ডা. মাহমুদুল কবির:
হোমিওপ্যাথদের অবস্থা দেখলে আমার মাঝে মাঝে এতিমখানা চিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠে। কিছু অবোধ বালক এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে, এটা করছে, ওটা করছে; তাদের একগাদা অভিভাবক আছে বলে মনকে প্রবোধ দিচ্ছে এবং সেই শান্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছে, উঠছে, পড়ছে, খেলছে কিন্তু বাস্তবে পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃস্ব, ‘কিছুই-নেই’-দের বড় প্রজাতি হয়ে পৃথিবীতে অবস্থান করছে। হয়তো জানে, জেনেও না জানার ভান করে কিংবা হয়তো সেটা বোঝার মতো বুদ্ধিমত্তাও তাদের মাঝে বিকশিত হয়নি।
আমার কথা অনেকের কাছেই খারাপ লাগে, রুক্ষ মনে হয়। কিন্তু শুনতে রুক্ষ ও তিক্ত শোনা গেলেও এটাই হচ্ছে বাস্তবতা- সেটা হোমিওপ্যাথগণ স্বীকার করুন আর না করুন। অন্যান্য কিছু দেশ আমার এই দেখাটির ব্যাপারে কিছুটা (পুরোটা কোনভাবেই নয়) আপত্তি তুললেও তুলতে পারেন- কিন্তু বাংলাদেশে অন্তত সে উপায়টি নেই। এখানে হোমিওপ্যাথিক সম্প্রদায় বাস্তবিক অর্থেই একটি এতিম সম্পদ্রায় হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কেন বলছি এই কথা! এটা বোঝার জন্য আমাদের প্রাগৈতিহাসিক তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন পড়বে না। বিগত কয়েকদিনের নাটকীয় ও হাস্যকর কর্মবিবরণী পেশ করলেই সেটি যে কোন মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবার কথা।
অন্যান্য দেশের মতো- বাংলাদেশও চলমান দুর্যোগের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বাস্তব কথা হচ্ছে, আমাদের সীমাবদ্ধতার দরুন, আমরা এটাও এখনো জানি না- আমাদের দেশে এই সংক্রমণের সত্যিকারের চিত্র কি, বাস্তব পরিস্থিতি কি। কাজেই এই মহামারীতে দেশের প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি মুহূর্তে আছে ঝুঁকির মাঝে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে, আমাদের দেশের চিকিৎসকগণ। এবং এই চিকিৎসক সম্পদ্রায়ের মধ্যে- কারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে? উত্তরটা খুব কঠিন হবার কথা নয়- যারা জেনারেল প্র্যাকটিস করেন, তারা। আর এই জেনারেল প্র্যাকটিশনার বা কনসালটেন্ট ফিজিশিয়ানদের একটি বৃহৎ অংশ হচ্ছেন আমাদের হোমিওপ্যাথগণ; যাদের চিকিৎসা করার অনুমতি সরকার অনুগ্রহ করে (!) দান করেছেন।

কথা হচ্ছে, একটি পেশাগত সম্পদ্রায়কে চূড়ান্ত ক্ষমতা থেকে অনুমতি প্রদান করা হলো, তারপর আর তাদের কোন বিশেষ খোঁজ-খবর, কর্মপরিল্পনা প্রদান, মূল কর্মপরিকল্পনাতে সমন্বয়, ফলপ্রসূ চিকিৎসা-প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ (স্বল্পকালীন হলেও), চিকিৎসার তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ পদ্ধতি, পরীক্ষা-ব্যবস্থাপনা, নীতিমালা– কোনকিছুই দেয়া হলো না; এটিকে কেমন ধারার অনুমোদন বলা চলে? তাদেরকে কি তাহলে পরোক্ষভাবে এটাই বলে দেয়া হলো না যে, “তোমরা বাঁচলে কি মরলে, কিভাবে কি করবে- তা আমাদের দেখার বিষয় নয়। পারলে কিছু একটা করো, মানুষ দেখুক- তারা চিকিৎসক পেয়েছে- এটাই যথেষ্ট”। প্রকারান্তরে এটা কি চিকিৎসক ও জনগণ উভয়ের সাথেই একটি নীরব প্রহসন নয়!
