ডা. তপন কাঞ্জিলাল, বি. এম. এস
[হোমিওপ্যাথিক ত্রৈমাসিক হোমিও সমীক্ষার পঞ্চম বর্ষের, দ্বিতীয় সংখ্যায়, ১০/০৭/১৯৮৪ ইং তারিখে পূর্ব প্রকাশের পর]
শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ডা. ক্রিশ্চিয়ান ফ্রেডরিক স্যামুয়েল হ্যানিম্যান (জন্মঃ ১০ই এপ্রিল ১৭৫৫, মৃত্যুঃ ২২শে জুলাই ১৮৪৩) শিক্ষাগত দিক থেকে এলোপ্যাথ হলেও তাঁর ইপ্সিত লক্ষ্য সমস্ত চিকিৎসকের ইপ্সিত লক্ষ্য—রোগী তাঁর পূর্বের স্বাস্থে পুনঃ প্রতিষ্ঠার কাজে না পৌঁছতে পারার জন্য এলোপ্যাথিক পদ্ধতির উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাঁর ব্যাপক এলোপ্যাথিক প্রাক্টিস ছেড়ে দিয়ে নিজেকে নিয়োজিত করলেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পঠন পাঠনের মাধ্যমে সত্যে উপনীত হবার জন্য।
সত্যের পথ যে বন্ধুর, পদে পদে আছে ত্যাগ ও তিতীক্ষা তা তিনি জানতেন। তাইতো সত্যের খোঁজে হাসিমুখে বরণ করে নিলেন দেশ থেকে বিতাড়ন, অনাহার-অর্ধাহার। মারা গেল তাঁর সন্তান। কিন্তু সত্যের পূজারীর ধ্যান কোন কিছুতেই ভঙ্গ হলো না। ধীর স্থির এবং দৃঢ়ভাবে তিনি সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে গেলেন।
কালেনের (CULLEN) মেটেরিয়া মেডিকা অনুবাদ করতে গিয়ে দেখলেন—সিনকোনা তার তিক্ত আস্বাদের জন্যই নাকি ম্যালেরিয়ার ওষুধ। হ্যানিম্যানের বিজ্ঞানী এবং যুক্তিবাদী মন এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারলো না। তাঁর জিজ্ঞাসু মন প্রশ্ন করল—বিশ্বে তো অনেক রকম তিক্ত আস্বাদের বস্তু আছে তাহলে কি সে সবই ম্যালেরিয়া সারাবে? নিজের জিজ্ঞাসু মনকে সন্তুষ্ট করার জন্য নিজেই গ্রহণ করলেন সিনকোনা মাদার টিংচার। তিনি অনুভব করলেন ম্যালেরিয়ার মত লক্ষ্মণ বা অনেক ক্ষেত্রেই (সবক্ষেত্রে নয়) সিনকোনা প্রয়োগে সেরে থাকে। তখন তিনি বললেন সিনকোনা ম্যালেরিয়া সারে, কারণ এর ম্যালেরিয়ার মত রোগ লক্ষ্মণ সৃষ্টি করার ক্ষমতা আছে। জন্ম নিল চিকিৎসা শাস্ত্রকে বিজ্ঞান ভিত্তিক করার প্রথম নীতি—সদৃশ বিধান তত্ত্বের। (Similia similibus Curentur)—1790)
