ডা. শাহীন মাহমুদ:
বিগত কয়েকটি প্রবন্ধে আমি জেনাস এপিডেমিকাস নিয়ে বেশ কিছু কথা বলেছি এবং কেউ লক্ষ করেছেন কিনা জানি না- হোমিওপ্রোফাইলাক্সিসের ব্যাপারটা আমি সযত্নে এড়িয়ে গেছি। কিন্তু এরপরও বেশ কিছু চিকিৎসকের সাথে আলাপ-আলোচনায়, কিছু শিক্ষার্থীর জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হলো- এখনো অনেকে এই ব্যাপারগুলো সম্বন্ধে আসলে অতটা স্পষ্ট না; কিংবা তারা ব্যাপারটিতে ততটা সচেতন না, যতটা বিশেষ করে এই তীব্রভাবে চলমান মহামারীতে থাকার কথা। সবাইকেই মনে রাখতে হবে, আমরা আমাদের নীতি, শিক্ষা ও দর্শনের বাইরে গিয়ে মানবজাতির কোন উপকারই করতে পারবো না। কারণ, হোমিওপ্যাথিতে তত্ত্ব ও ব্যবহারিক দিকের চমৎকার সমন্বয় বিদ্যমান। আমাদের নীতিই হোমিওপ্যাথি, কোন নির্দিষ্ট প্রকারের ঔষধ নয়। প্রয়োগের কারণ ও প্রয়োগপদ্ধতি মূলনীতির অনুসরণ না করলে- সেখানে ঔষধ যে আকৃতি-প্রকৃতিরই ব্যবহার করা হোক, সেটা হোমিওপ্যাথি নয়।
যাই হোক, প্রথমেই আসি জেনাস এপিডেমিকাসের প্রসঙ্গটিতে। জেনাস এপিডেমিকাস, বা কোন নির্দিষ্ট মহামারীতে প্রদর্শিত লক্ষণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের সাথে সদৃশ নির্দিষ্ট ঔষধটির ব্যাপারে মহাত্মা হ্যানিমান মূলত তাঁর রচিত অর্গানন অব মেডিসিনের ১০০, ১০১, ১০২ ও ১০৩ নং এফোরিজমে আলোচনা করেন। সেখানে তিনি জেনাস এপিডেমিকাস নির্বাচনের যে সতর্কতামূলক কর্মপন্থা ও নির্বাচন-পদ্ধতি তুলে ধরেন, তাকে সহজভাবে বিবৃত করতে গেলে-
১. পৃথিবীতে এই নামের, এই ধরনের কোন রোগ কোনদিন দেখা দিয়েছিলো কিনা সে ব্যাপারে ধারণা করার কোন প্রয়োজন নেই। পর্যবেক্ষণ ছাড়া এই ক্ষেত্রে কোনরকম অনুমান বা ধারণাকে স্থান দেয়া যাবে না। একই নামের এই রোগটি আগেও দেখা গেছে এবং অমুক অমুক ঔষধে ভালো হয়েছে- এরকম কিছু শুনে থাকলেও তাতে মনোযোগ দেয়া যাবে না। চিকিৎসকের এ সম্বন্ধে আগে থেকে কোন ধারণা আছে, এমনকি কিছু কিছু ধারণা আছে- এ ধরণের কোন চিন্তাও মন থেকে মুছে ফেলতে হবে। কেউ এই রোগের চিকিৎসায় কোন কালে ভালো হয়েছে কি হয়নি, ভালো হলে কিভাবে হয়েছে- সে ব্যাপারেও আপনার চিন্তার কোন প্রয়োজন নেই। হোমিওপ্যাথিতে প্রতিবারের প্রতিটি এপিডেমিকই নতুন এপিডেমিক। কেবল দেখা দেয়া রোগটির লক্ষণসমষ্টি সংগ্রহ করতে হবে।
২. এবার এই এপিডেমিকটির সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো নিশ্চিত করতে হবে। বেশ কয়েকটি কেইস চিকিৎসা করার পর, দেখতে পাওয়া যাবে যে- কিছু সংখ্যক ঔষধই ঘুরে ফিরে একেক রোগীতে একেকটা প্রয়োজন হচ্ছে। সেই ঔষধগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে।
