ডা. মহিমারঞ্জন মুখোপাধ্যায়:
সমস্ত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকই জানেন যে, বংশগত সূত্রে প্রাপ্ত ক্রনিক মায়াজমসমূহের বহিঃপ্রকাশিত মনোদৈহিক লক্ষ্মণসমূহকে বা রূপকে যখন বার বার অসদৃশ পন্থার চিকিৎসায় চাপা দেওয়া হতে থাকে তখন থেকেই অর্থাৎ সেই বাল্যকাল থেকেই রোগীটিকে টিবি, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, ব্রাইটস্ ডিজিজ, লিউকিমিয়া এবং ক্যানসার প্রভৃতি অত্যন্ত কঠিন রোগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার পথে ঠেলে দেওয়া হয়।
ডাঃ হ্যানিম্যান সোরা, সাইকোসিস, সিফিলিস এই তিনটি মায়াজমের আবিষ্কার করেন। পরবর্তী অধ্যায়ে ঐ তিনটির সংমিশ্রণে যে মায়াজম তৈরি হলো সেটির নামকরণ করা হয় টিউবারকুলার মায়াজম। পরবর্তীকালে আরও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যে একটি জটিল ভয়াবহ মায়াজমের সন্ধান আমরা পাই সেটিকে আমি নাম দিয়েছি “কার্সিনোমা মায়াজম” প্রকৃত ক্যানসার ও ক্যানসার মায়াজমের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। কার্সিনোমা মায়াজম আমি তাকেই আখ্যা দিতে চাই যে রোগটির ক্যানসার প্রকাশ হবার অনেক আগে থেকেই, এমন কি বাল্যকাল থেকেই একটা ক্যানসার হবার প্রবণতা বহন করে আসছে। অনেক চিকিৎসক এটিকে প্রি ক্যানসারাস স্টেজ (pre cancerous stage) নামে আখ্যা দিয়ছেন।
আমি আরও বলতে চাইছি যে, শিশুটি হয়ত বংশগত ভাবে সংমিশ্রিত মায়াজমের প্রভাবে কার্সিনোমা মায়াজম বহন কিরে আসছে এবং সুযোগ সুবিধা ও উপযুক্ত পরিবেশ পরিস্থিতির আনুকূল্য পেলে ঐ রোগবিষ দেহের যে যন্ত্রটিকে দুর্বল পাবে সেখানেই প্রকাশ পাবে। আর উক্ত মায়াজম বহনকারী শিশুটি যদি সাদৃশ বিধানের উপযুক্ত ধাতু সংশোধক চিকিৎসা পায়, তাহলে ঐ শিশুর ভবিষ্যত জীবনে ঐ ভয়ংকর ব্যাধিটি কখনও হতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা, আমরা ঐ প্রকারের শিশুদের সকলকে চিকিৎসা করার সুযোগ পাই না। সাধারণত এই রোগটি ধরা পরে একটু বেশী বয়সেই। এই অবস্থায় আমাদের কাছে এলে যখন দেখি প্রকৃত ক্যানসার অনেকখানি অগ্রগতি নিয়েছে তখন বহু ক্ষেত্রেই আমরা আরোগ্য দান করতে পারি না।
ক্যানসার চিকিৎসার সহায়ক বেশ কিছু প্রশ্নের মধ্যে এখানে দু-চারটির উল্লেখ করছি যথা—
⦿ ক্যানসার চিকিৎসায় আরোগ্য সহায়ক হবে এমন কি কি আবিষ্কার করতে হবে?
⦿ যে ক্ষেত্রে ক্যানসার আরোগ্য হয়েছে সেটা কেমন ভাবে সম্ভব হয়েছে?
⦿ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যার্থতা আসে কেন?
কিছু কিছু ক্যানসার আছে যাদের সূচনা অবস্থায় চিকিৎসা করলে ভাল হয়। মনে রাখতে হবে ক্যানসার বহু শ্রেণির আছে এদের মধ্যে কিছু শ্রেণি আছে যারা অতি দ্রুত ধ্বংস নিয়ে আসে, কিছু শ্রেণি আছে খুব ধীরগতিতে পরিণতির দিকে যায়। এতে দেহের প্রতিরোধ শক্তিও একটা ভূমিকা গ্রহণ করে। কিছু রোগী আমরা পাই প্রাথমিক অবস্থায় যাদের আরোগ্যদায়ক ওষুধ নির্বাচন উপযোগী লক্ষণ ও চিহ্ন পাওয়া যায়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ম্যালিগন্যান্ট গ্রোথসহ শক্ত ভাব নানা প্রকার যন্ত্রণা, পার্শ্ববর্তী গ্লান্ডসমূহ আক্রমণ এবং রোগীটির ক্রমবৃদ্ধি ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না।
যদি ঐ রোগীটির শিশুকাল থেকে আজ পর্যন্ত সমস্ত ইতিহাস জানা যায়, তাহলে হয়ত কিছু করা যায়। কিন্ত রোগী শিশুকালের কথা বলতে পারে না, তার শিশুকালের মানসিক অবস্থা কি ছিল বলতে পারে না, হয়ত মা-বাবা মারা গেছেন; এমনকি জীবিত থাকলেও অনেকেই সঠিক ভাবে বলতে পারেন না, রোগীর কোন নিকটাত্মীয়ও সঠিক জানাতে পারেন না। বেশির ভাগ রোগীতেই আমরা পাই শিশুকাল থেকেই এলোপ্যাথির দ্বারা চাপা দেওয়ার ইতিহাস, মানসিক লক্ষণ চাপা পড়েছে, চর্মরোগ চাপা পড়েছে, পোলিও বি সি জি, ত্রিপল অ্যান্টিজেন প্রভৃতি টিকা বারবার দেওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে এক গভীর জটিলতা, টনসিল, টিউমার অপারেশন এবং বহু বহু অ্যান্টিবায়োটিকস খেয়ে আদি লক্ষণসমূহ অবলুপ্ত হয়ে সামগ্রিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়—তখন রোগীটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগত একটি পরিষ্কার ছবি আমরা আর খুঁজে পাইনা।
ডাঃ কেন্ট বলেছেন,
“If the symptoms that have appeared from birth to the present date are undiscovered, it is not wonder that cancer is incurable.”