তখনকার লব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে এলোপ্যাথিক ছেড়ে হোমিওপ্যাথি করতে গিয়ে বিজ্ঞানী হ্যানিম্যান দেখতে পেলেন তাঁর অভিষ্ট সাধন হচ্ছে না। তখন আবার তাঁর মনে প্রশ্ন দেখা দিল—“তাহলে কি হোমিওপ্যাথি তাঁর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূর্ণ করতে পারবে না। সদৃশ বিধান তত্ত্ব কি সর্বত্র প্রযোজ্য নয়? তখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ওষুধের স্বল্পতাই কি এর কারণ, না সদৃশ বিধানতত্ত্বের প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোন বাঁধা এর জন্য দায়ী? এই ব্যপার নিয়ে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে অনুসন্ধান করেই বক্তব্য রাখলেন তাঁর সোরা (Psora) তত্ত্বের (সূত্র ৬০ ও উহার পাদটীকা) এবং বললেন রোগ দুই রকমের –
(ক)অ্যাকিউট ও
(খ) ক্রনিক।
ক্রনিক ডিজিজেস এর ব্যাখ্যায় বললেন—এর মূলে আছে সোরা, সিফিলিস এবং সাইকোসিস। শুরু হয় অজানিতভাবে (IMPERCEPTIBLE BEGINNINGS) এবং সঠিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা না হলে তা রোগীর সারাজীবন(মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত) চলে (সূত্র ৭২ অর্গানন অব মেডিসিন)।
ডা. হেরিং অর্গাননের তৃতীয় আমেরিকান সংস্করণের মুখবন্ধে শিক্ষক হ্যানিম্যানের এই ত্রিদোষ তত্ত্বকে অবজ্ঞা করে বলেন-
“কোন হোমিওপ্যাথ হ্যানিম্যানের তাত্ত্বিক বিষয় গ্রহণ করেন কিনা, তাতে কি এসে যায়- যদি তিনি আমাদের শাস্ত্রের মেটেরিয়া মেডিকা এবং হ্যানিম্যানের মূল নীতিগুলি মেনে চলেন? কোন চিকিৎসক তাঁর সোরা তত্ত্ব গ্রহণ করেন কিনা তাতেই বা এমন কি বিরাট কিছু আসে যায় যদি তিনি যথাসম্ভব সদৃশ ওষুধ সর্বদা নির্বাচন করেন?”
ডা. জন হেনরী অ্যালেন- ডা. হেরিং এর এই বক্তব্যে আপত্তি তুলে বলেন,
“ঘটনা হচ্ছে – আমরা যথসম্ভব সদৃশ ওষুধ খুঁজে পাব না যদি না আমরা মূল ক্রিয়াশীল মায়াজমকে বুঝতে বা চিনতে না পারি; কারণ সর্বক্ষেত্রেই সঠিক সদৃশ ওষুধ নির্ভর করে উপস্থিত মূল মায়াজমের ওপর”।
তাই মায়াজম চিনতে বা বুঝতে হলে দরকার সোরিক সিফিলিটিক ও সাইকোটিক লক্ষণসমূহকে জানা সঠিক আরোগ্যকারী হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করার জন্য।
আমাদের মহান শিক্ষক হ্যানিম্যান তাঁর লেখায় মূলত ৩টি মায়াজমের কথা বলেছেন- সোরা, সিফিলিস এবং সাইকোসিস কিন্তু আমরা আমাদের অনেক পূর্বসূরী এবং শ্রদ্ধেয় চিকিৎসক বৃন্দের লেখায় টিউবারকুলার মায়াজম বা অন্যান্য মায়াজমের কথা পাই। তাহলে মনে প্রশ্ন জাগে-
(ক) এই নতুন মায়াজমগুলো মহান হ্যানিম্যানের অসমাপ্ত কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সার্থক সফল প্রচেষ্টা, অথবা
(খ) এইগুলো ভুল?
