অনুবাদ: ডা. শাহীন মাহমুদ:
[এটি ডা. সাইরাস ম্যাক্সওয়েল বোগারের “A SYNOPTIC KEY OF THE MATERIA MEDICA” গ্রন্থটির “FOREWORD” অংশটুকুর সরাসরি অনুবাদ। উল্লেখ অংশটিতে কেইস-টেকিংয়ে লক্ষণের গুরুত্ব, মূল্যায়ন ও সংগ্রহপদ্ধতি সম্বন্ধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ বিধৃত হওয়ায়- ভাষান্তরের মাধ্যমে আমাদের পাঠকদের নিকট উপস্থাপনের চেষ্টা করা হলো। সেই সাথে এটি ডা. বোগারের সিনোপটিক কি বইটি সম্বন্ধেও পাঠকদের অর্থবহ প্রারম্ভিক ধারণা পেতে সহযোগিতা করতে পারে।]
সঠিক ব্যবস্থাপত্র- ঔষধজ লক্ষণকে রোগলক্ষণের সাথে যত্ন করে মেলানোর শিল্প এবং এজন্য প্রয়োজন হয়- লক্ষণচিত্রের অপরিহার্য দিকগুলোকে উপলব্ধি করার বিশেষ দক্ষতা, আমাদের বিশাল মেটেরিয়া মেডিকা থেকে কাজে লাগার মতো জ্ঞানটুকুকে আয়ত্ত্ব করার জন্য ব্যাপক খাটুনি এবং বিভিন্ন রেফারেন্স বইগুলোকে সর্বোচ্চ দক্ষতার সাথে ব্যবহার করতে পারার সক্ষমতা।
বইটির উদ্দেশ্য হচ্ছে এই কাজ করার পদ্ধতিকে সহজ করে হাজির করা- যাতে বেশিরভাগ কেইসে নিশ্চয়তার সাথে আরোগ্যকারী সঠিক হোমিওপ্যাথিক ঔষধটি খুঁজে বের করা যায়। এটি করতে বিশ্লেষণী (Analytic) ও সার-সাংক্ষেপিক (Synoptic) উভয় পদ্ধতির সমন্বয়কেই সবচেয়ে ভালো উপায় বলে বিবেচনা করা হয়। যেখানে সম্ভব, রোগীর মুখে তার ‘নিজের কাহিনী’ জানতে চাওয়ার মাধ্যমে রোগলক্ষণচিত্রের মূলমর্মটি সবচেয়ে ভালোভাবে পাওয়া যায়। তারপর প্রশ্নকারী এই বর্ণনাটিকে আরো বিশদ ও নির্ভুলভাবে নির্দিষ্ট করেন- যেখানে প্রথমেই রোগের কারণ ও পরিক্রমাটি তার বের করে আনা উচিৎ এবং তার সাথে তিনি অন্তর্ভুক্ত করবেন- যে বিষয়গুলো দুর্ভোগকারীর উপশম প্রদানের পথে বর্তমান অন্তরায় বলে মনে হচ্ছে, সেগুলো। বিশেষ করে অত্যন্ত সুস্পষ্টরূপে নিশ্চিত করা উচিৎ- রোগের প্রাকৃতিক পরিবর্তনসাধনকারী, হ্রাসবৃদ্ধিসমূহ (The modalities)। আর এ ধরণের প্রভাবকগুলোর মধ্যে নিচে উল্লেখিত বিষয়গুলো হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ: সময়, তাপমাত্রা, খোলা বাতাস, অবস্থানের ধরণ বা আসন, একা থাকা, নড়াচড়া, ঘুম, খাওয়া ও পান করা, স্পর্শ, চাপ, স্রাব ইত্যাদি।
গুরুত্বের ধারাবাহিকতায় এরপর বিবেচনায় আসে মানসিক অবস্থা। সেখানে ক্রোধপরায়ণতা, বিষণ্নতা অথবা ভয় হচ্ছে কর্তৃত্বকারী ফ্যাক্টর।
তৃতীয় পদক্ষেপটি রোগীর অনুভূতিগুলো সম্বন্ধে তার (রোগীর) নিজের বর্ণনার উপর কৃত মূল্যায়নের সাথে সংশ্লিষ্ট। ভুল পথে চালিত না হবার ক্ষেত্রে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিচের মৌলিক অনুভূতিগুলোর কোনটা (রোগীতে) বর্তমান আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া সবসময়ই উত্তম: জ্বালাপোড়া, খিঁচে নেয়া, কেটে ফেলা, ফেটে যাওয়া, থেঁতলানো ব্যথা, স্পন্দনশীল অনুভূতি এবং পিপাসা। আরো অনেক অনুভূতি থাকতে পারে কিন্তু প্রায়শই এগুলোর কোন একটা অন্যগুলোকে নিষ্প্রভ করে রাখে- বিশেষ করে যেগুলো হয়তো কল্পনাশক্তির লুকোচুরি থেকে উঠে আসে; বিশেষ কোন কাল্পনিক অনুভূতির তুলনায় এগুলো তার নিজ বৈশিষ্ট্যেই অধিক তাৎপর্যপূর্ণ।