৩. এবং এদের মধ্যে ব্যবহার করা ভিন্ন ভিন্ন ঔষধগুলোতে কোন কোন বিশেষ লক্ষণের ভিত্তিতে পার্থক্য নির্ধারিত হচ্ছে- সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে। কোন্ ধরণের পার্থক্যকারী লক্ষণে ও কন্সটিটিউশনে কোন্ ঔষধ প্রয়োজন হচ্ছে- তা নিশ্চিত করে, এবার সেই কন্সটিটিউশন বা পার্থক্যকারী দুই একটি বৈশিষ্ট্য শুনেই দ্রুতগতিতে রোগীকে আরোগ্য করা যাবে।
এছাড়াও তিনি ২৪১ নং সূত্রে, Intermittent fever ক্যারেকটারের এপিডেমিক, একটি এলাকায় বা মহামারীর জেনাস এপিডেমিকাস নির্বাচনের শর্ত ও সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন,
Epidemics of intermittent fevers occurring outside of places where intermittent fevers are endemic have the nature of chronic diseases, composed of individual acute attacks. Each individual epidemic has its own consistent nature common to all individuals affected. If this is established from the totality of symptoms common to all the patients, it reveals the right homoeopathic remedy, the one specific to the epidemic; this remedy almost always helps patients who were fairly healthy before the epidemic and not chronically sick with developed psora. [Translated by Jost Kunzli]
তিনি এখানে জেনাস এপিডেমিকাস প্রযোজ্য হবার তিনটি শর্ত প্রদান করছেন-
১. সেটা কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের নির্দিষ্ট কোন স্থানীয় কারণ থেকে উৎপন্ন হয়নি।
২. সেখানকার সমগ্র রোগীতে একই প্রকার লক্ষণ-সমষ্টির প্রকাশ ঘটবে, যার দরুন একই প্রযোজ্য ঔষধ সবার জন্য নির্বাচন করা সম্ভব হবে।
৩. বিকশিত সোরার প্রভাবে তাদের স্বাস্থ্য আগে থেকেই দুর্ভোগের মধ্যে ছিলো না, আক্রমণের আগে সেই লোকজন সুস্থই ছিলেন।
এফোরিজমটিতে ‘Intermittent fever’ শব্দটি উল্লেখ থাকায় অনেকে এই শর্তগুলো অন্য প্রকারের মহামারীতে প্রযোজ্য কিনা, তা নিয়ে বোধহয় দ্বিধায় ভোগেন। আপাতত এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে সংক্ষেপে বলছি, এটি সর্বপ্রকার মহামারীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ সবার মাঝে একই প্রকারের লক্ষণসমষ্টি না থাকলে, একই ঔষধ কোনক্রমেই প্রযোজ্য হতে পারে না। আর মানুষের শরীরে লক্ষণ-বৈচিত্র্য সৃষ্টিই হয় রোগীর মধ্যে থাকা মায়াজমের দ্বারা তার কন্সটিটিউশনের দূষণের দরুন। সেখানে বিকশিত সোরার তীব্র প্রাদুর্ভাব থাকলে, সবার মাঝে একই প্রকারের লক্ষণ-সমষ্টি সৃষ্টি হবার প্রশ্নই উঠে না। মায়াজমের সক্রিয়তা যত বেশি থাকবে, পৃথক পৃথক রোগীতে তার প্রাদুর্ভাব ও লক্ষণ বৈচিত্র্য অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন