ডা. বিনোদবিহারী ঘোষ:
বর্তমান কালপর্বে অর্থই সমাজের পরিচালিকা শক্তি। অর্থলোভাতুর মানুষ সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রের দখলদার হতে সচেষ্ঠ। হোমিওপ্যাথির ক্ষেত্রেও এর ব্যাতিক্রম থাকবে কেন? তাই দেখা যায়, নানা ছলাকলায় ডাঃ হ্যানিম্যানের নাম ভাঙ্গিয়ে অর্থোপার্জনে মত্ত কিছু হোমিওপ্যাথ নামধারি ব্যক্তি, যারা এই পদ্ধতির রীতি-নীতি সম্পুর্ণ বিসর্জন দিয়েছেন। আরও আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে, হোমিওপ্যাথিক সমাজের একটি বিরাট অংশ এদের মদদ দিয়ে সহযোগিতা করছেন।
ক্রমান্বয়ে এই ধংসাত্মক আবহাওয়া শিক্ষায়তনগুলিতে অনুপ্রবেশ করেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে যে নীতিমালা আমাদের নিয়ন্ত্রিত করে কিংবা করা উচিৎ তা আর অনুসৃত হয়না। কলেজের পঠনপাঠনের মাধ্যমে প্রকৃত হোমিওপ্যাথ তৈরীর উদ্দেশ্য সঠিকভাবে সাধিত হচ্ছে না। শিক্ষকদের অনুসৃত দৃষ্টান্ত ছাত্রছাত্রীদের সঠিক এবং যথাযথ পথে পরিচালিত করছে না। যদি কোন কলেজের অধ্যক্ষ ৬X থেকে উচ্চতর শক্তি কদাচিৎ ব্যবহার করেন তবে ছাত্রছাত্রীরা বুঝবে যে, নিম্নশক্তিই সঠিক। এইভাবে দেখা যায় কোন এক প্রাক্তন অধ্যক্ষ একটি উচ্চশক্তির ওষুধ একমাত্রা দিয়ে ক্রমাগত বায়োকেমিক ৬X দিয়ে থাকেন। অন্য একজন একমাত্রা উচ্চশক্তি এবং বায়োকেমিক ও মাদারটিংচার ক্রমাগত দিয়ে থাকেন। আবার একজন অধ্যাপক নাক্স ভম ৩০, চেলিডোনিয়াম এবং নেট্রাম ফস ৬X ক্রমাগত খাইয়ে যাচ্ছেন।এ রকম দৃষ্টান্তের অভাব নেই, এই ধরনের বহু চিকিৎসক একসঙ্গে অনেকগুলো ওষুধ দিয়ে থাকেন। অবশ্য তাদের বক্তৃতায় এর সপক্ষে বিশেষ কিছু বক্তব্য রাখেন না অথবা প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যান। অনেকে অবশ্য আবার সততার সঙ্গে ব্যাবস্থাপত্রে এর উল্লেখ করেন আবার অনেকে সেটুকুও করেন না। তাদের অনুগামীরা এই ধরনের শিক্ষাই পান। ফলস্বরূপ তরুন প্রজন্ম হ্যানিম্যান নির্দেশিত তথা অর্গাননসম্মত পদ্ধতি সম্বন্ধে কোন শিক্ষা পান না। পেলেও কথায় এবং কাজের অসঙ্গতি তাদের বিভ্রান্ত করে। এই বিভ্রান্তি কাটিয়ে সঠিক রাস্তায় চলার হদিশ তো মেলে না উপরন্তু বৃহত্তর ক্ষেত্রের ক্রিয়াকলাপ দেখে তারা মনে করেন এই রাস্তাই বোধ হয় সঠিক।
ভারত সরকার, পশ্চিমবঙ্গ সরকার মিশ্র ওষুধ ব্যবহারের ফরমান জারী করেছেন বহুদিন ধরে। একটি পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত মিশ্রপ্যাথি তথা মিহিজাম-পদ্ধতি সম্বলিত পুস্তিকা স্বাস্থকেন্দ্রের প্রতিটি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের হাতে পৌঁছে দিয়েছেন। এই ফরম্যান তুলে নেবার অনুরোধ বারংবার করা সত্বেও সেন্ট্রাল কাউন্সিল অথবা স্টেট কাউন্সিল এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করেছেন বলে জানা যায়নি।
সেন্ট্রাল কাউন্সিলের কাছে কোন কাজের আশা করাটা অবশ্য অরন্যে রোদনের সমান। কারন দেখা গেছে কাউন্সিলের উচ্চপদাধিকারী ব্যাক্তিগন কম্বিনেশন, মিশ্র ওষুধ, টনিক, পেটেন্টের ভারতজুড়ে ব্যবসা করছেন। তাঁর সেলস্ফোর্স, হোমিওপ্যাথদের বাড়িতে কিংবা চেম্বারে গিয়ে হোমিওপ্যাথ সম্পর্কে শিক্ষা দিচ্ছেন। মিহিজামের মিশ্র ওষুধ নানাভাবে নানাঢঙ্গে শিকড় গেড়ে বসেছে। হোমিওপ্যাথির পীঠস্থান বাংলা তথা ভারত উপমহাদেশে আজ মহাত্মা হ্যানিম্যান অপাংতেয়।
