ডা. শাহীন মাহমুদ:
গত কয়েকদিন ধরে করোনা ভাইরাসটি আমাদের মন-মগজের যথেষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। যতটা মনে হচ্ছে, এটি এখন একটি বিশ্ব আতঙ্কের নাম! মানুষের আতঙ্কিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। যে রোগ এতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, এতো অল্প সময়ে ২০টিরও বেশি দেশে যার অস্তিত্বের সন্ধ্যান পাওয়া গেছে এবং এত চকচকে চিকিৎসাব্যবস্থার যুগে কেবলমাত্র চীনেই ইতোমধ্যে ২৫৯ জন মারা গেছে, আক্রান্ত হয়েছে ১১৭৯১ জন (১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, সর্বশেষ মৃতের সংখা দেখুন), মৃতের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলছে। ফলে তা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। সতর্কতা ও সক্রিয়তা কেবল সঙ্গত নয়, কাম্যও বটে। কিন্তু কোনো একটা প্যানিক যেখানেই ছড়িয়ে পড়ুক, সেখানে কিছু মানুষের অন্তত মস্তিষ্ককে শীতল রাখতে হয়- সেই প্যানিককে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ও সমস্যাটির সমাধান করার জন্য- বিশেষ করে যাদের সে সামর্থ্য আছে।
আমরা জানি, করোনা ভাইরাস একটি ভাইরাস-ঘটিত সংক্রমণ। কাজেই প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থা এর আরোগ্যকারী চিকিৎসা প্রদানে অক্ষম। তারা ম্যানেজমেন্ট, স্বাস্থ্যবিধি, কোয়ারেনটাইন ইত্যাদি উপায়গুলোর পূর্ণ সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাপারটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করবে। তাদের সে সক্ষমতাও আছে এবং হয়তো সে আন্তরিকতাও আছে। কিন্তু তাদের আরোগ্যকারী চিকিৎসা দিতে না পারার জন্য নিজেদের মধ্যে থাকা অন্তর্নিহিত দুর্বলতা থাকাটা অবধারিত। আর সাধারণ মানুষের প্যানিক হওয়াটা যে স্বাভাবিক – সেটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু আমার প্রশ্ন – আমাদের হোমিওপ্যাথিক সম্প্রদায়কে নিয়ে। দেখে মনে হচ্ছে, তারা মোটেও আতঙ্কগ্রস্থ হননি। বরঞ্চ একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী বলে বোধ হচ্ছে। কিন্তু অতিরিক্তি আত্মবিশ্বাসের উৎপত্তিস্থল অনেকসময় আত্মপ্রত্যয়হীনতার মধ্যেও অবস্থান করে- আর আমার ভয় এটাই।
গত কয়েকদিন ধরে, ফেসবুকসহ অন্যান্য মিডিয়াগুলোতেও আমাদের হোমিওপ্যাথিক সম্প্রদায় করোনা ভাইরাস সম্বন্ধে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। কেউ কেউ করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে বিশেষ বিশেষ মতামত দিচ্ছেন, কেউ কেউ এর সাবধানতা নিয়ে সতর্ক করছেন। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য লাগছে- একটা ব্যাপক সংখ্যক হোমিওপ্যাথ এই রোগটিতে কি কি ঔষধগুলো প্রযোজ্য হবে – সে ব্যাপারে দেয়া তাদের মতামতের বহর দেখে। এবং আরও কিছু অতি-উৎসাহী, অতি-আত্মবিশ্বাসী হোমিওপ্যাথ তাদের ক্লিনিকের ঠিকানা দিয়ে আহ্বান জানাচ্ছেন- আরোগ্য করতে পারার আশ্বাস প্রদর্শন করে।
যারা চিকিৎসা করতে পারবেন বলে আহ্বান করছেন, তাদের ব্যাপারে আমি কিছু বলবো না- কারণ আমার লেখার অন্যান্য আলোচনাতেই এ ব্যাপারে মতামতটি ব্যক্ত হবে। যারা সাবধানতাগুলো উল্লেখ করে সতর্ক করছেন- তাদেরও আলাদাভাবে বলার কিছু নেই। কিন্তু যারা রোগটির ক্ষেত্রে ঔষধের নামগুলো সাজেস্ট করছেন- তাদের এই কাজটির ব্যাপারে আমার কিছু প্রশ্ন আছে।
১. এই কাজটি তারা কেন করছেন?