এবার হয়তো মান্নাপ্রাপ্ত অনেকেই বলবেন- আমাদের চিকিৎসা-বোর্ড হয়েছে, জাতীয় পর্যায়ে কমিটি হয়েছে, হটলাইন চালু করা হয়েছে, আমাদের পিপিই দেয়া হয়েছে, ভ্রাম্যমান চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে, হোমিওপ্যাথগণ সংঘবদ্ধ উদ্যোগ নিয়ে ফ্রি ক্যাম্পেইন করছে এবং তাতে তাদের উচ্চপর্যায়ের উৎসাহ-উদ্দীপনা আসছে ইত্যাদি ইত্যাদি ফিরিস্তি। কিন্তু একটু ভালোভাবে কাজগুলোতে নজর ফেলুন, আসলে এই কাজগুলোর জন্যই এদেরকে এতটা এতিম বলে আমার কাছে মনে হয়েছে।
আমরা বিভিন্ন সংবাদে দেখেছি, একটি চিকিৎসা-বোর্ড হয়েছে; কিন্তু তার অস্তিত্ব কোথায়? কেবল কাগজে-কলমে? এই চিকিৎসা বোর্ড এ পর্যন্ত কী করেছে? বোর্ডের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত চিকিৎসকগণ কি দিক-নির্দেশনা পেয়েছেন? এই বোর্ড কোথায় কাকে চিকিৎসা করেছে? তাদের মহামারীর ফাইন্ডিংস কি? তারা কোন ঔষধগুলো বাংলাদেশের চিকিৎসকদের পরামর্শ দিয়েছেন? বাংলাদেশে কভিড-১৯ এর বহুসংখ্যক রোগী থাকা সত্ত্বেও, অর্গানন অনুযায়ী জেনাস এপিডেমিকাস ফাইন্ডিংসে তারা কি পদক্ষেপ নিয়েছেন? তারা নামের আগে পরে পদবী-টদবী প্রচার করে, পিচ্ছিল কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপনের বন্যা ছুটিয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছেন কিন্তু সেই স্রোতে ভেসে আরোগ্য আসছে কি? নাকি এদেশের হোমিওপ্যাথদের আশা-আকাঙ্ক্ষাও ভেসে যাচ্ছে? একটা মিটিংও কি তারা কোনভাবে ব্যবস্থা করতে পেরেছেন, নাকি করোনার ভয়ে তটস্থ হয়ে অনলাইনেই উড়ে বেড়াচ্ছেন?
বিশাল সংখ্যক এক চিকিৎসা-কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং আরো নাকি উপ-কমিটি, বিভাগীয় কমিটি, জেলা কমিটি গঠিত হবে। শুনে মনে হচ্ছে- এদেশের হোমিওপ্যাথিক কর্তৃপক্ষ কতটা সচেতন। কিন্তু প্রকৃত চিত্র কি? যেখানে এদেশে সংক্রমণের আগেই সমস্ত কর্মকাঠামো প্রস্তুত হয়ে যাবার কথা- সেখানে এই প্রক্রিয়া এখনো চলমান, এখনো… হবে (!)। তো সংক্রমণে মানুষ মরে-টরে শেষ হলে তাদের কাজটা কি হবে? নামের আগে কমিটি-সদস্য যোগ করা?
ধরা যাক, এই বিশাল কর্মযজ্ঞও সম্পন্ন হলো- তাতে কাজের কাজ কি হবে? এতগুলো চিকিৎসক, ভ্রাম্যমান চিকিৎসাপ্রদান উদ্যোগ, কলেজ-গুলোতে চিকিৎসাপ্রদান কর্মসূচি, হটলাইনে চিকিৎসা-পরামর্শ এসব কিছু দিয়ে কিভাবে প্রমাণ করবেন যে, আদৌ আপনারা একজন কভিড-১৯ এর রোগীকে আরোগ্য করতে পেরেছেন? জীবন বাজি রেখে করা চিকিৎসকদের এই শ্রম কিভাবে স্বীকৃতি পাবে? একটিবারও কি সরকারের কাছে যথাযথ পদ্ধতিতে আবেদন জানানো হয়েছে, সরকারী ব্যবস্থাপনায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাকে যুক্ত করার?
করার অনেক কিছুই ছিলো। কিছু দৃষ্টান্ত আমরা আশে-পাশে দেখতেও পাচ্ছি। গুজরাটে সরকারি ব্যবস্থাপনায় হোমিওপ্যাথি প্রয়োগ, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে ২৫২৬ জনের মাঝে হোমিওপ্যাথির কার্যকারীতা প্রমাণ করে এবার প্রায় ৭৭ লক্ষ মানুষকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা দেবার রাস্তা উন্মোচন করেছে, মুম্বাইয়ের সেভেন হিলস হাসপাতালে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হয়েছে ও তারা সরকারের কাছে হোমিওপ্যাথিক ঔষধে প্রয়োগ করার আবেদন জানাচ্ছে, রুবি হল ক্লিনিক তাদের স্ব-উদ্যোগে হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতার সুস্পষ্ট প্রমাণ হাজির করেছে। কিন্তু আমাদের এখানে? আমাদের দেশে হয়তো হাসপাতালগুলো (ব্যবসায়িক স্বার্থ সংরক্ষণকল্পে) স্ব-উদ্যোগে এই কাজগুলো করবে না, কিন্তু আমাদের এই বিশাল সংখ্যা-সমৃদ্ধ জাতীয় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা-বোর্ড ও চিকিৎসা কমিটি কি করছেন? এদেশেও কি সরকারের নিকট কোয়ারেনটাইনে থাকা লোকগুলোকে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগের আবেদন করা যেতো না? পার্শ্ববর্তী দেশ (এ কয়দিনে) যেখানে তাদের অধিকারের জন্য সুপ্রীম কোর্ট পর্যন্ত যেতে পারে, সেখানে আমরা আছি পিপিই বিতরণ ও প্রচার নিয়ে ব্যস্ত। এখানে কি আবারও সেই ‘দেখো, তোমাদের জন্য কত কি করছি, ঠাণ্ডা থাকো আর যা দিচ্ছি তাই নিয়ে জীবন বাজি রেখে লড়ে যাও’- এ কথাটিই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে না?