ঔষধ তত বেশি লাগবে। আর একটি মহামারীতে বেশ কিছু বিচিত্র ঔষধ প্রয়োজন হলে- তাকে কি আর জেনাস এপিডেমিকাস বলা যায়! এজন্যই সম্প্রতি ডা. জর্জ ভিথোলকাস চলমান মহামারীটিতে জেনাস এপিডেমিকাস নির্বাচনের প্রযোজ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এবার আপনারাও চিন্তা করতে পারেন- আমাদের দেশের মানুষের মাঝে মায়াজমের যে প্রাদুর্ভাব ছিলো, স্বাস্থ্যের যে অবস্থায় আমরা ছিলাম বা আছি, আমাদের ক্ষেত্রে জেনাস এপিডেমিকাস নির্বাচিত হবার সম্ভাবনা কতটুকু। তারপরও যদি আমাদের অঞ্চলের সবার মাঝে একই বা নিতান্ত গুটিকয়েক প্রায়-একই রকমের লক্ষণসমষ্টি প্রদর্শিত হয়- তবে জেনাস এপিডেমিকাস নির্বাচিত হতে পারে। কিন্তু সেই তথ্য কি এখনো যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে? আমরা কি আমাদের এই অঞ্চলে কি ধরণের লক্ষণ-সমষ্টি নিয়ে মহামারীটি প্রদর্শিত হচ্ছে বা হবে- তা কি নির্দিষ্ট করতে পেরেছি?
বর্তমান সময়ের এপিডেমিক নিয়ে একটি সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকারে Dr. Ajit Kulkarni-ও ঠিক এই মন্তব্যটিই করেন,
“জেনাস এপিডেমিকাস যা চলমান মহামারীর লক্ষণসমগ্রের উপর নির্ভর করে- লক্ষণের পরিবর্তনের সাথে সাথে সেটিও পরিবর্তিত হতে পারে।….একজন হোমিওপ্যাথের জন্য বা ইনফ্লুয়েঞ্জা কেবল একটি নাম………………… ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য হোমিওপ্যাথিক দর্শন ও ব্যবহারিক চিন্তার সবচেয়ে প্রধান বিষয়।”
এবং তিনি আরো বলেন,
“লক্ষণাবলী ও প্যাথলজি এখন ভিন্ন এবং সঠিক উপায়ে সদৃশবিধান প্রয়োগ করতে চাইলে, যে অবস্থাটি এখন বিরাজ করছে, আমাদেরকে তার সমাধান করতে হবে। করোনা ভাইরাসের সম্ভাব্য বিধ্বংসী দিকটিকে আমাদের অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। COVID-19 তে মায়াজমেটিক মূল্যায়ন ভিন্ন হবে। একজন হোমিওপ্যাথ রোগের নামের উপর ভিত্তি করে প্রেসক্রাইব করেন না, বরঞ্চ অসুস্থ ব্যক্তি যে লক্ষণাবলী ও চিহ্নগুলো প্রদর্শন করেন তার সমগ্রতার ভিত্তিতে কিরেন।”
সর্বোপরি ডা. জর্জ ভিথোলকাস যে সিদ্ধান্তসূচক মন্তব্যটি করেন,
“আমি যেরকমটি আগে আলোচনা করেছি, এই ভাইরাসটির (COVID-19) জন্য ঠিক এই সময়টিতে কোন জেনাস এপিডেমিকাস নেই। একটি জেনাস এপিডেমিকাস তখনই পাওয়া যেতে পারে, যখন অধিকাংশ কেইসই একটি নির্দিষ্ট ঔষধ দ্বারা চিকিৎসা করা হবে ও আরোগ্য হবে; বলা চলে ৩০-৪০%।”
আমার মনে হয়, এ পর্যন্ত আলোচনাকৃত বিষয়বস্তুই জেনাস এপিডেমিকাস সম্বন্ধে ও বর্তমানে তার ধরণটি কেমন হতে পারে তা উপলব্ধি করার জন্য যথেষ্ঠ হবে। এবার আসি Homeoprophylaxis প্রসঙ্গে। মহামারীতে হোমিওপ্যাথিক প্রতিরোধক ঔষধ বা Homeopathic Prophylaxis হবে মূলত একটি মহামারীতে তার জেনাস এপিডেমিকাস হিসাবে নির্বাচিত ঔষধটিই। অতীতে মহাত্মা হ্যানিমান নিজেও বিভিন্ন মহামারীতে Homeopathic Prophylaxis ঔষধ প্রয়োগ করেছেন।