ধারাবাহিকতায় এরপর আসে পর্যবেক্ষণযোগ্য সমগ্র বাস্তব দিক বা পীড়ার (Sickness) অভিব্যক্তি: যার মধ্যে বিশেষ করে থাকা উচিৎ- মুখভঙ্গি, চালচলন, স্নায়বিক উত্তেজনা, সংবেদনশীলতা, অস্থিরতা অথবা জড়ত্ব, স্রাবগুলোর প্রকৃতি বা তাতে উপস্থিত কোন অস্বাভাবিক রং।
সবশেষে, কোন অঙ্গ বা অংশ আক্রান্ত হয়েছে তা অবশ্যই নির্দিষ্ট করতে হবে; এটা অনুসন্ধ্যানটিকে রোগনির্ণয়ের সাথেও সম্পর্কিত করে।
দ্রুত রেফারেন্স হিসাবে প্রয়োজনের খাতিরে যেভাবে সাজানো যায়:
হ্রাসবৃদ্ধি: কারণ, সময়, তাপমাত্রা, আবহাওয়া, খোলা বাতাস, আসন, নড়াচড়া, খাওয়া ও পান করা, ঘুম, একা থাকলে, চাপ, স্পর্শ, স্রাব
মন: ক্রোধপরায়ণতা, বিষণ্নতা, ভয়, প্রসন্নচিত্ততা
অনুভূতিসমূহ: জ্বালাপোড়া, খিঁচে নেয়া, কেটে ফেলা, ফেটে যাওয়া, থেতলানো, স্পন্দনশীল, পিপাসা
বাস্তব অভিব্যক্তি: চালচলন, অস্থিরতা, স্নায়বিক উত্তেজনা, মুখভঙ্গি, জড়ত্ব, স্রাব, রং, গন্ধ
আক্রান্ত অংশ: অঙ্গ, ডানদিক, বামদিক
সারসংক্ষেপ (THE SYNOPSIS) প্রদান করার উদ্দেশ্য হলো- প্রতিটি ঔষধের সহজাত বৈশিষ্ট্য বা সাধারণ অভিব্যক্তিকে সুস্পষ্টরূপে তুলে ধরা, যাতে সে অনুযায়ী প্রেসক্রাইবার তার কর্মপন্থা ঠিক করে নিতে পারেন। কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণের ভিত্তিতে, ঘনিষ্ঠরূপে সম্পর্কযুক্ত ঔষধগুলোকে বন্ধনীর মাধ্যমে উল্লেখ করে- এর বিষয়বস্তুর পরিসীমাকে বেশ বৃদ্ধি করা হয়েছে; এটা স্বাতন্ত্রীকরণের কাজেও সহযোগিতা করবে।
রোগচিত্রের সমগ্রতার বদলে কোন বিশেষ ফ্যাক্টরের উপর অতিরিক্ত গুরুত্বারোপ এর (রোগচিত্রের) সমন্বয়কে বিনষ্ট করে এবং রোগের প্রাকৃতিক চিত্রের একটি বিকৃত ধারণা তৈরী করে- যা প্রায়শই আরোগ্যকে কঠিন করে তোলে। তবে তা (এ কথা দিয়ে) এটা বোঝায় না যে, সমস্ত লক্ষণগুলো একই সমান গুরুত্ব বহন করে- কারণ কোন কোনটার প্রভাব অবশ্যই অন্যগুলোর চাইতে অধিক গুরুত্ববহ, তথাপি কমগুরুত্বপূর্ণগুলোও তাদের অপরিহার্য অংশ। আমরা বন্ধুদেরকে স্রেফ তাদের ব্যক্তিত্বের আভাস বা ভাব দেখেই যেমন চিনতে পারি, ঔষধগুলোকে সেরকমভাবে চিনে নিতে হবে; একটি অবিরত পরিবর্তনশীল, যৌগিক বহিঃপ্রকাশ কিন্তু সবসময়ই যা একই অভিপ্রায়কে প্রতিফলিত করে।
যখনই নির্বাচিত ঔষধ কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয় বা খুব সামান্য প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, সেখানে হয় ঔষধ নির্বাচন ত্রুটিযুক্ত ছিলো অথবা যৌক্তিকভাবে যে সম্ভাবনাটি থাকে তা হচ্ছে, ক্ষেত্রটিতে মূল মায়াজমগুলোর একটি বর্তমান- যা সোরিনাম, সালফার, মেডোরিনাম অথবা সিফিলিনামকে আহ্বান করছে।