২. আপনার এই কাজটির ভিত্তি কি?
৩. কাজটি করা কি হোমিপ্যাথিক দৃষ্টিকোণ থেকে নীতিসঙ্গত হয়েছে?
৪. কি করা উচিৎ ছিলো?
এবার প্রথম প্রশ্নটির ব্যাপারেই যদি কথা বলি- কাজটি তারা কেন করছেন? মানবসেবা? হোমিওপ্যাথির অপরিহার্য মূলনীতির একটি হচ্ছে- ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতা। এখানে কিছু নির্দিষ্ট ঔষধের নাম সম্ভাব্য রোগীগণকে ও প্রতিটি সাধারণ মানুষকে জানিয়ে দিয়ে আপনি কোন প্রকারের মানবসেবা করছেন? এর প্রকৃতি কি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের মানবসেবার নীতি ও প্রকৃতির সাথে সঙ্গত?
না, আপনারা হয়তো এটি সম্ভাব্য আক্রমণের প্রতি প্রস্তুত থাকার জন্য- সম্ভাব্য ঔষধের নাম চিকিৎসকদের অবগত করে রাখছেন; যেন তারা আগাম স্টাডি করতে পারে, ঔষধ সংগ্রহ করে রাখতে পারে। বেশ, ভালো কথা। সেটা তাহলে পাবলিক প্লাটফর্মে কেন? এর প্রস্তুতি কি এভাবে হবার কথা ছিলো? যে যা খুশি তাই বলবে, একেকজন একেক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে মতামত ব্যক্ত করবে এবং তা ব্যাপক হারে প্রচার করবে!
এর মাঝে মাত্র দুইদিন আমি পোস্টগুলোকে সেইভ করে ঔষধগুলোতে চোখ বুলালাম। তাতেই অন্তত ৩০টি ঔষধের নাম দেখতে পাচ্ছি- যেখানে মাদারটিংচার থেকে উচ্চশক্তির ঔষধ সবই আছে। সাধারণ মানুষের কোনটা নেয়া উচিৎ সেই প্রশ্নটা নাহয় বাদই দিলাম। আপনারা যাকে অনুসরণ করছেন, ডা. হ্যানিমানের মতো করে প্রমাণ দিয়ে বলুন, কার কথা আমার নেয়া উচিৎ এবং কেন নেয়া উচিৎ?

জানি, এবার হয়তো অনেকেই ডা. হ্যানিমানের কলেরার ব্যাপারে করা ভিরেট্রাম, ক্যাম্ফর, কুপ্রাম সম্বন্ধে পূর্বানুমানের উদাহরণ দেবেন এবং প্রত্যেকেই যার যার নিজের প্রেসক্রিপশনের ব্যাপারে- আপনার একান্ত নিজস্ব যুক্তিটা দাঁড় করিয়ে ব্যাপারটাকে হালাল করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু এটাও তো ভুললে চলবে না- ডা. হ্যানিমান সেখানে সাধারণ বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্যের ভিত্তিতে অনুমানের কথাই বলেছিলেন, নির্দেশনা নয় এবং সেটাও বহুযুগ ধরে একই সাধারণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে দেখা দেয়া- একটি রোগলক্ষণগুচ্ছের ব্যাপারে; আক্রমণচলাকালীন সময়েই মিউটেশন হওয়া কোন ভাইরাসের আক্রমণের ব্যাপারে নয়। এবং অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন হোমিওপ্যাথির আবিষ্কর্তা মহামানবটি ঔষধের প্রুভিং থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই মতামত প্রদান করলেও (আমি মনে করি, যারা খাঁটি প্রুভিং করেন- তাঁর নিজ শরীরে প্রুভিংকৃত ঔষধের ব্যাপারে এতটুকু মতামত দেবার অধিকার তারা রাখেন), অর্গাননের ষষ্ঠ সংস্করণে তিনি আমাদের তা করতে নিষেধ করে গেলেন- এমনকি এই ‘জেনাস এপিডেমিকাস’-এর ক্ষেত্রেও। (এফোরিজম – ১০০)
যাই হোক, সেটাও নাহয় মেনে নিলাম- তারা পূর্বানুমানই করছেন, হ্যানিমানের মতো করে (হ্যানিমানের নির্দেশনা মোতাবেক নয়!) কাজ করতে গিয়েই বাধ্য হয়েছেন; কিন্তু সেটা কিসের ভিত্তিতে? ডা. হ্যানিমান ‘জেনাস এপিডেমিকাস’-এর চিকিৎসার একটি পদ্ধতি অর্গাননে সুস্পষ্টভাবে প্রদর্শন করে গেছেন। কারো কি সেই পদ্ধতি অনুযায়ী পূর্বানুমান করার সামর্থ্য হয়েছে? একটা পোস্টেও কি ভিত্তি হিসাবে তাকে অনুসৃত করে সিদ্ধান্তে আসার বিবরণ প্রদান করা হয়েছে?
