ঘুম আমাদের মস্তিষ্কের একটি জটিল প্রক্রিয়া। এ বিষয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং এখনো চলছে। ঘুমের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য জানবার জন্য রোগীকে অনেকক্ষেত্রে পলিসমনোগ্রাফ যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করতে হয়।
বর্তমান এই ব্যস্ততার যুগে যেখানে মানুষের প্রবল সামাজিক, অর্থনৈতিক চাপের মধ্যদিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হয়, সেখানে সঠিক এবং নির্দিষ্ট সময়ের ঘুমই মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে নিশ্চিতভাবে সাহায্য করে। ফলে ঘুমের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু মানুষ অর্থ, ক্যারিয়ার প্রভৃতির পিছনে ছুটতে এত ব্যস্ত যে প্রকৃতির দেওয়া এই অমূল্য সম্পদটিকে কখন যে নিজের অজান্তে অবহেলায় হারিয়ে ফেলে তা সে নিজেই টের পায় না।
এখানে ‘নিদ্রা’ নামক অমূল্য সম্পদটির কথা বলা হচ্ছে। আর যখন সে টের পায় তখন হয়তো অনেকটাই দেরী হয়ে গেছে। জীবনের জটিলতার সাথে অনিদ্রা বা ডাক্তারী ভাষায় যাকে ইনসোমনিয়া বলে সেই রোগটির প্রকোপ বর্তমান সময়ে মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি গ্রামগঞ্জের অপেক্ষাকৃত সহজ সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষদের মধ্যেও এই রোগ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ ব্যাপারটিকে হালকাভাবে নিয়ে নিজেরাই দোকান থেকে ঘুমের ওষুধ কিনে খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। ফলে কিছু ক্ষেত্রে তা যেমন নেশার বস্তু হয়ে দাঁড়াচ্ছে অন্যদিকে দীর্ঘদিন এই জাতীয় ওষুধ খাওয়ার ফলে দেহের বিভিন্ন ভাইটাল অর্গান যেমন কিডনি, লিভার, এবং নার্ভ ঘটিত নানা রোগ জটিলতা দেখা দিচ্ছে। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় অত্যন্ত সহজ সরলভাবে এই রোগের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এই রোগের যন্ত্রনা যে কি তা অনিদ্রা বা ইনসোমনিয়ার রোগী মাত্রই জানেন।
নিদ্রা বা ঘুম নামক পদ্ধতিটি কয়েকটি পর্যায়ের মাধ্যমে হয়।
১. র্যাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ। এই পর্যায়ে চোখের নড়াচড়া হতে থাকে
২. নন র্যাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ। এই পর্যায়ে আমরা বিভিন্ন স্বপ্ন দেখি, অনেক সময় ঘুমের স্থাইত্ব এবং ঘভীরতার পরিবর্তন দেখা যায়।
তবে এই পর্যায় গুলির সমস্যা থাকলে অথবা যথাযথভাবে সংঘটিত না হলে মানুষ ইনসোমনিয়া বা অনিদ্রার শিকার হয়ে থাকেন।
কারণ:
- অলস জীবন যাপন
- অত্যধিক মাত্রায় চা কফি পান করার অভ্যেস থাকলে
- বিভিন্ন প্রকার মানসিক চাপ বা উত্তেজনা অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিসঅর্ডার (C.O.P.D) হলে
- হার্টের বিশেষ কিছু রোগের ক্ষেত্রে হতে পারে
- পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রস্টেট গ্লান্ডের বৃদ্ধিজনিত কারণে
- ক্যান্সার রোগীদের যন্ত্রণার কারণে
- প্রিয়জনের মৃত্যুজনিত শোকে মানসিক অবসাদ বা পারিবারিক সমস্যাজনিত কারণে
- অত্যধিক মাত্রায় মদ্যপান বা ধূমপানের অভ্যাস থাকলে
- যৌন হতাশা থেকেও অনিদ্রা হতে পারে