যখনই একটি একক মাত্রা থেকে আসা সার্বিক উন্নতি খুব ধীরে ধীরে হচ্ছে, সেখানে অন্য কোন ঔষধের নির্দেশক হিসাবে নতুন লক্ষণের আবির্ভাবের অপেক্ষায় না থেকে- আগের ঔষধটিই পরবর্তী উচ্চতর শক্তিতে পুণঃপ্রয়োগ করা উচিৎ; কারণ কেবলমাত্র সবচেয়ে সুদৃঢ়ভাবে প্রোথিত রোগসৃষ্টিকারী প্রবণতা, তার ভিন্ন ভিন্ন রকমের প্রকাশভঙ্গি সহযোগে- নির্দেশিত ঔষধের (শক্তির) সম্পূর্ণ ক্রমপর্যায়কে প্রতিহত করতে পারে। রয়ে যাওয়া লক্ষণগুলোর ঐসব নতুন বিকাশগুলোকে সূক্ষাতিসূক্ষ বিশ্লেষণ করলে- তা আমাদের অবশ্যই পরবর্তী (ঔষধ) নির্বাচনের দিকে দিকনির্দেশ করবে, তবে যতক্ষণ না লক্ষণের নতুন চিত্র- রোগের এই পর্যায়টি- পুরোপুরি একটি সুনির্দিষ্ট বা স্থির প্রকৃতি ধারণ করে, ততক্ষণ পর্যন্ত রোগচিত্রের ধারবাহিকতায় দৃশ্যত ঔষধটিকে বাছাই করা উচিৎ হবে না- সেরকম ক্ষেত্রগুলোতে আমরা সুবিধানুযায়ী আগের ঔষধেরই অন্য পোটেন্সি স্কেলে পরিবর্তন করতে পারি।
‘Synoptic Key’-এর এই নতুন পঞ্চম সংস্করণটি আমাদের পেশার সকল ভ্রাতাগণকে উৎসর্গ করা হয়েছে। (আগের সংস্করণগুলো থেকে) একমাত্র যে পরিবর্তনটি করা হয়েছে, তা হচ্ছে- আপাতদৃষ্টিতে বিশৃঙ্খল লক্ষণগুচ্ছগুলোকে তাদের গুরুত্বের বৈশিষ্ট্যানুযায়ী সমন্বয় করে সাজানো হয়েছে। সিমিলিমামের চূড়ান্ত নির্বাচনটি যার উপর প্রায় সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে। এমন একটি চিত্রকে তাদের (লক্ষণগুচ্ছকে) প্রতিফলিত করা উচিৎ, যেন তা সঠিক নির্দেশিত ঔষধের কথা বলে দেয়। শেষ এই সংস্করণটিতে আমার ব্যক্তিগত ফাইল থেকে অকাতরে রুব্রিক যুক্ত করা হয়েছে। অনেক ঔষধের লক্ষণ-বৈশিষ্ট্যকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যাতে তাদের ব্যবহারোপযোগীতা বৃদ্ধি পায়- বিশেষ করে স্বাতন্ত্রীকরণটিকে নির্ভুল করার ক্ষেত্রে। রেপার্টরিটি কেবলমাত্র অনুসন্ধ্যানকারীকে পথ দেখানোর অভিপ্রায়ে তৈরি করা হয়েছে।
সদৃশতম ঔষধটির, বিশৃঙ্খল জীবনীশক্তির সংস্পর্শে সহজাত যে সম্ভাবনাগুলো সৃষ্টি হবে তা আগে থেকে জানা যায় না। কাজেই প্রতিটি প্রেসক্রাইবারের আরোগ্যকারী ঔষধ নির্বাচনে চরম সতর্কতা অবলম্বন করা কর্তব্য। প্যারাসেলসাসের সেই কথাটি সবসময়ই সত্য, “Erste buch von blatern” [chap. 8. 1528], “কাজেই ব্যাপারটা এরকম- মার্কারি, (ইত্যাদি)-আরোগ্য করে- কেবল যা কিছু মার্কিউরিক”(“Just so, Mercury, (etc.), -cures- things Mercuric”)। পুরো প্যাথজেনেটিক লক্ষণগুচ্ছের মধ্যে যে প্রবাহ চলতে থাকে- তাকে ঔষধের “সহজাত ক্ষমতা” (genius) বলা হয়েছে। প্রেসক্রিপশনের ক্ষেত্রে তাকে তার যথাযথ অবস্থান প্রদান করা প্রতিটি প্রেসক্রাইবারের আদর্শ হওয়া উচিৎ। এই লক্ষ্যেই বইটি লেখা হয়েছে।
Discussion about this post