সেটা সম্ভবও নয়- কারণ আক্রমণটা দেখা গেছে মূলত চীনে। সেখানেই মারা গেছে ২৫৯ জন। এই কাজটি যদি প্র্যাকটিক্যালি কারো পক্ষে করা সম্ভব হয়- তাহলে তা হচ্ছে, সেই চীনের হোমিওপ্যাথদের। এ পর্যন্ত তাদের কথা মাত্র একটি জায়গায় পেয়েছি- যেখানে ৩০ জন হোমিওপ্যাথ কয়েকটি ঔষধের সম্ভাবনার ব্যাপারে মতামত প্রকাশ করেছেন। মতামতটি এসেছে Paola Brown এর প্রচেষ্টা ও যোগাযোগের ফলস্বরূপ Hong Kong Association of Homeopathy and the Macau Association of Homeopathy প্রেসিডেন্ট Prof. Aaron To (aka 杜家麟) –এর কাছ থেকে এবং যে মতামতের সাথে USA এর বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ Dr. Paul Herscu এর ‘Genus Epidemicus findings’ টি অনেকাংশে মিলে গেছে। ব্যস, এ পর্যন্ত পাওয়া এটাই সর্বোচ্চ নির্ভরযোগ্য তথ্য। পরবর্তীতে ইন্ডিয়ার Ayush একটা পরামর্শ প্রদান করেছেন এবং সেটাও কেবল একটা Preventive Measure হিসাবে; এটুকুও করেছেন মিটিংয়ে বসে নিজেদের দক্ষতার উপর অসীম বিশ্বাস ও রেপার্টরির হিসাব-নিকাশের উপর ভিত্তি করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এঁদেরও কেউ হ্যানিমান নির্দেশিত পন্থায় কাজটি করেছেন বলে জানতে পারা যায়নি। ধারণা ও পদ্ধতিগত যৌক্তিক পদক্ষেপের মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রথমটি অনুমান, পরেরটি বিজ্ঞান।
কাজেই প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে- এ পর্যন্ত করা আমাদের কাজগুলো কতটা নীতিসঙ্গত বা যৌক্তিক হয়েছে? আমরা আমাদের হোমিওপ্যাথদের মাঝে কোন কর্মপ্রক্রিয়া ও পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীদের মাঝে কোন শিক্ষা বপন করছি? এবার, আবারও শুরুর প্রশ্নটাতে ফিরে যাচ্ছি- এটি যদি হোমিওপ্যাথিক নীতিসঙ্গত না হয়ে থাকে, এবং তা যদি যৌক্তিকভাবে মানবসেবার জন্য করা না হয়ে থাকে- তাহলে কেন করেছেন?