১৭৯৯ সালে, অর্থাৎ ‘Essay on a New Principle’ রচনাটি জন্মের ৩ বছর পরে, হ্যানিমান ইউরোপের স্কার্লেটিনা এপিডেমিকে তার চমৎকারভাবে ফলপ্রসু ও আরোগ্যকারী চিকিৎসা প্রদানে জন্য ব্যাপক সুখ্যাতি অর্জন করেন, যে এপিডেমিকটি স্বাভাবিকভাবেই জার্মানীতে চলমান ছিলো। এমনকি ১৮০২ সালে তিনি ‘Cure and Prevention of Scarlet Fever’ নামে একটি প্যামফ্লেটও রচনা করেন ও বিতরণ করার বন্দোবস্ত করেন। তিনি স্কার্লেটিনার Prophylactic হিসাবে বেলেডোনাকে এসময় ব্যাপক সমর্থন করেন ও প্রচার করেন। এর কার্যকরী ক্ষমতা ও ফলপ্রসূতার প্রমাণ বর্ণনা করেন।
এরপর থেকে ১৮০৮ সালের মধ্যে জার্মানিতে চলমান পরবর্তী স্কার্লেটিনার মহামারীর সময় তিনি একোনাইটকে নির্দিষ্ট Prophylaxis ঔষধ হিসাবে দেখতে পান এবং এ ব্যাপারে ১৮০৮ সালে তিনি ‘Observations on the Scarlet Fever’ নামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এবং এই মহামারী দু’টোকে পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তেও উপনীত হন যে, একই প্রকারের দু’টো মহামারীর জন্য জেনাস এপিডেমিকাস ও Prophylaxis আলাদা আলাদা হওয়াটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক নীতি। এবং অর্গানন অব মেডিসিনের ৮১ নং এফোরিজমের ফুটনোটে দ্ব্যর্থহীনভাবেই ঘোষণা করেন,
“No epidemic disease should be taken for any previous one and treated in the same way, since all that break out at different times are different from each other”.
যাই হোক, তারপর থেকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাজগতে বহুবার এই Prophylaxis ঔষধের অত্যন্ত সফল ব্যবহারের দৃষ্টান্ত লক্ষ করা যায়। যেমন- ১৯৫৭ সালে বুয়েনাস এয়ারসে সংঘটিত পোলিও-র মড়কে হাজার হাজার লোককে Lathyrus নামে একটি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ দেয়া হয়, যাদের মধ্যে একজনেরও পোলিও হয়েছে বলে রিপোর্ট পাওয়া যায় নি। ১৯৭৪ সালে ব্রাজিলের মেনিনগোকক্কাল মেনিনজাইটিসের এপিডেমিকে ১৮৬৪০ জন শিশুকে একটি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ রোগ-প্রতিরোধের জন্য দেয়া হয়। তাদের মধ্যে মাত্র ৪টি শিশুর মেনিনজাইটিস দেখা দেয়। ১৯০২ সালে ইউনাইটেড স্টেটসের লোয়া-তে স্মলপক্স এর এপিডেমিক দেখা দেয় এবং সেখানে ১৫ জন চিকিৎসক রোগটি প্রতিরোধের লক্ষ্যে ২৮০৬ জন রোগীকে Variolinum নামের একটি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রদান