মূলত ডা. জে, এইচ, অ্যালেন, এইচ রবার্টস এবং পি স্পাইট সহ অনেকেই টিউবারকুলার মায়াজমের কথা বা এরই ছদ্মনাম সিউডো সোরার কথা বলেছেন। এই সিউডো সোরার লক্ষণরাজী হচ্ছে সোরা ও সিফিলিসের সংমিশ্রণ।
যদি আমরা সোরা ও সিফিলিসের সংমিশ্রণের একটি নামকরণ করি তাহলে আমাদের দায়িত্ব আসে-
(ক) সোরা ও সাইকোসিসের সংমিশ্রণের ও
(খ) সোরা, সিফিলিস ও সাইকোসিসের সংমিশ্রণের নামকরণ করা।
যদি আমরা এগুলির নামকরণ না করি তাহলে সোরা ও সিফিলিসের নামকরণের কি সার্থকতা থাকতে পারে? সাধারণভাবে বলতে গেলে প্রাকটিস অব মেডিসিনে যাকে টিউবারকিউলোসিস বলছে তার দুটো অবস্থা (condition) আমরা দেখতে পাই, যথা-
(১) যেখানে ক্ষয় হচ্ছে যথা টিউবারকিউলোসিসের জন্য অস্থি ক্ষয়ে যাচ্ছে, ফুসফুস ক্ষয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি। আর মায়াজমের মূল চরিত্রের ভিত্তিতে আমরা জানি ক্ষয় হচ্ছে সিফিলিটিক মায়াজমের ধর্ম তাই এই ক্ষেত্রটি সোরা এবং সিফিলিটিক মায়াজমের মিশ্রণ।
(২) যেখানে ক্ষয় হচ্ছে না- হয়তো কোন কারণে X-Ray করা হয় বুকের এবং সেখানে দেখা যায় ক্যালসিফাইড স্পট। এটা পূর্ব রোগের মত ধ্বংসের প্রতীক নয়। অন্যদিকে এটাকে বৃদ্ধির স্বরূপ বলতে পারি। এই ক্ষেত্রটি সোরা ও সাইকোসিসের সংমিশ্রণ।
তাই আমার মতে টিউবারকিউলোসিস হলেই সেটা সোরা এবং সিফিলিটিক মায়াজমের কথা যাঁরা বলেন তাঁরা অবচেতনভাবে দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিকে IGNORE করেন। তাই প্রাকটিস অব মেডিসিনের টিউবারকিউলার প্রবণতা হচ্ছে-
একটি মিশ্রমায়াজমের অবস্থা তা সোরা ও সিফিলিস, সোরা ও সাইকোসিস অথবা সোরা সিফিলিস ও সাইকোসিসের সংমিশ্রণ।
এই সংমিশ্রণের কোন একটি অবস্থার অংশ বিশেষকে একটি মায়াজম যথা টিউবারকিউলার মায়াজম যদি আমরা বলি তাহলে তা ভুল হবে। সিউডো সোরা শব্দটার প্রয়োগ বিভ্রান্তিকর, কারণ সিউডো কথার অর্থ হচ্ছে- মিথ্যা বা অবাস্তব। এই অবস্থা কোনমতেই সিউডো নয়। পূর্বসূরী যাঁদের মতের সাথে আমি দ্বিমত পোষণ করলাম, তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ কারণ তাঁদের লেখাই আমাকে মায়াজম চিনতে সাহায্য করেছে। তাই পাঠকবর্গকে অনুরোধ করব শ্রদ্ধা সহকারে নিম্নপুস্তকসমূহ যেন পড়েন—
(১) হ্যানিম্যান. এস. —
(ক) অর্গানন অব মেডিসিন
(খ) ক্রনিক ডিজিজেস
(২) কেন্ট. জে. টি. —
(ক) মেটেরিয়া মেডিকা
(খ) লেসার রাইটিংস
(গ) ফিলসফি
(৩) অ্যালেন. জে. এইচ.— ক্রনিক মায়াজম
(৪) রবার্টস. এইচ. এ. — দি প্রিন্সিপ্লস অ্যান্ড আর্ট অব কিওর বাই হোমিওপ্যাথি
(৫) স্পাইট. পি. — কম্পারিজন অব দি ক্রনিক মায়াজমস
(৬) কাঞ্জিলাল. জে. এন.— রাইটিংস অন হোমিওপ্যাথি
(৭) ঘটক. এন. — প্রাচীন পীড়ার কারণ ও তাহার চিকিৎসা
Discussion about this post