এই প্রকার ক্ষেত্রে যদি শিশুকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত কি কি রোগে ভুগেছে, কি কি চিকিৎসা হয়েছে তার ফলে কি অবস্থা দাঁড়িয়েছে? শিশুকালে অবাধ্য, গোঁয়ার, খুব ঝোঁকাল, প্রচন্ড কাঁদুনে, সকলকে বিরক্ত করে ছাড়তো, হিস্ট্রিক্যাল, প্রচন্ড ক্রোধী, খুব বোকা, খুব বুদ্ধিমান, অতি ভীতু কোন বিশেষ বস্তু বা পরিবেশে অতিভয়, বিশেষ কিছুর অনিবার্য আকাঙ্ক্ষা, অনিদ্রায় ভোগা ইত্যাদি এবং মেয়েদের বয়সন্ধিকালের লক্ষণসমূহ অত্যন্ত মূল্যবান। জীবন প্রারম্ভের কালে শিশুর বহিঃপ্রকাশিত বিশৃঙ্খলার ছবিসমূহকে নানা প্রকারের চাপা দিয়ে পরিবর্তিত করে দেওয়া হয়, তখন হোমিওপ্যাথির জন্য বিশেষ কিছুই থাকেনা। হোমিওপ্যাথিক আরোগ্যের জন্য সামগ্রিক লক্ষণ ও চিহ্নসমূহের প্রয়োজন অপরিহার্য। প্যাথলজির উপর হোমিওপ্যাথি হয়না। এই অবস্থায় শল্যচিকিৎসক কিছুই করতে পারেন না। উপশম দেওয়া এবং কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখাটা আরোগ্য নয়।
ডাঃ হ্যানিম্যান বলেছেন
“All curable diseases make themselves known to the intelligent physician in signs and symptoms.”
প্যাথলজিক্যাল লক্ষণসমূহ দ্বারা কখনও রোগ আরোগ্য করা যায় না। এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না লক্ষণসমূহ ও চিত্রসমূহ প্রকাশিত হচ্ছে ততক্ষণ আরোগ্য সম্ভব নয়। আনুপাতিক হারে যতবেশি প্যাথলজি বৃদ্ধি পাবে ততবেশী আরোগ্যদায়ী লক্ষ্মণসমূহ কমে যাবে। মূলতঃ যে কোন জটিল চির রোগ আরোগ্য করার কয়েকটি অনুকূল ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। যথাঃ-
১) বাল্যকাল থেকে আজ পর্যন্ত মানসিক, সার্বদৈহিক ব্যাধির লক্ষণসমূহকে ক্রমবিকাশ ধারা অনুযায়ী সংগ্রহ করা।
২) বর্তমানে রোগীটির ওষুধের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী জীবনীশক্তি যথেষ্ট পরিমাণে থাকা, এই জীবনীশক্তির ক্ষীণতা হোমিওপ্যাথিক আরোগ্যদানের প্রতিবন্ধক।
৩) রোগীর মধ্যে বংশগতভাবে কোন্ কোন্ মায়াজম বাসা বেঁধে আছে এবং বর্তমানে কোন মায়াজমটির প্রভাব প্রকট তার সঠিক অনুসন্ধান।
৪) রোগীর বাল্যকাল থেকে যদি কোন বিশেষ রোগ যথা টনসিল, ফিশচুলা, টিউমার অপারেশন দ্বারা তুলে দেওয়া না হয়ে থাকে।
৫) রোগী আরোগ্য সহায়ক তার ব্যক্তিগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য (Constitutional symptoms) সঠিক ভাবে চিকিৎসকের কাছে উপস্থাপন করতে পারে বা চিকিৎসক তা অনুধাবন করতে পারেন।
৬) যদি রোগীর কোন মূল্যবান যন্ত্রের (vital organ) যান্ত্রিক পরিবর্তন (Gross-pathological, organic and tissue changes) না হয়ে থাকে।
৭) যদি রোগী চিকিৎসকের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেন তাহলেই মাত্র একজন শ্রমশীল বিচক্ষণ চিকিৎসকের পক্ষে সেই রোগীটিকে আরোগ্য করা সম্ভব হতে পারে।