করেন। রোগ প্রতিরোধের হার ছিলো ৯৭%। এছাড়াও ডা. আইজ্যাক গোল্ডেন দীর্ঘ সময় ধরেই শিশুদের ভ্যাকসিনেশনের বদলে হোমিওপ্রোফাইল্যাক্সিসের কাছাকাছি একটি ব্যাপার হোমিওপ্যাথিক ভ্যাকসিনেশন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। আমি কয়েকটি উদাহারণ দিলাম মাত্র। মূলত এটি পৃথিবীতে লাগাতারই প্রয়োগ করা হয়েছে। বিস্তারিত জানতে চাইলে “Homeo-prophylaxis: Human Records, Studies and Trials” নামে Fran Sheffield এর করা কমপাইলেশনটি দেখে নিতে পারেন।
কিন্তু তারপরও হোমিওপ্যাথির মূলনীতির সাথে এই প্রক্রিয়াটি কিভাবে সঙ্গতিপূর্ণ সেই প্রশ্নটি বার বার উত্থাপিত হয়েছে। বিশেষ করে ডা. জর্জ ভিথোলকাস এ ব্যাপারে বেশ তীব্র মতামত ব্যক্ত করেছেন। হোমিওপ্যাথির মূলনীতি যেহেতু, ‘সদৃশ সদৃশকে আরোগ্য করে’। তার উপর ভিত্তি করে তার যুক্তি হচ্ছে, হোমিওপ্যাথিক ঔষধ যেহেতু লক্ষণসাদৃশ্যে প্রয়োগ করলেই কেবল কার্যকরী- কাজেই একজনের শরীরে যদি লক্ষণই না থাকে, তার জীবনীশক্তির যদি নেতিবাচক পরিবর্তনই না হয়ে থাকে- তাহলে সেখানে ঔষধের প্রতি সংবেদনশীলতাই বা কিভাবে তৈরি হবে? কিভাবে প্রয়োগকৃত ঔষধ শরীরে কোন প্রকারেরই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে? এবং তিনি সেই চিন্তার ভিত্তিতে প্রদর্শন করেন, মহাত্মা হ্যানিমান স্কারলেট ফিভারে ঔষধটি জেনাস এপিডেমিকাস হিসাবে বেলেডোনা নির্ণীত হবার পরে প্রয়োগ করেন ও সেই সমস্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র তা কার্যকরী প্রতিরোধক হিসাবে কাজ করে- যাদের এই বেলেডোনার লক্ষণসমষ্টির উদ্ভব ঘটার উপক্রম হয়েছিলো। তবে তার মতামত থেকে নির্দিষ্ট জেনাস এপিডেমিকাস ঠিকঠাকভাবে নির্বাচিত হলে, এবং সবার মাঝে একই লক্ষণসমষ্টি বিদ্যমান থাকলে- তৎকালীন বেলেডোনার মতো করে প্রতিরোধক ব্যবহারের সম্ভাব্যতাও ব্যক্ত হয়।
মূলত ডা. হ্যানিমান থেকে শুরু করে Hering, Boenninghausen, Kent, Allen, Boger প্রত্যেকেই Homeopathic Prophylaxis ব্যবহার ও প্রয়োগ করে গেছেন, এ নিয়ে কথা বলেছেন। Pierce Schmidt, Grimmer, William Gutman, Fergie Woods, Younan, ইত্যাদি চিকিৎসকগণও এর স্বপক্ষে লেখালেখি করেছেন। আগ্রহী ব্যক্তিগণ Dr. P. Sankaran এর “Prophylactics in Homeopathy” বুকলেটটিও পড়ে দেখতে পারেন।