আজ অভিভাবকগণের এই আচরণের কারণেই, আমাদের হোমিওপ্যাথগণকে আমার এতিম বলেই মনে হয়েছে। কেবল এতিম নয়, অবোধ এতিম। তারা পিপিই পেয়ে মহাখুশী। কিন্তু যে মানের পিপিই নিয়ে তারা কভিড-১৯ মোকাবেলা করতে যাচ্ছেন- তা দিয়ে ভাইরাস তো দূরের কথা, মশা-মাছি, ধূলা-বালু ছাড়া কোনকিছুকেই ফেরাতে পারবে কিনা সন্দেহ; সন্দেহ আছে, শেষ-মেষ এটা পড়ে- গরমে সেদ্ধ হয়ে, আর ঘাম নিষ্কাষণ না করতে পেরে আবার সবাই গণহারে রোগ-ব্যারাম বাঁধিয়ে বসেন কিনা।
একটা বিশ্বব্যাপী ছড়ানো চরমমাত্রায় সংক্রমণশীল মহামারীকে ঠেকাতে অপরিকল্পিত ভ্রাম্যমান, ভাসমান ও ছুটন্ত-উড়ন্ত চিকিৎসা কখনোই কোন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা হতে পারে না। এ সময় কি আমাদের জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতার সংঘবদ্ধ ও সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি ছিলো না? এখন কি আমাদের মূল-ধারার চিকিৎসাব্যবস্থার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আমাদের সক্ষমতা প্রমাণের সময় নয়?
হ্যাঁ, এ কথাটিতেও হয়তো অনেকে অধিকাংশ হোমিওপ্যাথদের অযোগ্যতার ধ্বনি তুলবেন, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসা-প্রযুক্তি ও টেকনিকগুলো সম্বন্ধে হোমিওপ্যাথদের অজ্ঞতার কথাটি তুলে ধরবেন। কিন্তু হোমিওপ্যাথদের চিরজীবন পিছিয়ে থাকার জন্য কোন ওসিলাই যথেষ্ঠ শক্তিশালী নয়। এদেশে নূন্যতম যোগ্যতাসম্পন্ন অন্তত কিছু চিকিৎসক তো অবশ্যই রয়েছেন এবং তারাই অভিভাবক হিসাবে এই কর্মপ্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন। অন্তত মূলধারার সাথে থেরাপিউটিক অংশটিতে অংশগ্রহণ করার মতো যোগ্যতা তাদের অবশ্যই রয়েছে। যেখানে একটি জাতীয় পর্যায়ের চিকিৎসা-বোর্ড গঠিত হতে পারে এবং ১৬১ জনের একটা জাতীয় পর্যায়ে একটা কমিটি যেখানে হতে গঠন করা যেতে পারে – সেখানে এই কথাগুলো উত্থাপন করা শোভা পাবে না।
বর্তমান সময়ে মানুষের পাশে যদি হোমিওপ্যাথি না দাঁড়াতে পারে, তাহলে হোমিওপ্যাথির প্রতি শ্রদ্ধা কোন পর্যায়ের মানুষের মাঝেই আর অবশিষ্ট থাকবে না। এবং সেই দাঁড়ানোটি অবশ্যই প্রমাণ-তথ্য-উপাত্ত-পরিসংখ্যানভিত্তিক হতে হবে। এগুলো না থাকলে, আজকের আমাদের দাঁড়ানোর গল্প, আগামীকালের পরিহাস ও কৌতুকের বিষয়ে পরিণত হবে। পাশের দেশে হোমিওপ্যাথি তার জয়যাত্রা শুরু করেছে (পরিসীমায় তা যতটুকুই হোক), আমাদের দেশের হোমিওপ্যাথিক কর্তৃপক্ষ ও হোমিওপ্যাথগণ যদি এখনো সতর্ক ও সচেতন না হন- তাহলে আগামীকাল অপমান করার (সংযতভাবে বললাম) জন্যও কেউ একজন হোমিওপ্যাথকে খুঁজবে না।
Discussion about this post