয়বস্তু ছিল- “De medicine in future” (The medicine in future). ১৮২৬ সালে তিনি গ্র্যাজুয়েট হন।”De Medina Futura” শিরোনামযুক্ত তার ডক্টরেট থিসিসে তিনি নিজেকে একজন হোমিওপ্যাথ হিসেবে ঘোষণা করেন।
১৮২৭-১৮৩৩ সালে সরকারের তরফ থেকে তৎকালীন রাজা ডা. হেরিংকে Surinam -এর রাজধানী Paramaribo-তে প্রাণী ও উদ্ভিদবিদ্যার উপর একজন গবেষক হিসেবে প্রেরণ করেন। এর অল্প কিছুদিন পরেই রাজা ডা. হেরিংকে তার হোমিওপ্যাথি নিয়ে গবেষণাকর্মগুলোকে প্রকাশ করতে বাঁধা দিলে ডা. হেরিং তার সেই চাকুরী থেকে ইস্তফা দিয়ে- Surinam সরকারের পক্ষ থেকে একজন সরকারি চিকিৎসক হিসেবে এর রাজধানী Paramaribo-তে কাজ করতে থাকলেন ।
ডা. হেরিং Paramaribo-তে তার নিজের বাড়ির ল্যাবে বুশমাস্টার সাপের বিষকে ট্রাইটুরেট করার সময় হঠাৎ করেই ল্যাকেসিসের প্রুভিং করেন। তিনি গো-বসন্তের টিকার একটি উন্নত বিকল্প উদ্ভব করতে সচেষ্ট হন, কারণ জেনার গো-বসন্তের যে টিকাটি ব্রিটেনে তৈরি করেছিলেন তা হেরিংয়ের কাছে চরম বিপদজনক ও হোমিওপ্যাথির দৃষ্টিতে একটি জগাখিচুড়ী পদ্ধতি বলে মনে হয়েছিলো। সাপের বিষ নিয়ে তার আগ্রহ ও অভিজ্ঞতা তার মাঝে এই ধারণা সঞ্চার করলো যে, পাগলা বা ক্ষিপ্ত কুকুরের লালা অথবা বসন্তের মামড়ির গুড়া, যে কোন রোগজ বস্তু, ভাইরাস বা জীবাণু, কিংবা বিষ দিয়ে হয়তো হ্যানিমানের নতুন পদ্ধতিতে রোগারোগ্যের একটি নিরাপদ উপায় (Fail-safe) প্রদান করা সম্ভব। ল্যাকেসিসের উচ্চ থেকে উচ্চতর শক্তিগুলো নিয়ে নিজের উপর পরীক্ষার পর পরীক্ষা চালাতে গিয়ে তার শরীরের ডান দিকটি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়। মানবকল্যাণে ত্যাগ স্বীকারের ক্ষেত্রে ডা. হ্যানিমানের সাথে ডা. হেরিংয়ের নাম স্বর্ণাক্ষরে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। Paramoribo -তে ৬ বছর থাকার পর, তিনি আমেরিকা এবং পরে ১৮৩৩ সালে Philadelphia-তে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
১৮৪৮ সালে তিনি Pennsylvania-তে প্রতিষ্ঠা করলেন Hahnemann Medical College at Allentown, যাকে হোমিওপ্যাথিক শিক্ষার সর্বকালের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। হেরিং এবং তার শিক্ষার্থীরা এক বছরে ৫০,০০০ এরও বেশি রোগীকে চিকিৎসা প্রদান করেন এবং ৩৫০০ হোমিওপ্যাথকে প্রশিক্ষণ দেন।
হেরিং তার বিশাল ক্লাসিক রচনা “The Guiding Symptoms of Our Materia Medica” ১৮৭৯ সালে তার মৃত্যুর বছরখানেক আগে সম্পূর্ণ করতে উদ্যোগী হন এবং অবশেষে তার শিক্ষার্থীদের দ্বারা ১৮৯১ সালে কাজটি সম্পন্ন হয় ও তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। ডা. হেরিং-ই প্রথম ব্যক্তি যিনি মাথাব্যথা ও হৃদরোগে সর্বপ্রথম (এলোপ্যাথিক চিকিৎসায় প্রথম ব্যবহৃত হবার ৩০ বৎসর আগে) নাইট্রোগ্লিসারিন ব্যবহার করেন। ১৮৮০ সালের ২৩ জুন একজন রোগীর হাউস-কল থেকে সন্ধ্যায় ফেরার পর হঠাৎ করে হার্ট এ্যাটাক করে মৃত্যুবরণ করেন।
ডা. হেরিং “Father of American Homeopathy” হিসাবে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়। তার প্রভাব USA পর্যন্ত বিস্তৃত হয় যার ফলস্বরূপ সেখানে প্রায় ৭০ বৎসর জুড়ে হোমিওপ্যাথি বিস্তৃতি লাভ করে। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘নম্রতার শক্তি অত্যন্ত ব্যাপক’।
তার কাজ ও অবদান:
- A Concise View of the Rise and Progress of Homoeopathic Medicine, 1833
- প্রধান প্রধান রোগগুলোতে ঔষধপ্রয়োগবিদ্যাসংক্রান্ত বিশেষভাবে লেখা তাঁর একটিমাত্র বই “The Homeopathic Domestic Physician”- ২টি খণ্ডে প্রকাশিত হয় ১৮৩৫ ও ১৮৩৮ সালে। এটা লেখা হয়েছিলো জরুরি ক্ষেত্রে বাসায় ব্যবহারের জন্য ঘরোয়া প্রেসক্রাইবারদের উদ্দেশ্যে।
- Hahnemann’s Three Rules Concerning the Rank of Symptoms, যা ‘হেরিং’স ল অব কিউর’ বা ‘হেরিং’স গাইডিং সিম্পটম্পস’ বা ‘হেরিং’স গাইডিং ডিরেকশন’ হিসাবে পরিচিত।
- Analytical Therapeutics (বিশ্লেষণমূলক ঔষধপ্রয়োগবিদ্যা)
- The Guiding Symptoms of Our Materia Medica, 10 volumes, 1879 – 1891
- এছাড়া তিনি ‘North American Homoeopathic Journal’, ‘The Homoeopathic News’, ‘The American Journal of Homoeopathic Materia Medica’ ইত্যাদির মূখ্য সম্পাদক ছিলেন।
- ড্রাগ প্রুভিংয়ের ক্ষেত্রে হেরিংয়ের অবদান এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ন্যাসসহ অন্যান্য সকল চিকিৎসকদের মন্তব্য, যদি হেরিং মেডিসিনের ক্ষেত্রে আর কোন অবদান না রেখে কেবলমাত্র একটি ড্রাগ ‘ল্যাকেসিস’ প্রুভিং করতেন, তাহলে সেটাই তিনি চিরস্মরণীয় হবার জন্য যথেষ্ট। শুধু এটুকুর জন্যই পৃথিবী চিরকাল তার কাছে ঋণী হয়ে থাকতো, চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকতো। হেরিং ৭২ টি ড্রাগ প্রুভ করেছিলেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – Cantharis, Colchicum, Iodium, Mezereum, Sabadilla, Sabina, Psorinum, Nux moschata, Lachesis, Crotalus, Apis mel, Hydrophobinum, Phytolacca, Platina, Glonoine, Gelsemium, Kalmia, Ferrum met, Fluoric acid, Phosphoric acid, Calcarea phos etc.
Discussion about this post