তাহলে এবার সেই সূত্র ধরেই, বর্তমানে চলমান মহামারীর Genus Epidemicus ও Prophylaxis – এর ব্যাপারটিতে আসি। যেহেতু চলমান COVID-19 মহামারীর ক্ষেত্রে জেনাস এপিডেমিকাস এখনো হ্যানিমান প্রদর্শিত পদ্ধতিতে পৃথিবীর কোথাও ঠিকঠাকভাবে নির্বাচন করা হয়নি। কাজেই, এর প্রকৃত Genus Epidemicus ও Prophylaxis সম্বন্ধে নিশ্চিত করার সত্যিকারে কোন উপায় নেই। বর্তমানে চলমান কভিড-১৯ এর তীব্র সংক্রমণপ্রবণতা ও প্রাণহানিকর ক্ষমতার দরুন- ভারতের আয়ুশ (AYUSH) হ্যানিমান প্রদর্শিত পন্থায় কোন রোগীর চিকিৎসা ছাড়াই বা কোন রকম বৈজ্ঞানিক ও পদ্ধতিগত গবেষণা ছাড়াই Ars.a কে Homeopathic Prophylaxis হিসাবে ঘোষণা করে এবং প্রচুর সমালোচিতও হয়। তথাপি তারা একটি বিস্তৃত রেপার্টরিয়াল স্টাডির পর এই মন্তব্যটি প্রদান করায়, প্রকৃতপক্ষে তা অন্যান্য ধারণাগুলোর তুলনায় কিছুটা গ্রহণযোগ্য পর্যায়েই ছিলো- তবে সেটা জেনাস এপিডেমিকাস হিসাবে কখনোই নিশ্চিত কিছু বলে দাবী করার কোন উপায় নেই। আর জেনাস এপিডেমিকাস না হলে তাকে Prophylaxis বলারও কোন উপায়ই থাকে না।
প্রকৃতপক্ষে, আমাদের দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের অবস্থা ও তাতে মায়াজমের প্রাদুর্ভাবকে চিন্তা করলে, ঠিক Genus Epidemicus পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। বেশি কিছু বিচিত্র ঔষধের প্রয়োজন এক্ষেত্রে হতে পারে। আসলে, আমাদের জন্য প্রযোজ্য প্রকৃত Genus Epidemicus ও Prophylaxis টি ঠিকঠাকভাবে নির্বাচন করতে চাইলে, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, মানুষের শারীরিক ও মানসিক গঠন ও ধাতুপ্রকৃতিতে কি প্রকারের লক্ষণ নিয়ে প্রকাশিত হয়- তা পর্যবেক্ষণ করে ও কিছু সংখ্যক রোগীকে চিকিৎসার মাধ্যমে আরোগ্য করেই কেবল জানা যেতে পারে। এমনকি বর্তমান মহামারীতে Camphor – কে সম্ভাব্য জেনাস এপিডেমিকাস বলে সম্ভাবনা প্রদর্শনকারী ডা. রজন সংকরণও বলেন,
“আমি এ ব্যাপারে খোলাখুলি বলছি, প্রতিটি এলাকায় আলাদা আলাদা জেনাস এপিডেমিকাস হতে পারে, এমনকি কোথাও তা নাও থাকতে পারে –বিশেষ করে মৃদুভাবে আক্রান্ত কেইসে, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন ঔষধের প্রয়োজন হয় অথবা (বিশেষ করে মৃদু কেইসগুলোতে) কাউকে হয়তো তার মূল (কন্সটিট্শিনাল) ঔষধটি প্রয়োজন হতে পারে। আমাদের কিছু সহকর্মী দেন, রোগটির বিভিণ্ন স্টেইজে ভিন্ন ভিন্ন ঔষধ প্রযোজ্য হতে পারে। আমাদের এ ব্যাপারে খোলামন নিয়ে আলোচনা করা উচিৎ”।
তবে, একটি ব্যাপারে সবাই একমত এবং চিকিৎসকদেরও এটি মনে রাখা আবশ্যক যে, একজন রোগীর কন্সটিটিউশনাল ঔষধটি, কিংবা যে ঔষধটির দ্বারা রোগী সার্বিকভাবে (Especially In Mental/Emotional & Energy Level) উন্নতি লাভ করছেন- তার জন্য সেই ঔষধটিই সর্বোত্তম জেনাস এপিডেমিকাস এবং সর্বোত্তম প্রতিরোধক (অন্তত তার জন্য)। তার আর অন্য কোন ঔষধ গ্রহণের প্রয়োজন নেই এবং অন্য কোন ঔষধ তার নিশ্চিত ক্ষতি করবে (এমনকি সেই মহামারীর প্রতি সংবেদনশীলও করে তুলতে পারে)। কাজেই সাবধান!