আপনি কতটা জানেন বা আপনি কত বড় গবেষক – সেটা জানানোর জন্য! আপনি কি মনে করছেন, আপনার ধারণা বা মতামত অন্যের শিক্ষণীয় ব্যাপার! আপনি কি পৃথিবীকে দেখাতে চাচ্ছেন- হোমিওপ্যাথি এত কঠিন একটা ব্যাপারে কি-রকম ফেসবুকে পোস্ট করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারে? তাতে কি পৃথিবীবাসীর হোমিওপ্যাথির প্রতি আস্থা বাড়বে বলে আপনি মনে করেন? নাকি আপনিও আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে মাথাগরম করে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন?
একজন হোমিওপ্যাথ হিসাবে আসলে কি করার কথা ছিলো এবং কাজটি কেমন ভাবে করার কথা ছিলো বলে আমি মনে করছি- সে ব্যাপারে আমার মতামতটি আমি দিচ্ছি-
- প্রথমেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক হোমিওপ্যাথিক সংস্থাগুলোর খোঁজ নেয়া উচিৎ ছিলো- জেনাস এপিডেমিকাসের ব্যাপারে অর্গানন নির্দেশিত ‘জেনাস এপিডেমিকাস চিকিৎসা’ পদ্ধতি অনুযায়ী চীনের হোমিওপ্যাথগণ কিছু করেছেন কিনা, না করা হয়ে থাকলে কিংবা তা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের মানসম্মত না মনে হলে – প্রয়োজনে নিজস্ব নির্ভরযোগ্য দক্ষ চিকিৎসক টিম দিয়ে তা দ্রুতগতিতে বাস্তবায়ন করা।
- এরপর সেই মূখ্য সংস্থাটি এ ব্যাপারে সার্বিক সতর্কতা, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্যবিধিগত নিয়ম এবং পদ্ধতিগত উপায়ে নির্বাচিত সম্ভাব্য ঔষধগুলো পৃথিবীর প্রতিটি দেশের সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়গুলোকে অবগত করবেন এবং অল্টারনেটিভ চিকিৎসা নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষকে (হোমিওপ্যাথদের উদ্যোগে বলে বিশেষ করে হোমিওপ্যাথিক উইংকে) জানাবে।
- এরপরের ধাপে দেশের সরকারগুলো তাদের নিজস্ব অবকাঠামোর ধরণ অনুযায়ী সমস্ত হোমিওপ্যাথকে তাদের প্রাপ্ত রিপোর্ট ও করণীয়গুলো দ্রুতগতিতে পৌঁছানোর বন্দোবস্ত করবে। মানবসেবার প্রকৃত আন্তরিকতা থাকলে এই পুরো কাজটি হবার কথা সর্বোচ্চ ৭ দিনে।
- প্রতিটি দেশের হোমিওপ্যাথগণ সেই রিপোর্ট ও সেখানে কি কি ঔষধ নির্বাচিত হয়েছে, কিভাবে হয়েছে, সাধারণ লক্ষণের বিস্তারিত বিবরণ, পার্থক্যকারী লক্ষণগুলো কি কি ছিলো অর্থাৎ কোন লক্ষণের ভিত্তিতে কোন ঔষধগুলো বাছাই হয়েছে তা দেখবেন। এবং এটাও মনে রাখবেন, নিজেদের দেশের সমাজ-সংস্কৃতির ভিন্নতা, মানুষের কন্সটিটিউশন, মায়াজমের প্রভাব ইত্যাদি কারণে এই একই আক্রমণ এখানে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখা দিতে পারে। কাজেই, ‘জেনাস এপিডেমিকাস ফাইন্ডিংস’ নিজের দেশে বা এলাকায় নতুন ভাবে করে নিতে হতে পারে। দেশের উর্ধ্বতন হোমিওপ্যাথিক কর্তৃপক্ষ – চিকিৎসকদের এর পদ্ধতিগুলোতে প্রশিক্ষিত করে ফলপ্রসূভাবে জরুরি অবস্থা মোকাবেলা করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাখবেন।