অধিকাংশ ক্যানসারের রোগী যখন চিকিৎসার জন্য আসেন, তখন হয়ত কয়েকবার অপারেশন করিয়েছেন, বহু এলোপ্যাথির প্রচণ্ড শক্তিশালী কেমোথেরাপি, আন্টিবায়োটিকস ষ্টেরয়েড গ্রুপের ওষুধ খেয়ে একটি জটিল অবস্থা সৃষ্টি করে নিজেকে শেষ করে এসেছেন, অনেক রেডিয়াম রে নিয়েছেন তখন হয়ত শুধুমাত্র প্যাথলজিক্যাল লক্ষণসমূহই উপস্থিত থাকে। এছাড়া রোগীর নিকট আর কিছুই পাবার আশা নেই এবং রোগীর জীবনীশক্তিও অনেক ক্ষীণ হয়ে যায়। এই অবস্থায় আরোগ্যদান সম্ভব হয়না।
আমার সুদীর্ঘ চিকিৎসক জীবনে বহু বহু তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে, তবে এইসব রোগীদের কিছুদিন যন্ত্রণাশূন্য অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি মাত্র, যা এলোপ্যাথিতে সম্ভব হয়নি। আমি ব্যাক্তিগতভাবে সুনিশ্চিত যে, বিশ্বের যে কোন প্যাথি অপেক্ষা একমাত্র হোমিওপ্যাথিই পারে উপযুক্ত সময়ে ধাতুগত চিকিৎসার দ্বারা ক্যানসার প্রতিরোধ করতে। ক্যানসার যখন সূচনার সময়ে আসে তখন অনেকক্ষেত্রে তাকে আরোগ্য করতে পারে একমাত্র হোমিওপ্যাথিই এবং ক্যানসার যখন উন্মুক্ত হয়ে এবং বহু অগ্রসরমান অবস্থায় আসে তখন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা তার অসহনীয় যন্ত্রণা কমিয়ে এনে তাকে কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারে।
ক্যানসার চিকিৎসা
প্রতিটি চির রোগের চিকিৎসার পদ্ধতি অনুযায়ীই এর চিকিৎসা হবে। অর্থাৎ আগেই রোগীটির বাল্যকাল থেকে আজ পর্যন্ত মানসিক, সার্বদৈহিক লক্ষণসমূহ সংগ্রহ করার পর লক্ষণসমূহের মূল্যমান নির্ধারণ, প্রয়োজনে রিউব্রিকগুলি সাজিয়ে যথাসময়ে রিপার্টরীকরণের পর যে ওষুধগুলি আসবে তাদের মধ্যে বর্তমান ক্ষেত্রে কোনটি রোগীর সঠিক উপযোগী হবে সেটি মেটেরিয়া মেডিকার সাহায্য নিয়ে ঠিক করে নেওয়া। রোগীর পূর্বক্ষেত্রে কোন্ কোন্ মায়াজম সংমিশ্রিত হয়েছে এবং বর্তমান লক্ষণ ও চিহ্নে কোন মায়াজমের প্রভাব বেশী বিকশিত সেদিকে অবশ্যই দৃষ্টি রেখে ওষুধটি নির্বাচিত হলে ভাল হয়। কোন অ্যাকিউট উপসর্গ এলে সাময়িক উপশমের জন্য কিছু অ্যাপ-সোরিক ওষুধ দেওয়া গেলেও, সব সময় অ্যান্টিমায়াজম্যাটিক ওষুধগুলির উপরই বিশেষ নজর রাখতে হবে। বিশেষ বিশেষ অঙ্গের এবং বিশেষ বিশেষ শ্রেণির ক্যানসারের ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিশেষ ওষুধের অধিকার আছে, সেগুলি বহু রিপার্টরী থেকে সংগ্রহ করতে হবে। তবে আসল কথা রোগীর বিশেষ কোন অঙ্গের উপর কোন ওষুধের গুরুত্ব স্বীকার করেও; আমার কথা রোগীর সামগ্রিক বৈশিষ্ট্যকে ছাপিয়ে কখনোই নয়।
ক্যানসারের advanced stage বা advanced pathological condition-এ গভীর ক্রিয়াশীল ওষুধ উচ্চশক্তির ব্যবহার নিরাপদ নয়, এক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী ৬, ১২, ৩০, ২০০ শক্তি পর্যন্ত ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে অনেকখানি নিরাপদ হলো ৫০ সহস্রতমিক শক্তির নিম্নতম অর্থাৎ ০/১ থেকে ধীরে ধীরে ক্রমোচ্চ মাত্রায় আরোহণ। সুদীর্ঘ চিকিৎসক জীবনে অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটের কিছুটা আলোকপাতের চেষ্টা করলাম বর্তমান প্রবন্ধে।
Discussion about this post