এটাও মনে রাখতে হবে, কোভিড-১৯ এর সংক্রমণটি অন্যান্য মহামারী সংক্রমণের মতো নয়। বিশেষ করে, যাদের বেলায় তা তীব্রভাবে আক্রমণ করবে, তারা অন্যান্য মহামারীর মতো একটি ঔষধের দ্বারাই আরোগ্য না হবার সম্ভাবনাই বেশি। এছাড়া, এই সংক্রমণটি কয়েকটি ধাপে অগ্রসর হয়ে রোগীর মৃত্যু ঘটায়। চিনের Military Medical Research Journal –তে এটিকে ৭টি স্টেইজে ভাগ করে উপস্থাপন করা হয়েছে। Chinese Pharmaceutical Association থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও লক্ষণের ভিত্তিতে আমেরিকান গবেষক ও হোমিওপ্যাথ Dana Ullman – COVID-19এর ক্রমবিকাশের ৪টি পর্যায় বিভাজন করেছেন। ইন্ডিয়ার ডা. অজিত কুলকার্নিও করেছেন ৩টি ভাগে বিভাজন। এই বিভাজনের গুরুত্ব হচ্ছে- আরোগ্যকারী চিকিৎসা করতে গেলে, রোগী কোন ধাপে আক্রান্ত হয়েছে, কোন পর্যায়ে আছে সে অনুযায়ী তাদের আলাদা আলাদা ঔষধ প্রেসক্রাইব হবে।
তথাপি পৃথিবীজুড়ে COVID-19 আক্রান্ত রোগীদের এবং এ পর্যন্ত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের করা চিকিৎসা বিবরণী ও বিভিন্ন তাত্ত্বিক পর্যায়ের জেনাস এপিডেমিকাস ফাইন্ডিংসের আলোকে যা দেখতে পাওয়া যায়-
Hong Kong Association of Homeopathy ও Macau Association of Homeopathy প্রেসিডেন্ট Prof. Aaron To (aka 杜家麟) সেখানে প্রায় ৩০ জনের মতো চিকিৎসকের ১৪-২১ দিন চিকিৎসা করার অভিজ্ঞতা থেকে COVID-19 রোগীদের Gelsemium, Bryonia, Eupatorium perf এই তিনটি ঔষধকে সবচেয়ে উপযোগী বলে মন্তব্য করেন। তিনি Gelsemium – ৩০ কে সেখানে Prophylactic হিসাবেও ঘোষণা করেন। জেনাস এপিডেমিকাস ফাইন্ডিংস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা আমেরিকান হোমিওপ্যাথ Paul Herscu-ও প্রায় একই প্রকারের মন্তব্য করেন- তার মতে সে সময় সবচেয়ে প্রয়োগযোগ্য ঔষধ ছিলো Gelsemium, Mercurius ও Eupatorium perf।
কিন্তু এই ভাইরাসের মিউটেশনের মাধ্যমে পরিবর্তনের দরুন এবং বিভিন্ন দেশে সহজাতভাবেই এর প্রকাশিত লক্ষণের ভিন্নতার দরুন উক্ত ঔষধগুলোই আমাদের জন্যও প্রযোজ্য হবে তা কোনভাবেই বলা যায় না। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে করোনা ছড়ানোর ধরণ এক নয়। এশিয়াসহ অনেক অঞ্চলে এ ভাইরাস ছড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যাপক পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় ঠিক এই তথ্যটিই উঠে এসেছে। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, এমনকি ইন্ডিয়ারও একেক প্রদেশে একেকটি ঔষধের বা ভিন্ন ভিন্ন ঔষধগুচ্ছের প্রয়োজন হলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। চলমান সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে রোগীদের চিকিৎসার যে বিবরণ প্রকাশিত হচ্ছে এবং যে গুটিকতক করোনা আক্রান্ত (Confirmed) রোগীর চিকিৎসা হোমিওপ্যাথগণ করতে সমর্থ হয়েছেন, তার ভিত্তিতে যে ঔষধগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োগযোগ্য হচ্ছে বলে দেখা যাচ্ছে-