এবার তাহলে বলা যাবে, হোমিওপ্যাথগণ- বলতে গেলে, এই এপিডেমিকের ব্যাপারে ডা. হ্যানিমানের মতামতটাই পেয়ে গেলেন- যিনি এর আগে এপিডেমিকে হোমিওপ্যাথির আরোগ্যকারী ক্ষমতাকে প্রমাণ করে দেখিয়ে রেখে গেছেন।
আর আমাদের হোমিওপ্যাথির অনেক বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞজনদেরও এই ঔষধের প্রচার-প্রচারণার কাজটিই করতে দেখছি- যাদেরকে আমি আমার শিক্ষক বলে মনে করি এবং যাঁদের মতামতকে আমি অত্যন্ত মূল্যবান মনে করি। তথাপি, আমাকে বলতে হচ্ছে- এ ধরণের মতামতের চাইতে কি একটি মহামারীতে ডা. হ্যানিমান ঠিক কি করতে বলেছেন, কি প্রস্তুতি নিতে বলেছেন- সে ব্যাপারে, অনুসরণকারী সমস্ত চিকিৎসককে অবগত করাটিই সর্বোত্তম পদ্ধতি ছিলো না? সাধারণ মানুষও কি আমাদের এমন চিন্তাশীল কর্মপ্রক্রিয়া দেখে অনেক বেশি আশ্বস্ত হতো না? অতীতের এপিডেমিকগুলোতে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ কিভাবে নির্বাচিত হয়েছে এবং এর সাফল্যের হার প্রচার করাই কি এর চেয়ে বেশি ফলপ্রসূ পদক্ষেপ হতো না? মানুষের মাঝে আতঙ্ক হ্রাস করতে ও হোমিওপ্যাথির প্রতি মানুষের মন ও মগজকে আকর্ষণ করার ব্যাপারে এটাই কি উত্তম উপায় নয়?
কিছু লোক তাদের যুক্তি, দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু সংখ্যক ঔষধের কথা পোস্ট করছেন- শত শত ফলোয়ার সেগুলোকে শেয়ার করছেন, হাজার হাজার চিকিৎসক সেই ঔষধের নাম মুখস্থ করছেন এবং ঔষধগুলো সংগ্রহের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। এরচেয়ে কি এটাই ভালো ছিলো না যে, তাদের পোস্টের মাধ্যমে প্রতিটি চিকিৎসক জানতে পারবেন- কি করতে হবে? কিভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে? ডা. হ্যানিমান কি কি কর্মপ্রক্রিয়া, কিভাবে অবলম্বন করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন?

এ প্রসঙ্গে মহামতি হ্যানিমানের এপিডেমিকের ক্ষেত্রে নির্দেশনাটি কি ছিলো তা আমি সংক্ষেপে উল্লেখ করছি-
১. পৃথিবীতে এই নামের, এই ধরনের কোন রোগ কোনদিন দেখা দিয়েছিলো কিনা সে ব্যাপারে মস্তিস্ক-অপচয়ের কোন প্রয়োজন নেই। পর্যবেক্ষণ ছাড়া এই ক্ষেত্রে কোনরকম অনুমান বা ধারণাকে স্থান দেবেন না। একই নামের এই রোগটি আগেও দেখা গেছে এবং অমুক অমুক ঔষধে ভালো হয়েছে- এরকম কিছু শুনে থাকলেও তাতে কান দেবেন না। আপনার নিজের এ সম্বন্ধে আগে থেকে কোন ধারণা আছে, এমনকি কিছু কিছু ধারণা আছে- এ ধরণের কোন চিন্তাও মন থেকে মুছে ফেলুন। কেউ এই রোগের চিকিৎসায় কোন কালে ভালো হয়েছে কি হয়নি, ভালো হলে কিভাবে হয়েছে- সে ব্যাপারেও আপনার চিন্তার কোন প্রয়োজন নেই। হোমিওপ্যাথিতে প্রতিবারের প্রতিটি এপিডেমিকই নতুন এপিডেমিক (মিউটেশন করা ভাইরাস এবার যাবে কোথায়!)। কেবল দেখা দেয়া রোগটির লক্ষণসমষ্টি সংগ্রহ করুন। (অর্থাৎ, চীনের হোমিওপ্যাথগণের নিকট থেকে কোন তথ্য না পেলেও আমাদের পক্ষে এর জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব!)