- দীর্ঘদিন ধরে কোনো জটিল ক্রনিক রোগে ভুগলে
- থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে
- বার্ধক্যজনিত কারণেও অনেক সময় অনিদ্রা লক্ষ করা যায়
- মেনোপজের পরবর্তী পর্যায়ে অনেক সময় মহিলাদের মধ্যে এই রোগটি দেখা যায়
- কিছু বিষেশ ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াজনিত কারণে
- অত্যধিক মাত্রায় কম্পিউটারে কাজ করলে বা টিভি দেখলেও অনিদ্রা জনিত রোগে ভোগার সম্ভাবনা থাকে
- প্রত্যাশা পূরণের ব্যর্থতাজনিত কারণে
- অনেক ক্ষেত্রে আবার দেখা যায় সাধ্যের অত্যধিক পরিশ্রম করলেও অনিদ্রার শিকার হতে হয়
- পেশাগত কারণে ঘুমের নির্দিষ্ট সময়ের পরিবর্তন হলেও অনিদ্রার প্রকোপ আসতে পারে।
লক্ষণ:
- ক্রমাগত দীর্ঘদিন অনিদ্রায় ভুগলে কাজের প্রতি মনোযোগ নষ্ট হয়
- অনিদ্রার ফলে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, সামান্য কারণে রোগী রেগে যায়
- মানসিক স্বতস্ফুর্ততা নষ্ট হয়ে মানসিক ভারসাম্যের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়
- অনেক ক্ষেত্রে স্বল্পস্থায়ী স্মৃতিশক্তি কমে যেতে দেখা যায়
- মনে আনন্দ ও ফুর্তির অভাব লক্ষ করা যায়
- যৌন জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়
- দুর্বলতা অনুভূত হয়
- এছাড়া মাথাব্যাথা, বমি ভাব, মাথা ঘোরা, শ্বাস কষ্ট প্রভৃতি লক্ষ করা যায়
- অ্যাংজাইটি বা মানসিক দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি পেতে লক্ষ করা যায়
- দৈনন্দিন কাজ কর্ম ব্যাহত হয়।
কী করবেন:
- ঘুমের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে
- শোবার ঘর বাড়ির অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি অংশে হওয়া উচিৎ, সম্ভব হলে বেডরুমের জানালায় ভারী পর্দা লাগান
- ঘুমের সময় তীব্র আলো জালানো উচিৎ নয়
- বিছানা শরীরের পক্ষে আরামদায়ক হওয়া উচিৎ
- প্রত্যহ একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়া ও ঘুম থেকে ওঠা উচিৎ
- সুস্থ যৌন সম্পর্ক সুনিদ্রা ডেকে আনে
- প্রয়োজনে যোগাসন অভ্যাস করতে হবে
- রাতের খাবার পরিমিত ও সহজপাচ্য হওয়া উচিৎ
- দিনের বেলায় বাইরের আলোর সম্মুখীন বেশি হওয়া উচিৎ এতে রাতের ঘুম ভালো হয়
- ঘুমোতে যাবার আগে মানসিক দুশ্চিন্তা সরিয়ে রাখাই বাঞ্ছনীয়
- অহেতুক ঘুমের ওষুধ খাবার অভ্যেস করবেন না
- মনে মনে সুখকর স্মৃতি কল্পনা করুন, লাভ হবে কিন্তু ঘুমের জন্য কাতর প্রার্থনা করলে আরও রেস্টলেস হয়ে পড়বেন।
পরীক্ষা- নিরীক্ষা:
Blood for T.C D.C E.S.R, Hb%.
Serum TSH
ECG
Serum Urea, creatinine. Uric acid
চিকিৎসা:
হোমিওপ্যথি চিকিৎসায় অনিদ্রাকে খুব সহজেই সারিয়ে তোলা যায়। আর যেহেতু হোমিওপ্যাথি ওষুধের কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই তাই দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে অন্যান্য জটিলতা আসে না। এক্ষেত্রে সাধারনত যে ওষুধগুলি দেওয়া হয় সেগুলো হলো- Nux Vom, Kali Phos, Ignatia, Coffea, Opinm, Cyprip প্রভৃতি। তবে কখনোই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ গ্রহণ করা উচিৎ নয় এবং নিয়মিত চিকিৎসকের ফলোআপে থাকা দরকার।
Discussion about this post