বর্তমান ছাত্রছাত্রীরা আরও দেখছেন যে বড় বড় ব্যাবসায়ীগন উপঢৌকনের ডালি সাজিয়ে তাদের প্রলুব্ধ করছেন। নামী দামী প্রতিষ্ঠান, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগন, হোমিও পত্র-পত্রিকাগুলিতেও তাদের প্রলোভনের খপ্পরে আটকে পড়ছেন। জাঁকজমক করে ন্যাশ্নাল/ইন্টারন্যাশ্নাল কংগ্রেস, কি করে হবে? লাখ লাখ টাকা চাই যে। নেতাদের ওই ব্যাবসায়ীদের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। ওই ব্যাবসায়ীরাই সরকারি আইন কানুরের জোরে দাঁতের মাজন থেকে চুল, মুখের সৌন্দর্য ইত্যাদির জন্য ডাঃ হ্যানিমেন এবং হোমিওপ্যাথির নাম ভাঙ্গাচ্ছেন, মিথ্যে কথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে কোটি কোটি টাকা মুনাফা লুটছেন। হোমিওপ্যাথিক সমাজ তাঁদের হাতিয়ার হয়েছেন। কারন এদের মদদ ছাড়া এ ব্যবসা তো চলে না। তরুন ছাত্রছাত্রীরা এসব দেখছে এবং শিখছে।
তাই আজ কলকাতার অতিপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী একটি হোমিওপ্যাথিক কলেজের (প্রাতস্মরণীয় ডাঃ ডি এন দে’র নামাঙ্কিত) এক্স-স্টুডেন্টস আসোসিয়েশনের বার্ষিক সভায় তথাকথিত পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত অদ্ভুত মতবাদের ধারক, মিহিজাম গোষ্ঠীর অন্যতম এক ব্যাক্তিকে তাঁরা সম্বর্ধনা দিয়েছেন যার এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি কলকাতার কোন হোমিওপ্যাথিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, নিদেন পক্ষে ছাত্র হিসাবেও পরিচিতি নেই। যিনি নিজের চিকিৎসা ব্যাবসার ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথি নামটির অপব্যাবহার করে পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত অবৈজ্ঞানিক এবং প্রকৃত হোমিওপ্যাথি বিরোধী পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে প্রচুর রোগী দেখার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সর্বদা সচেষ্ট। ভাবতেও অদ্ভুত লাগে!সেই মিহিজাম কোঃ প্রাঃ লিমিটেড’র কর্ণধারকে সম্বর্ধনা এবং মানপত্র দিচ্ছেন কোন মঞ্চ? যেখানে এই ঐতিহ্যবাহী কলেজের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক, বাংলা তথা ভারতবর্ষের হোমিওপ্যাথির গৌরব ডাঃ এস পি দে, ডাঃ বিশ্বনাথ সেনগুপ্ত, প্রমুখ বিরল এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব উপস্থিত। এটা কোন আকস্মিক ঘটনা নয়। এটা আমাদের ধারাবাহিক অকর্মন্যতার ফলশ্রুতি। তবে উৎসাহের বিষয় এই যে, সভার সভাপতি ডাঃ হিরেন গুপ্ত মহোদয় সভার শেষে সেই মিহিজাম স্পেসালিস্টকে অত্যন্ত তীক্ক্ষ্ণতার সঙ্গে কতগুলি প্রশ্নবানে জর্জরিত করেছেন। যার সঠিক উত্তর দেবার বদলে তিনি নিজের ঢাক নিজেই বাজিয়ে কোন মতে এ যাত্রায় বি দায় নিয়েছেন।
বিভ্রান্ত ছাত্রছাত্রীদের দোষারোপ করা যায় না। এর পেছনে সংগঠিত কোন শক্তি কাজ করছে। আমরা সঠিকভাবে প্রকৃত হোমিওপ্যাথিকে শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছি। এ তারই পরিণাম। পরিনামের ফল ভোগ করতেই হবে।
আমাদের আহবান, যাদের কান্ডজ্ঞান এখনো অবশিষ্ট আছে তাঁরা মরিয়া হয়ে চেষ্টা করুন। এই অন্তর্ঘাতের মোকাবিলা করতে। হোমিওপ্যাথির দল, মত গ্রুপ নির্বিশেষে সভা সমিতিতে এই সমস্ত অপহোমিওপ্যাথি কারবারীদের প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং চরিত্র তুলে ধরুন। এখনো একনিষ্ঠ হোমিওপ্যাথ বহু আছেন।আছে তাদের বহু ছাত্রছাত্রী, আছে তাদের বহু সতীর্থ যারা ডাঃ হ্যানিমেনের অমর আবিষ্কারকে ধংস করতে দেবেনা। হোমিওপ্যাথির অগ্রগতির পথের বাঁধা অপসারিত হবে এ বিশ্বাস আমরা করতে পারি। হোমিওসমীক্ষা আমাদের সঙ্গে বরাবরই ছিল, এখনো থাকবে। হোমিও সমীক্ষার লেখনী এবং সমীক্ষা’র বিজ্ঞান সভাগুলি হবে হোমিওপ্যাথদের সংগ্রামের হাতিয়ার।
Discussion about this post