২. এবার এই এপিডেমিকটির সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো নিশ্চিত করুন। বেশ কয়েকটি কেইস চিকিৎসা করার পর, দেখতে পাবেন- কিছু সংখ্যক ঔষধই ঘুরে ফিরে একেক রোগীতে একেকটা প্রয়োজন হচ্ছে। সেই ঔষধগুলোকে চিহ্নিত করুন।
৩. এবং এদের মধ্যে ব্যবহার করা ভিন্ন ভিন্ন ঔষধগুলোতে কোন কোন বিশেষ লক্ষণের ভিত্তিতে পার্থক্য নির্ধারিত হচ্ছে- সেগুলো চিহ্নিত করুন। কোন ধরণের পার্থক্যকারী লক্ষণে ও কন্সটিটিউশনে কোন ঔষধ প্রয়োজন হচ্ছে- তা নিশ্চিত করে, এবার সেই কন্সটিটিউশন বা পার্থক্যকারী দুই একটি বৈশিষ্ট্য শুনেই আপনি দ্রুতগতিতে রোগীকে আরোগ্য করতে পারবেন। [অর্গানন অব মেডিসিন, এফোরিজম – ১০০ থেকে ১০৪]
মোটের উপর, ঠিক এইটুকুই একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসককে জানতে হবে। হ্যাঁ, চিকিৎসকগণ যেকোন এপিডেমিকে রোগটি সম্বন্ধে নিজের ইচ্ছায় ও তাগিদে বিস্তারিত ধারণা লাভ করবে- এটিই কাম্য ও সমুচিত। কিন্তু উচিৎ কাজ না করে, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে- দিশাহারা কর্মপরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত এবং রোগের চাইতেও সংক্রামক গতিতে ভয়কে ছড়িয়ে দেয়া কখনোই উচিৎ নয়। এটি ভাইরাসজনিত সংক্রমণ তা জানাটা আমাদের জন্য এই কারণে উপকারী হতে পারে যে, এ ব্যাপারে আমরা ছাড়া আর কেউ কিছু করতে পারবে না জেনে- নিজের দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন থাকতে তাতে আমাদের সহযোগিতা হবে; এছাড়া এই তথ্যটা আমাদের আর কি এমন বিশেষ উপকার করবে- আমাকে বলুন তো! এর ধ্বংসকারী ক্ষমতা সংক্রমণের পরই সবার জানা হয়ে গেছে- তাহলে এবার তা নিয়ে মুখরোচক আলোচনা কি উপকারে আসছে!
হ্যাঁ, সতর্কতা ও স্বাস্থ্যবিধিগুলো আমাদের অবশ্যই জানতে হবে এবং এ কাজটি যারা জনস্বার্থে প্রচার করেছেন তাদেরকে আমার অভিনন্দন ও ধন্যবাদ। আর কেউ জানুক না জানুক, বিশ্বাস করুক না করুক- আমরা, যারা হোমিওপ্যাথিকে জানি- মানুষের রোগ, রোগাক্রমণ প্রক্রিয়া, তার কারণ, আরোগ্যপ্রক্রিয়ার প্রাকৃতিক নীতিটি জানি- তারা তো অন্তত নিশ্চিত যে, যে কোন এপিডেমিক যে ভিত্তি নিয়েই সৃষ্টি হয়ে থাকুক না কেন, তা আমাদের পক্ষে আরোগ্য সম্ভব। আর এজন্য আমাদের যা লাগবে তা হচ্ছে- রোগলক্ষণের সার্বিক পরিচয়- লক্ষণসমষ্টি। এছাড়া তাকে আরোগ্যের আর কোন পথ নেই।