প্রথম পর্যায়ে (প্রাথমিক অবস্থায়)– Gels, Bry, Ars-a, Eup-perf
দ্বিতীয় পর্যায়ে (রোগের কষ্টকর অবস্থায়)– Bry, Ars-a, Phos, Kali-bi, Ant-t, Lyc
তৃতীয় পর্যায়ে (বাজে অবস্থায়)– Carb-v, Camph, Stann, Lach, Merc-s, Ars-a,
এছাড়া বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে Influenzinum, Pyrogenium, Tuberculinum এই নোসোডগুলোর প্রয়োজনীয়তার কথাও বিবেচনায় রাখা যেতে পারে।
কিন্তু আমি আবারও বলছি, এই সাজেশনটি নিয়ে কোনভাবে সংস্কারাবদ্ধ হওয়া উচিৎ হবে না। বরঞ্চ প্রকৃত পর্যবেক্ষণকারী চিকিৎসককে এই অঞ্চলে প্রাপ্ত রোগীতে প্রদর্শিত লক্ষণ-সমষ্টির ভিত্তিতে বিচার করতে হবে- আমাদের কোন ঔষধ বা ঔষধগুচ্ছের প্রয়োজন। এ যাবৎ প্রকাশিত লক্ষণগুচ্ছ এই ঔষধগুলোর দিকে ইঙ্গিত করলেও, নিজের মন-মস্তিস্ক ও চিন্তাটিকে এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে- আমাদের এখানে আক্রান্ত রোগীদের মাঝে এর একটা ঔষধও প্রযোজ্য না হলেও যেন সে বিস্মিত না হয়।
References:
- Organon of Medicine, Aphorism (100-103, 241)
- Taking the Case, On the Genus Epidemicus, by Will Taylor, M.D
- Research Review of Genus Epidemicus, International Journal of Advanced Ayurveda, Yoga, Unani, Siddha and Homeopathy, 2019, Volume 8, Issue 1, pp. 545-550
- Homeoprophylaxis – Can you believe it?, Article in Homoeopathic Links · January 2014, DOI: 10.1055/s-0035-1567883
- Homeoprophylaxis: The Great Misunderstanding, Articlein Homoeopathic Links 29(02):111-112 · June 2016
- The open answer of Prof. George Vithoulkas regarding the paper “Homeopathy for Coronavirus Covid-19 Infection by Dr Aditya Kasariyans and Dr Rajan Sankaran”, [INTERNATIONAL ACADEMY OF CLASSICAL HOMEOPATHY, March 15 at 8:20 PM]
- LETS ALL HOMEOPATHS COME TOGETHER In THIS, [An Open Letter from Rajan Sankaran as the response to the words of George Vithoulkas, April 1 at 6:18 PM]
- Coronavirus Covid-19 – Analysis of symptoms from confirmed cases with an assessment of possible homeopathic remedies for treatment and prophylaxis, Manish Bhatia (https://hpathy.com/)
- The COVID-19 Pandemic and Its Homeopathic Approach – Interview with Dr. Ajit Kulkarni (https://hpathy.com/)
- The Prevention of Epidemic Diseases by Homoeopathy, by David Little, HOE: 1996-2007 (Simillimum.com)
- Homeoprophylaxis: Human Records, Studies and Trials, Compiled by Fran Sheffield 2005 – 2014 (Updated 22nd August 2014) [www.fransheffieldhomeopathy.com]
- Treated cases of Confirmed Covid-19 published in ‘Complete Repertory, Clinical Cases’( Facebook page of- Roger van Zandvoort) & Others website sources
Discussion about this post