হোমিওপ্যাথ ছাড়া অন্য কেউ যদি সেই লক্ষণগুলো সংগ্রহ করে – তবে তা লক্ষণগুচ্ছ (A bunch of Signs & Symptoms) হতে পারে- লক্ষণসমষ্টি (Totality of Symptoms) নয়। লক্ষণসমষ্টি সংগ্রহ করতে- হোমিওপ্যাথিক ইন্দ্রিয়, পর্যবেক্ষণশক্তি, বিচার-বিবেচনা ও মূলনীতি প্রয়োজন হয়। কাজেই সেটা WHO-ই হোক কিংবা FDA বা CDC – যতক্ষণ হোমিওপ্যাথদের দ্বারা রোগলক্ষণসমষ্টিকে সংগ্রহ করে অর্গানন অনুসারে সম্ভাব্য ঔষধ নির্বাচিত না হবে; ততক্ষণ পর্যন্ত সেই ভিন্নধর্মী উৎস বর্ণিত লক্ষণগুলোকে ভিত্তি করে ঔষধ সংক্রান্ত অনুমানপ্রসূত চিন্তায় ভেসে – নিজেকে পথভ্রষ্ট হবার সুযোগ দিয়ে কোন লাভ হবে না।
সাথে জানতে হবে মেটেরিয়া মেডিকাকে- যাতে লক্ষণসমষ্টি হাতে আসার পর উপযুক্ত ঔষধটি খূঁজে পাবার যোগ্যতা ও উপায় নিজের মধ্যে থাকে। আমি এই মহামারীর ভয়ানকত্বকে, প্রাণহানিকর, বিধ্বংসী ক্ষমতাকে অস্বীকার করছি না এবং যে সমস্ত সাধারণ মানুষ এতে ভয় পেয়েছেন, তাদেরও অসম্মান করছি না। কিন্তু হোমিওপ্যাথদের বলছি- সঠিক পন্থায় কাজ করার সক্ষমতা থাকলে, এবং হোমিওপ্যাথির প্রতি নিজেদের বিশ্বাস ও মনোবল অটুট থাকলে- এর চেয়েও মারাত্মক ফ্লু-কে একটি কঠিন প্রকৃতির সর্দির চাইতে আর বেশি কিছু মনে করার- আমাদের কোন কারণ দেখি না।
বাংলাদেশে এখনো ফ্লু-টির আক্রমণ হয়নি। আল্লাহ না করুন- আমরা তা প্রত্যাশাও করি না। কিন্তু পৃথিবীর সবকিছু আমাদের প্রত্যাশা মোতাবেক হয় না। কিন্তু যা প্রত্যাশিত ভাবে আমাদের পক্ষে করা সম্ভব- তা না করে, এলোপাথাাড় বিলাপ করাটাও বোকামী। আমাদের এখনো পূর্ণমাত্রায় সুযোগ আছে- হ্যানিমান নির্দেশিত উপায়ে, যথানিয়মে উপযুক্ত প্রস্তুতি নেবার। আমার বিশ্বাস, আমরা যদি সঠিক উপায়ে কাজটি করি- তাহলে পৃথিবীর বুকে সেটি একটি অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে (এমনকি আমরা এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত না হলেও!)। আর আমাদের একবারের সেই প্রশিক্ষিত প্রস্তুতির (National Homeopathic Team of Epidemic Management and Control) চিরকালীন সুবিধা এটাই- যখনই আমরা কখনো কোন মহামারীর কবলে পড়বো- মুহূর্তের নোটিশে যথাযোগ্য পদক্ষেপ নিতে পারবে।
এ কয়দিনে আমার সংগ্রহ করা পোস্টগুলোতে থাকা যে কথাটি আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে, তা Paola Brown এর হালকাচ্ছলে বলা একটি ভারী কথা! এত কঠিন মুহূর্তের করণীয়কে এত সহজ কথায় প্রকাশ করতে পারায়, তার সে কথাটি উল্লেখ করেই, আমি আমার আলোচনা শেষ করছি-
What to do? If someone in my house came down with the flu, I’d pull out my Materia medica and look up each remedy, identifying which symptom picture fit the best!
[কি করা? যদি আমার ঘরে কেউ সর্দি বাঁধিয়ে বসে, আমি আমার মেটেরিয়া মেডিকাটি খুলে বসি এবং প্রতিটি ঔষধে চোখ বোলাই, খুঁজে বের করতে হবে যে- কোন লক্ষণচিত্র সবচেয়ে বেশি মানানসই হয়!]

Discussion about this post